![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বর্ণনাকারী বলে,
একবার আমি ভ্রমণে বের হই। তখন আমি খুব গরীব। বন্ধুরা সবাই দূরে দূরে। কালের দুর্যোগ আমাকে ইয়ামানের সানা শহরে পৌঁছে দেয়। অবস্থা তখন এতই খারাপ যে, পকেটে একটা টাকাও নাই; ব্যাগে কোন খাবারও নাই। তাই আমি শহরের পথে পথে পাগলের মত ঘুরে বেড়াই। আর বড় বড় এলাকায় খুব আশায় আশায় ঘুরতে থাকি আর খুঁজে ফিরি এমন কোন দয়াবান লোক পাওয়া যায় কিনা যে আমার করুণ অবস্থা দেখে সাহায্য করবে। অথবা এমন কোন শিক্ষিত লোক যাকে দেখে দুঃখ ভুলে যাব এবং যে আমাকে সঠিক রাস্তা বাৎলে দিয়ে উদ্ধার করবে।
এভাবেই দিন কাটে। একদিন ঘোরাঘুরির শেষ হয়। কিংবা অনুগ্রহের সূচনা। এক বিশাল সভায় পৌঁছি। প্রচুর লোক সেখানে। সবাই কাঁদছিল। কিন্তু কেন? জানার জন্য সামনে বাড়ি। দেখি, সবার মাঝে কাবু একজন লোক। তার কাঁধে ব্যাগ। কান্নার আওয়াজ তারই। খুব সুন্দর ওয়াজ করে। ভয় ধরানো ওয়াজ শুনে লোকেদের টাসকি খাওয়া অবস্থা। যেমন জ্যোৎস্না চাঁদকে আর খোসা ফলকে আবৃত করে রাখে তেমনি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোক তাকে ঘিরে রাখে। তাই ওয়াজ শোনার জন্য আমি তার কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলি। ওয়াজ তখন তুমুুল পর্যায়ে। একেবারে মুখে ফেনা তোলা অবস্থা।
সে বলে চলে-
‘‘হে সীমালঙ্ঘনকারী উন্মাদ! পরে আছো অহংকারের পোশাক; নিজের মূর্খতায় ছুটে চলেছো লাগামহীন; অসৎ কথা আর কাজে ওস্তাদ তুমি প্রতিদিন!
একবারও কি ভেবে দেখেছো, কতকালই বা আর তুমি নিজের বিভ্রান্তিতে অটল থাকবে, উপভোগ্য মনে করবে দ্রোহের চারণভূমিকে!
কবে নিজের অহংকারের শেষসীমায় পৌঁছবে, কবে সাঙ্গ করবে তোমার খেলাধুলা?
তুমি তোমার অপরাধ দ্বারা যুদ্ধ করেছা ভাগ্যনিয়ন্তার বিরুদ্ধে, অর্ন্তযামীর বিরুদ্ধে দুঃসাহস প্রদর্শন করছো মন্দ চরিত্র দ্বারা?
তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছো কাছের লোকদের থেকে অথচ তুমি নও পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিসীমার বাইরে। তুমি আত্মগোপন করছো চাকর থেকে, অথচ প্রভুর কাছে তোমার গোপন নেই কিছুই!
তোমার কী ধারণা, মৃত্যু যখন চলে আসবে- বেঁচে যাবে তুমি? অথবা তোমাকে রক্ষা করবে তোমার সম্পদ- যখন তুমি ধ্বংস হবে?
কিংবা অনুতাপ, ঠেকাতে পারবে তোমার পদস্খলন?
দলবল, পারবে পুরুত্থান আটকাতে?
হায়, কেন তুমি সঠিক পথে চলো না? করো না কেন চিকিৎসা তোমার আত্মার ব্যাধির? তুমি দ্রোহের ছুরি ভোতা করে দিচ্ছো না কেন, বারণ কেন করছো না প্রবৃত্তিকে? অথচ সে তোমার সবচে বড় শত্রু।
মুত্যু কি অনিবার্য নয়? কী প্রস্তুতি আছে?
কী ভয় দেখানো হয় নি চুলের শুভ্রতা দিয়ে? অজুহাত আছে?
কবরে যেতে হবে না? কী বলবে ভাবছো?
যেতে হবে না আল্লাহর কাছে? কে সাহায্য করবে তখন?
কালের ঘণ্টা তোমাকে জাগ্রত করেছে বহুবার, কিন্তু ঘুমের ভাণ করেছো। উপদেশ তোমাকে কাছে টেনেছে, তুমি পালিয়ে গেছো। শিক্ষা তোমায় আলোকিত করেছে; অন্ধ সেজে বসে থেকেছো। সত্য প্রকাশিত হয়েছে তোমার কাছে , আর তুমি করেছো সন্দেহ। সুযোগ ছিল সমবেদনা জানানোর ; তুমি তা করো নি।
অর্জন করা অর্থকে সংরক্ষণ করে তুমি প্রাধান্য দিয়েছো নীতিকথা ওপর। যে নীতিকথা তোমার মানা উচিৎ ছিল।
তুমি দানের তুলনায় দালানকে উঁচু করেছো, যে দান তুমি দিতে পারতে।
গুরুর নির্দেশনা না মেনে পুরষ্কার পেতে চাও!
