![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী
প্রান্তিক জনপদেও সাধক বা মহাপুরুষদের আবির্ভাব ঘটে। যাঁরা জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের কল্যাণের বার্তা দিয়েছেন কবিতায় কিংবা গানের বাণীতে। এমনই এক সাধক কবি ও জ্ঞানের সাগর খ্যাত দুরবিন শাহের অন্যতম শিষ্য বাংলার মরমি সংগীতের অগ্রগণ্য বাউল গায়ক কফিলউদ্দিন সরকার। যাঁর বেড়ে ওঠা হাওর-বাওর আর নদী, খাল-বিল বেষ্ঠিত প্রান্তিক জনপদ দোয়ারাবাজার উপজেলার নিভৃত এক পল্লীতে। তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান কণ্ঠে তুলে খ্যাতি অর্জন করেছেন বহু কণ্ঠশিল্পী। এক হাতে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গেয়ে মুগ্ধ করেছেন দর্শক-শ্রোতাকে। ঠোঁটের সাহায্যে তাঁর মন্দিরা বাজানোর দৃশ্যে হৃদয়ে দাগ কাটে। অল্প সময়ে যেকোনো বিষয়ে গান লিখে দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতা ছিল তাঁর।
১৯৩২ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ধর্মঘর ইউনিয়নের মালঞ্চপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন, মা করিমুন্নেসা। এক বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ২০ বছর বয়স থেকে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের আকিলপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
কফিল উদ্দিন সরকার শিশুকাল থেকে রাত জেগে পালাগান শুনতে শুনতেই গানের জগতে প্রবেশ। যৌবনের সন্ধিক্ষণে গান লিখতে শুরু করেন। একতারা, দোতারা বাজিয়ে গাইতেন নিজের এবং বিভিন্ন মহাজনি গান। যৌবনকালে আখমাড়াইয়ের মেশিনে বাঁ হাতটি থেঁতলে যায়, কেটে ফেলতে হয় কনুই পর্যন্ত। বহু দুঃখ-দুর্দশায় জীবন কাটালেও থেমে থাকেনি তাঁর কণ্ঠ। শাহ আবদুল করিম, কামাল উদ্দিন, নেত্রকোনার সাত্তার মিয়াসহ অসংখ্য খ্যাতিমান শিল্পীর সঙ্গে একই মঞ্চে গেয়েছেন। একসময় মালজোড়া গানের শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
কিশোর বযসে তিনি ছুটে আসেন এ অঞ্চলের প্রখ্যাত মরমী সাধক দুর্বিন শাহ‘র সান্নিধ্যে। গ্রহণ করেন তাঁর শিষ্যত্ব। শিষ্যত্ব গ্রহণের পর কফিল উদ্দিন সরকার বাউলিয়ানা জীবনে পাড়ি জমান। গুরুর সান্নিধ্যে থেকে গান গেয়ে ঘুরে বেড়ান গ্রামে-গঞ্জে, শহর-বন্দরে। এক সময়ে তিনি জনপ্রিয় মালজোড়া গানে বাউল সমাজে খ্যাতি অর্জন করেন। বাউল স¤্রাট শাহ আব্দুল করিম, আব্দুছ সাত্তার, আলী হোসেন সরকার, বাউল ইদ্রিস আলী, সফর আলী, অশীয় ঠাকুর প্রমুখ খ্যাতনামা বাউলদের সঙ্গে তিনি মালজোড়া গান করেন। তিনি বাংলা গানের জগতে অসংখ্য বাউল গান, পালা গান, সারি গান, মুর্শিদী, লোকগীতি ইত্যাদি অসংখ্য পল্লী গান রচনা করেন। তাঁর রচিত প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত মিলে প্রায় ৫ সহ¯্রাধিক গান রয়েছে। একটা সময়ে বাউল কফিল উদ্দিন সরকারের অনেক গান হাতছাড়া হয়ে যায়। যে গানগুলো সারা দেশে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অনেক বাউল শিল্পীরা তাঁর গানে সুর করার কথা বলে গান নিয়ে নিজেদের নামে চালিয়ে দেন। এ নিয়ে গুনী এই মানুষটির মনে অনেক কষ্ঠ ছিল। অনেকে তাঁর রচিত গান গেয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। কিন্ত আমৃত্যু বাউল কফিল উদ্দিন সরকার এর সৃষ্টি গুলো ছিল অবহেলিত। তাঁর লেখা জনপ্রিয় গান গুলোর মধ্যে-
