নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কথা কবিতা

অধ্যাপক

কথা কবিতা › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্পেনে মুসলিম সভ্যতা

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১২:৩৫

মানুষ এতদিন ধরে জেনে এসেছে স্প্যানিশ নাবিক কলম্বাসই আমেরিকায় প্রথম পৌছান। কিন্তু ইতিহাস লেখক এস ফ্রেডরিক স্টার তার ‘আজকের ইতিহাস’ নিবন্ধে দাবি করেছেন, ১৪৯৮ সালের অনেক আগেই আমেরিকা আবিস্কার করেন আবু রাইহান। নিবন্ধ অনুসারে ৯৭৩ সালে আজকের মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে জন্ম তার। ওই ইতিহাস লেখকের মতে, আবু রাইহানই এশিয়া-ইউরোপসহ পৃথিবীর অজানা ভূমি আবিস্কারের প্রথম পথ প্রদর্শক।

কলম্বাসের ৫০০ বছর আগেই আমেরিকা আবিস্কার করেছিলেন আবু রাইহান আল-বেরুনী। একথা কেউ জানে না। আসলে স্পেনে মুসলিম সাম্রাজ্যের পতনের পর, বিশ্বজুড়ে খ্রিস্ট সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। তাই চোখে দেখা শিল্প ছাড়া অনেক তথ্যই গোপনে থেকে যায়। ফেডরিক স্টারের ‘আজকের ইতিহাস’ পড়তে যেয়ে হঠাৎ মনে পড়লো নব্বইএর দশকে দেখা একটা মুভির কথা। ইংরেজি মুভি। মুভিটার পুরো নাম মনে নেই। তবে শেষাংশের নাম ছিল গ্রানাডা। এখনো মনে আছে, সেময় আমরা এর বাংলা নামকরণ করেছিলাম ক্রন্দসী গ্রানাডা। সিনেমার মূল বিষয়বস্তু ছিল ১৪৯২ সালে সংঘটিত গ্রানাডা ট্রাজেডি। রাজা ফার্দিনান্ড এবং রাণী ইসাবেলা ছিলেন এই যুদ্ধের মূল নায়ক। এই যুদ্ধে যৌথ খ্রিস্টান বাহিনির কৌশল ছিল অস্ত্র নয়, মুসলিম গোত্রে গোত্রে বিরোধ লাগিয়ে দাও,ওরা এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে---- এই বাক্যটি সিনেমারই অন্তর্ভুক্ত। যা আজো মনে আছে। এই মুভিতেই দেখেছি, স্পেনের মুসলিম বিজ্ঞানী একটা ঘরে কাজ করছেন। সামনে পৃথিবীর মানচিত্র এবং প্রতিকুল বাতাস বিরোধী একটা জাহাজ। তিনি যখন গবেষণায় নিমগ্ন তখন গ্রানাডায় আগুন জ্বলছে। এক সময় শত্রুরা ঘরে ঢুকে তাকে হত্যা করতে। তিনি তাদের অনুরোধ করেন এই মানচিত্র আর জাহাজের কাঠামো নষ্ট না করতে। কারণ, এটা হলো সেই জাহাজ যা দিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অনায়াসে অভীষ্ট দেশে পৌছা যাবে। তার এ কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, তা হলো তিনি মারা যাবেন, এতে তার কষ্ট নেই, কিন্তু তার আবিষ্কার যেন কালের গর্ভে হারিয়ে না যায়। হয়ত তার নাম কেউ জানবে না, কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই। তবুও পৃথিবী ঋদ্ধ হোক। মুভিতে এটাই ছিল মুসলিম গবেষকের শেষ উক্তি। এখন আমরা একটু সূত্র মিলিয়ে দেখি, ১৪৯২ সাল,২ জানুয়ারি স্পেনে মুসলিম শাসনের পতন আর ১৪৯২ সালের ৩ আগস্ট কলোম্বাস ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে বারমুডা ট্রায়াঙ্গালে এসে বিভ্রান্ত হন, এরপর দিক ভুল করে চলে যান আমেরিকার দিকে। এভাবেই পাদপ্রদীপের আলোয় আসে কলম্বাসের নাম। এখানে উল্লেখ্য যে, কলম্বাস দেশ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে যে সমুদ্র যাত্রা করেছিলেন, তেমন নাও হতে পারে, কারণ তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেছিলেন। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতের সাথে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বাণিজ্য সংযোগ ছিল স্থল পথে। মধ্য এশিয়ার দুর্গম পথ দিয়ে তাদেরকে স্থলবানিজ্য করতে হত। তাই হয়তবা কলম্বাসে মাথায় আসে উলটো দিকে সমুদ্রপথে ইন্ডিয়া যাওয়া যেতে পারে। যেহেতু সমুদ্র পাড়ি দেয়ার সুরক্ষিত জাহাজ মুসলিম গবেষকের মাধ্যমে ইতোমধ্যে হস্তগত হয়েছে। তার এইসব সাগরপথে অভিযানের পেছনে অনেক কারণের পাশাপাশি মূল কারণ ছিল, ধর্মপ্রচার এবং ইউরোপীয়ান বাণিজ্যের প্রসার , বাণিজ্যপথ আবিস্কার এবং নতুন উপনিবেশ সন্ধান ।

