![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বহুকষ্টে অর্জিত দুকলম বিদ্যার জোরে এই কঠিন সময়ে বাবুদের অনুগ্রহে আমিসহ তিনটি প্রাণীর দু’বেলা ডালভাত জুটে যায়। অন্যথায় কবে ইহলিলা সমাপ্ত করে পরলোকে যাত্রা করতাম, তা একমাত্র বিধাতাই জানেন।
জমিদার বাবুর সামান্য এক কর্মচারী হিসেবে খামারের কোনে, একটুকরো জমিতে ফসল ফলিয়ে দিনাদিপাত করি। তাতেই চলে যায় তিন জনের ছোট সংসার।
আমার শীর্ণ কুটির হতে জমিদার বাবুর ঝা চকচকে বিশাল অট্টালিকা দেখা যায়। মাঝে মাঝে ভাবি, ওই প্রাসাদে যাহারা রহে, তাহারা কি এই ধরণীর কেউ, নাকি অন্য জগতের? পরক্ষণেই সম্বিৎ ফেরে এটা ভেবে যে, ওই প্রাসাদ হতে তো মাঝেমধ্যেই জমিদার বাবুর কাছের লোকেরা আমাদের ভগ্ন কুটিরে একটু পদধুলি দিয়ে যান। জমিদার বাবুর কাছের মানুষ, যাদের আমরা কুলীন বলি, এবং তারা যেখানে থাকে সেটাকে আমরা কুলীনপাড়া বলেই জানি। শুনেছি, সেথায় নাকি বড় মানুষের বাস। কখনো তো যাওয়ার কপাল হয়নি। শুধু মাঝে মধ্যে দূর থেকে দেখি, কুলীন বাবুরা পাইক-পেয়াদা সহ বড় বড় ঘোড়ার গাড়ি, বিলেতি গাড়িতে চেপে রাজপথে, রাজকীয়ভাবে যাতায়াত করেন।
বছরে দু-একবার এই পর্ণকুটিরে পদধূলি দেন, কিন্তু হাজার হলেও তারা রাজপথে চলা মানুষ। তাই তেনারা যখন আসেন, তখন আমাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়। গ্রামবাংলার মানুষ আমরা একটু অতিথিবৎসল; যখন তারা আসেন, তখন আমাদের সাধ্যমতো সেবা-যত্ন করার চেষ্টা করি, যদিও কখনোই তাদের খুশি করতে পারিনি। সেটা সম্ভবও না, কারণ তারা বড় মানুষ—যেটা তাদের কাছে রোজকার ব্যাপার, সেটা আমাদের মতো মানুষের কাছে এলাহী ব্যাপার। বাবুমশাইরা আসবেন বলে ময়ূরপঙ্খী গাড়ি, দামি-দামি খাবারের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করি। তাদের মন পাওয়ার কী যে প্রাণান্তকর চেষ্টা, তা বর্ণনাতীত।
কোন এক গ্রীষ্মে এক বাবুমশাই আসিবেন, আমাদেরই কয়েকজনের জমিজমা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে। যথারীতি, আমাদের সাধ্যমত আয়োজনের ত্রুটি রাখা হলো না। বাবুমশাই এসে আমাদের নিয়ে বসলেন; কাগজপত্রের সমস্যা হেতু জমিজমার সমাধান সম্ভব হল না।
আমি মন খারাপ করে বাড়ির উঠোনে বসে ভাবছি, কিভাবে সমাধান করা যায়, কিন্তু অল্প জ্ঞানে তেমন কূলকিনারা হয় না।
এমন সময় বাবুমশাই সান্ধ্যভ্রমণে বেড়িয়েছেন, আমাকে দেখে কী মনে করে কাছে ডাকলেন।
আমি দুরুদুরু বুকে, টানপায়ে বাবুমশাইয়ের কাছে গেলাম।
বাবুমশাই উনাকে আমাদের গ্রামটি ঘুরিয়ে দেখাতে বললেন।
বাবুমশাই অনেক গল্প করলেন। গল্পে গল্পে অনেক কথা হল। অনেক গল্পের পর মনে হল, বাবুমশাই অনেক উদার ও বড় মনের মানুষ।
চলতি পথে আমাদের গ্রামের পুকুরের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। প্রতি বছর আমাদের পুকুরে মাছ ধরা হয়, যেটা গঞ্জের হাটে বিক্রি করা হয়। এবছর মাছের আবাদ তেমন ভাল না হলেও একেবারে মন্দ হয়নি। বাবু কিছুক্ষণ দেখলেন মাছ ধরা।
কী মনে করে তিনি বললেন, "কি হে, এত বড় বড় মাছ পাও তোমরা মাঝে মাঝে দু-একটা দিলেও তো পারো। এভাবে সব নিজেরা ভোগ করা তো বড় একপেশে হে।"
বাবুর কথায় বড্ড লজ্জিত হলাম, মনে হল, তাইতো এটা তো বড় অন্যায় করে ফেলেছি। এটা তো বাবুদেরই দয়া-দাক্ষিণ্যে পাওয়া পুকুর, বাবুদের প্রাপ্য দিচ্ছি না।
কাচুমাচু হয়ে বাবুকে বললাম, "বাবুমশাই, বড় ভুল হয়ে গেছে, মার্জনা করবেন। কালকেই আপনার ও বড় কর্তার অংশটা পৌঁছে দিয়ে আসবো।"
সেখান থেকে আবার চলতে চলতে, একটু জিরানোর জন্য একটি সজনে গাছের নিচে দাঁড়ালাম। সামনে গম ক্ষেত। গম কাটা চলছে। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর বাবু মশাই বললেন, "এটা কি গাছ? মনে তো হচ্ছে সজনে গাছ। অনেক সজনে ধরেছে।"
"জি, বাবু, এটা সজনে গাছ।"
জানো, একবার উজানে গিয়ে সজনে দিয়ে মাছ খেয়েছিলাম। বড্ড তৃপ্তি পেয়েছিলাম। আমাদের ওখানে তো আর এসব গাছ নেই, তাই আর সেই স্বাদ নেওয়া হয়নি।
"তাইতো, বাবুমশাই, যেখানে থাকে, সেখানে তো এমন জিনিস না থাকারই কথা।"
"আজ্ঞে বাবু, আমি মাছের সাথে কিছু সজনেও দিয়ে আসবো।"
আরো কিছুক্ষণ পর বাবু বললেন, "এগুলি কি কাটছে? গম?"
