নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এখানে প্রকাশিত সবকিছু নিছকই আমার কল্পনাপ্রসূত অবচেতন মনের বিশেষ কিছু চিন্তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এসবের কোনকিছু বাস্তবের কোন ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে মিলে গেলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয়।

গ্রু

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য।

গ্রু › বিস্তারিত পোস্টঃ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ: ছায়ার খেলা

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:৪৪



চৌধুরী ভিলার ড্রয়িংরুম এখন পুলিশের দখলে। ইন্সপেক্টর রফিক সাহেব অনিরুদ্ধর পরিচিত। তিনি গম্ভীর মুখে সোফায় বসে আছেন। মফিজুর রহমানকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তার মাথায় আঘাতটা বেশ গুরুতর ছিল, তবে ডাক্তার বলেছেন ভয়ের কিছু নেই।

সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো সেই আয়নাটা। ওত বড় একটা বেলজিয়াম আয়না, যা সরাতে অন্তত চারজন মানুষের দরকার, তা মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল কী করে? বাড়ির সব দরজা-জানালা বন্ধ ছিল। শুধু অনিরুদ্ধ কয়েক মিনিটের জন্য বাগানে গিয়েছিল।

"অনিরুদ্ধ সাহেব, আপনি তো সবসময় যুক্তির কথা বলেন। এখন বলুন তো, একটা বিশাল আয়না কি ডানা মেলে উড়ে গেছে?" ইন্সপেক্টর রফিক টিপ্পনী কাটলেন।

অনিরুদ্ধ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সে নির্বিকার গলায় বলল, "আয়না ওড়েনি রফিক সাহেব। আয়নাটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যারা সরিয়েছে, তারা জানত আমি ঠিক কখন বাগানে যাব।"

"তার মানে আপনি বলতে চাইছেন বাড়ির কেউ এর সাথে জড়িত?"

"অবশ্যই। বাইরের কারোর পক্ষে এত অল্প সময়ে এটা করা অসম্ভব।"

অনিরুদ্ধ ড্রয়িংরুমের দেয়ালের দিকে তাকাল যেখানে আয়নাটা ঝোলানো ছিল। দেয়ালে চারটা গর্ত। স্ক্রু দিয়ে আয়নাটা আটকানো ছিল। অনিরুদ্ধ গর্তগুলো পরীক্ষা করল। তারপর নিচু হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা কিছু একটা কুড়িয়ে নিল। একটা ছোট কাঁচের টুকরো। নীল রঙের।

"এটা কী?" রফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

"নীল রঙের কাঁচ। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ওই আয়নাটা তো সাদা ছিল। বেলজিয়াম কাঁচ সাধারণত স্বচ্ছ হয়। তাহলে এই নীল কাঁচ এল কোত্থেকে?"

ঠিক সেই সময় নীলা ঘরে ঢুকল। তার চোখ লাল, কাঁদছিল বোঝা যায়। সে অনিরুদ্ধর কাছে এসে দাঁড়াল।

"অনিরুদ্ধ সাহেব, আমার চাচাকে কি কেউ মারতে চেয়েছিল?"

অনিরুদ্ধ নীলার দিকে তাকাল। "মারতে চেয়েছিল কিনা জানি না, তবে তাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। নীলা, আপনার বাবা অর্থাৎ জহির চৌধুরী কি কোনো নীল কাঁচের জিনিস ব্যবহার করতেন?"

নীলা কিছুক্ষণ চিন্তা করল। "না, মনে তো পড়ছে না। তবে তার একটা আংটি ছিল নীল পোখরাজের। মৃত্যুর পর সেটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।"

অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ল। সে লাইব্রেরি ঘরের সেই নকশাটার কথা ভাবল। নীল পদ্ম।

"রফিক সাহেব, এই বাড়ির চাকর-বাকরদের কি জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন?"

"হ্যাঁ। পুরোনো চাকর কাশেম কিছুই জানে না বলে কাঁদছে। আর মালি লোকটা তো ভয়ে বাড়ি ছেড়েই পালিয়েছে। তবে একটা তথ্য পেয়েছি। জহির চৌধুরী মারা যাওয়ার আগে তার সম্পত্তির একটা বড় অংশ কোনো এক 'নীলপদ্ম ট্রাস্ট'কে লিখে দিয়ে গেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই নামে কোনো ট্রাস্টের অস্তিত্ব নেই।"

অনিরুদ্ধর মনে একটা খটকা লাগল। জহির চৌধুরী বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। তিনি অস্তিত্বহীন কোনো ট্রাস্টকে সম্পত্তি লিখে দেবেন কেন?

সে আবার দোতলায় গেল। নীলা তার পিছু পিছু এল। অনিরুদ্ধ জহির চৌধুরীর শোবার ঘরে ঢুকল। ঘরটা খুব গোছানো। দামী সব আসবাবপত্র। ঘরের এক কোণে একটা সিন্দুক রাখা।

"এই সিন্দুকের চাবি কার কাছে?" অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।

"বাবার কাছে ছিল। এখন সম্ভবত পুলিশের হেফাজতে আছে," নীলা উত্তর দিল।

অনিরুদ্ধ সিন্দুকের কাছে গিয়ে বসল। সে সিন্দুকটা পরীক্ষা করছিল না, সে পরীক্ষা করছিল সিন্দুকের নিচের কার্পেটটা। কার্পেটের ওপর কিছু একটা ঘষার দাগ। মনে হচ্ছে সিন্দুকটা সরানো হয়েছে।

"নীলা, এই সিন্দুক কি সচরাচর সরানো হয়?"

