![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজ তার সঙ্গে দেখা হল। পুরনো রঙচটা জামা পড়া একটা মেয়ে, অসহায়ের মত ছাদের এক পাশ থেকে আরেক পাশ দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তার মুখটা চুল দিয়ে ঢাকা, কিছু দেখা যায় না। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা একটা ফ্রকের মত জামা পরনে তার, যার রঙ কোন এক কালে হলুদ ছিল, এখন সাদা হয়ে গেছে। পায়ের দিকটা আবছা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না, সে দৌড়ানোর কারণে পাগুলো কেমন ঘোলা লাগছে। স্যান্ডেল নেই পায়ে, না থাকাটাই স্বাভাবিক। অশরীরীদের পায়ে স্যান্ডেল থাকবে কেন।
প্রতিদিন সূর্য ডুবলেই শুরু হয় ধুপধাপ শব্দ, যেন ছাদের উপর কেউ দৌড়াচ্ছে। রাত দুইটার সময়ও আমার ভাই ছাদে গিয়ে কারও দেখা পায়নি। এখনও সন্ধ্যা, চারপাশের বিল্ডিংগুলোতে জোরে সাউন্ড দিয়ে কুসুমদোলা চলছে, টিভির শব্দে ধুপধাপ কাঁপুনি কারও নজরে আসে না। প্রথম প্রথম যদিও অনেকেই টের পেয়েছে তার উপস্থিতি। ‘কুসুমদোলা’র বিরতির সময় আমাদের বাসার টিভিতে ‘মিউট’ দেয়া হয়, তখন হঠাৎ করে সবকিছু অস্বাভাবিক রকমের শান্ত হয়ে যায়। মাঝে মাঝে পাশের বাসার লোকজন ভোঁতা গলায় চেঁচামেচি শুরু করলে সেই অস্বাভাবিকতায় যেন একটু ভাটা পড়ে। তবে এই ক্ষণিকের নিস্তব্ধতাই যথেষ্ট ছিল তার পায়ের শব্দ বুঝার জন্য।
আগে সন্ধ্যা হলে আমার খালাতো ভাই তার বন্ধুদের নিয়ে ছাদে আড্ডা দিতো, শুরুর দিকে শব্দ শোনার পর আমরা ভাবতাম বুঝি ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছাদের এপার থেকে ওপারে দৌড়ের শব্দ, আমাদের পুরনো বাড়ির জানালাগুলো রীতিমত কাঁপে। উচ্ছ্বন্নে যাওয়া খালাতো ভাইয়ের কথা ভেবে গজগজ-কটমট করতে করতে কাটতো বাড়ির দর্শকদের বিরতির ‘মিউট’ দেয়া সময়টুকু। সেদিন অফিসফেরত খালাকে গেটের কাছে পেয়ে আমার মা যেই না সুর করে অভিযোগটা তুলতে যাচ্ছিল, ভুলটা ভাঙল তখনই। খালা জানালেন তার ছেলে পুরো ‘উইকেন্ড’ বন্ধুর বাড়িতে কাটিয়েছে, এখনও ফিরেনি।
এরপরে আমাদের পুরো বাড়ির মেরুদন্ডে ছোটখাটো একটা শীতল স্রোত বয়ে গিয়েছিল। ভয় কাটানোর জন্য আমার ভাই কয়েকবার রাত দুইটা সময় ছাদে গিয়ে দেখে এসেছে। কিন্তু দৌড় থামেনি।
