| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গ্রু
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য।

পরদিন সকালে আকাশ পরিষ্কার। গতরাতের বৃষ্টির কোনো চিহ্ন নেই, শুধু রাস্তার ধারের গাছগুলো থেকে টুপটাপ জল পড়ছে। অনিরুদ্ধ তার জীর্ণ নীল রঙের পাঞ্জাবিটা পরে তৈরি হয়ে নিল। সে সাধারণত রিকশায় চড়তে পছন্দ করে। ঢাকার রিকশায় বসে আকাশ দেখা যায়, আর শহরের কোলাহলটাকে একটা মিউজিকের মতো মনে হয়।
মফিজুর রহমানের বাসা ধানমন্ডির সাত নম্বর রোডে। বিশাল বাড়ি। পুরনো আমলের স্থাপত্য। গেটের সামনে বড় করে লেখা 'চৌধুরী ভিলা'। গেটে দারোয়ান বসে ঝিমোচ্ছিল, অনিরুদ্ধর পরিচয় পেয়ে সে তাকে ভেতরে নিয়ে গেল।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই একটা ঠান্ডা অনুভূতি হলো অনিরুদ্ধর। চারদিকে বড় বড় গাছ, রোদের আলো খুব একটা ভেতরে পৌঁছাতে পারছে না। বাগানটা বেশ অযত্নে পড়ে আছে। ঝোপঝাড় বেড়ে গেছে। মফিজুর রহমান ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছিলেন। তার চোখে কালশিটে পড়া, বোঝা যাচ্ছে সারা রাত তিনি ঘুমাননি।
"আসুন অনিরুদ্ধ সাহেব। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।" মফিজুর রহমান সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
"কেমন আছেন আজ?" অনিরুদ্ধ চারদিকে তাকাতে তাকাতে জিজ্ঞেস করল।
"ভালো না। সারা রাত আমার মনে হয়েছে কেউ একজন বারান্দায় হাঁটছে। খড়ম পায়ে হাঁটার শব্দ। ভাইজান ঘরে খড়ম পরতেন।"
অনিরুদ্ধ কোনো মন্তব্য করল না। সে ড্রয়িংরুমের মাঝখানে রাখা সেই বিশাল বেলজিয়াম আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আয়নাটা কারুকাজ করা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো। আয়নার কাঁচটা খুব স্বচ্ছ, যেন তাকালে নিজের ভেতরটা দেখা যায়। অনিরুদ্ধ আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখল। তার অবিন্যস্ত চুল, চশমার পেছনে শান্ত চোখ।
"এই কি সেই আয়না?"
"হ্যাঁ। এই আয়নাটার সামনেই আমি তাকে দেখেছি।"
ঠিক সেই সময় একজন তরুণী ঘরে ঢুকল। পরনে সাদা শাড়ি, চোখে চশমা। মেয়েটির চেহারা শান্ত কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে এক ধরণের বিষণ্ণতা।
"চা নিয়ে আসব চাচা?" মেয়েটি মফিজুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল।
"হ্যাঁ নীলা, চা নিয়ে এসো। আর শোনো, ইনি অনিরুদ্ধ সাহেব। ভাইজানের বন্ধু... মানে, একজন গবেষক।" মফিজুর রহমান কেন যেন অনিরুদ্ধর আসল পরিচয় গোপন করলেন।
নীলা অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। "আপনি কি পারালৌকিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন?"
অনিরুদ্ধ অবাক হলো। "আপনি কী করে বুঝলেন?"
"চাচার আচার-আচরণ দেখে। তিনি ইদানীং খুব ভয় পাচ্ছেন। আর আপনি যেভাবে আয়নাটা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে আপনি মানুষের চেয়ে ছায়া খুঁজছেন বেশি।"
নীলা চলে যাওয়ার পর মফিজুর রহমান নিচু স্বরে বললেন, "নীলা আমার বড় ভাইয়ের মেয়ে। জহির ভাইজানের একমাত্র সন্তান। মা নেই, ভাইজানই ওকে মানুষ করেছেন। ভাইজানের মৃত্যুর পর থেকে ও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। সারাদিন তার লাইব্রেরিতে বসে থাকে।"
অনিরুদ্ধ ভ্রু কুঁচকাল। "নীলা কি আপনার মতো কোনো ছায়া দেখেছে?"
