![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১টা কৃষ্ণনগর হাটের সময়। অধিকাংশ হাটুরে দুপুর ১২টার মধ্যে তাদের কাজ শেষ করে বাড়ির পথ ধরে, কিন্তু কিছু হাটুরে আছে, যাদের হাট শুরু হয় এই ১২টার পর। খুব বেশি না হলেও কিছু মানুষ আছে এই দলে। তারা এই সময়ে হাটে উপস্থিত হয়, হাট করে ভাঙা হাটে। অনেকে আবার সব হাটুরে চলে যাবার পর - মানে ২টার দিকে বাড়ির পথে রওনা হয়।
উপেন একটু পেটুক, খেতে খুব ভালোবাসে। ঠিক পেটুক না, বলা যায় ভোজনরসিক। সে চায় একটু টাটকা এবং ভালো মানের সবজি যেন তার পাতে থাকে। তাই সে সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে কবে শনিবার আসবে। এই দিন কৃষ্ণনগর হাটের দিন। কৃষ্ণনগর আবার এলাকার সবচেয়ে বড় হাট, আর এই হাটের তরতাজা সবজির নামডাক খুব। ভোজনরসিক উপেন কিছুতেই এই হাটে সবজি কেনার সুযোগ হাতছাড়া করে না।
শনিবার দিন সকালে উঠে খাওয়া-স্নান সেরে ৬টার আগেই রওনা হয় যেন সে ৬টা বা সর্বোচ্চ হলে ৭টার মধ্যেই কৃষ্ণনগর পৌঁছাতে পারে। বেশি দেরি হলে আবার তাজা ও ভালো সবজি সব বিক্রি হয়ে যাবে, তাই সে আগে এসে তার পছন্দমতো সবজি কেনে। বেশিরভাগ দিনই উপেন তার পছন্দমতো সবজি পায়। তার কেনাকাটা শেষ হলে বিদ্যুতের দোকানে বসে একটু চা পান করে। তার কিছু পছন্দের মানুষ আছে, তাদের সাথে দেশ-বিদেশের হরেক রকম গল্প করে বাড়ির পথে রওনা দেয়। এটি তার রোজ শনিবারের সকালের কার্যসূচি।
কোনো এক শনিবার উপেন সাতসকালে তাজা সবজি ক্রয় করে বিদ্যুতের দোকানে বসে চা পান করছে, আরো অনেকের সাথে দেশ-বিদেশের আলাপচারিতায় ব্যস্ত। সকাল গড়িয়ে দুপুর ১২টার পর ভাঙা হাটের হাটুরেদের আনাগোনা বেড়ে গেলো , সাথে আছে দোকানিদের দোকান গুটানোর ব্যস্ততা।
আড্ডা চলছিল দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে। দেশের থেকে যে কখন নিজের অর্থনৈতিক অবস্থায় চলে আসলো, ঠাহর হল না। অবশ্য সুবোধ দা থাকলে এমনটি স্বাভাবিক।
সুবোধ দা সকলের খুব প্রিয় একজন মানুষ। সে শহরে বড় দপ্তরে হিসাবরক্ষণের দায়িত্বে আছে। শোনা যায় মাইনে ভালই। যেহেতু দাদা হিসাবরক্ষণের দায়িত্বে আছেন, সেহেতু তিনি হিসাবে খুব পাকা। হিসাব নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়লে দাদাকেই জিজ্ঞাসা করে সবাই। যে-কোনো ধরনের আর্থিক বিষয়ে খুব সুন্দর সমাধান দেন। দাদা যখন আড্ডায় বসে, তাকে ঘিরেই সবাই বিভিন্ন বুদ্ধি-পরামর্শ নেয়। যেহেতু দাদা হিসাবে পাকা, তাই তিনি এই পরামর্শ প্রদান বাবদ আড্ডার কোনো খরচ বহন করেন না।
আজকেও যথারীতি আড্ডা চলছিল, কিন্তু কেন যেন আড্ডাটা জমছিল না। অনেক ভেবে বোঝাগেল, সুবোধ দা আজ কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত। দাদা শুধালো উপেন, 'কি গো দাদা, তোমাকে আজ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। কিছু হয়েছে নাকি?'