ইংরেজিতে ‘একটিভ ডিনায়াল’ নামের একটি শব্দ আছে। কীভাবে কীভাবে যেন আমাদের পুরো বিল্ডিংয়ের বাসিন্দারা সবাই এই ফর্মুলা মেনে নিল। সন্ধ্যা হলেই রান্নাঘরের জানালাগুলো শক্ত করে আটকে, বেডরুমে এসে টিভি ছেড়ে সবাই ভুলে গেল কেউ একজন লম্বা লম্বা পা ফেলে ছাদে দৌড়াচ্ছে। কিংবা বলা যায় ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল। মাঝে মাঝে রবিবারের সন্ধ্যায় চার্চ থেকে ফিরে যখন চায়ের আসর বসে তিনতলায়, তখন সবাই ঝাড়ফুঁক করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। কিন্তু সিদ্ধান্তটা বেকারির বিস্কুট কিংবা হোটেলের পুরির সঙ্গে কখন যেন সবাই পেটে করে বাড়ি নিয়ে যায়। আরেক রোববার আসে, আবারও হয় সিদ্ধান্ত। আমার ভূমিকা কি এখানে? আমি উস্কানির কাজ করি। একদল ভীতু মানুষকে আরও ভয় দেখাতে আমার দারুণ লাগে। যদিও আমি নিজে তাদের চেয়ে কম ভীতু নই।
আমি ওকে নিয়ে অনেক ভেবেছি। তবে ও ছেলে না মেয়ে এই প্রশ্ন কেন জানি আমার মাথায় কখনও আসেনি। সত্তরের দশকে বানানো এই বাড়িটির কিছু পুরনো ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করেছি কদিন। ভাইবোনদের মুখে শুনেছিলাম, বাড়িটির নির্মাণ চলার সময় ভর দুপুরে নাকি এক শ্রমিক ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিল। তবে কেন যেন আমার দৌড়ের শব্দটা শুনে কোন জোয়ান শ্রমিকের পায়ের শব্দ মনে হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে আমি ভর দুপুরের গল্পকে ‘বোগাস’এর খাতায় ফেলে দিয়েছি। তবে একটি প্রশ্ন তো মনে এসেছেই, ও এত দৌড়ায় কেন? ও কি আমার মত স্বাস্থ্যসচেতন? আমার মত পেটের মেদ নিয়ে চিন্তিত? কিন্তু অশরীরীদের কি এসব জাগতিক দুশ্চিন্তা আদৌ আছে? ওদের তো শরীরই নেই।
গ্রীষ্ম গিয়ে বর্ষা এসেছে, ভাবছি বৃষ্টির মধ্যে কি ও দৌড়াবে?
যথারীতি আজও ‘কুসুমদোলা’ চলছে, আজ মহা এপিসোড। তাই সবাই একটু বেশিই ব্যস্ত। তার উপর কদিন হল আমার বাবা-মা ফেসবুক চালানো শিখেছে। এখন যদি তাদের সামনে গিয়ে নেচেও বেড়াই, তারা খেয়াল করে না। ধরে নেয় আমি এটা আমার স্বাস্থ্যসচেতনতার নতুন কোন পন্থা। যাই হোক, এই সুযোগে আমি ভাবলাম আজ এর শেষ দেখেই ছাড়বো। আমিও যথেষ্ট ভীতু, কিন্তু সন্ধ্যায় ছাদে যাওয়ার অভ্যাস বহুদিনের।
আগে আমি আমার দুই কুকুরকে নিয়ে যেতাম। আমার বড় কুকুর, যাকে আমি দিদি বলি, ও মারা গেছে বর্ষার শুরুতে। ওর কবরটা ছাদেই। দীর্ঘ ৯ বছরের অসংখ্য স্মৃতি আমাদের এই ছাদে। ছোট থেকে দুজনকে নিয়ে আমি কত খেলেছি। চৈত্রের সন্ধ্যাগুলো একসাথে বাতাস খেয়ে কাটিয়েছি। মাঝে মাঝে অন্ধকারে বসে কাঁদতাম, দিদি কীভাবে যেন বুঝত। লাফ দিয়ে উঠে কংক্রিটের বেঞ্চের ফাঁকা জায়গাটায় আমার পাশে বসতো, আমার দিকে ঝিকিমিকি চোখে তাকিয়ে থাকতো। পাড়ার স্ট্রিটলাইটের আলো ওর ছোট্ট চোখে জ্বলে উঠত, ও যেন কুকুরদের ভাষায় আমাকে বুঝাতো, ‘আমি আছি তোমার পাশে।’ ও নেই, তাই এখন যাওয়া হয় না, তবে ভয়টা কম লাগে। আমার দিদিকে শুইয়ে রেখেছি ওখানে, অশরীরী জগতে অনেক বড় দেহরক্ষী হয়েছে আমার।