"না। এটা অনেক ভারী। এটা নাকি দেয়ালের সাথে গাঁথা।"

অনিরুদ্ধ পকেট থেকে একটা টর্চ বের করে কার্পেটের নিচের দিকটা দেখল। সেখানে একটা ছোট গর্ত। সেই গর্তের ভেতরে একটা প্লাস্টিকের পাইপ লাগানো। পাইপটা নিচের তলায় নেমে গেছে।

"এটা কিসের পাইপ?" নীলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

"এটা শব্দ পরিবহনের পাইপ। ওপরের তলায় কেউ কথা বললে নিচের ড্রয়িংরুমে বসে তা পরিষ্কার শোনা যাবে। জহির চৌধুরী সাহেব খুব সতর্ক মানুষ ছিলেন। তিনি বোধহয় শোবার ঘরে বসে নিচের সব কথা শুনতে চাইতেন। অথবা অন্য কেউ এটা বসিয়েছে তাকে নজরে রাখার জন্য।"

অনিরুদ্ধ হঠাৎ থামল। সে শুনতে পেল একটা সুক্ষ্ম শব্দ। টক... টক... টক...। ঘড়ির কাঁটার মতো শব্দ। কিন্তু ঘরে কোনো ঘড়ি নেই।

শব্দটা আসছে দেয়ালের ভেতর থেকে। অনিরুদ্ধ কান পাতল। শব্দটা নিয়মিত। সে দেয়ালের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আঘাত করল। ফাঁপা শব্দ হলো।

"নীলা, আপনি এখান থেকে একটু দূরে সরুন," অনিরুদ্ধ সতর্ক করল।

সে পকেট থেকে একটা ছোট্ট ছুরি বের করে দেয়ালের প্লাস্টার আলগা করল। প্লাস্টার খসে পড়তেই যা বেরিয়ে এল, তা দেখে নীলা চিৎকার করে উঠল।

দেয়ালের ভেতরে একটা মানুষের কঙ্কাল। কঙ্কালটা দাঁড়িয়ে আছে। তার গলায় একটা নীল রঙের ফিতে বাঁধা। আর ফিতের সাথে ঝুলছে একটা ঘড়ি। সেই ঘড়িটাই টক টক শব্দ করছে।

রফিক সাহেব দৌড়ে ঘরে এলেন। কঙ্কাল দেখে তারও চোখ ছানাবড়া।

"এটা কার লাশ? অনিরুদ্ধ সাহেব, আপনি কি জাদুকর নাকি?"

অনিরুদ্ধ গম্ভীর হয়ে গেল। "আমি জাদুকর নই রফিক সাহেব। তবে যে এই কাজটা করেছে, সে একজন দুর্দান্ত শিল্পী। এই কঙ্কালটা আসল মানুষের নয়। এটা প্লাস্টিক আর ফাইবারের তৈরি। কিন্তু দেখুন, এর হাতে একটা আসল আংটি আছে।"

সে কঙ্কালের আঙুল থেকে আংটিটা খুলে নিল। একটা নীল পোখরাজ।

"বাবার আংটি," নীলা ফিসফিস করে বলল।

"তার মানে," অনিরুদ্ধ শান্ত গলায় বলল, "কেউ একজন জহির চৌধুরীকে এখনো বাঁচিয়ে রাখতে চাচ্ছে। অথবা আমাদের বিশ্বাস করাতে চাচ্ছে যে তিনি মরেও মরেননি। এই কঙ্কাল, এই ঘড়ি- সবই একটা নাটক। কিন্তু নাটকের মূল উদ্দেশ্য কী?"

অনিরুদ্ধ জানে, উত্তরটা পাওয়া যাবে সেই নিখোঁজ আয়নাটার ভেতরে। আয়নাটা উধাও হয়নি, ওটা বাড়ির ভেতরেই আছে। সে জানত, অন্ধকার নামার পর আসল খেলা শুরু হবে।

সেদিন রাতে অনিরুদ্ধ চৌধুরী ভিলায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। রফিক সাহেব তার সাথে দুজন কনস্টেবল দিয়ে দিলেন। রাত যখন গভীর হলো, সারা বাড়িতে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল।

অনিরুদ্ধ ড্রয়িংরুমের সেই ফাঁকা দেয়ালের সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসল। তার হাতে একটা টর্চ আর এক কাপ ঠান্ডা চা। সে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। সে জানে, জহির চৌধুরী ফিরবেন। আয়না দিয়ে না হোক, অন্য কোনো পথে।

হঠাৎ দোতলার করিডোরে সেই খড়মের শব্দ শোনা গেল। খট... খট... খট...।

অনিরুদ্ধ হাসল। "আসুন জহির সাহেব। আপনার জন্য আমি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি।"

করিডোরের ছায়াটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগল। বাতাসের গন্ধে আবার সেই চন্দন কাঠের সুবাস। কিন্তু এবার সেই সুবাসের সাথে মিশে আছে রক্তের গন্ধ।

(চলবে...)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.