| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গ্রু
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য।

বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টির একটা বিশেষত্ব আছে, এই বৃষ্টি একবার শুরু হলে থামার নাম নেয় না। ঢাকার আকাশ আজ যেন একটু বেশিই ভারাক্রান্ত। আনিসুর রহমান সাহেব, যাকে সবাই অনিরুদ্ধ বলে চেনে, তার জানালার পাশে বসে এক কাপ কড়া লিকারের চা খাচ্ছেন। চায়ের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। অনিরুদ্ধর হাতে একটি পুরানো বই, 'দ্য লজিক অফ সায়েন্স'। তবে তার মন বইয়ে নেই, তার মন পড়ে আছে জানালার বাইরের বৃষ্টির দিকে।
অনিরুদ্ধর এই ছোট্ট ঘরটা বেশ অগোছালো। চারদিকে বইয়ের স্তূপ। সোফার এক কোণে একটা বিড়াল কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। বিড়ালটির নাম রাখা হয়েছে 'নিউটন'। নিউটন খুব অলস বিড়াল, সারা দিন ঘুমায়।
ঠিক এই সময়ে কলিং বেলটা বেজে উঠল। এই অবেলায় কে আসতে পারে? অনিরুদ্ধর কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই বললেই চলে। যারা আছে, তারা এই বৃষ্টিতে ঘর থেকে বেরোবে না। অনিরুদ্ধ দরজা খুলল। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। পরনে দামী স্যুট, তবে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। হাতে একটি ব্রিফকেস। ভদ্রলোকের চোখেমুখে এক ধরণের আতঙ্ক এবং ক্লান্তি।
"আপনি কি আনিসুর রহমান? মানে অনিরুদ্ধ সাহেব?" ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর কাঁপছে।
অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ল। "হ্যাঁ। ভেতরে আসুন। আপনি খুব ভিজে গেছেন।"
ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকলেন। নিউটন বিড়ালটা এক চোখ খুলে তাকে দেখে আবার চোখ বন্ধ করল। আগন্তুক সোফায় বসলেন, কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে তিনি স্বস্তিতে আছেন।
"আমার নাম মফিজুর রহমান। আমি আপনাকে একটা বিশেষ কারণে খুঁজতে এসেছি।"
অনিরুদ্ধ নিঃশব্দে রান্নাঘরে গেল। আরেক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এল আগন্তুকের জন্য। তারপর সোফায় বসে শান্ত গলায় বলল, "চা খান। শরীরটা গরম হবে। তারপর কথা শুরু করা যাবে।"
মফিজুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। তার হাত সামান্য কাঁপছে। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর পকেট থেকে একটা খাম বের করলেন। খামটা নীল রঙের, এবং অদ্ভুতভাবে সেটা একেবারেই ভেজেনি। মনে হচ্ছে খুব যত্নে রাখা হয়েছিল।
"অনিরুদ্ধ সাহেব, আমি একটা অসম্ভব ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। আপনি যুক্তি দিয়ে বিচার করেন বলে আমি আপনার কাছে এসেছি। দয়া করে এই চিঠিটা একটু পড়ুন।"
অনিরুদ্ধ চিঠিটা হাতে নিল। খামের উপরে কোনো ঠিকানা নেই, শুধু লেখা আছে 'মফিজ'। চিঠিটা খুলতেই একটা মৃদু সুগন্ধ ভেসে এল। চন্দন কাঠের গন্ধ। চিঠির লেখাগুলো খুব ঝরঝরে হাতে লেখা। অনিরুদ্ধ পড়তে শুরু করল:
'প্রিয় মফিজ,
কেমন আছিস? জানি, তুই খুব অবাক হয়েছিস এই চিঠি পেয়ে। তুই ভাবছিস আমি তো মারা গিয়েছি তিন বছর আগে। কিন্তু মৃত্যু কি আসলেই সব কিছুর শেষ? নীলপদ্ম যখন ফোটে, তখন পৃথিবীর নিয়ম বদলে যায়। আমি ফিরছি। তোর বাড়িতে যে বড় আয়নাটা আছে, তার সামনে একদিন রাতে দাঁড়িয়ে দেখিস। আমি আসছি।
ইতি—
তোর বড় ভাই, জহির।'
অনিরুদ্ধ চিঠিটা পড়ে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইল। জহির সাহেব তিন বছর আগে মারা গেছেন, এটা সে জানে। ঢাকার নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন জহির চৌধুরী। তার মৃত্যু সংবাদ খবরের কাগজে বড় করে এসেছিল। পাহাড় থেকে গাড়ি খাদে পড়ে মৃত্যু। লাশও পাওয়া গিয়েছিল।
মফিজুর রহমান ফিসফিস করে বললেন, "অনিরুদ্ধ সাহেব, ভাইজান মারা যাওয়ার পর তার লাশ আমি নিজে শনাক্ত করেছি। তার দাফন হয়েছে আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে। তাহলে এই চিঠি কে লিখল? আর এই হাতের লেখা... হুবহু ভাইজানের।"
অনিরুদ্ধ জানালার দিকে তাকাল। বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে। সে মৃদু হাসল।
"মানুষ মারা গেলে আর ফিরে আসে না, মফিজ সাহেব। এটা প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু মানুষ অনেক সময় ফিরে আসার অভিনয় করে। আপনি বললেন আয়নার কথা। আপনার বাসায় কি বড় কোনো আয়না আছে?"