লোহার খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠার পরপরই আশ্বিনের স্যাঁতস্যাঁতে হাওয়া আমার মুখে ঝাপটা মারলো, জানান দিলো মেঘেরা এদিকে আসছে। আবছা অন্ধকারে আজ তার দেখা পেলাম। ক্লান্তিহীনভাবে দৌড়াচ্ছে একটা কিশোরী মেয়ে, যার শরীরের অস্তিত্ব হয়ত অনেক আগেই জৈবসার হিসেবে গ্রহণ করেছে প্রকৃতি।
‘আমি জানতাম তুমি আছো, কেউ বিশ্বাস করে না। এমন রাগ লাগে তখন। উল্টো সবাই আমাকে ভুল বুঝে। আচ্ছা তুমি যেও না, আমি কাউকে ডেকে আনছি। আমি চাই তারা দেখুক তুমি আছো।’ এই অশরীরীকে দেখে এক ধরণের হিমশীতল স্রোত সারা শরীরে বয়ে গেল সত্যি, তবে তার দেখা পেয়ে আমি ভয়ের বদলে যেন নিজের ভেতর আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। সবার চোখ রাঙ্গানিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল এই পরিবারে আমার পাশে কোন মানুষ নেই, হয়ত অশরীরী কেউই আমার কষ্ট বুঝবে।
কদিন আগে আমি দৌড়ানোর ঘটনা নিয়ে একটি কৌতুকপূর্ণ স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, সেটিকে আমার বন্ধুরা হালকাভাবে গ্রহণ করলেও একে অন্যভাবে নিয়েছিল আমার বাড়ির বাসিন্দারা। তাদের ধারণা হয়েছিল, আমি আমার উস্কানিমূলক ভূমিকা নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে আত্মপ্রকাশ করতে চাচ্ছি। ‘একটিভ ডিয়ানাল’ মোড তখন এতোটাই চরমে পৌঁছে গেল, তারা ঘোষণা দিয়ে দিল—‘পুরনো বাড়িতে এসব শব্দ টব্দ হয়, এগুলা চিন্তা করার মত কোন বিষয় না।’ মুহূর্তের মধ্যে আমি হয়ে গেলাম খলনায়িকা! আমার স্ট্যাটাসের জন্য বাড়িতে ভাড়াটিয়া আসা বন্ধ হয়ে যাবে, আমি পরিবারের শত্রু—অভিযোগের সব তীর একযোগে আমার পিঠে। দারুণ, তাই না?
আমি দরজার দিকে ফিরলাম, কিন্তু মত পাল্টালাম। নাহ, কি হবে তাদের প্রমাণ দিয়ে? বরং ভূতের বাড়ির গুজব সত্যি হয়ে যাবে। এবার সত্যি ভাড়াটিয়া আসা বন্ধ হয়ে যাবে। থাক বরং, ও চুপচাপ দৌড়াক। কারও জানার দরকার নেই। আমাকে তো এমনিতেই সবাই ভুল বুঝে, বুঝুক। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি বললাম, ‘আচ্ছা তুমি এত দৌড়াও কেন? একটু থামো না, কথা বলি।’
‘না না থামা যাবে না। আমার দৌড়াতে হবে। কেন দৌড়াতে হবে আমি জানি না, শুধু জানি দৌড়াতে হবে।’ দৌড়াতে দৌড়াতেই সে এমনভাবে বলল যেন সে ভাল করেই জানতো আজ আমি আসবো। আশ্বিনের কালো আকাশে মেঘেরা জমা হচ্ছে, নতুন ঢাকার এই পুরনো বাড়ির ছাদে একটি অশরীরী মেয়ে দৌড়াচ্ছে। কেমন যেন সবকিছু!