"এই জমিও তো মনে হয় জমিদার বাবুর, কিন্তু তোমরা গম ফলাচ্ছো, অথচ জমিদার বাবুকে একটু পাঠানোর প্রয়োজন মনে করো না? এটা তো ঠিক না।"
ইশ, কত ভুল করি! ছি ছি ছি!
"বাবুমশাই, আমরা মুখ্যসুখ্য মানুষ ভুল করে ফেলি। এখন থেকে আর ভুল হবে না। এবারের মত মার্জনা করে দিন।"
এরপর আরো অনেক কথা হল। বুঝলাম, আমাদের অনেক ভুল-ত্রুটি আছে, কিন্তু বাবু অনেক বড় মনের মানুষ, তাই এসব তিনি নিজগুণে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
আমিতো জমিদার বাবুর জমি দেখভাল করি, কিন্তু সেটার অনুমতির কোনো কাগজ আমার কাছে নেই। অনেক দিন ধরেই ভাবছি, যদি কোনোভাবে কুলীন পাড়ায় কোনো চাপরাশি বা পিয়নকে অনুরোধ করে কাগজটি নিতে পারি, তাহলে আমার একটা ব্যবস্থা হয়।
এদিকে আবার জমিতে ফসল লাগানোর জন্য বীজ কিনতে হবে, সেজন্য গঞ্জে বীজের দোকানে যেতে হবে। সে বলেছে পরশুদিন না গেলে আর বাকিতে বীজ দিবে না।
এসব ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি। তখন বাবুমশাই হেঁকে উঠলেন, "কি হে, কি এতো ভাবছো? চলো, সন্ধ্যা তো হইলো। এখানেই কি রাত কাটিয়ে দিবো?"
বাবুমশাইয়ের হাক শুনে বাস্তবে ফিরলাম। বললাম, "চলুন, বাবু, আপনাকে বিশ্রামের স্থানে নিয়ে যাই।"
যাওয়ার পথে বাবুমশাই বললেন, "তুমি মনে হয় কিছু নিয়ে চিন্তায় আছো। কি হয়েছে, বলো?"
অভয় দিলে, "বাবুমশাই, একটা বিষয় নিয়ে অনেক দিন যাবৎ ফেঁসে আছি।"
বলো হে, কি হয়েছে? নির্ভয়ে বলো।
বললাম, "বাবু মশাই, আমার যে জমিটা আমি ফসল ফলাই, সেটার কোনো অনুমতির কাগজ নেই। সমস্যা টা হলো এই অনুমতির কাগজের জন্য একটা..."
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বাবুমশাই উচ্চসরে হেসে উঠে বললেন, "বুঝতে পেরেছি, আর বিস্তারিত বলতে হবে না।"
"কিন্তু বাবু মশাই..."
"হয়েছে, হয়েছে, আর বলতে হবে না। তোমার কি মনে হয় আমি এগুলি বুঝি না? তোমরা ক বললেই বুঝতে পারি কি বলতে চাচ্ছো। চলে এসো, পরশুদিন তোমার সব সমস্যা সমাধান করে দিবো। আর হ্যা, যেগুলি আনতে বললাম, ভুলোনা কিন্তু!"
বাবুমশাইকে পৌঁছে দিয়ে আমার কুটিরে আসার সময় ভাবছি, আমার ফসলি জমির অনুমতির জন্য তো গ্রামের মোড়ল বাবুর কাছ থেকে সুপারিশ পাঠাতে হবে, যেটা এখনো পাঠানো হয়নি, কিন্তু আমিতো এই কথাটা বাবুমশাইকে বলতেই পারলাম না, উনি শুনতেই চাইলেন না। কি জানি বাপু, উনারা কুলীন মানুষ, উনারা অনেক ক্ষমতাবান, এক আঙ্গুলের ইশারায় সব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারেন। কিন্তু বাবু তো বললো পরশুদিন যেতে। সেদিন তো গঞ্জে বীজ আনতে যাওয়ার কথা, তানাহলে আর বাকিতে বীজ দিবে না। কি যে করি?