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীন যুগে যখন ইউরোপীয় দেশসমূহ অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল তখনই ইসলাম ধর্ম জ্ঞান বিজ্ঞান আর মানবিকতার আলো জ্বালায়।

৭১১ সালে মুসলমানেরা স্পেন (যার মধ্যে বর্তমান পর্তুগালও অন্তর্গত ছিল) আক্রমণ করে ও শিঘ্রই সমগ্র স্পেন দখল করে।
১০ম শতকের শুরুতে গৃহযুদ্ধের কারণে স্পেনের কেন্দ্রে মুসলমান শাসকদের পতন ঘটে।
১১৪৩ সালে পর্তুগাল কাস্তিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
১২শ শতকের শেষার্ধে স্পেনে গ্রানাডা ছিল মুসলমানদের শেষ ঘাঁটি।
১৪৬৯ সালে আরাগোনের রাজা ফার্দিনান্ড এবং কাস্তিয়ার রাণী ইসাবেলা বিয়ে করেন। এর ফলে স্পেনের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই খ্রিস্টান রাজ্য একত্রিত হয়ে একটি রাজ্যে পরিণত হয়। রাজা ফার্দিনান্ড ও রাণী ইসাবেলার ঘরে ১৪৯৫ সালে জন্ম নেন কন্যাসন্তান ক্যাটেরিনা।
১৪৯২ সাল নাগাদ নতুন এই রাজ্যের সেনারা স্পেনে মুসলমানদের শেষ ঘাঁটি গ্রানা্ডা দখল করে।

