নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পরিবর্তনের অঙ্গীকার

আই নাজ বলছি

আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই আল্লাহকে, তারপর সেই মানুষটিকে বেশি ভয় পাই যে আল্লাহকে মোটেই ভয় পায় না।

আই নাজ বলছি › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রেস্টিজ কনসার্নড

০১ লা অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৬



খিলজী সাহেবের প্রেস্টিজ- পরিণাম
দিল্লীর এক বাদশাহ। খান্দানের সন্তান তালেব আলী খিলজী। এই পরিচয় তিনি নিজেই দিয়ে থাকেন তাঁর চেনা-জানা মহলে। বংশ তালিকা নাকি তাঁর বাবার কাছে ছিল, তা হারিয়ে গেছে। বাবার জীবদ্দশায় এই বংশ পরিচয় তিনি জেনেছেন তাঁর বাবা থেকে, বাবা জেনেছেন তাঁর বাবা থেকে। জানাজানির এ সিলসিলার তিনি শেষ ব্যক্তি। কিভাবে তাঁরা বাংলা মুল্লুকে আসেন, এ সম্পর্কে তালেব আলীর দেয়া সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো এই, দিল্লীর কোন এক খিলজী বাদশাহের বংশের কে একজন সুবে বাংলায় এসে বিয়ে-শাদী করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন এবং সন্তানাদি রেখে ইন্তেকাল করেন। তালেব আলী দাবী করেন, তিনি সেই বংশেরই সন্তান। এই বংশ গৌরবেই তাকে কাল-ব্যাধির মত আক্রান্ত করে বসে, আর পরিণামে ভিখারী করে ছাড়ে। বংশ গৌরব ধরে রাখাই ছিল তাঁর প্রেস্টিজ কনসার্নড।
সেই দিল্লীও নেই, বাদশাহীও নেই। বাদশাহর বংশধররা কে কোথায় গিয়ে ঘর বেঁধেছেন, কিভাবে তারা জীবন যাপন করেছেন, কে কোন মুল্লুকে চলে গেছেন, ইতিহাস এতসব তথ্য ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু তালেব আলী এই খিলজী বংশের সেই ধারাকে ধরে বেঁচে আছেন অত্যন্ত গর্বের সাথে। তালেব আলীর দাবী যে মিথ্যা, একথা আমি বলি না। কারণ, অনেকেই বাইরে থেকে এসে বাংলাদেশে বসবাস শুরু করেন। কেউ এসেছেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে, কেউ এসেছেন ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে, কেউ কেউ এসেছেন নিছক জীবিকার সন্ধানে, আবার অনেকে এসেছেন শুধু রাজনৈতিক কারণে। এজন্য আমি তালেব আলীর দাবী যেমন নির্ভুল বলে গ্রহণ করতে পারি না, তেমনি প্রত্যাখ্যান করার যুক্তিও পাই না।
তালেব আলীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৬২ সালে। রাজধানীর একই এলাকায় তখন উভয়ে বাস করতাম। পাশাপাশি বাসা ছিল। তাই তাঁর সঙ্গে বাসা বদলের দিনই পরিচিত হই। প্রথম দিনের আলাপেই জেনেছিলাম তিনি দিল্লীর বাদশাহ বংশের সন্তান। তিনিই নিজের বংশ পরিচিত তুলে ধরেন। আমিও কখন তাঁকে বলেছিলাম, আপনার মত বাদশাহী বংশের ভদ্রলোকের পাশে থাকার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি, কিন্তু ভয়ও করছি। ভাগ্যবান এজন্য যে, আমি একজন বাদশাহ বংশের লোকের পাশের বাসায় বাস করি, কিন্তু ভয় এজন্য যে, আপনার মত এত বড় খান্দানী লোকের সঙ্গে সমাজ করে চলা কি কখনো আমার পক্ষে সম্ভব হবে?
