নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এখানে প্রকাশিত সবকিছু নিছকই আমার কল্পনাপ্রসূত অবচেতন মনের বিশেষ কিছু চিন্তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এসবের কোনকিছু বাস্তবের কোন ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে মিলে গেলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয়।

গ্রু

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য।

গ্রু › বিস্তারিত পোস্টঃ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ: যুক্তির ব্যবচ্ছেদ

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:১৩



অন্ধকার ড্রয়িংরুমে অনিরুদ্ধ একা বসে আছে। তার হাতের টর্চটা নেভানো। কেবল জানালার বাইরে থেকে আসা চাঁদের আলোয় ঘরটা আবছা দেখা যাচ্ছে। খড়মের শব্দটা এখন সিঁড়ির খুব কাছে। খট... খট... খট...। প্রতিটি শব্দ যেন হৃদপিণ্ডের স্পন্দনের সাথে মিশে যাচ্ছে।

করিডোরের ছায়াটা এখন সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদেহী এক অবয়ব। গায়ে একটা লম্বা আলখাল্লা। মাথায় সাদা চাদর জড়ানো। মুখটা অন্ধকারে ঢাকা, শুধু জহির চৌধুরীর সেই তীক্ষ্ণ চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করছে।

"মফিজ কোথায়?" আগন্তুকের কণ্ঠস্বর খুব নিচু, যেন পাতাল থেকে উঠে আসছে।

অনিরুদ্ধ শান্ত গলায় বলল, "মফিজ সাহেব হাসপাতালে। আপনি তাকে খুঁজে পাবেন না। তবে আমি আছি। আপনি কি আমার সাথে এক কাপ চা খাবেন জহির সাহেব?"

আগন্তুক থমকে দাঁড়াল। সে বোধহয় আশা করেনি যে কেউ এভাবে শান্ত গলায় তাকে আপ্যায়ন করবে।

"তুমি কে?"

"আমি অনিরুদ্ধ। আমি যুক্তিতে বিশ্বাস করি। আপনি ভূত হোন আর মানুষ হোন, যুক্তির বাইরে আপনি নন। বসুন।"

আগন্তুক ধীর পায়ে নিচে নেমে এল। সে অনিরুদ্ধর ঠিক সামনে এসে দাঁড়াল। চন্দন কাঠের গন্ধটা এখন খুব তীব্র। অনিরুদ্ধ হঠাৎ টর্চটা জ্বেলে আগন্তুকের মুখের ওপর ধরল।

আগন্তুক মুখ ফেরানোর চেষ্টা করল, কিন্তু অনিরুদ্ধ তার আলখাল্লার হাতাটা খপ করে ধরে ফেলল। হাতটা শক্ত, রক্ত-মাংসের হাত। কোনো প্রেতাত্মার হাত নয়।

"চমৎকার মেকআপ কাশেম সাহেব," অনিরুদ্ধ মৃদু হাসল। "কিন্তু চন্দন কাঠের আতরটা একটু বেশি হয়ে গেছে। আর আপনার খড়মের শব্দটা খুব যান্ত্রিক। মনে হচ্ছে পায়ের নিচে কোনো স্প্রিং লাগানো আছে।"

আগন্তুক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে তার মাথার চাদরটা সরিয়ে ফেলল। সে কাশেম নয়। সে মফিজুর রহমানেরই একজন কর্মচারী, যাকে অনিরুদ্ধ আগে দেখেনি। যুবকটির নাম হিমাদ্রি।

"আপনি কীভাবে বুঝলেন?" হিমাদ্রি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

"খুব সহজ। জহির চৌধুরী যখন মারা যান, তখন তার এক পা ছোট ছিল। তিনি হাঁটার সময় একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। কিন্তু আপনার খড়মের শব্দটা একদম তাল মিলিয়ে চলছে। ভূত হলেও তার পুরনো স্বভাব যাওয়ার কথা নয়। আর কাশেম সাহেব খুব বৃদ্ধ মানুষ, তার পক্ষে এত ভারী সাজপোশাক পরে সিঁড়ি দিয়ে নামা সম্ভব নয়।"

হিমাদ্রি মাথা নিচু করল। "আমাকে এটা করতে বলা হয়েছে।"

"কে বলেছে? নীলা?"

