নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সবার আমি ছাত্র

ঘুটুরি

একজন অতি সাধারন

ঘুটুরি › বিস্তারিত পোস্টঃ

যে জীবন শামুকের

০৪ ঠা জুন, ২০২৩ রাত ২:৩৭

নদীর নাম সোনারুপাখালী। অদ্ভুত সুন্দর এক নাম। নামের বিশ্লেষণ করলে হয়ত আসতে পারে সোনালি পাখা। অর্থ যাইই হোক নদী ততখানি বড় নয়। গোলপাতার একটা বন আছে এখানে, বন পেড়ুলেই নদী। পানি এখনো বাড়েনি তাই খানিক চরের মত জায়গা হয়ে রয়েছে। বিকেলের গা সয়ে যাওয়া রোদ আকাশে, নদীর পাড়ের কাছে খানিক বসে নেয়া যায়।
আকাশে অনেকক্ষন ধরেই একটা চিল ঘুরপাক খাচ্ছে। খাবারের সন্ধানে হয়ত। বিশাল এক বৃত্তাকার পথ করে নিয়ে আকাশের বুকে ঘুরেই যাচ্ছে। আকাশ থেকে নিচে তাকিয়ে, চরের সাদা বালুতটে একজন মানুষ কে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কত মানুষই তো আসে যায়, বসে তো থাকে না কেউ।
মানুষটা একদৃষ্টিতে তে তাকিয়ে আছে একটা শামুকের দিকে। স্লথ গতি। তাও একটানা না, কিছুক্ষন এগিয়ে থেমে থাকছে, শুড় নাড়াচ্ছে, খানিক তার খোলোসের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, আবার শুড় নাড়িয়ে অল্প অল্প করে খোলস থেকে বেরিয়ে উকি দিচ্ছে, তারপর খানিক আগাচ্ছে। মনে হচ্ছে, খুব ভীত, তাই খুব সতর্ক, এক ধাপ এগিয়ে খুব ভাবনা চিন্তা করে পরের ধাপ দেবার চিন্তা। তাও আগানোর সময় মনে হচ্ছে খোলসটা তার উপর চেপে বসেছে, ভার সইছে না শরীরে। শামুকটার দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় সময় থমকে আছে, জীবন যেন ধীর হয়ে গেছে। কোনো তাড়াহুরো নেই, কোন প্রতিযোগিতাও নেই। এ যেন অসীম পথচলা, সীমিত জীবন কে টেনে হিচড়ে স্মরনীয় করে রাখবার কোনো তাড়না নেই।
শামুকটা মানুষটার এখন বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে। এসেই দাঁড়িয়ে রইল। যেন মানুষ আর শামুক মুখোমুখি।
- খানিক কথা বলতে পারি?
মানুষটা চমকে উঠে, কে কথা বলে, চারিদিক তো জনশূন্য। মতিভ্রম কি?
- এই যে মানুষ, খানিক কথা বলতে পারি?
শামুকের দিকে অবাক তাকিয়ে, মানুষ উত্তর দেয়
- তুমি ই কি কথা বলছ?
- হ্যা আমিই বলছি, তোমাকেই বলছি।
- কিভাবে সম্ভব এটা!
- বলছি। এই যে আমাকে শামুক দেখছ, আমি এক সময় মানুষই ছিলাম। নিয়তির কালে কালে শামুক এ রুপান্তর হয়েছি। মনুষ্যকাল খুব অনুভব করি, অনেকক্ষন বসে আছ বিধায় সাহস করে এগিয়ে আসলাম।
- কিভাবে হলে তুমি শামুক
- শৈশবে বড্ড ডানপিটে ছিলাম, উড়ে বেড়াতাম প্রজাপতি মত, রঙধনুর সাত রঙের মত শুধু সাত রঙ নয়, বহু রং এ রাঙিয়ে এক সময় বড় হলাম, দেখলাম চারদিকে বড্ড প্রতিযোগিতা, সবাই দৌড়াচ্ছে, আমার সজাতি আমাকেও দৌড়াতে বলল, আমি প্রতিযোগি হতে চাই নি, ছুটতে চাই নি। আমি চেয়েছিলাম হতে নির্জন দূপুরের মত, কখনো হতে চেয়েছিলাম গভীর নদীর মত, নিঃশব্দে বয়ে বয়ে যায়। নাটাই এর সুতোয় বাধা ঘুড়ি হয়ে উড়তে চাইনি, তাও প্রতিযোগিতায় নামতে হয়, সবচেয়ে শেষ হই আমি। শেষ সারিতেই অবস্থান আমার। এভাবে দিন কেটে যায়, একের পর এক দায়িত্ব আসে, ভারে আমি নুজ্য হতে হতে নুইয়ে পড়ি, ওই দেবদারু গাছের মত আমার উচ্চ করি শিড় হয়ে দাঁড়ানো হয় না। আমার মেরুদণ্ড ক্ষয় হতে থাকে। আমি তুচ্ছ হই, আমি হই অবহেলিত। সবার থেকে আলাদা হতে থাকি, কারন ওই প্রতিযোগিতায় আমি কখনো জিতে যাবার চেস্টা করি না।
সূর্যগ্রহণ হতে চাই না আমি, বরং হতে চেয়েছিলাম দীর্ঘ পূর্নিমার রাত, ঝড়ের মত বিদ্ধংসী না হয়ে বসন্তের স্নিগ্ধ বাতাস হতে চেয়েছি, কিন্তু তা কি আর মানায় এই ছুটে চলা জীবনে।