দৌড়াতে দৌড়াতেই সে জিজ্ঞেস করল আমাকে, ‘আচ্ছা তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো না কেন? তোমার তো ভয় পাওয়ার কথা। তুমি দেখি মন খারাপ করে আছো।’
হ্যাঁ আসলেই, ভয় পাওয়ারই কথা। বললাম, ‘একটু যে পাচ্ছি না তা নয়, তবে এটা তো স্বপ্ন, তাই গুরুত্ব দিচ্ছি না।’
এবার দৌড় থামিয়ে, আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা যে স্বপ্ন কিভাবে নিশ্চিত হলে? সত্যিও তো হতে পারে।’
তার চোখ! যেন দুটো হিরার টুকরো। নাহ, আমরা যেমন চোখের নিচে কালি পড়া সাদা চোখের ভূত দেখি এমন কিছু না। তাকে দেখে মনে হল, মাকে ছাড়া অবহেলায় বড় হয়ে উঠা কোন কিশোরী। আমি এবার যেন জমে গেলাম, হিমশীতল একটা বাতাস ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। আমি নিজেকে ধরে রাখলাম সর্বস্ব যুক্তি দিয়ে। বললাম, ‘স্বপ্নই তো। নাহলে আমি বুঝি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতাম। পালাতাম না এতক্ষণে? হয়ত ছাদেই আসতাম না। দিদি মারা যাওয়ার পর তো ছাদে আসাই বন্ধ করে দিয়েছি।’
সে আবার দৌড়াতে শুরু করেছে। বিল্ডিং কাঁপছে। আমি চুপ করে তার অক্লান্ত দৌড় দেখছি, স্বাস্থ্যসচেতন আমি একটু দৌড়ঝাঁপ করলেই হাঁসফাঁস করতে থাকি, কিন্তু অশরীরী হওয়ায় তার কোন ক্লান্তি নেই। সে দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছেই।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা তুমি কে? আমি যতদূর জানি, এই বাড়িতে তোমার মত কারও অপমৃত্যু হয়নি যে তুমি এসে হানা দিবে। তোমাকে চেনা চেনাও লাগছে না। তাহলে তুমি কোত্থেকে এসেছ?’
দৌড়াতে দৌড়াতে সে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ। আমি এখানকার না। গত কয়েক মাস আগে আমি হঠাৎ নিজেকে এখানে আবিষ্কার করি, এরপর থেকে এখানেই আটকে আছি। অশরীরী জীবনটা অনেক জটিল, বুঝলে। এখানে কোন নিয়ম নেই, থাকলেও বুঝা দায়।’
‘তবে তুমি আমাকে চেনো।’
আমি খুব অবাক হলাম তার কথায়, আমি তাকে চিনি?
‘তোমার মনে আছে, খুব ছোটবেলায় যশোরে থাকতে তুমি এক নাচের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলে, সেখানে একমাত্র ক্রিস্টান একটা মেয়ে ছিল, নাম লিনা। ছোট করে ছাঁটা চুল, ওকে দেখে তোমার ছেলে ছেলে লাগতো। তুমি তখন গার্লস স্কুলে পড়তে, সেই তোমার ছেলেবন্ধুর মত ছিল।’ সে বলে।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ একটু মনে আছে। আমি লজ্জায় ওর সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। আমরা এত ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। আমার মনে হত ও ছেলে।’
‘আমিই সেই লিনা।’
‘ওহ তাই নাকি!’ আবারও আমার অবাক হওয়ার পালা। ‘তুমি তো বেঁচে থাকলে এতদিনে বিয়ে শাদি করে সংসার করতে, কি হয়েছিল? মরলে কেন?’
‘আমি আত্মহত্যা করেছিলাম। তোমার হয়ত মনে আছে, আমার রোল ছিল দুই। সবসময় ভাল রেজাল্ট করার একটা মানসিক চাপে থাকতাম। এসএসসি পরীক্ষায় আমার গোল্ডেন জিপিএ আসেনি, তাই আমাকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল তিন দিন। তিন দিন পর আমাকে বের করলে আমি সোজা দৌড়ে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে যাই, রাস্তার দিকে দৌড় দিয়েছিলাম। ইচ্ছা করে একটা ট্রাকের নিচে চাপা পড়ি।’ সে দৌড়ায় আর বলে।
কেন যেন মায়া হল তার জন্য। ‘তুমি আটকে আছো কেন? তোমাকে মুক্তি দেয়ার কি কোন উপায় আছে?’
