![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পাকিস্তানের এক বিচিত্র উপজাতির কাহিনী
বিচিত্র সাজে অনিন্দ্যসুন্দরী কালাস রমনী
পাকিস্তানের একেবারে উত্তর পশ্চিম প্রান্তে আফগান সীমান্ত ঘেঁষে পাহাড় ঘেরা দুর্গম একটি জেলা। নাম চিত্রল। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরো দুর্গম পাহাড় ঘেরা একটি জনপদ। নাম কাফিরস্থান।
একে ত দুর্গম পাহাড় পর্বত সংকুল চিত্রল উপত্যাকা, তার মধ্যে আবার আরেক দুর্গম জনপদ কাফিরস্থান। এই ডবল দুর্গমের ধকল সামলিয়ে সেখানে যাওয়া সহজ নয়। তবুও, অনেক টুরিস্ট ভিড় জমায়। কেন যায় সে কথা নিয়ে এবং আমার নিজের দেশের নাম শুনে চমকে যাওয়ার পটভূমিতে এই গল্প। ভ্রমণ কাহিনীও বলতে পারেন।
কাফিরস্থানের একাংশ ১৮৯৫ সালে আফগান আমির আব্দুর রহমান দখল করে নেন। নতুন নাম রাখেন নুর স্থান, আলোকিত জনপদ। একাংশ পাকিস্তানের চিত্রল উপত্যকায় রয়ে গেছে।
কাফিরস্থানের নাম হয়তো শুনেন নাই। শুনবেন বা কি করে? অনেক পাকিস্তানিরাই জানে না সেটা আবার কোথায়? পাকিস্তানের খুব কম লোকেরই সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।
ঘটনাক্রমে, প্রায় দুই যুগ আগে সেখানে যাওয়ার সুযোগ এসে যায়। একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে আমার মিশন ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে চিত্রলের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি করা।
ক্ষুদ্র ঋণের ব্যাপারে আমি এক্সপার্ট নই তা সবাই জানেন। কিন্তু কনসালটেন্সি কাজে দক্ষতার খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না। এখান থেকে, সেখান থেকে মাল মসলা জোগাড় করে, সংশ্লিষ্ট লোকজনের সাথে আলাপ আলোচনা করে সাজিয়ে গুছিয়ে রিপোর্ট লিখলেই দায়িত্ব শেষ। রেগুলার চাকরির মত তেমন কোন জবাবদিহি করতে হয় না কিন্তু কাজের শেষে ভালো অংকের একখানা চেক পাওয়া যায়।
তাহলে চলুন আমার সাথে সেই রহস্যময কাফিরস্থানে।
খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের চিত্রল জেলা চারিদিকে উচু পাহাড়ে ঘেরা। পেশোয়ার থেকে সেখানে যাওয়ার একটাই মাত্র গিরিপথ। নাম লোয়ারি গিরিপথ, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ হাজার ফুট উপরে।
গ্রীষ্মকালে তিন চার মাস এই গিরিপথ বেয়ে কষ্টেসৃষ্টে লোকজন আসা-যাওয়া করে। ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় জীপ, ল্যান্ড রোভার ও ট্রাক চলে শম্বুক গতিতে। সামান্য একটু গিরিপথ পার হতে লেগে যায় দূই তিন ঘন্টা।
মাঝে মাঝে পাহাড়ের ঢাল থেকে পাথর পড়ে রাস্তা আটকে যায়। ড্রাইভার প্যাসেঞ্জার মিলে পাথর সরিয়ে আবার পথ চলা শুরু হয়।সহমর্মিতা ও সহযোগিতার সুন্দর উদাহরণ। আমাদের দেশ হলে সবাই গালে হাত দিয়ে বসে থাকত, কখন সরকার এসে তাদের রাস্তা ঠিক করে দিবে সে আশায়। গিরিপথটি শীতকালে সাত আট মাস বরফে ঢাকা থাকে। গাড়ি চলার উপায় নাই।
তখন বলতে গেলে ৮ মাস চিত্রল পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চল থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাই, শীতকালের আ্গেই চিত্রলের লোকজন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খাদ্য সামগ্রী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এনে মজুদ করে রাখে