একসময় দেখলাম, আমার চলার গতি অনেক কমে গেছে, আমার পিঠের চামড়া মোটা হতে হতে কিসের যেন প্রলেপ পড়েছে।সবাই আমার শরীরের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, শরীর ছাড়াও যে মন আছে, আত্না আছে, তার ঔষধ কেউ দিল না। আমি অসুস্থই থেকে যাই। মানুষরা খুব বিরক্ত হতে থাকে। যেন জীবন যাত্রায় এক পরাজিত মানুষ কে নিয়ে সময় দেবার মত সময় কারো হয় না। চকচকে কোনো বস্তুকে ঐ সূর্যের আলোর নিচে আনো, দেখবে আলোর প্রতিফলনের ঝলকানি, দূর থেকে চোখে পড়বে। সবাই ঐ আলোর ঝলকানিতেই মত্ত। ভিটেমাটির ওই সাঝবেলায় যে প্রদীপ তার মূল্যই বা কতখানি ইট পাথরের দেয়ালের মাঝে ঐ প্রবল ফর্সা আলোর কাছে?
আমি ম্লান হতে থাকি আলোর মিছিলে। মিটমিটিয়ে জলতে থাকি, দেখেও না দেখার মত এক আলো হয়ে।
দিন যেতে থাকে, প্রতিদিন আমি হেরে যেতে থাকি, আমার ভেতরে যে প্রদীপ তা বডড আন্দোলিত হতে থাকে, যেমনটা ঝড়ের বাতাসে নিভু নিভু হয়। কিন্তু নেভে না, আমি জেদ ধরে থাকি। নিভতে গিয়েও টিকে থাকি। জীর্নকায় থেকে শীর্নকায় হই। কেউ দেখে না আমায়, তাকায় না, শুধায় ও না। এত মানুষ অথচ আমি কোলাহলে একলা পড়ে থাকি, চারিদিকে এত কথা আমি বাকশূন্য থাকি।
একদিন দেখি আমি কথা কইতে পারছি না। যেন আমার শব্দভান্ডারের সব শব্দ শেষ। লোকজন ভাবে আমি চিরতরে বাকশক্তি হারিয়েছি। এতে কিছু কদর বাড়ল, কিন্তু একি! এ তো করুনার কদর। দূর্বলরাই এ করুনার কদর পায়। দুটো করুনার কথা, দুটো মায়াভরা দৃস্টিতে অসহায়ত্তের বানী, মিথ্যে ভরসায় করুনার কদর চলতে থাকে। অথচ বহু প্রার্থনায় তীব্র খরায় আক্রান্ত কোন চাষীর আকাংখিত বৃস্টি আমি হতে চাইনি, টিনের চালে ঝমঝমিয়ে জলকনা হতে চেয়েছিলাম।
গনিতবিদ ছিলাম না, তাই জটিল কোন হিসেবের তাগিদ ছিল না। জীবন হিসেবের কখনও ডান পাশ আর বাম পাশ মিলিয়ে চলতে হবে এভাবে অংক কষে দেখিনি। ইচ্ছেও করত না। শুধু জানতাম সুখের ধারাপাত। সহজ। ছড়িয়ে দিলে কেবল বাড়তেই থাকে।
মানুষের জীবন পরীক্ষায় তাই আমি কেবল অকৃতকার্য হতে থাকি। আমার পাশ মার্ক জোটে না। আমার পাশ করতে ইচ্ছে একসময় মরে যায়।
এক পূর্নিমার রাতে, ভরা পূর্নিমায় আমার শরীর জেগে ওঠে। আমি চাঁদ দেখি। যত না চাঁদ দেখি তার চেয়ে বেশি দেখি তার ছড়ানো আলো। আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার প্রচন্ড ঘুম চলে আসে। যেন অনেককাল আমি নির্ঘুম ছিলাম।
আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
- তারপর।
আকাশে চিল উড়তে উড়তে এবার দেখল মানুষটা এখনো বসেই আছে, তবে নিচের দিকে তাকিয়ে। একটু কাছাকাছি নেমে এসে দেখল মানুষটা একটা শামুকের দিকে তাকিয়ে আছে। চিলটা আবার চক্রাকারে উড়তে শুরু করল
- তারপর যখন ঘুম ভাংগে, প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব হয় আমার। দেখি আমার শরীর জুড়ে এক খোলস। আমাকে আবৃত করে রেখেছে। যেন ঢাল৷ চারিদিকে মানুষের খুব উত্তেজনা, আমাকে নাকি খুজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। আমি বলি, এই যে!! এই যে আমি!!!
কেউ শোনে না, কেউ দেখে না। আমি বুঝতে পারি, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়র মত বুঝতে পারি কোথায় কি ঘটছে।
হঠাৎ কে যেন বলে উঠল,
এমা! বিছানায় শামুক এল কিভাবে, ছিহ! বলে আমাকে জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। আমি প্রতিবাদ করি না। বলি না আমার রুপান্তর। চেস্টাও করি না।
সেই থেকে আমি এক শামুক। গন্তব্যহীন এক পর্যটক। আমার কোনো নীড় নেই। কোনো প্রতিযোগিতাও নেই।।
মানুষটা এবার আকাশের দিকে তাকায়৷ আকাশে চিলটা উড়েই যাচ্ছে, বিকেলের আলো এখন ফুরিয়ে যাবার সময় চলে এসেছে।
শামুকের কথা গুলি মাথায় ঘুরছে।
মানুষটা চোখ বন্ধ করে রইল।
ঘুরতে ঘুরতে চিল টা এবার যখন এলো তখন নদীর চরে কোনো মানুষ দেখতে পেল না আর৷ শুধু দেখল দুটি শামুক ধীর গতিতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা জুন, ২০২৩ ভোর ৬:৫৬

