![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী
কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দোয়ারাবাজার উপজেলার দোহালিয়া ইউনিয়নের পানাইল জমিদার বাড়ি। প্রায় ৪শ’ বছরের পুরনো বাড়ির প্রবেশদ্বারটি আজো স্মৃতি বহন করছে অতীত জৌলুসের। ধারণা করা হয়, ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে জমিদার বাড়ির দু’তলা বিশিষ্ট বসতঘর ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এখনও রয়ে গেছে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক এ স্মৃতিচিহ্ন।
এ বাড়িতে বসবাস করেছেন জমিদার পরিবারের পূর্বপুরুষ প্রেম নারায়ণ চৌধুরী। যিনি পরবর্তীতে মুসলমান হয়ে মোহাম্মদ ইসলাম নাম ধারণ করেছিলেন। তারই উত্তরসূরী দেওয়ান ছনুবুর রাজা চৌধুরী। পরবর্তী বংশধর এ উপমহাদেশের ইসলামী রেনেসাঁ ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের বিপ্লবী সৈনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আহবাব চৌধুরী ও দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরী।
দোয়ারাবাজার উপজেলার দোহালিয়ার পানাইল জমিদার বাড়িটিকে দেওয়ান বাড়ি বা রাজবাড়ি নামেও ডাকা হয়। বিশাল বাড়ির আঙিনা। আঙিনার একেকটি বাড়ির ভিন্ন ভিন্ন নাম। কোথাও লেখা রয়েছে রাজবাড়ি, দেওয়ান বাড়ি অথবা জমিদার বাড়ি। মূলত সবই এক সুতোয় গাঁথা।
জনশ্রুতি রয়েছে, জমিদারি আমলে জমিদারদের বাড়ির পাশ দিয়ে জুতো, সেন্ডেল, খড়ম পায়ে দিয়ে সাধারণ মানুষজন যেতে পারতেন না। কালের বিবর্তনে জমিদার বাড়ির আগেকার অনেক স্মৃতিচিহ্ন অবশিষ্ট নেই। কিন্তু এখনও বিদ্যমান রয়েছে জমিদার আমলের খননকৃত বেশ কয়েকটি পুকুর।
জানা গেছে, এক সময় বিশাল আকৃতির একটি পুকুর ছিল জমিদার বাড়িতে। পরবর্তীতে এই পুকুরকে খনন করা হয়। পুকুরের অদূরেই বহু পুরাতন স্থাপনা ঐতিহ্যবাহী দেওয়ান বাড়ি জামে মসজিদ। প্রায় ৩শ’ বছর আগে নির্মিত এটি। যা পরে সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদের নিকটে দেওয়ান বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান অবস্থিত। সেখানে চিরশায়িত আছেন এ অঞ্চলে দেওয়ান বাড়ির পূর্বপুরুষ মোহাম্মদ ইসলাম। যিনি দেওয়ান পরিবারের প্রথম পুরুষও বটে। তার পাশের কবরে রয়েছে তৎকালীন সময়ে সুদূর ইরাকের বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারে আসা আবু তাহের (রহ.)-এর স্ত্রীর কবর।
জানা যায়, ইসলাম প্রচারক আবু তাহের (রহ.) সুনামগঞ্জে ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি দোয়ারাবাজারে আসার পথে পানাইল লঞ্চঘাটে পৌঁছলে তার গর্ভবতী স্ত্রী আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। পরে ইসলাম প্রচারক ওই সাধকের অনুরোধে জমিদার বাড়ির পারিবারিক কবরেই সমাহিত করা হয় তার স্ত্রীকে। এর পাশে কবর রয়েছে দেওয়ান ছনুবুর রাজা চৌধুরীর। এছাড়া দেওয়ান মোহাম্মদ আহবাব চৌধুরীসহ পরবর্তী প্রয়াত বংশধরদের অনেক কবর রয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ দিকের পুকুরের নিকটে শায়িত আছেন জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরী।
দোয়ারাবাজার উপজেলার দোহালিয়ায় অবস্থিত দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরী ও তার পূর্বপুরুষদের স্মৃতি বিজড়িত জমিদার বাড়িটি এখনও কালের সাক্ষী হয়ে গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে জানান দিচ্ছে। সুষ্ঠু তদারকি ও সংস্কারের অভাবে দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরীর শেষ স্মৃতিটুকুও এখন বিলুপ্তির পথে। এক সময় এখানে দেশবিদেশের অসংখ্য জ্ঞান অনুসন্ধিৎসুকদের সমাগম ঘটতো। দেওয়ান মঞ্জিল, প্রায় ৪শ’ বছরের পুরনো প্রবেশদ্বার, পুরনো মসজিদ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরীর কবরস্থান ও তার পারিবারিক লাইব্রেরি পর্যটকদের নজর কাড়তো।
সরজমিনে জানা যায়, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরীর পারিবারিক অনেক ভূ-সম্পত্তিই বেদখল রয়েছে। তার উত্তরসূরীরা দেশের বাইরে থাকায় ঐতিহাসিক এই বাড়িটি জৌলুস হারাতে বসেছে। বেশ কয়েকটি মনোরম সুপ্রাচীন ভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তার পারিবারিক লাইব্রেরি এখন বিলুপ্তপ্রায়।
উল্লেখ্য, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক হিসাবে সম্মানিত হয়েছিলেন। এবং একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন আসাম উচ্চ পরিষদে ছাতক-দোয়ারার এমএলসি (এমপি) তিনি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন তমুদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। সুষ্ঠু তদারকির উদ্যোগ নিলে তার পারিবারিক স্থাপনাগুলো সম্ভাবনাময় পর্যটনস্থান হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠবে বলে স্থানীয়দের ধারণা।
[দৈনিক মানবজমিন, দৈনিক সুনামকন্ঠ ও ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকার ইতিহাস-ঐতিহ্য পাতায় প্রকাশিত প্রবন্ধ]
©somewhere in net ltd.