খিলজী সাহেব আমার কথা হেসে উঁড়িয়ে দেন। মহল্লার যে মসজিদে তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন আমিও সেই মসজিদে নামাজ পড়তাম। এজন্য দিনে দুতিনবার দেখা হতো। তাঁর সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য ছিল অন্তত কুড়ি বছরের। বয়সের বিচারে তিনি আমার মুরব্বী ছিলেন। এতদসত্তে¡ও তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। খুবই রসিক লোক ছিলেন। যে কোন কথায় নির্মল রস সৃষ্টি করে কথা বলতে পারতেন। স্কুল পর্যন্ত তার লেখা-পড়া ছিল বটে, কিন্তু লেখা-পড়া ভালই জানতেন। বিদেশী এক কোম্পানিতে ভাল মাহিনায় চাকরি করতেন। নিজেরে বাসায়ই বাস করতেন; আর আমি বর্তমানের মত তখনও ভাড়া বাড়িতে বাস করতাম। খিলজী সাহেব সবদিক দিয়েই সঠিক ছিলেন; কিন্তু বেঠিক ছিলেন বিশেষ এক জায়গায়। সেই বিশেষ জায়গাটি হলো এই, কৃষ্টি আর খান্দানের কথা উঠলেই তাঁকে দেখতাম অন্য এক মানুষ। কথা বলার সময় তিনি বাদশাহী বংশের মেজাজ আনতে এবং গোটা অবয়বে খান্দানী গাম্ভীর্যের ছায়া ফেলতে কসরত করতেন। তিনি মনে করেন, এদেশে খান্দান নিয়ে গর্ব করার মত পরিবার অত্যন্ত বিরল। তাঁর জানামতে হাতেগোনা যে কটি পরিবার আছে, তন্মধ্যে তার পরিবারও একটি।
একবার এক সামাজিক বৈঠকে তিনি নিজেকে বাদশাহের বংশ বলে খুব দাপটের সঙ্গে যখন কথা বলেছিলেন, তখন তাঁরই সমবয়সী বেয়াই সম্পর্কীয় এক রসিক ব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করে বসলেন, খিলজী সাহেব, আপনি বাদশাহর বংশধর, তা আমি স্বীকার করি; কিন্তু একখানা কথা, আর সে কথা হলো এই, রাজা-বাদশাহ, আমীর-ওমরাহ, সুলতান ও রাজা-মহারাজাদের ইতিহাস পড়ে জানা যায় যে, কতিপয় সম্মানজনক ব্যতিক্রম ছাড়া বাদ বাকী সকলেরই দুই নম্বর স্ত্রী অসংখ্য থাকতো, আসল স্ত্রী বা কেতাবী স্ত্রী থাকতো মাত্র এক বা দুজন। মানসিংহের ছিল ১৫শত; আর বাদশাহ জাহাঙ্গীরের ছিল সাড়ে ৪ শত দুই নম্বর স্ত্রী। এই দুই নম্বর স্ত্রীদের কেউ কেউ সন্তানও গর্ভে ধারণ করেছেন। আপনি কোন বাদশাহর কোন শ্রেণীর আর কত নম্বর স্ত্রীর সন্তানের বংশধর, তা কি জানতে পারি?
খিলজী সাহেব একথা শুনে তেলে-বেগুনে জ¦লে ওঠেন। হাতের লাঠি নিয়ে তিনি এমন দৃশ্যের সৃষ্টির, যাকে রীতিমত ফৌজদারী ঘটনা বলা যায়। আর একটু আগে বাড়তে পারলে আর বেয়াই সাহেবও খিলজী সাহেবের লাঠির নাড়গালের মধ্যে থাকলে খুনের মামলা না হলেও এটেম্পট টু মার্ডারের মামলা দিব্যি হতে পারতো। মজলিসের লোকজন অনেক কষ্টে তাঁকে শান্ত করেন এবং একটা মিটমাট করেন। প্রশ্নকারী ভদ্রলোক সাহস করে কথা বলে দেন বিপদেই পড়লেন। খিলজী সাহেবকে শান্ত করতে বেশ সময় লাগে।
বাদশাহ বংশের তালেব আলী খিলজী বংশের প্রেস্টিজ নিয়েই বেঁচে আছেন। এটাই তাঁর একমাত্র প্রেস্টিজ কনসার্নড। তিনি সব কিছু সহ্য করতে পারেন; কিন্তু তাঁর প্রেস্টিজের দুর্গে কেউ ঢিল ছুঁড়লে সেই ঢিলের আঘাত মোটেই সহ্য করতে পারেন না। বংশের প্রেস্টিজকে তিনি যে শুধু মৌখিক প্রচারের মাধ্যমে জিন্দা রেখেছেন তাই নয়, পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনেও সেই প্রেস্টিজের শানদার প্রদর্শনী করেছেন।
ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় পাঁচ কাঠা জমিনের উপর ছিল তাঁর বাড়ী। চৌচালা টিনের চারখানা ঘর। দু’খানা ভাড়া দিয়ে রাখতেন আর দুখানায় তিনি বাস করতেন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে বি.কম. পাস করার পর একটি ব্যাংকে চাকরি নেয়। আমি যখন তাঁর পাশের বাসা ভাড়া নেই, তখন ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তো। খিলজী সাহেব যে ঘরে বাস করতেন সে ঘরের একটি কক্ষকে তিনি মনের মত করে বৈঠকখানার চারদিকের দেয়ালে। অভ্যাগতদের জন্য ছিল বেশ কখানা চেয়ার। সামনে থাকতো কাপড়ের আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত টেবিল। তিনি বসতেন একখানা আরাম কেদারায়। আলবোলা থাকতো দুরে। বেশ লম্বা ছিল আলবোলার নল। আলবোলায় টান দিতেন আর অভ্যাগতদের সঙ্গে নবাবী কায়দায় কথা বলতেন। কথা বলার সময় মনে হতো সামনে রয়েছেন তাঁর পরিষদবর্গ।
তাঁর আর্থিক অবস্থা বেশ সচ্ছল ছিল। ঘরে তিন কাজের লোক। বাদশাহ খান্দানের লোক, চাকর-বারক তো থাকবেই ফুট-ফরমায়েশের জন্য। ঢাকা জেলার সাভারের দিকে ছিল তাঁর দেমের বাড়ী। দেশের বাড়ীতেও ছিল বেশ ভ‚সম্পত্তি। জমিজমা বর্গা দিয়ে রাখতেন। সারা বছরের চাউল, ডাউল, পিঁয়াজ, রসুন, মরিচ, দেশের বাড়ী থেকেই আসতো। এদিকে বাপ-বেটা দুজনই চাকরি করতেন। ঘর ভাড়া লাগতো না। নিজের বাড়ীতেই থাকতেন। ভাড়া দুটি ঘর থেকেও মাসে মাসে ভাড়া পেতেন। এই সচ্ছলতার মধ্যে থেকেই তালেব আলী খিলজী সাহেব তার খান্দানী প্রেস্টিজ নিয়ে দিন যাপন করতেন।
বড় মেয়ের বিয়ে তিনি খুবই ধুমধামের সঙ্গে দেন। মহল্লার অনেকেই তাজ্জব বনে যায়। খিলজী সাহেব নাকি আগেই ঘোষনা করেছিলেন যে, তিনি মেয়ের বিয়েতে এমন এক ভোজের আয়োজন করবেন, যাতে অতিথিরা বহু দিন পর্যন্ত মনে করে যে, খিলজী সাহেবের মেয়ের বিয়েতে একটা দাওয়াতই খেয়েছিলাম বটে! খিলজী সাহেব বাস্তবেও মেয়ের বিয়েতে এমন একটি শানদার ভোজের আযোজন করেছিলেন বলে অনেকেই আমাকে বলেছেন। গরীব-দুঃখী মহিলাদের প্রত্যেককে একখানা করে শাড়ী দিয়েছিলেন। হাতে জমা টাকায় কুলাবে কিনা এই আশঙ্কায় তিনি দেশের বাড়ীর কিছু জমিও বিক্রি করেছিলেন। মেয়ের বিয়ের এই মহা আয়োজন আর ধুমধাম দেখে খিলজী সাহেবের দূর সম্পর্কীয় এক মুরব্বী বয়েসী চাচা বলেছিলেন, তালেব, তুমি এত ধুমধাম না করলেও পারতে! এত ব্যয়ের তো প্রয়োজন ছিল না। একথা শূনে তালেব সাহেব চাচাকে স্মরণ করিয়ে দেন, চাচা, মরা হাতিও লাখ টাকা! আমরা কোন বংশের সন্তান তা কি ভুলতে পারি? নজর তো ছোট করতে পারি না। প্রেস্টিজ কনসার্নড।’
চাচা জবাবে বলেছিলেন, যা ভাল মনে কর বাবা তাই কর। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে বেশ বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে, কেমন কেমন যেন লাগছে!