সহধর্মিণী আমার অনেক বুদ্ধিমতী। আমি আমার জীবনের অনেক কিছুই তার মতামত নিয়ে করি, দেখেছি সে আমাকে সর্বদাই সু পরামর্শ দেয়।
রাতে বাসায় ফিরে অর্ধাঙ্গিনীকে সারাদিনের সবকিছু সবিস্তারে বললাম। সবকিছু শুনে সে বললো, "জমিটা আমাদের বেশি দরকার, আর বাবু মশাই বলেছেন যদি না যাও, তাহলে উনি বিরক্ত হতে পারেন। শুধু শুধু বাবু মশাইয়ের বিরাগভাজন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। দরকার হলে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে বীজ কিনো, তাও বাবুমশাইয়ের কথা অন্যথা করো না।"
সেদিনের মত সবকিছু শেষ করে শুতে গেলাম। শোয়ার সময় পরবর্তী দিনের কাজগুলো মনে মনে আরেকবার ভেবে নিলাম।
১. বাবুমশাই ও আরো দুই কর্তার জন্য মাছ বরফ দিয়ে ভালোভাবে বাঁধাই করতে হবে।
২. সজনে নিতে হবে সবার জন্য।
৩. যদি সম্ভব হয়, গম নিতে হবে।
পরদিন আমার সমস্ত কাজ বাদ রেখে আগে কুলীন পাড়ায় নিয়ে যাবো বলে পুকুর থেকে বড় মাছ ধরলাম, সেটা বরফ দিয়ে ভালোভাবে বেঁধে রাখলাম। গাছ থেকে সজনে পেরে বেঁধে নিলাম। গোল বাঁধলো গমের ব্যাপারে। গম তো ভেজা। ভেজা গম নিয়ে গেলে বাবুমশাই শুকাবে কোথায়? খুব চিন্তায় পড়লাম। পরে ভাবলাম, নাহয় আগামী সপ্তাহে আবার নিয়ে যাবো।
এমনি নানান ব্যস্ততায় কিভাবে যে দিন পার হল, ঠিকই পেলাম না। যাইহোক, সবকিছু ঠিক মত নিয়েছি।
এমন সময় কুলীন পাড়া থেকে খবর এলো, আমি যেনো সূর্য মধ্যগগনের আগেই সদর দরজা পার হই।
বুঝলাম, বাবু মশাই আমার কথা মনে রেখেছেন, একটি অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি হল।
যাইহোক, সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে রাতে একটু তাড়াতাড়ি নিদ্রার উদ্দেশ্যে বিছানায় গেলাম। কিন্তু জীবনের প্রথমবার কুলীন পাড়ায় যাবো, একটু ভয় ও ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করছে। আচ্ছা, আমি ঠিকমতো চিনতে পারবো তো যাওয়ার রাস্তা?
যদি কেউ রাজপথে দেখে আমাকে জরিমানা করে?
সূর্য মধ্য গগনের আগে ফটক পার হতে না পারি, তখন তো মহা মুশকিল হবে।
সকালেও উঠতে পারবো তো?
কি পরে যাবো? এমন হাজারটা প্রশ্ন মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে।
ভাবতে ভাবতে কখন যে পুব আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে, খেয়াল করিনি।
রাতে ঘুম হলো না। কি আর করা, তাড়াহুড়ো করে উঠে হাতমুখ ধুয়ে, নতুন ধুতি পাঞ্জাবি পড়তে পড়তে গাড়োয়ান এসে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। তাকে গতকালই সবকিছু বুঝিয়ে বলা ছিল। নিজের ভুলে সকালের খাওয়াটা হল না, খেতে গেলে দেরি হবে, তাই এক গ্লাস জল খেয়েই রওনা দিলাম।
গরুর গাড়িতে যেতে যেতে আকাশ-পাতাল ভাবছি, আর চারপাশের প্রকৃতি দেখছি। একটু রোদ বের হতেই গরমে ঘেমে একাকার অবস্থা। পাশ দিয়ে বড় বড় গাড়ি যাচ্ছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো বাবু যাচ্ছেন। কত ব্যস্ততা, কোথাও কেউ জিরোচ্ছে না, সবাই যেনো চাবি দেওয়া রোবটের মতো খালি দৌড়াচ্ছে।
এভাবে ই কখন যে অনেকটা পথ পেরিয়ে কুলীন পাড়ার কাছে চলে এসেছি, সেটা খেয়াল করিনি।
কুলীন পাড়ার ফটকের সামনে, সে তো এলাহী কাণ্ড! বিশাল বড় দরজা, সেই দরজা দিয়ে বিলেত থেকে আনা রাজকীয় গাড়িতে মানুষ ঢুকছে।
আমি কি করবো বুঝতে না পেরে, এক পেয়াদাকে বললাম, "আমাকে তো অমুক বাবু আসতে বলেছেন, কিন্তু আমি কিভাবে উনার দেখা পাবো?"
আমার কথা শুনে পেয়াদা একটু বিরক্তি নিয়ে বললো, “এদিক দিয়ে তোমার মত মানুষ ঢুকতে পারবে না। ওই পাশে ফকির মিসকিনদের যাওয়ার রাস্তা, এখন তুমি বিরক্ত করো না। এখান থেকে যাও, বড় বাবু ডুকবে, দেখলে তুমি বিপদে পড়বে।"
আমি ভয় পেয়ে পড়িমরি করে দূরে চলে আসলাম। কি করবো বুঝতে পারছি না, এমন সময় গঞ্জের হাটের ঠিকাদার দাদার সাথে দেখা, সে এখানেই কাজে এসেছে।
তাকে দেখে আমার প্রাণে একটু জল আসলো। তারাতারি তাকে গিয়ে বললাম,”দাদা, আমি তো অমুক বাবুর সাথে দেখা করবো, কিন্তু কিভাবে করবো বুঝতে পারছি না, আমাকে একটু রক্ষে করো না দাদা!"
সে বলল, "তুমি যে উনার সাথে দেখা করবে, সেটা উনি জানে?"
"হ্যা, জানে তো। উনি আমাকে আসতে বলেছেন।"
দাদা বললো, "তাহলে উনি তোমাকে কোনো কাগজ দেননি?"