"জানি না। ও কিছু বলে না। তবে মাঝেমধ্যে ওকে দেখেছি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কথা বলতে। কার সাথে কথা বলে, জানি না।"
চা এল। চা দিতে এল একজন বৃদ্ধ চাকর। তার নাম কাশেম। কাশেম এই বাড়িতে চল্লিশ বছর ধরে আছে। তার হাত কাঁপছে। অনিরুদ্ধ লক্ষ্য করল, কাশেম চা রাখার সময় আয়নাটার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। যেন তাকালেই কোনো বিপদ হবে।
"কাশেম সাহেব," অনিরুদ্ধ ডাকল।
বৃদ্ধ চমকে উঠল। "জ্বি স্যার?"
"আপনি কি জহির সাহেবকে দেখেছেন গত কয়েকদিনে?"
কাশেমের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে তোতলামি করতে লাগল, "না... না স্যার। মরা মানুষ কীভাবে আসবে? খামোখা ভয় দেখান কেন?"
সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মফিজুর রহমান বিষণ্ণ গলায় বললেন, "সবাই ভয় পাচ্ছে অনিরুদ্ধ সাহেব। এই বাড়ির বাতাসটাই বিষাক্ত হয়ে গেছে।"
অনিরুদ্ধ চা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। "আমি একবার ওপরের ঘরগুলো দেখতে চাই। বিশেষ করে জহির সাহেবের লাইব্রেরি আর তার শোবার ঘর।"
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় অনিরুদ্ধর মনে হলো, দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো যেন তাকে দেখছে। জহির চৌধুরীর একটা বড় তৈলচিত্র দোতলার করিডোরে ঝোলানো। ছবিতে জহির সাহেব এক হাতে পাইপ নিয়ে বসে আছেন, মুখে রহস্যময় হাসি। তার চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ। অনিরুদ্ধ ছবির সামনে দাঁড়াল।
হঠাৎ তার কানে এল গুনগুন গান। সুরটা খুব করুণ। শব্দটা আসছে করিডোরের শেষ মাথার ঘর থেকে।
"ওটা কার ঘর?" অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।
"ওটা নীলার ঘর। ও গান গাইতে ভালোবাসে। তবে এই গানটা ভাইজানের খুব প্রিয় ছিল।"
অনিরুদ্ধ লাইব্রেরি ঘরে ঢুকল। হাজার হাজার বই। চারদিকে ধুলোর আস্তরণ। তবে একটা টেবিল খুব পরিষ্কার। সেখানে কয়েকটা কাগজ আর একটা কলম রাখা। অনিরুদ্ধ টেবিলের কাছে গিয়ে দেখল, কাগজে একটা অদ্ভুত নকশা আঁকা। একটা বৃত্ত, তার ভেতরে একটা নীল পদ্ম। নকশাটা একেবারেই টাটকা। কালি এখনো শুকায়নি পুরোপুরি।
সে জানালার পর্দা সরাল। জানালার বাইরে থেকে বাগানটা দেখা যায়। বাগানের এক কোণে একটা ছোট পুকুর। পুকুরের মাঝখানে কিছু একটা ভাসছে। অনিরুদ্ধ চোখ ছোট করে দেখল। ওটা কি কোনো মানুষের মাথা? নাকি অন্য কিছু?
সে মফিজুর রহমানের দিকে তাকাল না, দ্রুত নিচে নেমে এল। বাগানের দিকে দৌড়ে গেল সে। পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখল, কোনো মানুষের মাথা নয়, একটা প্লাস্টিকের তৈরি মুখোশ ভাসছে। হুবহু জহির চৌধুরীর চেহারার মতো।
অনিরুদ্ধ মুখোশটা জল থেকে তুলল। পিছন থেকে কারোর হাসির শব্দ শোনা গেল। সে ঘুরে দেখল কেউ নেই। শুধু বাতাসের শব্দ আর গাছের পাতার মর্মর ধ্বনি।
কিন্তু মুখোশটা ভেজা ছিল না। ওটা শুকনো। তার মানে কেউ এইমাত্র এটা পুকুরে ফেলেছে। আর সেই ব্যক্তিটি এখনো আশেপাশেই আছে।
অনিরুদ্ধ মৃদু স্বরে বলল, "খেলা শুরু হয়েছে মফিজ সাহেব। তবে এই খেলাটা অলৌকিক নয়, বেশ লৌকিক।"
সে যখন ড্রয়িংরুমে ফিরে এল, তখন দেখল আয়নাটা আর সেখানে নেই। দেয়ালের ওই জায়গাটা ফাঁকা। মফিজুর রহমান মেঝেতে পড়ে আছেন, তার কপালে রক্ত। নীলা চিৎকার করে কাঁদছে।
পুরো বাড়িটা যেন এক নিমেষে শ্মশান হয়ে গেল। অনিরুদ্ধ বুঝল, শত্রু অনেক শক্তিশালী এবং সে বাড়ির ভেতরেই আছে।
(চলবে...)
©somewhere in net ltd.