![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমাদের রান্নাঘরের পাশের জানালা দিয়ে অনেকগুলো মেহগনি গাছ দেখা যেত। সকালে জানালা খুললে সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ যখন থালাবাসনের উপর পড়ত, গোলাপি রঙের রান্নাঘরটি তখন স্বপ্নের মত লাগতো। আমি মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ভেজা মুখে চা বসাতে আসতাম, ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপে চুমুক না দিলে আমার দিন শুরু হয় না। মামীর দেয়া সাদার মধ্যে গোলাপি হলুদ ফুলফুল কাপে চা ঢালার পরপরই মেহগনি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা রোদে নেচে উঠত গরম চায়ের ধোঁয়া। চায়ে চুমুক দিয়ে আমি সূর্যের আলোর দিকে সরাসরি তাকানোর সাহস করতাম। জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখতাম টিনের চালের উপর শত সহস্র আবর্জনার ফাঁকে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমানো বিড়ালগুলোকে। টিনের ঘরগুলোর সামনে এক চিলতে উঠোন ছিল, উঠোনে দুটো বাচ্চা মেয়ে খেলা করতো। তখনও আরএফএলের চুলাটা ‘টাশ’ করে জ্বালানো যেত। এখন চুলা জ্বালাতে ম্যাচ ব্যবহার করতে হয়, কালক্রমে তার অটোম্যাটিক হওয়ার ক্ষমতা চলে গেছে। চায়ের কাপটা রয়ে গেছে, কিন্তু মামী নেই। মেহগনি গাছগুলোরও মৃত্যু হয়েছে। গাছের ডালে বসে ছোট ছোট দুটো ছানাকে চাল খাওয়ানো ব্যস্ত মা চড়ুইকে আমি কখনও ভুলবো না। জানি না ওরা এখন কোথায় আছে।
মৃত গাছগুলোর গুঁড়ি যেদিন ভ্যানে তোলা হচ্ছিল, আমি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমগাছটির সাথে মিলে ওদের জন্য প্রার্থনা করেছিলাম। সেদিন আমার সঙ্গে দিদিও ছিল, তখনও জানতাম না কয়েক মাস পরে দিদিও চলে যাবে না ফেরার দেশে। সে গল্প আজ থাক। আজ গল্প হবে বিল্লুকে নিয়ে। বিল্লুর সঙ্গে আমার পরিচয় আরও পরে। কীভাবে সেটাই বলছি।
মেহগনিদের মৃত্যুর পর টিনশেড বাড়িগুলোর একাংশও ভাঙা হল। টিনের চাল সরানোর পর উপর থেকে পুরো বাড়িটাকে পুতুলের ঘরের মত লাগছিল—এইখানে বাথরুম, এক পাশে ডাইনিং, এখানে মনে হয় বেডরুম ছিল। দেয়ালে লাগানো মলিন ক্যালেন্ডার বলে দেয় কত স্মৃতি হাতুড়ি বাটালের তোপে ভেঙ্গে পড়ছে। পুরনোর দিন শেষ, আসছে নতুনদের সময়। উঠবে বহুতল দালান। মেহগনিদের জন্য এখানে জায়গা কই! অচেনা গন্ধের শ্রমিকদের এমন হুলুস্থুলে সেই কদিন বিড়াল সমাজের উপর এক বিপ্লব বয়ে গিয়েছিল, টিনের চালে গা এলানোর দিন শেষ। পাশের পুরনো বিল্ডিংয়ের তিনতলা থেকে আগে রশি দিয়ে ঝোলানো বাটিতে খাবার আসতো, এখন কি হবে? চিন্তার অন্ত নেই ছোট্ট প্রাণীগুলোর। পরিবর্তনের এই হাওয়া আতঙ্কিত করেছে আমগাছের কাক পরিবারকেও। সবে বসন্ত শুরু হল, কই না সংসার গুছাবে তারা, আবাসন নিয়ে সংকট এখন!