পূণ্যের চেয়ে পোশাক তোমার কাছে প্রিয়!
নামাজ ফেলনা উপহারের কাছে!
যৌতুক ভাল দানের চেয়ে!
ধর্মীয়-গ্রন্থের চেয়ে সুস্বাদু খাবার শেষ্ঠ!
তেলাওয়াতের চেয়ে আড্ডাই ভাল!
তুমিই দাও সৎকাজের আদেশ, তার সীমারেখা পায়ে দলো তুমিই!
মানুষকে বাধা দাও অসৎ কাজ থেকে; নিজেই থাক না তা থেকে বেঁেচ!
জুলুম তুমি দূরে রাখ; সেটা আবার তুমিই করো!
মানুষকে ভয় করো ; অথচ আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো না!’’
অতঃপর তিনি আবৃত্তি করেন,-
‘‘ধ্বংস হোক সেই দুনিয়াদার, যে দেয় দুনিয়ার প্রতি মনোযোগ
দুনিয়ার প্রতি আসক্তি আর প্রেমাতিশয্য যার মনোরোগ
হায়, যদি সে জানত, কাক্সক্ষার সামান্যই উপযোগ!
অতঃপর তিনি ওয়াজ থামিয়ে দেন। এবং ব্যাগ কাঁধে নিয়ে লাঠিটা বগলদাবা করেন। তার চলে যাবার ভাব দেখে লোকেরা নিজেদের পকেট থেকে সাধ্যমত তাকে দান করে। আর বলে, এগুলো দয়াকরে গ্রহণ করুন, প্রয়োজনে কাজে লাগবে। তিনি ভদ্রলোকের মত গ্রহণ করে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পথে বেড়িয়ে পড়েন। অনেকে তাকে বিদায় জানানোর জন্য পিছু নেয় । কিন্তু তিনি তাদের নিরস্ত করে দ্রুত কেটে পড়েন। পাছে আবার পথ চিনে ফেলে আর আস্তানা জেনে যায়।
বর্ণনাকারী বলে,
এরপর আমি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তাকে অনুসরণ করি। একসময় একটা গুহা দেখা যায়, যাতে তিনি চুপিসারে দ্রুত ঢুকে পড়েন। আমি তাকে এতটুকু সময় দিলাম যাতে বাইরের পোশাক বদলাতে পারে। তারপর আমি হঠাৎ হাজির হই। ঢুকে আমি যা দেখি তা বিশ্বাস করার মত নয়। দেখি কী- ছাগলের রোস্ট আর তন্দুর রুটি নিয়ে বসে পড়েছে এক তরুণের সাথে। সাথে আবার খেজুর ভেজানো পানি। আমি তো অবাক!
অনেক কষ্টে বলতে পারি, কী হুজুর, ওয়াজ করলেন কী, আর এখন হচ্ছেটা কী?
তিনি আচমকা গরমকালের প্রচ- গরম বাতাসের মত শ্বাস ছাড়েন। আর রাগে এমন ক্ষেপে যান যেন ফেটে পড়বেন। কিছুক্ষণ আমার দিকে প্রখর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। আমি ভয় পেয়ে যাই। না জানি আমার ওপর আক্রমণ করে বসে কি না। রাগের আগুন নিভে গেলে তাকে আবৃত্তি করতে শুনি-
‘‘আমি মিষ্টান্নর জন্য ডোরাকাটা চাদর পরেছি
সব রকম মাছের গলায় বিদ্ধ করেছি বড়শি;
আর আমি আমার ওয়াজকে বানিয়েছি জাল-
যেন ধরা পড়ে নর ও মাদী শিকার।
আমাকে বাধ্য করেছে সময়; যেন আমি ঢুকে পড়ি
নিজের উদ্ভাবিত কৌশলে বাঘের উপস্থিতিতে তারই ডেরায়
অথচ আমি ভয় পায় নি কালাবর্তকে; কিংবা সেজন্য
প্রকম্পিত হয়নি আমার বাহুর মাংস।
আর লোভী আত্মা আমাকে এমন ঘাটেও নামায়নি
যা কলঙ্কিত করতে পারে আমাকে।
আর যুগ যদি করত ন্যায় বিচার-
ক্ষমতা পেত না অযোগ্য লোকেরা
অতঃপর তিনি আমাকে কাছে ডেকে বলেন, খাও, আর যদি চাও, উঠে যাও, আর যা মনে চায়, বলো।
এবার আমি সেই তরুণের দিকে তাকাই। অনুরোধ করি সেই সত্তার কসম দিয়ে যে দূর করে দুঃখ কষ্ট, যে, আমাকে তুমি নিশ্চয় জানাবে এই ব্যক্তি কে? উত্তরে সে বলল, আবূ জায়েদ সারুজী, যাযাবরদের সর্দার, সাহিত্যিককুলের শিরোমণি।
এরপর সেখানে আমি আর থাকিনি। যা দেখেছি আর জেনেছি এরচে বিস্ময়ের আর কী হতে পারে আমার জানা নেই!
মূল আরবী থেকে অনুবাদ। লেখক: আল্লামা হারীরী।।
ছবি: ইন্টারনেট
©somewhere in net ltd.