লোয়ারি গিরিপথ, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,২৩০ ফুট উপরে
শীত কালে চিত্রলে যাতায়াতের সহজ উপায় পেশোয়ার থেকে পি আই এর ফ্লাইট। প্লেনে চড়লেই যে ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌছাতে পারবেন এ ভরসা পাইলট কখন দেয় না। অনেক সময় আবহাওয়া খারাপ থাকলে বা চিত্রল উপত্যকায় বাতাসের ঊর্ধ্বমুখী গতি থাকলে বিমান আবার পেশোয়ারে ফিরে আসে। কিছুটা ভুটানের পারো বিমানবন্দরের মতো। ছোট রানওয়ে, উপর থেকে চিলের মত ছো মেরে ল্যান্ড করতে হয়। কোন কোন সময় এক নাগাড়ে চার পাঁচ দিন বিমান বন্ধ থাকে।
শীতকালে লোকজন একেবারেই যে চলাফেরা বন্ধ করে দেয় তা নয়। অনেক সময় জরুরী প্রয়োজনে অথবা পেটের তাগিদে চিত্রলের কিছু সাহসী লোকজন এ পথে বরফের স্তর ঠেলে চলাফেরা করে। তখন তারা কথা বার্তা বন্ধ রাখে। কারণ, কথার তরঙ্গ ধ্বনিতে উপর থেকে বরফ ধ্বসে বরফ সমাধি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এ ধরনের বিপদসঙ্কুল সড়ক পথে যাত্রার ঝক্কি ঝামেলা কে নেয়? তাই পি আই এর ফক্কার ফ্রেন্ডশিপ এফ২৮ বিমানে চড়ে বসলাম। বিমানে বসতেই আমার পাশের যাত্রী আলাপ জুড়ে দিলেন। নাম বললেন জাবেদ । কোহাটের পাঠান।
বাঙ্গাল মুলুকে আমাদের ধারণা পাঠানরা ইয়া লম্বা-চওড়া হয়ে থাকে। ফটাফট গুলি চালায়। জাবেদকে দেখে সে ভুল ভাঙলো। উচ্চতা পাঁচ ফুট হয় কি না হয়। নিরীহ কিসিমের লোক। বেশির ভাগ পাঠানই ভদ্র ও অতিথি বৎসল।। তবে স্বাধীনচেতা। স্বাধীনতার ওপর আঘাত আসলে রুদ্র রূপ ধারণ করে। তার আলামত দেখেছে ব্রিটিশ, রাশিয়ান এবং সর্বশেষ আমেরিকানরা।
উচ্চতায় যারা খাটো তারা পুষিয়ে নেয় অন্য ভাবে। জাবেদের অস্ত্র বাক্যবাণ। তিনি নানা বিষয়ে রানিং কমেন্টারি শুরু করলেন। এক সময় সৌদি আরবে সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করতেন। জানালেন, তার অধীনে চট্টগ্রামের আবুল বাশার নামে এক লোক কাজ করতেন। আবুল বাশার তাকে একটা বাংলা গানের চরণ মুখস্থ করিয়েছিলেন। জাবেদ পাঠানি উচ্চারণে সে গান আমাকে শোনালেন,“ ও একটা গান লিখো আমার জন্য”। হিন্দুকুশ পর্বতমালা গা ঘেঁষে চলন্ত বিমানে বসে বাংলাদেশের গানের কলি শুনতে কার না হৃদয় উদ্বেলিত হয়? হোক না সে পাঠানি উচ্চারণে।
আমার রাশিফলে সেদিন সম্ভবত যাত্রা শুভ লেখা ছিল না। চিত্রলে পৌঁছে বিমানটি নামতে পারছিল না। উপত্যকা থেকে ঊর্ধ্বমুখী হাওয়ার তোড় বেশি। পাইলট ঘোষণা দিলেন, খাওয়াতিন আওর হযরত, হাম পেশোয়ার ওয়াপস যারাহে। লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, উই আর গোয়িং ব্যাক টু পেশোয়ার। ব্যস, কিচ্ছা খতম।
এ সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে প্রজেক্ট এর লোকজন একটা ল্যান্ড রোভার রেখে দিয়েছিল। তাতে যাত্রা শুরু করলাম। এ সময় কোথা থেকে ভগ্নদূতের মত জাবেদ উদয় হলেন। আমার সাথে চিত্রল যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি তো খুশিতে ডগমগ। আমাকে কেষ্ট বিষ্টু ঠাওর করে পাশে বসতে সংকোচ বোধ করলেন। ড্রাইভার এর পাশে বসে পড়লেন।