এভাবেই কাটলো কয়েকদিন। প্রকৃতির সন্তানরা ঠিকই যার যার পথ খুঁজে নিল। রশি দিয়ে বাঁধা বাটি এখন সামনের রাস্তায় আসে। তিনতলার লোকটা খাবার নিয়ে ‘আয় আয়’ বলে ডাক দেয়। প্রথম দিন বুঝতে একটু দেরি হলেও অভুক্ত থাকতে হয়নি কাউকে। কাক পরিবারগুলোও বুঝে গেছে, আম গাছ কাটা হবে না। অন্তত এই বছর না। তিনতলার লোকটা দেয়া এক বাটি ভাতে মুখ দেয় প্রায় ১০ টা বিড়াল, শক্ত পুরুষগুলোর সঙ্গে মারামারি করে পারে না সদ্য কিশোর বয়সে পা দেয়া সাদা বিড়ালটি, যার মাথাটা ছাই রঙের। সবাই খায় হাপুসহুপুস করে, সানশেডের কোণায় দুই পা সামনে দিয়ে বসে বসে দেখে সে। আশা করে, সবাই খেলে যদি কিছু থাকে তাহলে সেটাই খাবে নাহয়। কিন্তু সদা ক্ষুধার্ত এই দুনিয়ায় একটি ভাতও অবশিষ্ট থাকে না। দুদিন পরপর পেট বাঁধানো কমলা ছোপছোপ বিড়ালনি একাই তো দুজনের খাবার খায়। দিন যায়, ক্ষুধা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ছাই রঙের মাথার সাদা বিড়ালটি।
বর্ষা এলো। মেহগনিদের জন্মস্থানে এরই মধ্যে মাথাচাড়া দিয়েছে ইট-সিমেন্টের দালান, যার বয়স এখন দোতলা। আধুনিক দোতলার উচ্চতা এসে থেমেছে পুরনো বাড়িটির তিনতলার রান্নাঘরের পাশে, যেখান থেকে মাছের গন্ধ আসে, লোকটা সবার জন্য ভাত মাখে দুই বেলা। ছোট্ট গোলাপি নাক দিয়ে শুঁকতে শুঁকতে একদিন ঠিকই জায়গাটা আবিষ্কার করে ফেলল ছাই রঙের মাথার সাদা বিড়ালটি। মাটিতে শুইয়ে রাখা লম্বা লম্বা বাঁশ, শুকনো সিমেন্টের ধুলো এড়িয়ে একদিন ভর দুপুরে পুরনো বাড়িটির রান্নাঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে মিউ মিউ শুরু করল সে। লোকটাকে দেখা যায় না, অনেকক্ষণ নানাভাবে মিউ মিউ করার পর তার দিকে একটি মাছ ছুঁড়ে দিল এক বৃদ্ধ মহিলা। সেদিন থেকে এখানে গোপন আস্তানা গড়ল বিড়ালটি। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে, ভর দুপুরে এসে মিউ মিউ করলে কিছু না কিছু তো পাওয়া যায়!
ঝড়বৃষ্টির রাতেও বিড়ালটিকে ওখানেই দেখা যেত। কখনও বাঁশের উপর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে, কখনও দূর থেকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে মিউ মিউ করছে, সন্ধ্যার নানা শব্দে ওর মিউ মিউ মনে হত অনেক দূরে বাজছে। তিনতলা বরাবর বসে থাকলেও চারতলা থেকেও মাঝে মাঝে মাছের কাটা ছুঁড়ে দেয়া হত তার দিকে। ওকে চারতলা বরাবর আমন্ত্রণ জানাতেই নাম দিলাম—বিল্লু। এই নাম যে তার, সে বুঝে। নাম ধরে ডাকলে দৌড়ে আসে। কিন্তু বাস্তব জীবনে মাঝে মাঝে স্বর্গেও ঝড় নামে।
একদিন এমনই এক দুপুরে গায়ে হলদে রোদ মেখে শোপিসের মত দাঁড়িয়ে মিউ মিউ করছিল বিল্লু। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বড় একটা কাঠের টুকরো ওর দিকে ছুঁড়ে মারলো! এই হামলার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমরা কেউই। ধমক দিতে দিতে লোকটা বিল্লুকে দৌড়ানি দিল। রশিতে গামছাটা মেলে সদ্য উঠা দালানের কোণায় এসে দেখল মাছের কাঁটাসহ আরও অনেক খাবার ছড়ানো। অপরাধীর মত আমরা চুপটি করে জানালা বন্ধ করে দিলাম! তিনতলা ও চারতলা দুখানেই। লোকটি কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে চলে গেল। রাত এগারোটা। জানালার বাইরের আবছা অন্ধকারে সাদা একটি শোপিসকে দেখে আমার মন আনন্দে নেচে উঠলো। আমরা সবাই ওর জন্য চিন্তিত ছিলাম। বেচারা ব্যাথা পেয়েছে কীনা কে জানে। সেদিন ফ্রিজ থেকে বের করে বাসি একটা মুরগির আস্ত রান ওকে খাইয়েছি। চাঁদের আলোয় দেখলাম ওর কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ এই গোপন আস্তানার খোঁজ পেয়ে উঠে এসেছে। তবে সবাইকে খাওয়ানোর সামর্থ্য তো নেই।
