![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কেবলই দুঃখের শ্বাস
এই শহরে পথ চলতে চলতে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া কতজনকে যে খুঁজে বেড়াই। পৃথিবীর কত অলিতে গলিতে হন্ন হয়ে হাঁটি কাউকে আর একটিবার দেখবার জন্য। কত প্রিয় মুখ ম্লান হয়ে আছে কত কাল ধরে। আমি কেবল আকুল হই। কিন্তু কারোরই দেখা পাইনা। এ রকম কত যে মুখ অনেক দূরের স্বপ্ন হয়ে আছে।
আবার কিছু মুখের কথা মনে নেই। কিংবা মন চায়নি কখনও তাদের দেখতে। বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেছে তারা। এই রকমই না দেখতে চাওয়া বিস্মৃত কত মুখ যে আঁধারে পড়ে আছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেই রকমই হারিয়ে যাওয়া একটি মুখের দেখা পেয়েছিলাম একদিন ---
বারডেম হাসপাতাল থেকে পরিচিত এক রোগীকে দেখে পথের উপরে নেমে হাঁটছিলাম। কোনো মুমূর্ষু মানুষকে দেখার পর মন ভাল লাগার কথা নয়। যদি তিনি থাকেন জীবনের প্রান্ত সীমায় দাঁড়িয়ে। বিষন্নতায় মনটা তাই ছেয়ে আসছিল । তখন সন্ধ্যা ঘনয়মান। একটি সিগারেট কিনে ধরাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময় দেখি, আরও একজন মানুষ সিগারেট কিনছে। আমি তার দিকে তাকাই, সেও আমার দিকে তাকায়। দুজন দুজনকেই চিনতে পারি।
ওনার নাম আব্দুল মান্নান। একবারই দেখেছিলাম তাকে। সেও বহু বছর আগে। একবার দেখা এই মুখটিকে এত বছর পরও চিনতে পারলাম। ওনার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল নীলু। ওরা তখন কেনাকাটা করে বের হচ্ছিল নিউমার্কেট থেকে। ঠিক গেটেই হয়েছিল দেখা। নীলু বলেছিল --- 'ইনি আমার হাজব্যান্ড।' আর আমাকে দেখিয়ে ওর স্বামীকে বলেছিল, 'ওর নাম শুভ্র। আমার ইউনিভার্সিটি বন্ধু।' আশ্চর্য লাগল -- সামান্য মুহূর্তে দেখা মানুষটিকে মনে রেখেছি এতদিন!
কিছুটা বিমর্ষ কন্ঠে প্রথম কথা বলেছিল আব্দুল মান্নান, কেমন আছেন আপনি?
--- ভাল আছি। আপনি ভাল আছেন?
--- ভাল মন্দ মিলিয়েই আছি। জানেন, অনেক দিন আগে আমি একবার কলাবাগানে একটি মেসে আপনাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। আপনি ছিলেন না। আপনার মেসমেট রা বলেছিল, 'উনি এখন এখানে থাকেন না।' আপনি কোথায় থাকেন, তাও তারা বলতে পারেনি।
---- কেন গিয়েছিলেন ?