"হ্যাঁ, ড্রয়িংরুমে একটা বিশাল বেলজিয়াম আয়না আছে। ভাইজান সেটা খুব শখ করে কিনেছিলেন।"
"গত রাতে আপনি কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন?"
মফিজুর রহমান শিউরে উঠলেন। "দাঁড়িয়েছিলাম। রাত তখন তিনটা। আমি একটা ছায়া দেখেছি অনিরুদ্ধ সাহেব। হুবহু ভাইজানের মতো ছায়া। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন। কিন্তু আয়নায় তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল না।"
অনিরুদ্ধ চায়ের কাপটা টেবিলে রাখল। তার চোখে এখন একটা অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য। রহস্য তাকে সবসময় টানে। আর এই রহস্যের মধ্যে একটা অলৌকিক গন্ধ আছে, যা সে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করতে চায়।
"মফিজ সাহেব, আপনার বাসায় আমাকে যেতে হবে। তবে আজ নয়। কাল সকালে বৃষ্টির রেশ কমে গেলে আমি আসব। তবে একটি শর্ত আছে।"
"কি শর্ত?"
"আজ রাতে আপনি ওই আয়নার ঘরে একদম ঢুকবেন না। দরজা তালা দিয়ে রাখবেন। পারবেন না?"
মফিজুর রহমান মাথা নাড়লেন। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। "চেষ্টা করব। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তালা দিয়েও তাকে আটকানো যাবে না।"
মফিজ সাহেব চলে যাওয়ার পর অনিরুদ্ধ অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। নিউটন বিড়ালটা এখন জেগে উঠেছে এবং তার পায়ের কাছে এসে ঘষা দিচ্ছে। অনিরুদ্ধ বিড়ালটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলল, "নিউটন, নীলপদ্ম কি আসলেই ফোটে? নাকি কেউ আমাদের চোখের সামনে একটা মায়া তৈরি করছে?"
বৃষ্টির শব্দে ঘরটা যেন আরও নির্জন হয়ে উঠল। অনিরুদ্ধ জানত, এই রহস্যের সমাধান সহজ হবে না। জহির চৌধুরীর মৃত্যু যদি স্বাভাবিক না হয়ে থাকে, তবে এই চিঠি একটি সতর্কবার্তা। কিন্তু কার জন্য? মফিজুর রহমানের জন্য, নাকি অন্য কারোর জন্য?
অনিরুদ্ধ নীল রঙের খামটা আবার হাতে নিল। চন্দন কাঠের গন্ধটা যেন আরও তীব্র হয়েছে। সে মৃদু স্বরে বলল, "আয়না কখনো মিথ্যা বলে না, কিন্তু আয়নার পেছনে লুকিয়ে থাকা মানুষটি পারে।"
রাতের অন্ধকারে ঢাকা শহর ডুবে যাচ্ছে। অনিরুদ্ধর চোখে ঘুম নেই। সে ভাবছে সেই বেলজিয়াম আয়নার কথা। সেখানে কি সত্যিই মৃত মানুষের ছায়া দেখা যায়? নাকি অন্ধকার নিজেই একটা চেহারা নিচ্ছে?
(চলবে...)
©somewhere in net ltd.
১|
২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪৭
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর ঝরঝরে লেখা চলুক.........