তখন আমার মনে পড়লো, তাইতো বাবুমশাই চলে যাবার সময় আমাকে একটা কাগজের টুকরো দিয়েছিল, বলেছিল, "এটা তোমার লাগবে।" সেটি আমি তো আমার ধুতির কোণায় বেঁধে রেখেছিলাম। সেটা বের করে দাদা কে দেখালাম।
দাদা দেখে বললো, "এটা দিয়ে তুমি ওই পাশের ওই ছোট দরজাটা দিয়ে ঢুকতে পারবে। তুমি ওই পাশে যাও, গিয়ে দারোয়ানকে এটা দাও, তাহলে তোমাকে ঢুকতে দিবে।"
দাদার কথায় একটু আশ্বস্ত হলাম তাহলে ঢুকতে পারবো। বুকের ভেতর জমে থাকা ভয়টা যেন একটু কমে এল। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম পাশের দরজার সামনে।
সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হল, যেন এক বিশাল হাট বসেছে কেউ ঢুকছে, কেউ বেরোচ্ছে, কেউ কাউকে ধাক্কা দিচ্ছে, কেউ কাগজ দেখাচ্ছে। এ কেমন রাজদরবার! দারোয়ান যে কোথায়, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
অনেকক্ষণ খুঁজে খুঁজে অবশেষে এক পালোয়ানসদৃশ লোককে নজরে পড়ল সবার কাগজ সে-ই নিচ্ছে, গলায় কর্কশ স্বর, মুখে ক্লান্তির রেখা।
আমি বিনীতভাবে লাইনের শেষে দাঁড়ালাম। গরুর গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে একটু বেশি দৃষ্টিকটু লাগছিল বোধহয়। এক এক করে সামনে এগোলাম। বুকের ভেতর কেমন যেন ঢিপঢিপ করছে এই বুঝি বলে উঠবে, “তোমার নাম নেই, ফিরে যাও!”
অবশেষে তাঁর সামনে পৌঁছলাম। ধুতির ভাঁজ থেকে বাবুমশায়ের দেওয়া কাগজটি তাকে দিলাম।
তিনি চোখের কোণ দিয়ে তাকিয়ে কাগজটি পড়লেন, তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“ওদিকে গিয়ে অপেক্ষা করো। যার কাছে এসেছো, সে এখন সিরিয়ালে তিন নম্বরে। সময় লাগবে।”
একটু থেমে আবার বললেন,
“এই দরজা দিয়ে গরুর গাড়ি নিয়ে ঢুকবে? রাজদরবারে এসেছো, আর সঙ্গে এনেছো গরুর গাড়ি! সাহস তো কম নয়। যাও, গাড়ি দূরে রেখে এসো।”
তার কথা শুনে বুকের ভেতরটা একটু কেঁপে উঠল। নিজের ভুল বুঝে চুপ করে মাথা নিচু করলাম। ধীর স্বরে বললাম,
“ আজ্ঞে, এখনই সরিয়ে রেখে আসছি।”
কিছুক্ষণ পরে আবার সেই পালোয়ানসদৃশ লোকটির কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই বিরক্তির ভাব মুখে এনে বলল,
“এই তো একটু আগেই তো কাগজ নিলাম! এখনই ঢুকতে চাও? যাও, পরে এসো।”
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম এক কোণে। সূর্য তখন মধ্য গগনের কাছাকাছি। বাবু মশাই বলেছিলেন, তার আগেই যেন দেখা করি। কিন্তু এখানকার নিয়ম তো অন্যরকম দেখা করার চেয়ে দেখা পেতেই যেন হাজার পরীক্ষা।
ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে পড়েছি এই বুঝি বাবু চলে যান, আমি সুযোগটাই হারাব!
তখনই, হঠাৎ মলিন বসনে এক ব্যক্তি আমার কাছে এসে দাঁড়াল। চেহারায় একটা চাতুর্যের ছাপ, চোখে অতিরিক্ত সপ্রতিভতা।
সে নিচু গলায় বলল,
“কি হে, ঢুকতে পারছ না বুঝি? সময় লাগছে তো? তুমি যদি চাও, আমি কিন্তু ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”
তাঁর কথায় যেন অন্ধকারে আশার আলো দেখতে পেলাম। মনে হল, এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। আমি খুশিতে বলেই ফেললাম,
“তাহলে তো আমি বেঁচে যাই। দেখো না বাপু, উপকারটা করতে পারো কিনা।”
সে কিঞ্চিৎ হেসে বলল,
“তুমি চাইলে এক্ষুণি ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে পারি। তবে একটা শর্ত আছে তোমাকে ও আমার একটা উপকার করতে হবে।”
আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি করতে হবে আমাকে?”
সে যেন অতি সাধারণ এক কথা বলল,
“বেশি কিছু না, আমাকে শুধু দুই আনা দিলেই হবে।”
কথাটা শুনে আমি থমকে গেলাম। প্রথমে বুঝতে পারলাম না সে কী বলতে চাইছে।
দুই আনা, সে তো অনেক। আমার সাতদিনের সংসার খরচ চলে যায় তাতে। আর আজ সঙ্গে করে এনেছি মাত্র দুই আনা।
কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শেষমেশ তাকে অনেক মিনতি করে বললাম,
“বাবা, আমার কাছে তো বেশি পয়সা নেই। দেখো না, এক আনা দিয়েই কিছু করা যায় কিনা!”
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, ভাবল, তারপর গলায় একটা নীরব চুক্তির সুর এনে বলল,
“ঠিক আছে। তবে একটা শর্ত আছে তুমি কাউকে কিছু বলবে না। একেবারে চুপচাপ আমার সঙ্গে যাবে। আর শুধু তুমি একাই যাবে।”
আমার ভেতরে কোথাও একটা প্রশ্ন জেগে উঠেছিল এই চুপিচুপি ঢোকার পথ কি ঠিক? কিন্তু পরিস্থিতির সামনে নিজের প্রশ্নটাই তখন বড় বেমানান মনে হল।
তারপর লোকটি আমাকে সঙ্গে নিয়ে পাশের এক সরু গলির ভেতর ঢুকে পড়ল। আমি নিঃশব্দে তার পিছু নিলাম। ঢোকার সময় নজরে পড়ল গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ানের সঙ্গে তার চোখে চোখে কী এক রহস্যময় ইশারা হল। যেন চুপিচুপি কোন বোঝাপড়া চলল চোখের ভাষায়।
গলির ভেতরটা ছিল স্যাঁতসেঁতে আর আঁধার। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ আলোয় ভেসে উঠল এক প্রশস্ত রাস্তাঘাট। আমরা এক জায়গায় এসে দাঁড়ালাম—চোখ ধাঁধানো সেই দৃশ্য দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
মসৃণ পিচঢালা পথ, দুপাশে রাজপ্রাসাদের মতো অট্টালিকা, আর তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিলেতি গাড়ি। এই কি সেই কুলীনপাড়া, যার গল্প আমি শুধু শুনেছি।
লোকটা আমার বিস্ময় লক্ষ করে বলল,
“এই যে, তুমি ভিতরে ঢুকে গেছো। আমার কাজ এখানেই শেষ। এখন আমার পাওনা মিটিয়ে দাও। আরও কাজ পড়ে আছে।”
তার কথায় যেন সম্বিত ফিরে পেলাম। পকেট থেকে এক আনা বের করে তার হাতে দিলাম।
সে মুদ্রাটা এক ঝটকায় নিয়ে নিল, আর বিদায়ের আগে বলল,
“আবার যদি আসো, আমাকে খুঁজে নিয়ো। এই দরজার আশেপাশেই থাকি আমি। এক নিমেষেই ঢুকিয়ে দেব!”