ড্রাইভার এর নাম পল, ধর্মে খ্রিষ্টান। পাঞ্জাবের লোক। পাঞ্জাবি আর পাঠানদের মধ্যে তেমন বনিবনা হয় না। তাদের মধ্যে মাঝে মাঝে গরম গরম বাক্যবিনিময় হতে লাগল। আমার হস্তক্ষেপে তা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়নি। অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে শেষমেষ চিত্রলে পৌঁছানো গেল।
চিত্রলে কয়েকদিন কাটানোর কাফিরস্থানের পথে রওনা দিলাম। সাথে দুইজন স্থানীয় কনসালট্যান্ট।
আগেই বলেছি, চিত্রল থেকে আরো এক অধিকতর দুর্গম পাহাড়ি জনপদের নাম কাফিরস্থান। সেখানে যাওয়ার পাহাড়ি রাস্তা এত সরু যে কোথাও কোথাও ল্যান্ড রোভারের চার চাকার সংকুলান করাই মুশকিল। পাশে রেলিং নাই। ড্রাইভার একটুখানি বেখেয়াল হলে ৫ -৬ হাজার ফুট গভীর খাতে জীবন লীলা সাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। লাশ খুঁজে আনতেই কেটে যেতে পারে সাত দিন। এ কাজের জন্য বিশেষজ্ঞসহ কাজ করছে একটা এনজিও।
চোখের ভ্রান্তি কিনা জানিনা, কখনো কখনো মনে হল গাড়ির একপাশের চাকা শূন্যে ভাসছে। তা যে আবার নিজের ঠিকানা খুঁজে পাবে সে সম্পর্কে সন্দেহ মন থেকে দূর হচ্ছিল না।এ পরিস্থিতিতে টেনশন কমানোর জন্য বুদ্ধিমানেরা চোখ বন্ধ রাখে। অতটা বুদ্ধি না থাকলেও তাই করলাম।
যা হোক, কোন রকম চড়াই উতরাই পার হয়ে রহস্যময় কাফিরস্থানে পৌঁছানো গেল। এখানে এক বিচিত্র নৃগোষ্ঠীর লোক বাস করে। তাদের নাম কাফির, প্রাক ইসলামী যুগের আরব দেশের সে কাফের নয়। অবমাননাকর শব্দ নয়। জাস্ট একটা নৃগোষ্ঠীর নাম।এদের কালাস কাফির বা রেড কাফির নামেও অভিহিত করা হয়। পাকিস্তানের অন্যান্য এলাকার জনগোষ্ঠীর থেকে এদের চেহারা আলাদা, ভাষা আলাদা, ধর্ম কর্ম, চাল চলন বিচিত্র।
এক সময় পুরো চিত্রল জেলায় কাফিররা বাস করত। কিন্তু সময়ের পরিসরে অনেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। এখন মাত্র তিনটি গ্রামে কাফিররা তাদের আদি ধর্ম কর্ম ও কালচার টিকিয়ে রেখেছে। পাকিস্তান সরকার তাদের আদি ধর্ম ও কালচার টিকিয়ে রাখতে উৎসাহ যোগায়। বিভিন্ন দেশ থেকে টুরিস্ট আসার ফলে ভান্ডারে বেশ কিছু ফরেন এক্সচেঞ্জ জমা পড়ে।
তাদের নামের বাহার শোনার মত। যখন যে নাম বা কথাটি ভালো লাগে নবজাতকের জন্য সে নাম রেখে দেয়। কারো নাম লাহোর খান।একজনের নাম ইঞ্জিনিয়ার খান। পুরো কাফির স্থানের একমাত্র গ্রাজুয়েট। তিনি ইঞ্জিনিয়ার নন, আমাদের গাইড হিসেবে কাজ করছিলেন। অন্য এক জনের নাম কায়েদে আজম। এক মেয়ের জন্ম নিয়েছিল ইলেকশনের সময়। তার নাম রাখা হয়েছে ইলেকশন বিবি।
এদের উৎস সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তি আছে। প্রচলিত ধারণা যে তারা আলেকজান্ডারের সাথে খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৩২৭ সালে যে কারণেই হোক মূল বাহিনী থেকে আলাদা হয়ে এ অঞ্চলে আস্তানা গাড়ে। হয়তো যুদ্ধ-বিগ্রহ করে ক্লান্ত হয়ে পালিয়ে এসেছিল। এদের আদি নিবাস ছিল গ্রীস ও মেসিডোনিয়া।
বহুদিন যাবত লোকচক্ষুর আড়ালে নিজেদের সে আদ্দিকালের প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের গ্রীসের ধর্ম-কর্ম ও কালচার টিকিয়ে রেখেছিল। গ্রীস থেকে বহু পর্যটক তাদের এই হারিয়ে যাওয়া জ্ঞাতি গোষ্ঠীদের এবং সে সঙ্গে তাদের তাদের অতীত জীবনের কালচার ও ধর্মকর্মের প্রতিচ্ছবি দেখতে চলে আসে। গ্রীসের লোকজন তাদের জন্য একটি স্কুলও করে দিয়েছে।