১৪০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে মুসলিম শাসকদের নৈতিক অধঃপতন শুরু হলে স্পেনের ভাগ্যাকাশেও দেখা দেয় দুর্যোগের ঘনঘটা। আশপাশের খ্রিস্টান রাজারা ক্রমাগত আক্রমণ করতে থাকে স্পেনের মুসলিম রাজ্যসমূহে। ফলশ্রুতিতে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ২ রা জানুয়ারি গ্রানাডার তৎকালীন মুসলিম শাসক আবু আব্দুল্লাহ (পাশ্চাত্যে তাকে ববডিল নামে ডাকা হয়) রাজা ফার্ডিনান্ড এবং রানি ইসাবেলার সঙ্গে এক চুক্তির মাধ্যমে পরাজয় স্বীকার করে নেন।
গ্রানাডার সর্বশেষ মুরিস শাসক (Moorsih king) ছিলেন নাসরিদ বংশীয় আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ (Abu Abdullah Muhammad XII)। বিলাস-ব্যসনে মত্ত ও উচ্ছন্নে যাওয়া আবু আব্দুল্লাহ ছিলেন গ্রানাডার তাইফার সুলতান আবুল হাসানের ছেলে। ছেলের ষড়যন্ত্র ও কুচক্রের কারণে অনেকটা সিরাজুদ্দৌলার মতোই বাবা আবুল হাসান পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। মির জাফরের মতো আবু আব্দুল্লাহকে বানানো হয় নামকাওয়াস্তে সুলতান। এই পুতুল সুলতানের কাছেও ১৪৮৯ সালে ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলার কাছ থেকে চূড়ান্তরূপে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণের নির্দেশনা আসে এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় অস্বীকারের ভয়াবহ পরিণতির কথাও।
বিভিন্ন এনসাইক্লোপিডিয়ার ইতিহাস অনুযায়ী আবু আব্দুল্লাহ উপায়ান্তর না দেখে গ্রানাডা সম্পূর্ণভাবে হস্তান্তর করতে বাধ্য হন ১৪৯২ সালের ২ রা জানুয়ারিতে। একটি উদাহরণ পাওয়া যেতে পারে এম বি সিঞ্জ (M B Synge) তার দ্যা বাল্ডউইন্স প্রজেক্ট (The Baldwins Project) প্রকাশিত ‘সাহসী মানুষদের সাহসী কাজ’ (Brave Men and Brave Deeds)’ নামক আর্টিকেলে। তিনি লিখেছেন, December had nearly passed away. The famine became extreme, and Boabdil determined to surrender the city on the second of January. “ডিসেম্বর শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। দুর্ভিক্ষ চরম আকার ধারণ করেছে। আর ববডিল (আবু আব্দুল্লাহ) গ্রানাডা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলেন ২ রা জানুয়ারি।” এখানে উল্লেখ্য যে, খ্রিস্টান বাহিনী কয়েক মাস ধরে গ্রানাডার চারপাশে অবস্থান নিয়ে এ নগরীকে অবরোধ করে রেখেছিলো। ফলে সেখানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
স্পেন থেকে মুসলমানদেরকে ১৪৯২ সালেই বের করে দেয়া হয়নি। শাসক আবু আব্দুল্লাহর সাথে ইসাবেলা আর ফার্ডিনান্ডের যে চুক্তি হয়েছিলো তাতে গ্রানাডার মুসলমানদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়ার চুক্তি থাকলেও স্পেনের নতুন শাসকেরা অন্যদের ধর্মের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিল না। ফলে মুসলমানদের উপর নির্যাতন নেমে আসে।
তবে, খ্রিস্টানদের এই নির্যাতনের আওতায় কেবল মুসলমানরাই ছিলো না বরং গ্রানাডার অধিবাসী প্রায় তিন লাখ ইহুদিকেও এই একই ভাগ্যবরণ করতে হয়। উপরন্তু ইহুদিদের ওপর খ্রিস্টানরা মুসলমানদের চেয়ে বেশি নির্যাতন চালায় এবং ১৪৯২ সালের ৩১ মার্চ [এই তারিখটি স্মরণ রাখা প্রয়োজন] রানি ইসাবেলা ও রাজা ফার্ডিন্যান্ড ইহুদিদের দমনে ‘আল-হামরা ডিক্রি’ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। সেখানে ইহুদিদের দুটি প্রধানশর্ত দেয়া হয়। এক. যদি স্পেনে থাকতে চাও তবে খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করতে হবে; দুই. অন্যথায় এ দেশ থেকে চলে যেতে হবে। ষড়যন্ত্রপ্রিয় এবং দাঙ্গাপ্রিয় ইহুদিদেরকে অত্যন্ত অপমানজনকভাবে স্পেন থেকে তাড়ানো হয়।
১৪৯২ সালের মার্চে যদিও স্পেনের ইহুদিদের ৩ মাসের সময় দিয়ে আল-হামরা ডিক্রি জারি করা হয় কিন্তু এ ডিক্রির আওতায় মুসলমানরা ছিলো না। কেননা ২ রা জানুয়ারি ১৪৯২ সালে যে ‘ট্রিটি অব গ্রানাডা’ স্বাক্ষরিত হয় সেখানে মুসলমানদের সঙ্গে এ ধরনের কোনো আচরণ করা হবে না বলে শর্তারোপ করা ছিলো। তাই খ্রিস্টান শাসকরা কার্যত তখনো মুসলমানদের ওপর প্রত্যক্ষ কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারেনি।কিন্তু এর কিছুদিন পর থেকেই ক্রমান্বয়ে খ্রিস্টানরা গ্রানাডাচুক্তির শর্তগুলো ভাঙতে শুরু করে এবং ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে তারা তাদের স্বরূপে আবির্ভূত হয়। ইহুদিদের মতো মুসলমানদেরকেও একই শর্ত দিয়ে নতুন অধ্যাদেশ জারি করা হয়; হয় তোমাদের খ্রিস্টান হতে হবে নয়তো ছাড়তে হবে স্পেন।
এর পরের ইতিহাস অত্যন্ত বেদনাবহ এবং করুণ। প্রাণের ভয়ে হাজার হাজার মুসলমান খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে, নিজেদের মুসলিম পরিচয় বিসর্জন দিয়ে গ্রহণ করে ক্যাথলিকিজম। যাদের সামর্থ্য ছিলো তারা মাতৃভূমি ছেড়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতে। আর এভাবেই একসময় সমগ্র স্পেন হয়ে পড়ে মুসলিমশূন্য এক খ্রিস্টান দেশ।