তালেব আলী চাচাকে সান্ত¡না দিয়ে বলেছিলেন, চাচা, যাই বলুন, বংশের প্রেস্টিজ তো অবশ্যই রাখতে হবে।
চাচার শেষ কথা ছিল, ‘শেষ পর্যন্ত এই প্রেস্টিজটা থাকলেই হল।’
খিলজী সাহেবের মেয়ের বিয়ে কিভাবে হয়েছিল তা আমি দেখিনি। কিন্তু ছোট ছেলের খতনা অনুষ্ঠান আর তার বড় ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান আমি দেখছি। ছোট ছেলের খাতনা অনুষ্ঠান ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠান। তখন কমিউনিটি সেন্টারে ছিল না। মাঠে সামিয়ানা খাটিয়ে আলোয় আলোময় করে তোলা হয়েছিল অনুষ্ঠান। মাইকের লাউড স্পীকার লটকিয়ে গানের রেকর্ড বাজানো হয়। রাজধানীর বিখ্যাত কাওয়ালদের এনে কাওয়ালী গানের আসর বসানো হয়। সারারাত কাওয়ালী গান চলে। সেই শানদার খাতনা অনুষ্ঠানের দাওয়াতে যারা এসেছিলেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকের হাতে ছিল ছেলের জন্য উপহার। খাতনা অনুষ্ঠানটি ছিল বড় লোকের বিয়ে অনুষ্ঠানেইর মতই। এই খাতনা অনুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের জন্যও তালেব সাহেবকে দেশের বাড়ীর বেশ জমি বিক্রি করতে হয়েছিল। তাঁর আপনজনদের অনেকেই এত ব্যয়বহুল অনুষ্ঠানের উপর প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি তাদেরকেও উত্তর দিয়েছেন এই বলে, আমি কোন খান্দানের লোক তা কেন আপনার দেখছেন না? খান্দানের ইজ্জত বলতে তো একটা কথা আছে। তাও কি স্বীকার করেন না? খিলজী সাহেবের পাল্টা প্রশ্ন শুনে আর কেউ কথা বলেনি।
তালেব আরী খিলজী সাহেবের বড় ছেলের বিয়েতে ধুমধাম আরো বেশি হয়েছিল। ছেলে ব্যাংকে চাকরি করে, উচ্চ শিক্ষিত, সন্তানদের মধ্যেও বড়। এই দর্শন ও তাঁকে বেশি ধুমধাম করার প্রেরণা যুগিয়েছিল। তিনি মনে করেন, দিল্লীর বাদশাহ বংশের বঙ্গীয় সন্তানের বিয়ে তো দিল্লীর শাহী কায়দায় হওয়া উচিত। প্রেস্টিজ কনসার্নড। এ প্রেস্টিজ রক্ষার জন্য তিনি দেশর বাড়ীর অবশিষ্ট ভ‚সম্পত্তি বিক্রি করে ফেলেন। ছেলের বিয়ের কয়েক মাস আগেই চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সে সময় তিনি এককালীন বেশ কিছু টাকাও পেয়েছিলেনণ। এই অর্থও বিয়েতে ব্যয় হ। কি মহা ধুধাম! বাদ্য-বাজনা, খানা-পিনা আর সাজ-সজ্জা ছিল দেখার মত ব্যাপার-স্যাপার। যারা দেখেছে তারাই শুধু বুঝতে পারে। কেউ কেউ মনত্ব্য করলেন, বাদশাহ বংশের লোক তো, বাদশাহী নজর। অনেকে পেট ভরে তৃপ্তি সহকারে খেলেন আবার তীর্যক মনত্ব্যও করলেন।
ছেলেরবিয়ে সম্ভবত ১৯৬৮ সালের জানুয়ারী অথবা ফেব্রæয়ারীতে হয়েছিল। এ বিয়ের প্রায় এক বছর পর রাজধানীর দক্ষিণ সীমান্তের এক এলাকায় আমি বাসা বদল করে চলে যাই। যাবার আগেই দেখেছি, তালেব আলী খিলজী সাহেবের বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক অবস্থার শুরু হয়েছে। কাবুলিওয়ালারা ঘন ঘন তাঁর বাসায় আনাগোনা করছে। প্রেস্টিজ রক্ষার জন্য তিনি মোটা অংকের অর্থ কাবুলী ওয়ালাদের থেকে নিয়েছিলেন বলে শুনেছিলাম। মাসে মাসে তিনি নিয়মিত সুদ দিতে পারতেন না বলে কাবুলিওয়ালা প্রায়ই তাঁকে জ¦ালাতন করতো। তালে