হিমাদ্রি চমকে উঠে অনিরুদ্ধর দিকে তাকাল। "আপনি নীলা আপার নাম বলছেন কেন?"

"কারণ এই বাড়িতে জহির চৌধুরীর কণ্ঠস্বর এবং তার পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানে নীলা। সেই নকশা, নীলপদ্ম- সবই তার মস্তিষ্কপ্রসূত। কিন্তু কেন? সে কেন নিজের বাবাকে নিয়ে এই নাটক সাজাবে?"

অনিরুদ্ধ হিমাদ্রিকে পুলিশের হাতে তুলে দিল না। সে তাকে যেতে দিল। সে জানে, হিমাদ্রি শুধু একটা দাবার ঘুঁটি। আসল খেলোয়াড় অন্য কেউ।

পরদিন সকালে অনিরুদ্ধ লাইব্রেরিতে গিয়ে বসল। সে জহির চৌধুরীর ডায়েরিগুলো খুঁজছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে একটা ছোট ডায়েরি পেল, যা আলমারির একদম পেছনে লুকানো ছিল। ডায়েরিটা খুলতেই অনিরুদ্ধর চোখ কপালে উঠল। ডায়েরিতে লেখা আছে:

'আমি জানি মফিজ আমাকে বিষ দিচ্ছে। প্রতিদিন চায়ের সাথে অল্প অল্প করে আর্সেনিক মেশানো হচ্ছে। আমি জানি আমার মৃত্যু আসন্ন। কিন্তু আমি মফিজকে এটা বুঝতে দিচ্ছি না। আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি নীলার নামে লিখে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু নীলা নিজেই এর মধ্যে জড়িয়ে আছে। সে মফিজের সাথে হাত মিলিয়েছে। আমি একাই লড়ছি। নীলপদ্ম ট্রাস্ট নামে আমি একটা ফাঁদ তৈরি করেছি। এই ফাঁদে যে পা দেবে, সেই শেষ হবে।'

অনিরুদ্ধ ডায়েরিটা বন্ধ করল। রহস্যটা এখন আরও জটিল হয়ে গেছে। গতকাল পর্যন্ত সে ভেবেছিল নীলা নির্দোষ, কিন্তু ডায়েরি বলছে অন্য কথা। তাহলে মফিজ আর নীলা কি একসাথেই জহির চৌধুরীকে মেরে ফেলেছে?

কিন্তু সেই আয়নাটা কোথায় গেল?

সে নীলার ঘরের দিকে গেল। নীলা জানালার পাশে বসে আকাশ দেখছে। তার হাতে একটা নীল রঙের কলম। সে আনমনে কাগজে কিছু একটা আঁকছে।

"নীলা, আপনার বাবার ডায়েরিটা পড়লাম," অনিরুদ্ধ ঘরটিতে ঢুকতে ঢুকতে বলল।

নীলা ফিরে তাকাল। তার মুখে কোনো ভয়ের চিহ্ন নেই। "কোন ডায়েরি? বাবা তো ডায়েরি লিখতেন না।"

"লিখতেন। তবে সেটা সাধারণের জন্য নয়। তিনি জানতেন তাকে বিষ দেওয়া হচ্ছে।"

নীলার মুখে একটা করুণ হাসি ফুটে উঠল। "অনিরুদ্ধ সাহেব, আপনি অনেক কিছু জানেন, কিন্তু সবটা জানেন না। মফিজ কাকা বাবাকে বিষ দেননি। বাবা নিজেই নিজেকে বিষ দিচ্ছিলেন।"

অনিরুদ্ধ স্তম্ভিত হলো। "কী বলছেন?"