দাদার ঘড়িতে টিকটিক করে শব্দ করে উঠলো। শব্দ শুনে দাদার মধ্যে একটু ব্যস্ততার আভাস পাওয়া গেলো। দাদা বললো, 'এখনকার মতো উঠি রে উপেন, আর দেরি করলে হাটে কিছু পাব না।'
কিন্তু দাদা, বললে না কি হয়েছে?
সবজি কিনে এনে বলছি রে। যাসনে, কিন্তু একসাথে বাড়ি যাবো।
কি আর করা, দাদা বলেছে থাকতে, তাই আর ওঠা হলো না উপেনের। আর দাদার কি হয়েছে সেটাও জানার আগ্রহ দমন করা দরকার, তাই বসে রইল।
দাদা হল সেই সব হাটুরেদের একজন, যারা ভাঙা হাটে সবজি কেনে। সেটার কারণও আছে। শুধিয়েছিল একদিন দাদাকে: 'কেন সে ভাঙা হাটে সবজি কেনে?' তার উত্তরটা চমকপ্রদ ছিল।
দাদা বলেছিল: 'উপেন, একটু মাথাটা খেলাও, তাহলেই বুঝবে। আচ্ছা, একটা উদাহরণ দেই— ধর বেগুন, হাটে যে বেগুন দেখিস, খুব সুন্দর, কোনো পোকা নেই, চকচকে। কিন্তু তোর তো বেগুন ক্ষেত আছে। সেখানকার বেগুন কি এমন চকচকে?'
না তো দাদা। আমার ক্ষেতের বেগুনের অর্ধেকই পোকা ধরে। অনেক ওষুধ দেওয়ার পরেও পোকা ধরে।
তাহলে বোঝ, এই যে হাটের বেগুন তাতে কি পরিমাণ কীটনাশক দেয় যে কোনো পোকাই থাকে না। এই এত কীটনাশক সব তো আমাদের পেটে যাবে। তাই আমি হাটে চেষ্টা করি পোকাওয়ালা বেগুন কিনতে। কেন জানিস? পোকা-ধরা বেগুনে কীটনাশক কম দেওয়া থাকে তাইতো পোকা ধরতে পারে, ফলে আমাদের শরীরে কম কীটনাশক ঢোকে।
তাই আমি কি করি— পোকা বেগুন কিনি, রান্নার সময় পোকা কেটে ফেলে দিলেই হল। আর পোকা বেগুন কিনতে হলে তাড়াতাড়ি আসলে অনেক বাছাবাছি করা লাগে, তাতে দোকানিরা রাগ করে। তাই আমি শেষ বেলায় যাই, তখন সবাই বেছে চকচকে বেগুন নিয়ে যায়, আর পড়ে থাকে পোকা বেগুন। আমি সেগুলি সহজেই নিতে পারি।
তাইতো, এভাবে তো কখনো ভেবে দেখা হয়নি। দাদার কথায় যুক্তি আছে।
কিন্তু পরক্ষণেই প্রশ্ন জাগে: 'তাইতো, হাটে যে বেগুন নিয়ে আসে, সেগুলি তো একই ক্ষেতের ফসল। একই ক্ষেতে কি একেক জায়গায় একেক রকম কীটনাশক দেয়? সব জায়গায় তো একই রকম কীটনাশক দেয়? তাহলে চকচকে আর পোকা, সব বেগুনেই তো সমান কীটনাশক পড়ে। তাহলে শুধু শুধু কেনো এত হ্যাপা করতে যাবো? বরং কিছু বেগুন ফেলে দিতে হবে পোকার জন্য।
এই প্রশ্নের উত্তর উপেন মেলাতে না পারলেও বিদ্যুৎ দা বলেছিল, 'আরে রাখো তো ওই সব যুক্তি-তর্ক! আসল কথা হল ভাঙা হাটে জিনিসপত্রের দাম কম থাকে। পোকা-পচা সবজি শেষের দিকে থাকে, তাই দোকানিরা দাম কমিয়ে রাখে। আর মাঝে মাঝে তো ফ্রিতেও পাওয়া যায়। সুবোধ দা ওই কিছুটা কম দামের অপেক্ষাই করে। এতদিন দাদার সাথে আড্ডা দেও, এখনো তাকে চিনতে পারো নি?'