সাহেবের মধ্যে যে একটা রসিক মন ছিল, তা যেন হারিয়ে গিয়েছিল। চিন্তিত থাকতে দেখতাম সব সময়। মসজিদে ঢুকলে অনেক ক্ষণ মসজিদে বসে থাকতেন। সেই এলাকা ছেড়ে দেয়ার পর অনেক বছর তাঁর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। দেশব্যাপী তখন শুরু হয়েছে মুক্তি সংগ্রাম। তখন তো অবস্থা এমনই ছিল যে, কে রাখে কার খবর। অনেক বছর পার হয়ে যায়। খিলজী সাহবের সাথে আর দেখা হয়না। বেঁচে আছেন না মরে গেলেন সে খবরও জানতাম না।
১৯৮৪ সাল। বাসা বদল করে রাজধানীর নতুন এক এলাকায় এসেছি। সেই এলাকার এক কাঁচা বাজার মাছ, তরিতরকারী কিনতে প্রায়ই যেতাম। একদিন অতিবৃদ্ধ তরকারী বিক্রেতার দোকান থেকে কিচু তরকারী কেনার জন্য দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন এক সব্জির সের মূল্য জিজ্ঞাসা করছিলাম। বৃদ্ধ তরকারী বিক্রেতা আমার দিকে তাকিয়ে দাম বললেন বটে; কিন্তু দৃষ্টি আর ফেরালেন না। প্রায় মিনিট দুয়েক এক দৃষ্টিতে থাকিয়ে বললেন, আপনি কি মাস্টার সাহেব? মাস্টার সাহেব বলার অর্থ হলো আমি তখন টিউশনি করতাম। আমিও তাঁর দিকে তাকিয়ে চিনে ফেললাম। তিনি যে খিলজী সাহেব তাতে আর সন্দেহ থাকলো না। আমি যখন তাঁর প্রশ্নের উত্তরে জ¦ বললাম, তখই তিনিই নিশ্চিত হলেন। তাড়াতাড়ি দোকান থেকে নেমে এসে আমার সঙ্গে কোলাকুলি করলেন। তাঁর সঙ্গে সেদিন আমার যে কথোপকথন হয় তা নি¤œরূপ:
- আপনার এ অবস্থা কেমন করে হলো?
- কপাল, মাস্টার সাহেব! কপাল! কপালে করাঘাত করে তিনি একথা বললেন।
- এই বৃদ্ধ বয়সে কিভাবে তরকারীর আড়তে যান আর তরকারী আনেন?
- আমি যাই না, ছোট ছেলে যায়। সে দোকান চালায়। আমি মাঝে মাঝে দোকানে এসে বসি।
- ছেলেটি কি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে?
- মেট্টিক পাস করেছে, তারপর আর পড়াতে পারিনি?
- আপনার স্ত্রী কি বেঁচে আছেন?
- অনেক আগেই তাকে শেষ বিদায় দিয়েছি।
- বাসাটা তো আছে?
- না মাস্টার সাহেব, তা নেই। মুক্তিযুদ্ধের আগেই বিক্রি করে ফেলেছি। দায়- দেনা অনেক হয়ে গিয়েছিল। কাবুলিওয়ালাদের জ¦ালাতনটা ছিল মারাত্মক। বড় ছেলের বউও বিয়ের বছর দেড়েক পর সন্তান প্রসবের পর মারা যায়। ছেলে আর বিয়ে-শাদী করেনি। বাড়ী বিক্রি করে দায়- দেনা পরিশোধ করে হাতে যা টাকা ছিল তার প্রায় সবই ছেলেটির জার্মান যেতে লেগে যায়। জার্মান যাওয়ার পর কয়েক মাস সে কিছু কিছু টাকা পাঠাতো। প্রায় এক বছর এভাবেই চলছিল। এরপর থেকে আর টাকা দেয়নি। তবে চিঠি-পত্র বছরে দুচারটা পাই। সে এক জার্মান মেয়ে বিয়ে করে ওখানেই আছে। সে যা আয় করে তাকে নাকি তারই চলে না। আমি টাকার জন্য পত্রও লেখিনা। আমি তরকারী ব্যবসা করছি। নিকটেই এক বাসা ভাড়া করে থাকি। ছোট ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলের ঘরের নাতি স্কুলে যায়। এখন ছেলে, ছেলের বউ, নাতি আর আমি আছি। কোনভাবে দিন কেটে যাচ্ছে।
- ছোট ছেলের বিয়েতে কেমন ধুমধাম করলেন? বাদশাহ বংশের সন্তান তো?
- আর লজ্জা দেবেন না মাস্টার সাহেব।
- আভিজাত্যের এই ভ্রান্তিবিলাস আপনার এই অবস্থার জন্য দায়ী, তা কি এখন বুঝেন?