দৌড়ানোর মধ্যেই সে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমি আটকে আছি কারণ আমার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। প্রকৃতি আমাকে শাস্তি দিয়েছে, দৌড়ানোর শাস্তি। অনন্তকাল ধরে আমি দৌড়ে যাচ্ছি তো দৌড়ে যাচ্ছি। প্রকৃতিকে আমি বুঝাতে পারিনি আমার হতাশার কারণ।’
তার কথা শুনে আমার সত্যি খারাপ লাগলো। আমি বললাম, ‘জানো, আমিও বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি। শেষবার যখন দিদি মারা গেল, আমি বেঁচে থাকার সব কারণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। শুধু মনে হত, আর একটি বার যদি দিদিকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম। এখনও মনে হয় জানো, প্রতিটি দিন।’
এবার সে দৌড় থামিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এল, আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমার দিদি ভাল আছে। অনেক ভাল আছে। দিদি তোমাকে বলেছে সামনে এগিয়ে যেতে, সে তোমার জীবনের একটি অধ্যায় ছিল, অধ্যায়ের সমাপ্তি আছে। তুমি ঠিক পথেই আছো, দিদি তোমার জন্য প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করছে।’
কখন যেন আমার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে আমি টের পাইনি। ধরা গলায় বললাম, ‘কিন্তু দিদিকে যে খুব মিস করি। তুমি কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলে আমাদের ছাদে, তোমার দৌড়ানোর জ্বালায় বিল্ডিং কাঁপে প্রতি সন্ধ্যায়। অথচ দিদির সঙ্গে একবার দেখা হবে না?’
ভূতও বিরক্ত হয়, এই প্রথম দেখলাম সেদিন। একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে বলল, ‘তোমার দিদি তো আত্মহত্যা করেনি। তার ডাক এসেছে সে চলে গেছে। ও কেন এখানে আটকে থাকবে? ওকে প্রকৃতি গ্রহণ করেছে, ওকে আর দেখা যাবে না।’
তখন আমার রীতিমত রাগ লাগলো। এক অশরীরীর উপর রাগ হচ্ছে আমার! কী অদ্ভুত! মনে হচ্ছিল সে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে আর কতদিন দৌড়াবে? প্রশ্নটা করে মনে হল যেন বাড়িতে উটকো মেহমান এসেছে, জিজ্ঞেস করছি কবে ফিরবে।
এবার সে পুনরায় তার ভৌতিক রূপে ফিরে গেল, হয়ত আমাকে বুঝানোর জন্য যে সে ভূত, বাড়ীর উটকো মেহমান নয়। ফ্যাকাসে মাটিমাখা মুখটা আমার মুখের সামনে এনে, জ্বলজ্বলে হীরকখণ্ড চোখদুটো আমার চোখে রেখে সে বলল, ‘এর উত্তর আমার এখনও জানা নেই। জানলেও তোমাকে বলবো না। এ জগতে অনেক প্রশ্ন আছে, সব প্রশ্নের উত্তর মানুষের না জানাই ভাল।’
আমার রাগ আবার ভয়ে পরিণত হল। মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেলো ভয়ের শীতল স্রোত। হঠাৎ আমি আবিষ্কার করলাম, ভয় আমাকে গ্রাস করছে। আমি হাত পা নাড়াতে পারছি না। একী! আমি তো কথাও বলতে পারছি না। কাউকে যে ডাকবো। ছাদের ওই কোণার পাশে আমগাছটা। সন্ধ্যাবেলা আমগাছের কাকগুলো কা কা করছে কেন? হঠাৎ জোরে বাতাস বইতে শুরু করল, ঠাণ্ডা বাতাস। আমি ছাদের গেটের সামনে, অচল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। শীত শীত লাগছে।
ওটা কার গলা? আমার খালার গলা না? হ্যাঁ, ওই যে সে গেট খুলছে। আমি দাঁড়িয়ে দেখছি। হা করে খালাকে ডাকার চেষ্টা করলাম, মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। খালা আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলছে গেট তালা দিতে দিতে। আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি তারা কী বলছে……‘না ও তো পুরো উইকেন্ড ওর ফ্রেন্ডের বাসায় কাটালো, এখনও ফিরেনাই।’ আমি সর্বস্ব শক্তি দিয়ে তাদের ডাকার চেষ্টা করলাম, হালকা গোঙানির শব্দ ছাড়া কিছুই বের হল না। যা আমার নিজের কানেও ঠিকমতো পৌঁছায় নি। আমার মনে হচ্ছে খালা চলে গেলে আমি আর এখান থেকে নড়তে পারবো না……
আমার হাতে জিহ্বা দিয়ে চাটে কে? গরম জিহ্বার উষ্ণ সুড়ুৎ, হাত ভিজে যাচ্ছে। মায়ের কণ্ঠ আরও কাছে আসছে, মা আমাকে ডাকছে……বেবি বেবি!!