"বাবা একজন স্কিৎজোফ্রেনিক রোগী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন তিনি মারা গেছেন এবং তার শরীরটা অন্য কেউ দখল করেছে। তিনি নিজেকেই চিঠি লিখতেন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাথে কথা বলতেন। মফিজ কাকা সেটা জানতেন এবং বাবাকে আড়াল করার চেষ্টা করতেন। আর 'নীলপদ্ম ট্রাস্ট' আসলে কোনো সম্পত্তি নয়, ওটা একটা ওষুধের নাম যা বাবা নিয়মিত খেতেন।"

অনিরুদ্ধর যুক্তির জগৎটা যেন ওলটপালট হয়ে গেল। যদি জহির চৌধুরী পাগল হয়ে থাকেন, তবে মফিজুর রহমানকে আক্রমণ করল কে? আর আয়নাটা উধাও হলো কীভাবে?

"তাহলে গতকাল রাতে হিমাদ্রি কেন ভূতের সাজে এসেছিল?"

"হিমাদ্রি আমার বাবার খুব ভক্ত ছিল। সে চেয়েছিল বাবার স্মৃতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে। সে আয়নাটা লুকিয়ে রেখেছে কারণ ওই আয়নার ভেতরে বাবা কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছিলেন।"

অনিরুদ্ধ এবার বুঝল। সে দ্রুত নিচে নেমে এল। সে জানে আয়নাটা কোথায়। সে বাগানের সেই ছোট ঘরটার দিকে দৌড়ে গেল যেখানে মালির যন্ত্রপাতি রাখা থাকে।

ঘরের দরজা লাথি দিয়ে খুলতেই সে দেখল সেই বিশাল বেলজিয়াম আয়নাটা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে রাখা। আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মানুষ। তিনি মফিজুর রহমান নন।

তিনি জহির চৌধুরী। জ্যান্ত মানুষ।

তার হাতে একটা রিভলবার। তিনি আয়নার দিকে তাকিয়ে হাসছেন।

"অনিরুদ্ধ সাহেব, আপনি কি নীলপদ্ম দেখতে চান?" জহির চৌধুরী শান্ত গলায় বললেন।

অনিরুদ্ধর কপালে ঘাম দেখা দিল। তিন বছর আগে মারা যাওয়া মানুষটা তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। এটা কি মতিভ্রম, নাকি কোনো ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র?

"আপনি তো মারা গেছেন জহির সাহেব," অনিরুদ্ধর গলা শুকিয়ে এল।

"মারা গিয়েছিল আমার জমজ ভাই, কবির। মফিজ তাকে মেরে ফেলেছিল সম্পত্তির লোভে। আমি তিন বছর ধরে এই বাড়িতেই ছিলাম, মাটির নিচের একটা গোপন ঘরে। আজ আমি ফিরে এসেছি মফিজের বিচার করতে।"

অনিরুদ্ধ দেখল জহির চৌধুরীর চোখ দুটো উন্মাদনায় জ্বলছে। তিনি সুস্থ নন। কিন্তু তার হাতের রিভলবারটা খুব বাস্তব।

হঠাৎ আয়নার ওপর একটা ছায়া পড়ল। জহির চৌধুরী চমকে উঠে আয়নার দিকে গুলি ছুড়লেন। কাঁচ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আর সেই ভাঙা কাঁচের পেছন থেকে বেরিয়ে এল মফিজুর রহমান। তার হাতেও একটা পিস্তল।

দুই ভাইয়ের মুখোমুখি লড়াই। অনিরুদ্ধ বুঝতে পারল, সে এক ভয়াবহ পারিবারিক যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে গেছে। যেখানে সত্য আর মিথ্যার কোনো সীমারেখা নেই।

(চলবে...)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.