মুসলমানদের রেখে যাওয়া সমৃদ্ধ স্থাপত্যকলার নিদর্শন এখনও দক্ষিণ স্পেনের গ্রানাডা ও কর্ডোভার মত শহরগুলিতে দেখতে পাওয়া যায়।

“প্রাচীনকালে সভ্যতা, সৌন্দর্য ও শিক্ষার বিচিত্র লীলাভূমি ও কীর্তি মন্দির বলিয়া যে সমস্ত মহানগরী খ্যাতিলাভ করিয়াছিল, তন্মধ্যে গৌরবোন্নত, সৌন্দর্য-সমালঙ্কৃত, সমৃদ্ধিসম্পন্ন স্পেনের কর্ডোভা মহানগরী অন্যতম। বোগদাদ ব্যতীত কর্ডোভা মহানগরীর সহিত অপর কোনও নগরীর নামও উল্লেখিত হইবার যোগ্য নহে। মুসলমান-স্পেনের কর্ডোভা নগরী হইতে যখন সভ্যতার স্বর্গীয় প্লাবন, জ্ঞান-বিদ্যাশিক্ষার উত্তাল তরঙ্গমালা বক্ষে ধারণ করিয়া কুসংস্কার-জঞ্জাল পরিপূর্ণ ইউরোপকে বিপ্লাবিত এবং বিধৌত করিবার জন্য চতুর্দিকে তীব্রবেগে ছুটিয়া পড়িতেছিল, তখন বর্তমান জ্ঞানগর্বিত সভ্যতা-প্রদীপ্ত ইংরাজ, ফরাসী এবং জার্মান জাতির পূর্বপুরুষগণ পর্বতগহবরে এবং গভীর কাননাবাসে বন্য ফল-মূল এবং আম-মাংসে উদরপূর্তি করিয়া আপনাদের বন্যজীবন অতিবাহিত করিত।