হঠাৎ বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলাম। মা আমাকে ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে, তার চোখেমুখে আতঙ্ক। পাশে আমার ছোট কুকুর পলি লেজ উঁচু করে উত্তেজনার ভঙ্গীতে আমার আঙুল চেটে দিচ্ছে।
‘কি হয়েছে? তুমি এমন করছ কেন? গোঙানির শব্দ পেয়ে তোমার ভাইয়া আমাকে ডাকল। দুঃস্বপ্ন দেখেছ?’ মা আমাকে জড়িয়ে ধরে। অনেকদিন পর মায়ের গন্ধ পেতে পেতে আমি তাকিয়ে দেখি বাইরে বিকাল। আকাশে মেঘ করেছে, বৃষ্টি নামবে যেকোনো সময়। পলি তার লোমশ তুলতুলে শরীর নিয়ে আমার গায়ের ভেতর ঢুকল, ভ্যাপসা গরমের মধ্যে ওর এই আচরণ অস্বাভাবিক লাগলো। হঠাৎ মনে হল আজ কত তারিখ, এখন কয়টা বাজে, আমি এখন চাকরি করছি না পড়াশুনা করছি, কিছুই মনে পড়ছে না।
আমাকে একটু স্বাভাবিক হতে দেখেই মা তার নিজের রূপে ফিরে গেলেন। আমাকে বললেন, ‘তুমি যে কেন এইসব স্ট্যাটাস দাও ফেসবুকে। এসব কথা ফেসবুকে না লিখলেই তো পারো। জানি তুমি ডিলিট করে দিছো, কিন্তু সবাই তো দেখেই ফেলছে। ডিনেসাদের মাসীরা সবাই বলাবলি করতেছে এই বাড়ি ভূতের বাড়ি, এখানে তারা আসবে না। কেন যে লেখো এগুলা। তোমাদের জন্য মানুষের কাছে মুখ দেখাইতে পারি না………’
আমি উল্টো পাশ করে শুয়ে আবার চোখ মুদলাম, মায়ের কথা অস্পষ্ট হয়ে এলো। বাইরে সন্ধ্যা নামছে, মেঘের কারণে আজ অন্ধকার একটু আগেই হল। বাতাসে গুমোট ভাব কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সূর্য শেষ বিদায় জানানোর পরপর যখন আকাশে গর্জন করে উঠলো মেঘ, ঠিক তখনই ছাদের উপর ধুপধাপ শব্দে বিল্ডিং কেঁপে উঠলো। মেঘের গর্জনে কেউ তা শুনলো না। আমি পলির সঙ্গে পিঠ ঘেঁষে জানালা দিয়ে আসা ঝিরিঝিরি হাওয়ায় গা এলিয়ে দিলাম।
২| ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১২:৩৯
কাওসার চৌধুরী বলেছেন:
শুভেচ্ছা নেবেন। আপনার লেখাগুলো সময় নিয়ে পড়বো এজন্য 'অনুসরণ' করলাম। আপনি কি এখনো 'সেফ' হন নাই?
©somewhere in net ltd.
১|
১৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১২:৩৮
কাওসার চৌধুরী বলেছেন:
শুভেচ্ছা নেবেন। আপনার লেখাগুলো সময় নিয়ে পড়বো এজন্য 'অনুসরণ' করলাম। আপনি কি এখনো 'সেফ' হন নাই?