মিরোরডডল বলেছেন:



শরীর ছাড়াও যে মন আছে, আত্না আছে, তার ঔষধ কেউ দিল না।

প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব হয় আমার। দেখি আমার শরীর জুড়ে এক খোলস। আমাকে আবৃত করে রেখেছে।

শুধু দেখল দুটি শামুক ধীর গতিতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে।


কিছুদিন আগে রশিদকে বলেছিলাম যে সামুতে কবিতা লেখায় কেউ তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না।
এটা একান্তই আমার ধারণা।
ঠিক সেভাবেই বলতে হয়, এ ধরণের ছোট গল্প লেখায় ঘুটু এগিয়ে আছে।
লেখা দিয়ে বুকের ভেতরের অনুভুতিকে এভাবে স্পর্শ করা খুব কঠিন, সবাই পারেনা।
You did & you always do.


০৪ ঠা জুন, ২০২৩ রাত ৯:৩০

ঘুটুরি বলেছেন: আপনার মন্তব্যর জন্য ধন্যবাদ। এ মন্তব্য আমার জন্য এক বিশাল প্রাপ্তি। আবারো আমার ধন্যবাদ জানবেন।

২| ০৪ ঠা জুন, ২০২৩ সকাল ৮:৪৯

আহমেদ জী এস বলেছেন: ঘুটুরি,





জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া মানুষের মেটামরফোসিস।
মানুষ কি জীবনযুদ্ধে হেরে যায় নাকি মানুষকে ছলেবলে কৌশলে হারিয়ে দেয়া হয় ?
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরাও অমন করে শামুক হয়ে যেতে শুরু করেছি...............

০৪ ঠা জুন, ২০২৩ রাত ১০:০৩

ঘুটুরি বলেছেন: ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যর জন্য। কবি কামিনী রায় এর একটি কবিতার লাইন আছে " পরের কারণে স্বার্থ দিয়ে বলি. এ জীবনে মন সকলি দাও" । এ লাইনটি আমার কাছে খুব সাংঘর্ষিক মনে হয়। এই "পর" কি ভাববে, ভেবেই নিজে যে কোন মেঘের আড়ালে কবেই চলে ভেসে গেছে তা আর বোঝা হয়ে ওঠে না। যখন সময় হয় তখন আর সেই মেঘ কোথায় যে ভেসে গেছে তার আর ঠিকানা পাওয়া যায় না।

৩| ০৪ ঠা জুন, ২০২৩ দুপুর ১২:৫২

রাজীব নুর বলেছেন: সোনারুপাখালি নদীটা কোন জেলায়?
সুন্দরবনের দিকে নাকি?

০৪ ঠা জুন, ২০২৩ রাত ১০:০৭

ঘুটুরি বলেছেন: আপনি সঠিক। ওইদিকেই।

৪| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ৭:০৭

মিরোরডডল বলেছেন:





ছয় মাস হয়ে গেছে ঘুটু।
নত্নুন লেখা চাই।


১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ৯:১৭

ঘুটুরি বলেছেন: এই যে দিচ্ছি

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.