চিন্তায় ছেদ পড়ল গরুর গাড়ির চাকার বিকট শব্দে। রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়িতে একরাশ মাটি নিয়ে যাচ্ছে পাশের গ্রামে। সেখানে নাকি নতুন ভাটি জ্বালাবে। নতুন এক পদ্ধতি এসেছে— তাতে মাটির ইট আগুনে পুড়িয়ে লাল বানিয়ে সেটা দিয়ে ঘর বানায়। যারা একটু বিত্তশালী, তারাই এমন ঘর বানায়। শহরে নাকি সব এমন লাল ইটের দালান। গ্রামেও শুরু হয়েছে ইদানিং। পাশের গ্রামের মাতব্বর মশাই নতুন ঘর বানাবে, তাই ইট কেটে সেই ইট ভাটিতে পুড়িয়ে লাল বানাবে।
ভাটিতে নাকি অনেক তাপ। সেই তাপে ইট পুড়ে লাল হয়ে যায়। যা দিবে তাই পুড়ে যাবে।
ইতিমধ্যে সুবোধ দা. সবজি কিনে হন্তদন্ত হয়ে এলো, নেয়ে ঘেমে একাকার। গ্রীষ্মের এই দিনে দুপুরবেলা সূর্য যেন আগুন ঢেলে দিচ্ছে। এসেই দাদা বিদ্যুৎকে বলল, 'একটু ঠাণ্ডা জল দেও গো বাপু।'
উপেন ও বিদ্যুৎ দাকে বলল, 'সাথে দুকাপ চা দিও।’অনেকক্ষণ বসে আছি, গলাটা শুকিয়ে কাঠ, একটু ভিজিয়ে নেই।'
'হ্যাঁ, কি যেন বলছিলি?' উপেন।
'বলছিলাম, দাদা আজ তোমাকে একটু অন্যমনস্ক লাগছে। কোনো সমস্যা হয়েছে?
আর বলিস না, হাটে যেন ডাকাত পড়েছে! সব কিছুর এত দাম—মানুষ বাঁচবে কী করে? এর মধ্যে ছেলে আবার বায়না ধরে বাড়িতে 'দিকনির্দেশক যন্ত্র’ লাগিয়েছে! যাতে করে মুঠোফোনে, কম্পিউটারে দেশ-বিদেশের খবর পাওয়া যায়। বাসায় সেটার সংযোগ নিয়েছে।'
'মানে? কি বললে—দিকনির্দেশক যন্ত্র? মানে কম্পাস? এটার জন্য আবার সংযোগ নেওয়া লাগে?'
'আরে পাগল না রে! ওই যে ছোকরাগুলো রাস্তার বিদ্যুতের খুঁটিতে নতুন তার টাঙাচ্ছে—ওই সংযোগ!'
'ওহ! তাই বলো, ইন্টারনেট কানেকশন।'
'হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটাই ওটাই।'
'কিন্তু তার জন্য আবার দিকনির্দেশক যন্ত্র লাগবে কেন?'
'আরে, ওই যে চারকোণা বাক্সটা!'
'ওহহো! রাউটার! কী সব জটিল জটিল শব্দ বলো না! দাদা, তুমি যে কলেজে বাংলায় ভালো ছিলে সেটা তোমার কথা শুনলেই বোঝা যায়।'
'যা বলছিলাম... ওই দিকনির্দেশক যন্ত্র—সেটা আবার বিদ্যুতে চলে।'
'হ্যাঁ, ওটা চালাতে তো বিদ্যুৎ লাগবেই। আমার বাড়িতেও নিয়েছি। খুব উপকারী একটা যন্ত্র। তুমি এখানে বসেই দেশ-বিদেশের সব কিছু জানতে পারবে—চোখের নিমেষে।'
'হ্যাঁ বুঝেছি। বুঝেছি বলেই তো ছেলেকে লাগাতে দিয়েছি ওটা। কিন্তু সুবিধা তো আছেই—সাথে অসুবিধাও আছে অনেক।
তা ঠিক দাদা, সব কিছুরই সুবিধা-অসুবিধা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে আমার মনে হয়, এটাকে আমরা যদি ভালো কাজে ব্যবহার করি, তাহলে কিন্তু এটা অনেক ভালো একটা জিনিস।"
"'আরে বাপু, একটু দম নে! আমি এটার উপকারী দিক জানি বলেই ছেলেকে বারণ করিনি। কিন্তু আমার চিন্তাটা সেখানে না।'"
"'তুই কি খেয়াল করেছিস, ওই দিকনির্দেশক যন্ত্র (রাউটার) কত ওয়াটের?'"