---- সে অনেক কথা। আমার হাতে সময় খুব কম। যদি সময় থাকত, তাহলে সব কথা বলা যেত। আমি অপেক্ষা করছি, এই রাস্তার উপরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি গাড়ি আসবে। আমি সেই গাড়িতে উঠে চলে যাব।
--- কিছু কথা নাহয় বলেন, আমি শুনি।
--- এখান থেকে রমনা পার্ক বেশি দূরে নয়। এই পার্কে একদিন বিকালে নীলুকে নিয়ে আমি এসেছিলাম বেড়াতে। নীলু চিনে চিনে লেকের পাড়ে একটি কড়ই গাছের ছায়ায় বসে। মাঝে মাঝে কড়ই গাছ থেকে মরা পাতা ঝরে পড়ছিল। নীলু বলছিল, এই ঝরা পাতা আগেও একদিন এমনি করে ঝরে পড়েছিল। আজও পড়ছে।
নীলু বলেছিল, দেখ -- 'লেকের জল কত স্বচ্ছ। কী স্তব্ধ হয়ে আছে দুঃখিনীদের মতো। তুমি একটি ঢিল ছুড়ে দাও ঐ জলে।'
আমি ঢিল ছুড়েছিলাম সেই নিস্তব্ধ জলে। জলের সেই তরঙ্গ আর আলোড়ন দেখে নীলু বলেছিল ---'হলোনা তোমারটা।'
আর একদিন নীলুই আমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল বুড়িগঙ্গার ধারে। আমি বলেছিলাম, চলো সদরঘাটের প্লাটফর্মে যাই। ওখানে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখব, বুড়িগঙ্গার জল। নীলু সেখানে গেলনা। সে আমাকে নিয়ে গেল ওয়াইজ ঘাটে। সে বেছে বেছে একটি শানকরা ঘাটের উপর দাঁড়াল। মনে হলো, এই ঘাট এই নদী এই পথ ওর অনেক দিনের চেনা।
আমাকে নীলু বলেছিল, 'আজকের নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আনন্দের মনে হচ্ছে না। এর চেয়ে ক্রন্দনের শব্দ অনেক সুন্দর।'
মান্নান সাহেবকে একটু পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছিল। সে আবারও একটি সিগারেট কিনে ধরায়। আমাকেও একটি অফার করে। তিনি বলছিলেন --- ' আপনি কী কখনও জীবন মূত্যু সন্ধিক্ষণের মানুষের চোখের পাতা দেখেছিলেন? ঐ সময়ে তাদের চোখগুলোতে জলের কনা চিকচিক করে। বলতে পারেন, কেন সেই জলগুলো অমন চিকচিক করে?'
ঐ যে হাসপাতালটা দেখছেন, এর নাম ছিল পিজি হাসপাতাল। এই হাসপাতালটিতে একটি মেজর অপারেশন হয়েছিল নীলুর। আমি একজন ডাক্তার, তাই অপারেশন থিয়েটারে থাকবার অনুমতি পেয়েছিলাম । একজন রোগীকে যখন এ্যানেস্থেসিয়া দেয়া হয়, সে তখন অজ্ঞান অবস্থায় অনেক কথাই বলে। নীলুকে যখন এ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়, অজ্ঞান অবস্থায় সে বারবার আপনার নাম বলেছিল। চোখের কোণ থেকে তখন চিকচিক করে জল ঝরে পড়ছিল। আর বিরবির করে বলছিল -- 'আমি শুভ্রকে দেখব।'
মান্নান সাহেবের কন্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। এবং কথা বলতে যেয়ে থেমে থেমে যাচ্ছিল। আমি বললাম --- তারপর নীলুর কী হলো? ও এখন কেমন আছে ? মান্নান সাহেব বলছিল --- সেদিন ছিল শুক্রবার। আমার বাসা তখন জিগাতলায় । মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে বের হয়েছি। মনটা কেমন যেন উদাস লাগছিল। ভাবলাম, আপনার সাথে একটু দেখা করব। হাঁটতে হাঁটতে সেই দিনই চলে গিয়েছিলাম কলাবাগানে আপনার মেসে। কিন্তু আপনাকে পাইনি।
হঠাৎ সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার আমাদের সামনে এসে থামে। রাস্তার উপর গাড়িটা থামানো দেখে ট্রাফিক পুলিশ এসে চালককে ধমকাতে থাকে। মান্নান সাহেব তখন আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত গাড়িতে গিয়ে ওঠে।
আরও কিছুক্ষণ একাকী দাঁড়িয়ে থেকেছিলাম পথের উপরে। তারপর একটি দুঃখের শ্বাস ফেলে সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে সামনের দিকে হাঁটতে থাকি।
©somewhere in net ltd.