এই বলে সে অদৃশ্য হয়ে গেল শহরের গলির আরেক ছায়ায়।
ধাতস্থ হতে আমার একটু সময় লাগল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম সবকিছুই চোখ ধাঁধানো, ঝকঝকে তকতকে। কিন্তু তার মধ্যেও যেন কোথায় এক নিঃসঙ্গতা। নিস্তব্ধ, এক অলিখিত দূরত্ব যেন সব জৌলুস ঢেকে রেখেছে।
দেয়ালের নির্দেশিকা পড়ে অবশেষে বাবুমশাইয়ের কক্ষ খুঁজে পেলাম। কক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালাম কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অচেনা জায়গা, একটু ভয় করছে। ভাবলাম, একটু উঁকি দিয়ে দেখি, কেউ ভিতরে আছেন কি না।
আমি উকি দিতে যাচ্ছি, এমন সময় পেছন থেকে এক কর্কশ গলা ধমকে উঠল,
“কে তুমি? চোরের মতো উঁকি দিচ্ছ কেন? কী চাও?”
আমি চমকে উঠলাম, কাঁপা কণ্ঠে বললাম,
“না মানে... বাবুমশাই দেখা করতে বলেছিলেন...”
সে আমাকে টেনে একপাশে সরিয়ে নিয়ে, বলল,
“আমি বাবু মশাইয়ের পিয়ন। আমার অনুমতি ছাড়া কারো সঙ্গে দেখা করা যাবে না। এখানে দাঁড়াও। আমি দেখে আসি উনি আছেন কি না।”
তার কথায় একটু খটকা লাগল যিনি পিয়ন, তিনি নিজেই জানেন না বাবু মশাই কক্ষে আছেন কি না? তবুও কিছু বললাম না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
অবশেষে কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এসে বলল,
“বাবুমশাই কক্ষে নেই, সভায় গেছেন।”
ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম তাঁর সামনে। ছোট্ট একটা কক্ষ তিনজন মানুষ গাদাগাদি করে বসে আছে কেদারায়, নিঃশব্দে। একজন খবরের কাগজে চোখ গুঁজে আছে, যেন দেশের যাবতীয় দায়িত্ব তাঁর চোখের পাতায় চেপে বসে আছে। আরেকজন কানে হেডফোন গুঁজে সিনেমার জগতে। তৃতীয়জন ছোট্ট কম্পিউটারের স্ক্রিনে কী যেন দেখে চুপিচুপি হাসছে।
তাদের দেখে মনে হল না এরা কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে ফাইল, কাগজ, জীর্ণ কভার, কিন্তু কেউ যেন সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। যেন এই কক্ষটা শুধু তাদের সময় কাটানোর এক মঞ্চ।
অনেকক্ষণ পর একটা বেল বাজল ছোট্ট একটা কর্কশ ধ্বনি। তখন পিয়নটা উঠল, বাবু মশাইয়ের কক্ষে গেল। ফিরে এসে আমার দিকে না তাকিয়েই বলল,
“এখন যেতে পারো, বাবু মশাই একা আছেন।”
তারপর হঠাৎ রুক্ষ স্বরে বলল,
“কোথাও আসলে কিছু হাতে করে আনতে হয়, সেটাও জানো না? তোমাদের গ্রামের মানুষদের একটুও ভদ্রতা নেই, উজবুক একেকজন!”
অপমানটা বুকের মধ্যে কাঁটার মতো বিধল, কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস হল না। শুধু মাথা নিচু করে বাবু মশাইয়ের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলাম।
বাবুমশাইয়ের দরজাটা একপল্লার দরজা, যেটা সচরাচর দেখা যায় না। আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আলতো করে টোকা দিতেই ভিতর থেকে ভেসে আসলো গম্ভীর বাবুমশাইয়ের গলা। গলা শুনেই আমি চিনতে পারলাম বাবুমশাইকে।
বাবুমশাই বললেন, “কে তুমি? ভিতরে আসো।” আমি দরজাটি আলতোভাবে খুলে প্রণাম দিয়ে বাবুমশাইয়ের সামনে দাঁড়ালাম।
কক্ষে প্রবেশ করতেই আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠল, মনে হল আমি বোধয় অন্য কোনো জগতে এসে পড়েছি। কারণ বাইরে প্রচণ্ড দাবদাহ হলেও কক্ষের ভিতরটা মনে হচ্ছে শীতকাল। বেশ ঠাণ্ডা কক্ষ, কিন্তু এমন ঠাণ্ডা কেনো?