তাদের কালচার ধর্ম-কর্ম লিখতে গেলে একটা পুরো কিতাব লিখতে হয়। তাই শুধুমাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা গেল।
যেমন, কাফিররা গোপনে নানা দেব-দেবীর নামে পশু বলি দেয়। এত গোপনীয়তা কেন তাই বা কে জানে। কাফির কালচার বলে কথা।
কেউ মারা গেলে মরদেহ কফিনে পুরে মাটির উপর রেখে দিত। তবে, এ রীতি তারা এখন পরিত্যাগ করেছে। কারণ, উপত্যকার অনেক অসাধু লোকজন মরদেহের খুলি ও হাড়গোড় রাতের আঁধারে চুরি করে পাকিস্তানের মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট বিক্রি করে। মৃত্যের আত্মার শান্তির জন্য তারা এখন শবদেহ মাটির গভীরে সমাহিত করে।
বিবাহ সম্পর্কিত তাদের একটি কালচার বড়ই বিচিত্র। বিয়ে সব সমাজেই কিছুটা হলেও জুয়ার মতই। আমাদের এ কাফিররা তার একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।
ধরুন, আপনার হাতে ৫০ হাজার টাকা আছে। তা বিনিয়োগের চিন্তা করছেন। এ টাকা যৌতুক দিয়ে আপনি কোন কাফির বা কালাস সুন্দরী কে বিবাহ করলেন। আপনার বিনিয়োগ কিন্তু সব সময় বৃথা যায় না। কোন এক দিন হয়তো আরো এক পয়সাওয়ালা মজনুর দৃষ্টি পড়ল সুন্দরীর প্রতি। তারা একে অপরের প্রেমে মজল। এক সকালে দেখা গেল দু'জনেই উধাও।
কিন্তু পাহাড় ঘেরা উপত্যকা থেকে পালানো সহজ নয়। ধরা পড়তেই হবে। তখন ময়-মুরুব্বি নিষ্পত্তি করে দেয় যে যৌতুকের ৫০ হাজার টাকার দ্বিগুণ অর্থাৎ এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিলে তাদের বিবাহে কোন আপত্তি তোলা হবে না। স্ত্রী-হারানো স্বামীর লাভ ৫০ হাজার টাকা।শেয়ার মার্কেটে সব টাকা খোয়ানোর চাইতে মন্দ নয়।
এবার নয়া মজনুর অপেক্ষা করার পালা। কিছুদিন পর হয়তো আর এক রোমিও সে সুন্দরীর প্রেমে মজে উঠলো।আবার পলায়ন। এবার খেসারত ২ লক্ষ টাকা। আমাদের মজনূর লাভ এক লক্ষ টাকা।
অবশ্য, আকছরই যে এ ধরনের লাইলি-মজনুর ঘটনা ঘটে তা নয়। আমি মনে করলাম গাইড ইঞ্জিনিয়ার খান মজা করার জন্যই গল্পটি ফেঁদে বসেছিল। পরে অবশ্য এ ধরনের একটা গল্প বইতে অথবা ইন্টারনেটে পড়েছিলাম।
আরেকটি ট্রাডিশন নীতিবাগীশদের দিলে খটকা লাগতে পারে। তাই ইতস্তত করলেও বলে ফেলি।এটাও একটা লেখায় পড়েছিলাম।
বছর শেষে কাফিররা তাদের সমাজে সন্তান ধারণে সক্ষম মহিলাদের সালতামামি নেয়। যারা সন্তান ধারণ করতে পারে নাই তাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয় শক্ত-সামর্থ্য যূবা পুরুষের। তাকে দূরে পাহাড়ে নিয়ে চর্বচোষ্য লেহ্য পেয় যোগান দিয়ে শক্ত-সামর্থ্য করা হয়। শীতের আগেই সেপ্টেম্বর মাসের কোন এক তারিখে ফিরে এসে সন্তানকামী কাফির রমনীকূলের জন্য ভলান্টারি সার্ভিস দিতে থাকে।
এদের কি বলা হয় জানেন? বডলোক। বড় লোক নয়। অবশ্য, তাদের কারবার অনেক বড় লোকের মতোই বটে। আমার সাথী বর্ষীয়ান স্থানীয় কনসালটেন্ট, লাহোরের বাসিন্দা, মুখে চুকচুক ধ্বনি তুলে আফসোস প্রকাশ করল। ভাবখানা এই, সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায়, 'দেখা হলো না রে শ্যাম নত্তুন বয়সের কালে'।