"'না তো দাদা। সেটা তো খেয়াল করিনি।'"
ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ দাদাও চা নিয়ে হাজির, নিজেও এক কাপ নিয়ে পাশে বসে পড়ল। চা খেতে খেতে দাদার কথা শুনছে দুজনেই।
"'নয় (৯) ওয়াট। নয় ওয়াট মানে বুঝিস?'"
"'না দাদা।'"
দাদা পকেট থেকে ছোট একটা ক্যালকুলেটর বের করল। দাদার পকেটে এটা সবসময়ই থাকে।
"'তাহলে দেখ—
৯ ওয়াট মানে এটা এক ঘণ্টায় ৯ ওয়াট শক্তি খরচ করে,
মানে ২৪ ঘণ্টায় ২১৬ ওয়াট শক্তি খরচ করে, তাহলে এটা দিনে ২১৬ ÷ ১০০০ = ০.২১৬ ইউনিট শক্তি খরচ করে,
অর্থাৎ ৩০ দিনে এটি ০.২১৬ × ৩০ = ৬.৪৮ ইউনিট শক্তি খরচ করে।
তাহলে কি দাঁড়ালো?
এটি এক মাসে ৬.৪৮ ইউনিট,
প্রতি ইউনিটের দাম এখন ৭ আনা করে,
তাহলে মাসে ওই যন্ত্র চালাতে ৪৫.৩৬ বা প্রায় ৫০ আনা খরচ হয়।'"
"'এখন তুই ভেবে দেখ—
এই দুর্মূল্যের বাজারে ৫০ আনায় এক হালি ডিম পাওয়া যায়।
কিন্তু যন্ত্রটা তো আসলেই দরকারি,
তাই ওটা একেবারে বন্ধ তো করতে পারবো না,
করা ঠিক ও হবে না,
কিন্তু একটা কাজ করা যেতে পারে।'"
"'কি কাজ দাদা?' দুজনেই সমস্বরে বলল।
এখন ভেবে দেখ—
আমি যদি রাতে ঘুমানোর সময় আর দুপুরে ঘুমানোর সময় যন্ত্রটি বন্ধ রাখি,
তাহলে সব মিলিয়ে দিনে প্রায় ১২ (বার) ঘণ্টা বন্ধ থাকবে।
তাতে মাসে প্রায় ২৫ আনা বেঁচে যাবে।
২৫ আনাতে দুটি ডিম কেনা যাবে—এক সাজের তরকারি!
আরও ভালো হয় যদি যন্ত্রটা তখনই চালু করব, যখন দরকার হবে।
বাকি সময় বন্ধ থাকবে।
কিন্তু এটা কিভাবে করা যায়, সেটাই ভেবে কুলকিনারা করতে পারছি না।
বড় মুশকিলের ব্যাপার...
যাইহোক, যাবি না? বেলা যে গড়িয়ে এল।
ওহো! আরেকটু বস, আমি হাটের মধ্যে আরেকটা পাক দিয়ে আসি।'"
বলে দাদা হাটের ভিতর গেল।
উপেন আর বিদ্যুৎ ঠায় বসে আছে।
ভাবছে, কি শুনল এতক্ষণ?
'এমন মানুষও পৃথিবীতে আছে?
কিভাবে সম্ভব?
এটা তো কৃপণ না, একে বলে হাড়কেপ্পন!
২৫ আনা! মানুষ তো চায়ের দোকানে এক বসাতেই এর চেয়ে ঢের বেশি খরচ করে।
এত পয়সা দিয়ে কি হবে?'
উপেন বলল, 'কি বিদ্যুৎ দা, কি বুঝলে?'
বিদ্যুৎ বলল, "ভয়ে আছি দাদা!
শুনেছি মানুষ মরার আগে তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে হয়।
মরার সময় সুবোধ দা আবার না বলে বসে—
‘আমি মরে গেলে শুধু শুধু কাঠ খরচ না করে,
আমাকে ভাটিতে জ্বালিয়ে দিস।
খরচ কমবে।'
©somewhere in net ltd.