- খুব বুঝি। হাড়ে হাড়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। কিন্তু বুঝলেই বা কি, সংশোধনের তো পথ খোলা নেই।
- ছোট ছেলের মধ্যে কি খিলজী খিলজী ভাব নেই?
- না, সে এসব শুনতেই চায় না। সে হিসাবী ও খুব পরিশ্রমী। এখন দায়- দেনা নেই; বরং ছেলেটির কিছু সঞ্চয়ও আছে।
তালেব আলীর সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তখন এক যুবক আমাদের দুজনকে সালাম দিয়ে দোকান নামক টঙ্গে উঠতে দেখলাম। তালেব আলী তাকে দেখিয়ে বললেন, এই যে আমার ছোট ছেলে ফারুক। চিনতে পারলেন? ফারুককে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, আমার পাশের বাসার মাস্টার সাহেব, চিনতে পারলি? তোকে কত আদর করতেন।
খিলজী সাহেবের কথা শুনে ফারুকও দোকান থেকে নেমে এসে আমকে পা ছুঁয়ে সালাম করলো। আমিও তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলাম। ফারুককে দেখে মনে হলো, সে উন্নতি করবে।
কথোপকথন শেষ করে এই দোকান থেকেই তরিতরকারী কিনে সেদিনের মত বিদায় নিলাম। খিলজী সাহেব আমাকে বাজার থেকে পার করে মেইন রোড পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। বিদায়ের সময় তিনি বললেন, মাস্টার সাহেব, দুঃখ শুধু একটাই রয়ে গেল। ছোট ছেলেটাকে যদি বড় ছেলের মত বিয়ে দিতে পারতাম, তারপর যদি বাড়ীটা বিক্রি হতো, তাহলে কোন দুঃখ থাকতো না। কিন্তু কপালে তার আর ঘটলা না।
খিলজী সাহেবের কথা শুনে আমার মনে হলো, তাঁর বংশের প্রেস্টিজ- নেশা এখনও কাটেনি। তথাকথিত আভিজাত্যের সাপ মরেছে বটে; কিন্তু লেজ বিষ এখনও আছে। এজন্য লেজ নাড়তে দেখা যাচ্ছে।
তালেব আলীকে বললাম, যা হবার ছিল তা হয়ে গেছে, আফসোস করে কি লাভ! হায়াতে যদি কুলায় তাহলে নাতির বিয়েটা ধুমধাম করেই দেবেন। খিলজী সাহেব বললেন, এই বয়স কি পাবো মাস্টার সাহেব? এত টাকাই বা পাবো কোথায়?
আমি স্পষ্টই বুঝলাম, খান্দানী নেশা এখনও তাঁকে ধাক্কা দেয়। তালেব আলীর সঙ্গে এই ছিল আমার শেষ দেখা। পরের সপ্তাহে বাজারে গিয়ে দেখি তালেব আলী দোকানে নেই, তার ছেলে ফারুক ও নেই। পাশের দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে, দুদিন আগে তালেব খিলজী ইন্তেকাল হয়েছে। শুনেই ইন্নানিল্লাহ পড়লাম। ১৯৬২ সন থেকে আমার দেখা তার সংসার জীবনের এবং ব্যক্তিগত জীবনের সব ছবি একে একে চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে আমার চোখটাও সজল হয়ে ওঠলো। বাসা চিনি না, তাই খবর নিতেও পারলাম না। পরের সপ্তাহে বাজারে গিয়ে দেখি ফারুক দোকানে দোকানদারী করছে। আমাকে দেখেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো এবং বললো, চাচা, আমার আব্বা নেই। আমি আগেই শুনেছি, তাঁকে বললাম। তারপর সান্ত¡না দিলাম। মিথ্যা আভিজাত্যের কুহকিনীর পিছনে সারাজীবন ধাবমান বোকা তালেব আলী খিলজির জন্য বড়ই করুণা হলো। তাঁর জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মনে মনে দোয়া করলাম আর আল্লাহর কাছে এ প্রার্থনা করলাম, হায় পরোয়ারদেগার, ফারুককে তুমি এই ব্যাধি থেকে মুক্ত রেখো।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১২

স্রাঞ্জি সে বলেছেন:

প্যারা আছে বটেই কিন্তু স্পেস দিলে আরো সুন্দর লাগত গল্প টাকে

২| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫১

আই নাজ বলছি বলেছেন: এডিট করবো কি? ভাইয়া..

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.