চারপাশে তাকাতে লাগলাম, লক্ষ্য করলাম একটা মেশিন চলছে, যেটা থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বের হচ্ছে। কক্ষটার ভিতরটা খুব পরিপাটি করে সাজানো। সেগুন কাঠের টেবিল, গদিওয়ালা কেদারা, কাচ দিয়ে ঘেরা বইয়ের তাক। বইয়ের তাকগুলোতে মোটা মোটা বই। দেখেই মনে হয় অনেক জ্ঞানী মানুষের কক্ষ।
এই কক্ষের এক স্প্রিং ওয়ালা গদির কেদারায় আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছেন বাবু মশাই। আমাকে দেখে চিনতে পারলো কিনা, ঠিক বুঝতে পারলাম না।
“কে তুমি? কি চাও?”
একটু অপ্রস্তুত হয়ে বাবুমশাইকে বললাম,
“বাবু, আপনি সেদিন আমাদের গায়ে গিয়েছিলেন জমির বিবাদ মেটানোর জন্য।”
“ওহ হ্যাঁ, হ্যাঁ! তুমি এসেছো। যেগুলি আনতে বলেছিলাম, সেগুলি এনেছো?”
“জি, বাবুমশাই, এনেছি। কিন্তু সদর দরজার দারোয়ান সেগুলি নিয়ে আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিল না, তাই সাথে করে আনতে পারিনি।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি থাক, আমি দিন শেষে বাড়ি যাওয়ার সময় আমার বাসায় পৌঁছে দিও।”
“আজ্ঞে, বাবুমশাই।” বলে আমি দাঁড়িয়ে আছি। বাবুমশাই দেখলাম, সেই পিয়নদের মতো কম্পিউটারের পর্দায় কি একটা ভিডিও দেখতে মনোনিবেশ করলেন।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ বাবু মশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কি হে? আর কিছু বলবে?”
“আজ্ঞে, বাবুমশাই, আমার জমির ব্যাপারে কিছু কথা ছিল।”
“তোমাদের জমির বিবাদ মেটাতেই তো গিয়েছিলাম, কিন্তু তোমাদের তো কোনো কাগজই নেই, বলেই তো সমাধান করতে পারলাম না। যেটা ওখানেই পারলাম না, সেটা এখানে কিভাবে করবো?”
“বাবুমশাই, ওই বিবাদ নয়, আমি যে জমিটা আবাদ করি, সেটার কাগজ।”
“ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমার জমির কাগজ। আচ্ছা, ঠিক আছে, কি যেনো হয়েছে?”
“আমার আবাদ করা জমির অনুমতির কাগজ নেই, সেটার জন্য এসেছি।”
“তোমার জমির অনুমতির কাগজ নেই? তাহলে তুমি জমি আবাদ করছো কিভাবে? এটা তো অন্যায় করছো!”
“বাবু, আসলে জমিটা আমাকে আমার গায়ের মোড়ল বাবু দিয়েছিলেন আবাদ করার জন্য, আর বলেছিলেন, আপাতত আবাদ করো, পরে জমিদার বাবুর কাছ থেকে অনুমতি এনে দিবেন। সেটার জন্যই এসেছি।”
“অহ, বুঝলাম। তুমি পাশের রুমে যাও, গিয়ে দেখো অমুক নামের বাবু আছে, তার কাছে গিয়ে বল, আমি পাঠিয়েছি। তারপর তোমার সমস্যা তাকে বলো, সে সমাধান করে দিবে।”
আমি নিচুস্বরে প্রণাম জানিয়ে কক্ষ থেকে বের হলাম। ভাবছিলাম, বাবুমশাই সেদিন আমার কোনো কথা না শুনেই বলেছিলেন ‘সব বুঝেছি’, কিন্তু আজ তিনি আবার সব কথা শুনছেন, কেমন হল ব্যাপারটা! অনেক ব্যস্ত মানুষ, অনেক মানুষের সাথে প্রতিদিন কথা হয়, তাই হয়তো ভুলে গেছেন।
কিন্তু তিনি আমাকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারেননি, আর যখন চিনলেন, তখন শুধু আমি কী কী জিনিস আনবো, সেগুলি মনে রেখেছেন, কিন্তু আমার সমস্যাটির কথা মনে নেই। তাহলে কি বাবুমশাই সেদিন আমার কথা ঠিকমত না শুনেই বলেছিলেন ‘সব ঠিক করে দেব’?
অবশ্য সেদিন তো আমার পুরো কথা শুনতেই চাননি। কি জানি, বাপু, মাথায় কিছু ঢুকছে না। এইসব সাতপাঁচ ভাবছি।
“কি ব্যাপার? পথের মাঝখানে তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? আসে কোত্থেকে এইসব?”
কর্কশ গলা শুনে আমি বিচলিত হয়ে দ্রুত একপাশে সরে দাঁড়ালাম। দেখলাম একজন কেতাদুরস্ত লোক যাচ্ছেন, হাতে একটি মোটা হিসাবের খাতা। সেই খাতায় কি সব লেখা, সেই সব লেখা পরতে পরতে যাচ্ছেন। জমিদার বাবুর হিসাব বই হবে হয়তো।
আশেপাশে একটু তাকাতেই দেখলাম, বাবুমশাই যাঁর কথা বলেছেন, তাঁর নামফলক। বুঝতে পারলাম, এটাই সেই বাবুর কক্ষ। কি করব বুঝতে পারছি না। বাবু মশাইয়ের কক্ষে ঢুকতে গেলে তো পিয়নের অনুমতি লাগে, এখানেও কি তাই? কিছুক্ষণ চিন্তা করে আশেপাশে তাকালাম, কিন্তু কাউকে পেলাম না। কি করব?