‘‘আমি চাইলাম যারে ভবে পাইলানাম তারে
সে এখন বাস করে অন্যের ঘরে
জীবন দিয়া যারে আমি ভেসেছিলাম ভালো
সে আমারে ভুল বুঝিয়া দূরে চলে গেলো
আশা ছিল প্রাণ বন্ধুরে রাখিবো এই বুকে
বন্ধুয়ারে লইয়া আমি হাঁসিবো সুখে“
এক সময়ে এই জনপ্রিয় গানটি অন্যের নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছিল। কফিল উদ্দিন সরকার জীবদ্দশায় অবশ্য তাঁর লেখা গানটি উদ্ধার করেন। পরে মোবাইল কোম্পানি তাঁকে রয়ালিটি দিতে বাধ্য হয়। তাঁর রচিত আরেকটি সারা জাগানো গান হলো-
‘‘আমার বন্ধুয়া বিহনে গো, সহেনা পরানে গো
একেলা ঘরে রইতে পারিনা।
বসন্তেরই কালে ডালিম পাকা ডালে
কার কুঞ্জে যেন আছো তুমি আইলায়না ।
থাকো বন্ধু সুখে সেল দিয়া মোর বুকে
মনে যদি থাকে তোমার ভুইলোনা-২‘‘
কফিল উদ্দিন সরকারের রচিত দেহ তত্ত্বের অনেক জনপ্রিয় গান রয়েছে। যে গানগুলো গেয়ে সুনাম কুঁড়য়েচেন এদেশের অনেক নামী দামী শিল্পীরা। সেই সকল গান গুলোর মধ্যে দেশ সেরা একটি গান হলো-
‘‘আতর গোলাপ সোয়া চন্দন সাজাইলাম ফুল বিচানা
অভাগীর বাসরে বন্ধু আইলায়না।
তব প্রাণ যৌবন তোমায় করিলাম অর্পন
কুলেতে বসাইয়া রাখমু তোমায় করিয়া যতন।
সপে দিলাম জীবন যৌবন সাজাইয়া ফুল বিছানা
অভাগীর বাসরে বন্ধু আইলায়না।‘‘
জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে উপনতি হয়েও বাউল কফিল উদ্দিন সরকার তাঁর রচিত অপ্রকাশিত গান গুলো যক্ষের ধন হিসেবে বুকে আগলে রাখতেন। ১৯৬৭ সালের ৭ নভেম্বর তাঁর রচিত ‘রতেœর ভান্ডার‘ নামে প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড দুটি সংকলন প্রকাশিত হয়।
অর্থনৈতিক দন্যদশার কারণে বাউল কফিল উদ্দিন সরকারের পরিবারযখন উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। প্রত্যন্ত এলাকার তার ভক্ত ও শিষ্যদের সাহায্য সহযোগিতায় জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে হাসপাতাল বেডে তিনি চিকিৎসা নিয়েছিলেন। তখনি দোয়ারাবাজার উপজেলা শিল্পকলা একাডেমীর সভাপতি গীতিকবি ডাঃ নির্মল বণিক আমি সহ স্থানীয় সংবাদ কর্মীদের ডেকে ছিলেন বাউল কফিল উদ্দিন সরকারের চিকিৎসার্থে সহযোগিতার জন্য কি করা যায়। এক বৈঠকে তার চিকিৎসার জন্য অর্থনৈতিক যোগান দিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার পরামর্শ করা হয় এবং ওই অনুষ্ঠান হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ বাউলের চিকিৎসার জন্য ব্যায় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে দোয়ারাবাজার উপজেলা সদরের মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক অনাড়ম্বর সঙ্গীতানুষ্ঠানের উদ্যোগ নিলেও ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ৫ মিনিটে তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। সিলেটের একটি বেসরকারী হাসপাতালে প্রবীণ এই বাউলসাধক ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেহত্যাগ করেছেন।
[২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার বিনোদন পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদন]
©somewhere in net ltd.