হেমন্তের শিশির যখন পড়ছে, তখন পুরোদমে কাজ চলছে নতুন বাড়িটির। শ্রমিক মানেই যম, তা বুঝা হয়ে গেছে বিল্লুর। তাই ওই বাড়িতে আর পা রাখে না সে। এখন তার আস্তানা সরাসরি আমাদের বাড়িই। সানশেডে বসে মিউ মিউ, সকাল থেকে দুপুর। সন্ধ্যায় এক লাফে আমাদের বারান্দায় এসে বসে থাকা। নাহ, সবসময় এত খাবার থাকতো না। তাই দিতামও না। তবে ‘তিনতলার লোকটা’ কীভাবে যেন ওর মিউ মিউ থামিয়ে দিতো, পেট ভরিয়ে দিতো। সানশেডের উপর ওর জন্য ভাতভর্তি পিরিচ উঠিয়ে দিতে দেখেছি অনেকদিন। খেয়েদেয়ে বিল্লু আমাদের আরেক পাশের বিল্ডিং, যেখানে বাড়িওয়ালা পরিবারটি সকাল সন্ধ্যা নোয়াখালীর ভাষায় চিৎকার করে কথা বলে, সেই বাড়ির সানশেডে ঘুমায় মাঝে মাঝে। বৃষ্টির ঝাপটা এখানে আসে না। আবর্জনার স্তুপে জ্বলজ্বল করে ধবধবে সাদা বিল্লুর নরম শরীরটা।
মাঝখানে অনেকদিন বিল্লুর কোন খবর পাইনি। নবান্ন গেল, বড়দিন গেল, বিল্লু লাপাত্তা। ততদিনে তিনতলা বরাবর দেয়াল তোলার কাজ শেষ, বারান্দায় গ্রিলও দেয়া হয়েছে। ছোট ছোট রুম করা হয়েছে, মেঝেতে টাইলস। এমনই শৈত্যপ্রবাহের এক দিনে মা দেখালো বিল্লুকে। নতুন বিল্ডিংটির এক হাত বারান্দায় শোপিসের মত বসে আছে, ঠিক এই জায়গাটিতেই আগে এসে বসতো সে। যখন পুরো ফ্লোরটি বিস্তীর্ণ মাঠের মত ছিল, এখন সীমানার দেয়ার তোলা হয়েছে। ভাগ করা হয়েছে বেডরুম, রান্নাঘর, বাথরুম, বারান্দা। লাল রঙে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখে আরও জোরে মিউ বলে চিৎকার করে ছোট্ট বিল্লু। অনেকদিন পর ওকে দেখে আমি জিজ্ঞেস করি কেমন আছে সে। মিউ বলে কিছু একটা উত্তর দেয়। খাবার চায় নাকি কুশল বিনিময় করে বুঝি না। খাবারই চায় হয়ত। চারতলা থেকে মা ওর দিকে কাঁটা ছুঁড়ে দেয়, কিন্তু গ্রিলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তা নিচে পড়ে যায়। বোকা বিল্লু বারান্দার ভেতরেই ছোঁড়া খাবারটি খুঁজতে থাকে। ও কি বুঝে না সীমানা কি জিনিস? আসলেই মনে হয় প্রাণীরা এসব বুঝে না। সীমানা তো মানুষের বানানো।
একটু পরে ও উপরে উঠে আসে, ছাদে। আমি আর মা দ্বিগুণ উৎসাহে ওকে খাবার দেই। কখনও মাছের মাথা, কখনও মুরগির সিদ্ধ করা পা। প্রতিদিন জানালায় আসা মায়ের সঙ্গী কাকগুলো হিংসে করে। মাথায় ঝুঁটিওয়ালা কাকটি দূর থেকে সব দেখে। গলাভাঙ্গা কাকটি ভোঁতা কন্ঠে কা কা করে প্রতিবাদ জানায়। গলাভাঙ্গা কাক? সে আরেক গল্প। ভ্যাপসা গরমের সময় ছাদে জমা পানিতে গোসল করতো দোয়েল, শালিক আর চড়ুইয়ের ঝাঁক। এখন ওরা দেখি খেতে আসে কাকদের দেখাদেখি। বিল্লুর খাওয়ার পর ছাদে কিছু উচ্ছিষ্ট খাবার থেকে যায়, তাও খাওয়ার লোক ঠিক করে দিয়েছে প্রকৃতি।
লাল গ্রিলের বারান্দার ভেতর দিয়ে ছোট্ট একটা রুম দেখা যায়, জানালা গলে সেখানে রোদ পড়ে সকাল বিকাল। রোদের মধ্যে চলে আম গাছের পাতাগুলোর ছায়ার নাচন। কে যেন এত্তগুলো বই এনে ছড়িয়ে রেখেছে মেঝেতে। পুরনো বইগুলো দূর থেকে দেখতে দেখতে আমি ভাবি, একদিন এখানে ভাড়াটিয়া আসবে। খাট পাতা হবে, কম্পিউটার রাখা হবে। ছোট্ট রুমটা নিমেষেই ভরে যাবে আটপৌরে আসবাবপত্রে। চৈত্রের দুপুরে যখন আমগাছে পাখি ডাকবে, তখন সেই বিছানায় চুল এলিয়ে দিয়ে হয়ত ভাতঘুম দিবে কেউ। ফ্যানের বাতাসে চাদরের বাড়তি অংশ উড়বে, উড়বে তার চুল। খোলা জানালায় পর্দা টানানো হবে, পর্দা ভেদ করে রোদ ঢুকবে অন্য কোন রঙে। বইগুলো তখন হারিয়ে যাবে, ঠিক যেমন হারাবে বিল্লুর গোপন আস্তানা।
©somewhere in net ltd.