একটু ভেবে মনে সাহস সঞ্চয় করে দরজায় টোকা দিলাম। এবার আর ভিতর থেকে কোন আওয়াজ আসলো না। আরও একবার টোকা দিলাম। কিছু হল না দেখে ভাবলাম, একটু উঁকি দেই। দরজাটা হালকা করে ঠেলে তাকিয়ে দেখি, এখানেও তিনজন মানুষ গাদাগাদি করে বসে আছে। তিনজনই ভাবলেশহীন ভাবে চোখের কোনা দিয়ে একটু তাকিয়ে আবার যে যার মত কাজে লেগে গেল। এক জন একটা সাদা কাগজে কিছু একটা লিখছে, বাকি দুইজন খবরের কাগজ পড়ছে।
কি করব বুঝতে না পেরে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। ছোট্ট একটা কক্ষ, তার মধ্যে আবার একটা কাচ দিয়ে ঘেরা কক্ষ, সেটার ভিতর কি আছে, সেটা বাহির থেকে দেখা যায় না। আর বাকি অংশে অল্প একটু জায়গার মধ্যে তিনজন গাদাগাদি করে বসে আছে। তাদের তেমন কোনো কাজ করতে দেখলাম না, তাহলে শুধু শুধু তিনজন এইভাবে বসে থাকার কি কারণ, সেটা বুঝতে পারলাম না। কেউ কিছু বলছে না, তাই আমিই বললাম,
“আজ্ঞে, অমুক বাবু আছেন?”
কেউ কিছু বলল না, শুধু একজন ইশারায় কাচের দরজা দেখিয়ে দিল। বুঝলাম, বাবু ওই কাচের দরজার ওপাশে আছেন।
কাচের দরজাটা একটু করে খুলে প্রণাম জানিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সৌম্যদর্শন বাবু, দেখলাম মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারের পর্দায় একটি কৌতুকের ভিডিও দেখছেন। বাবুর কক্ষটিও শীতল, ছোট কিন্তু পরিপাটি করে সাজানো।
খানিক বাদে ভিডিওটি শেষ হলে, বাবু আমার দিকে তাকালেন। বাবুর মুখে এখনো কৌতুকের রেশ লেগে আছে। বললেন,
“বল, কি হয়েছে?”
আমি আমার সমস্যাটি সবিস্তারে বাবুকে বললাম। উনি মনে হল খুব অনাগ্রহ সত্বেও শুনছিলেন, তবে মনোযোগ ছিল হাতের একটি কাগজের দিকে। আমার কথা শেষ হলে বাবু বললেন,
“পড়তে পার?”
“জি, বাবু, একটু আধটু পারি।”
“তাহলে এটা নিয়ে পড়, পড়ে তোমার মতামত দাও, দেখি তুমি কেমন পড়তে পার।”
আমি বাবুর দেওয়া কাগজখানি পড়তে থাকলাম। মনে হল, দেশের জলের সমস্যা নিয়ে কিছু লিখেছেন। আমি ঠিক বুঝলাম না, আমার সমস্যার সাথে এটার কি সম্পর্ক। তথাপি আমি পুরোটা পড়ে বাবুকে বললাম,
“বাবু, এটা তো দেশের জলের সমস্যা নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখা। আপনি পুকুর খনন করার কথা বলেছেন, তাহলে কি আমার জমির উপরই পুকুরটা খনন করবেন? আমি বড় বিপদে পড়ে যাবো, বাবু। তিনটে প্রাণী ওই জমির আবাদের উপর বেঁচে আছি।”
বাবু ধমক দিয়ে বললেন,
“গাধাকে দিয়েছি রামের পাঠ! আমি কি লিখেছি যে তোমার জমিতে পুকুর খনন করতে হবে? তোমরা আসলে তোমাদের নিয়েই থাকো, মাঝেমধ্যে দেশ নিয়েও একটু ভাবতে হয়। যাকগে, কি বলছিলে, যেন? তোমার জমি কি হয়েছে?”
আমি বাবুকে আবার আমার জমির সমস্যাটা বললাম।
বাবু তখন বললেন, “তুমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।”
আমি বের হওয়ার সময় দেখলাম, উনি বেল বাজালেন। বেল বাজতেই বাইরে যারা বসেছিল তাদের মধ্যে একটু চঞ্চলতা দেখা দিল। একজন উঠে বাবুর কক্ষে ঢুকল। কিছুক্ষণ পরে আবার বের হয়ে এসে, কিছু কাগজ নিয়ে আবার ঢুকল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলাম। কিছু সময় পরে, বাবু বের হয়ে বাবুমশাইয়ের কক্ষে গেলেন।
খানিক বাদে, বাবু আবার তাঁর কক্ষে এসে ঢুকলেন। ঢোকার সময় বললেন, “দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাবুমশাইয়ের কাছে যাও।”
বাবুকে প্রণাম জানিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে, বাবুমশাইয়ের কক্ষে অগ্রসর হলাম। বাবুমশাইয়ের কক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, আসলেই কি আমার সমস্যার কোনো সুরাহা হবে? কি জানি বাপু, উনারা তো সব কেমন যেন নাকউচু ধরনের। মানুষ এমন হয়?
সকাল থেকে পেটে দানা-পানি পড়েনি। এখানে তো বসতেই বলছে না কেউ। শেষ পেটে কিছু পড়েছিল গতকাল রাতে, এখন তো দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। দেখা যাক, কি হয়।
বাবুমশাইয়ের কক্ষে আলতো করে দরজাটা খুলে, প্রণাম দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার দিকে একবার তাকিয়ে বাবুমশাই আবার কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রাখলেন (ভিডিও দেখছিলেন)।
কিছু সময় পর, তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাপু, তোমাদের আইকিউ এত কম কেন, বলতে পারো?”