ইউরোপের সমস্ত রাজ্য হইতে জ্ঞানপিপাসু সহস্র সহস্র ছাত্র,ধীসমৃদ্ধ বিজ্ঞানবিশারদ অধ্যাপকমন্ডলীর নিকট জ্ঞানাহরণার্থ সমবেত হইত। কর্ডোভার বিরাট বিজ্ঞানাগারে ছাত্রমন্ডলীকে যন্ত্রসংযোগে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং রাসায়নিক বিশ্লেষণ শিক্ষা দেওয়া হইত। সাধারণের পাঠের জন্য সপ্তদশটি বিরাট লাইব্রেরী এবং বহুসংখ্যক পাঠসম্মিলনী (ক্লাব) ছিল।এতদ্ব্যতীত প্রত্যেক স্কুল-কলেজ এবং মস্‌জিদে ছাত্রমন্ডলীর এবং উপাসকদিগের পাঠের জন্য বিবিধ প্রয়োজনীয় গ্রন্থাদি রক্ষিত হইত। গৌরবের মাধ্যাহ্নিক কালে বত্রিশটি কলেজ এবং ৫০০ উচ্চশ্রেণীর সুপরিচালিত বিদ্যালয় কর্ডোভাতে বিদ্যমান ছিল। পাঠক মনে রাখিবেন, স্পেনে প্রত্যেক নগরেই স্ব-স্ব বিদ্যালয় এবং কলেজ ও পাঠশালাসমূহ বিদ্যমান ছিল। স্পেনের মহানগরী গ্রানাডাতেও ২০টি সুপরিচালিত কলেজ এবং বহুসংখ্যক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। স্পেনের প্রত্যেক সোলতান এবং আমীর অল্পাধিক পরিমাণে বিদ্যোৎসাহী ও জ্ঞানচর্চালিপ্সু ছিলেন বলিয়া স্পেন সাম্রাজ্য তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যাহ্ন মিহির-করে উদ্ভাসিত এবং বিশ্বজগতে প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছিল। প্রত্যেক সোলতানই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতেন। রাজ্যের সম্ভ্রান্তবর্গ এবং আমীরগণ সোলতানদিগের অনুসরণে বিরত ছিলেন না। শিক্ষার জন্য ধনাঢ্য ব্যক্তি হইতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যক্তিগণ পর্যন্ত স্ব-স্ব সম্পত্তির অধিকাংশ ’ওয়াক্‌ফ’ করিয়া যাইতেন। তৎকালে যে ব্যক্তি বাটিতে ছাত্র’ জায়গীর’ এবং লাইব্রেরী না রাখিতেন, তিনি নিতান্ত অভদ্র এবং অশিক্ষিত বলিয়া সমাজে লাঞ্ছিত হইতেন। খলিফা হাকামের সময় প্রায় তিন লক্ষ ছাত্র এবং ছাত্রী কর্ডোভাতে অধ্যয়ন করিত। ভূগোল শিক্ষার জন্য গোলক (Globe) এবং মানচিত্র ব্যবহৃত হইত। কর্ডোভার’ রসদখানায়’ (মানমন্দিরে) বহুসংখ্যক নতুন যন্ত্র সংগৃহীত এবং নির্মিত হইয়া রক্ষিত হওয়ায় নানা দিগ্‌দেশ হইতে পন্ডিতমন্ডলী আগমন করিয়া জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনা এবং নক্ষত্রাদির গতি নির্ধারণ করিতেন। বিদ্যোৎসাহী খলিফা হাকাম প্রভূত অর্থব্যয় করিয়া পৃথিবীর নানা রাজ্য এবং নানা রাজধানী হইতে বহু যত্নে শত শত লোক নিযুক্তি পূর্বক প্রায় ছয় লক্ষ মূল্যবান এবং দূষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। ইতিপূর্বে পৃথিবীতে এরুপ বিরাট এবং মূল্যবান লাইব্রেরী আর কখনও স্থাপিত হইয়াছিল না।