অবিশ্বাস্য এবং সে সঙ্গে বিচিত্র কালচার বটে। তবে বিবাহের রকমফের নিয়ে দূনিয়াভর বৈচিত্র্যের অভাব নেই। শুনেছি, আমাদের বাড়ির কাছেই ভুটানে বড় ভাই বিয়ে করলে তার স্ত্রী অন্য ভাইদের এজমালি সম্পত্তি হয়ে যায়।
কালাস বালিকা
কাফিররা গরিব কিন্তু খুবই ফুর্তিবাজ। পরিবারের কারো মৃত্যু হলে পুরো ভ্যালিতে উৎসব লেগে যায়। বিভিন্ন জায়গা থেকে জ্ঞাতিগোষ্ঠী জড়ো হয়। উৎসবের শেষে হাটু পর্যন্ত দেনায় ডুবে যায়। সে সুযোগে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সুদের কারবারিরি হাজির হয়।বন্ধক রাখতে হয় জমি-জেরাত, গয়নাগাটি এমনকি ফলবান গাছপালা।
উৎসবমুখর কালার সম্প্রদায়
আমার ধারণা ছিল আমিই প্রথম বাঙালি যার পদচিহ্ন এ বিরান মুলূকে পড়ে থাকবে। অচিরেই সে ভুল ভাঙলো।
কাফিরস্থানে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি মহিলা সমিতি রয়েছে। সে সমিতির সাথে আমাদের আলাপ আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়। মহিলাদের সাজগোজ, পোশাক আশাক, বিচিত্র ভাষা অবোধ্য। তবে, তাদের চিন্তা ধারা বাস্তবমুখী। সংসারের ঝক্কি-ঝামেলা তাদেরই বইতে হয়। অন্য দিকে, পুরুষেরা বেশির ভাগই স্বপ্নের জগতে বাস করে। আমোদ ফুর্তি বেশি পছন্দ করে।
মহিলারা না জানে উর্দু, ইংরেজি জানার ত কথাই উঠে না। আলোচনা করতে দূ'স্তরের দোভাষী প্রয়োজন হল। আমরা ইংরেজিতে প্রশ্ন করতাম, একজন তা উর্দুতে তরজমা করতেন। তিনি আবার চিত্রলের 'খোয়ারি' ভাষায় তাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। এ ভাবে দূই স্তরের মাধ্যমে কথাবার্তা চলছিল। হঠাৎ এক মহিলার মুখে শুনতে পেলাম 'বাংলাদেশ'। আমি তো অবাক।
পরে জানা গেল, একজন ধর্মান্তরিত কাফির ৭১ সালের আগে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ঠিকাদারের কাজ করতেন। সেখান থেকে চৌদ্দগ্রামের এক মহিলার সাথে আশনাই হয় যা শেষমেষ বিবাহ পর্যন্ত গড়ায় । সে মহিলার সাথে দেখা করতে আমার কৌতুহল দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সভা শেষ হলে তার বাড়িতে দেখা করলাম।
তার বাড়ির পাশে বিরাট ফলের বাগান। বাগানের শেষ প্রান্তে উচ্ছল তরঙ্গ তুলে বয়ে চলেছে পাহাড়ি কুনার নদী। আফগান সীমান্তে হিন্দুকুশ পর্বতে জন্ম। কুনার আফগানিস্তানে প্রবেশ করে কাবুল নদীর সাথে মিলিত হয়। আফগান থেকে আবার পাকিস্তান সীমানায় প্রবেশ করে সিন্ধু নদীর জলধারায় মিলিত হয়ে আরব সাগরের অথৈ জলে বিলীন হয়ে যায়।কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।
কুনার নদী
আমাদের এক কালের কুমিল্লা বাসিনী বাংলা প্রায় ভুলেই গেছিলেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় তার সাথে কথাবার্তা চলল। তার দুই ছেলে মাতুল কুলের একজনের দেখা পেয়ে আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগলো কিন্তু কথা বার্তা হলো না। সমস্য ভাষাগত। নানা ধরনের ফল মুল সহকারে আপ্যায়নের পর আমরা বিদায় নিলাম।
চিত্রল বাসিনী বাঙালি নারী, দুই পৌত্র সহ
আমার কাফিরস্থানের অভিজ্ঞতা বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। তবে, এই বিচিত্র পাহাড়ি অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মুখে বাংলাদেশ নাম শুনে আমি যে চমকে উঠেছিলাম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
©somewhere in net ltd.