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি, বাবুমশাইয়ের দিকে।
“তুমি আমাকে আগে বলবে না যে তোমাদের ওখানকার মোড়ল একটা সুপারিশ পাঠাবে, সেটার ভিত্তিতে আমরা অনুমতি দেবো। তোমার মোড়লের সুপারিশ তো এখনো আসেনি। ওটা না আসলে কিছু করা সম্ভব না। তুমি বরং ওটা আসলে আমাকে জানিও, একদিনেই হবে তোমার কাজ। অফিস সময় শেষ হতে আর বেশি নেই, তুমি একটু অপেক্ষা করো।”
দাঁড়িয়ে আছি বাবুমশাইয়ের কক্ষে। বাবুমশাই আমার সাথে মাছ, সজনে, গম নিয়ে গল্প করছেন। এগুলোর নিয়ে গল্প করতে করতে তাঁর মুখের অভিব্যক্তি দেখার মতো। শিশুদের মতো চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
মাছ কেটে এনেছি কিনা, জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, অতদূর থেকে কেটে আনলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তাই কেটে আনিনি। বাবুমশাইকে বললাম, গম অনেক ভেজা আনলে পচে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাই আনিনি। শুনে মনে হল, একটু মন খারাপ হয়ে গেল। বললেন, “তাহলে শুকিয়ে নিয়ে এসো।”
এমন গল্প করতে করতে অফিস শেষ হল।
বাবুমশাই এবং বড় দুই কর্তামশাইয়ের দুই খাস চাকরসহ, আমি বের হয়ে তিনজনের বাড়িতে জিনিসগুলো পৌঁছে দিলাম। বড়কর্তাদের খাস চাকরদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, তবে আমার কাজ শেষ হল।
কাজ শেষ হতে সূর্য্য মামা পাটে বসেছে। এখনি রওনা হতে না পারলে অনেক রাত হয়ে যাবে, পথে আবার বন পেরোতে হবে, বেশি রাত হলে বিপদে পড়তে পারি, তাই তড়িঘড়ি করে রওনা হলাম।
গাড়োয়ান ঢিমে তালে গাড়ি চালাচ্ছে আর আমি পিছনে বসে আকাশ পাতাল ভাবছি। কতসময় পার হয়েছি জানিনা গাড়োয়ানের হাকে সম্বিৎ ফিরল।
কি দাদা, একেবারে চুপ হয়ে বসে আছ কেন? সকালে তো তাও কথা বলছিলে, এখন কি হল? দুজন যাচ্ছি তুমি যদি এমন চুপ করে থাক তাহলে কি ভাল লাগে? কি হয়েছে বল।
কি আর বলব ভাবছি, পৃথিবী টা বড় অদ্ভুত। মানুষে মানুষে কত পার্থক্য।
কি দাদা কি হয়েছে? কোন সমস্যা না থাকলে বল।
আচ্ছা বলতো এখন যদি আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাই। তাহলে তুমি কি করবে?
কেন? তোমার শুশ্রূষা করে তোমাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করবো। সেটাই তো করা উচিত। হঠাৎ এমন কথা বলছ যে। তোমার কি শরীর অসুস্থ লাগছে? দাঁড়াবো গাছের ছায়ায়?
না। সারাদিন খাওয়া হয়নি তো তাই শরীরটা একটু খারাপ লাগছে।
আয়হায় বলছ কি? দাড়াও দাড়াও
বলেই গাড়োয়ান গাড়িটা একটি বট গাছের ছায়ায় দাড় করালো। তার কাছে মুড়ি আর গুড় ছিল। সেগুলি দিল। আমি সেগুলি খাচ্ছি আর ভাবছি। এই দাদাও মানুষ আর কুলীন পাড়ার ওরাও মানুষ। কিন্তু এদের ভিতর কতটা পার্থক্য। খাওয়া শেষে আবার চলতে শুরু করেছি।
গাড়োয়ান বলছে দাদা আমি বুঝতে পেরেছি শুধু তুমি না, আমি অনেক কেই কুলীন পাড়ায় নিয়ে গিয়েছি প্রায় সবাই এমন অবস্থার মধ্যে পড়ে। কি বলব দাদা, আমি জানিনা তোমার সাথে কি হয়েছে কিন্তু এতটুকু বুঝতে পারছি তোমার অভিজ্ঞতা খুব একটা ভাল না।
হ্যাঁ দাদা, মানুষ যে এমনও হতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। কথা বলতে বলতে কখন যে বাড়ির সামনে এসে পড়েছি, বুঝতেই পারিনি।
বাড়ির ভিতরে পা রাখতেই ছোট ছেলেটা দৌড়ে এসে কোলে উঠে পড়ল। আধো আধো গলায় বলল, “বাবা, আমার গাড়ি কোথায়?”
ঝোলা থেকে হাঁটের সেই মাটির গাড়িটা বের করে ওর হাতে দিলাম যেটা কুলীনপাড়া থেকে ফেরার পথেই কিনেছিলাম। ওর চোখেমুখে যে খুশির ঝিলিক ফুটল, তা দেখে বুকটা একটু হালকা হল।
গিন্নী আমার মুখটা দেখেই বুঝে গেল, কাজটা হয়নি। তাই কিছু জিজ্ঞেস করল না। আমি পাশের পুকুরে গিয়ে স্নান সেরে এলাম। ফিরে দেখি, গিন্নী নিঃশব্দে রাতের খাবার সাজিয়ে রেখেছে।
চুপচাপ খেয়ে নিলাম। তারপর যাবতীয় ছোটখাটো কাজ গুছিয়ে নিয়ে, শুতে যাবার আগে গিন্নী ধীরে বলল
—“কি হল গো, কুলীনপাড়ায়?”
আমি সব খুলে বললাম। একে একে সব কথা। কেউ জিজ্ঞেস করে না খেয়েছি কি না, কেউ বসতেও বলে না কিন্তু কী অবলীলায় মাছ-গম-সজনে নিয়ে গল্প করে! কথার শেষে গিন্নী একটিমাত্র কথা বলল।
………………………….ঈশ্বর তাদের মঙ্গল করুন। ………………….
©somewhere in net ltd.