বালিকা এবং স্ত্রীলোকদিগের জন্য স্বতন্ত্র স্কুল এবং কলেজ বিদ্যমান ছিল। এখানেই মাতৃজাতির মধ্যে সর্বপ্রথম ইউরোপের বোগদাদের ন্যায় কবি, চিকিৎসক, অধ্যাপিকা, আইন-ব্যাখ্যায়িত্রী, ঐতিহাসিক এবং ধাত্রী পরিদৃষ্ট হইত। এখানেই হামেদা, হাফেজা, রোকেয়া, জয়নব, মোরিয়া, সোফিয়া, ফজল প্রমুখ বিদূষী এবং প্রতিভাশালিনী রমণীরত্ন জন্মগ্রহণ করিয়া স্পেনের জ্ঞানচর্চার গৌরব উন্নত এবং মহান করিয়া তুলিয়াছিল। অতীতের এই গরীয়সী মহানগরী কর্ডোভাতেই সমগ্র ইউরোপের মধ্যে সর্বপ্রথমে রমণীগণ জ্ঞানালোচনায় পুরুষদিগের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। এখানেই একদিন বিজ্ঙানাগার এবং রসায়ন শিক্ষার প্রক্রিয়া (Experiment) এবং বিশ্লেষণ লইয়া মুসলমান ছাত্র ও ছাত্রীগণের মধ্যে বাদানুবাদ হইত। হায়! বর্তমানে এই মুসলমান জগতে এ সকল সম্পূর্ণরুপে অপরিজ্ঞাত এবং অদৃষ্ট।
কর্ডোভাতে চিকিৎসাবিদ্যা আশাতীত উন্নতি লাভ করে। জালিনুসের (Galen) পরে চিকিৎসা-শাস্ত্রের ভৈষজ্যতত্ত্ব, রোগনিদান এবং শরীর-বিদ্যার বিবিধ অজ্ঞাত এবং দুর্জেয় তত্ত্ব এখানে আবিস্কৃত এবং সৃষ্টিকৃত হয়।
একাদশ শতাব্দীর সুপ্রসিদ্ধ ভিষক আবুল কাশেম (Albacasis) এখানেই তাঁহার অস্ত্র-চিকিৎসা আশ্চর্য নৈপুণ্য দেখাইয়াছিলেন। তাঁহার অস্ত্র-চিকিৎসার প্রণালী আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ছিল।
আরবী সাহিত্যে এবং ইতিহাস এখানে চরম উন্নতি লাভ করিয়াছিল। শত শত পন্ডিত জন্মগ্রহণ করিয়া অমৃতনিস্যন্দিনী আরবী ভাষায় সাহিত্য এবং ইতিহাস রচনা করিয়া অমরত্ব লাভ করিয়াছিলেন। (সংক্ষেপিত)
(স্পেনে মুসলমান সভ্যতাঃ ইসমাইল হোসেন সিরাজী)

সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছুই বদলে যায়। ইতিহাসের পালাবদলের হাত ধরে আবার ১৪৯২ সালে মুসলমানদের করুণ পরিণতি লাভ করতে হয় নিজ হাতে গড়ে তোলা জ্ঞান-গরিমা ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক, জ্ঞানের নগরী রাজধানী গ্রানাডাতে। কারণ তারা ভোগ বিলাসিতা আর পরস্পর কলহে লিপ্ত হয়েছিল।

পবিত্র কোরানে আল্লাহ্‌ বলেছেন, “পৃথিবীতে ভ্রমণ করে লক্ষ্য কর,পাপীদের পরিণাম কী হয়েছে”। সুরা নামল আয়াত নং ৬৯।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১২:৫১

মুহাম্মদ আশিকুজ্জামান বলেছেন: আর একটা কথা সাহাবীরা দাওয়াত দেবার জন্য পৃথিবীর যেইখানেই মানুষ ছিল সেইখানে পৌঁছে গেছিলেন। মাদাগাস্কার দ্বিপের নাম ছিল মদিনাতুল আল আসগর। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার নাম ছিল ফি-আমানিল্লাহ.। চীনের ক্যান্টন শহরে আজও আসসারায়ে মুবাসসারা ১০ জনের একজন সাদ ইবে আবি ওয়াক্কাস রাঃ এর কবর। এখন সব কিছুর আগে মুসলিমদের ইমান আর সুন্নাতকে আকড়ে ধরতে হবে। যাই হোক ভাল লাগল আপনার লেখাটী।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.