নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাস্তব জীবনে আমি খুব কম কথা বলতে আর চুপচাপ থাকতে পছন্দ করলেও লিখতে খুবই ভালোবাসি, সেটা যে কোন বিষয় নিয়েই হোক! তবে অবশ্যই যে বিষয়ে জানি সে বিষয় নিয়ে :)

শব্দ যোদ্ধা

লেখালেখি হল নীরবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ

শব্দ যোদ্ধা › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্পঃ অপেক্ষা

৩০ শে নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:২২

'বাবা, আমাকে একটা নীল রংয়ের সোয়েটার কিনে দিবা?'
বলেই শুভ্র করুন চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে জবাবের অপেক্ষায়।

সোবহান সাহেবের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বেশ ক'দিন ধরেই ছেলেটা একটা সোয়েটারের কথা বলছে, শীতকালও আসি আসি করছে। তাছাড়া এমনিতেই ছেলেটা কখনও কিছু আবদার করে না; কিন্তু এমন সময়ে আবদার করল যখন মাসের শেষ, হাতে হাজারখানেক টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই। হরতাল অবরোধ এসবের কারনে ঠিকমত অফিসও হচ্ছে না। বেতন হওয়ার আগে পর্যন্ত পরিবারটাকে টেনে তো নিতে হবে। কি বলবেন এখন? চাইলেও ছেলেটাকে 'না' বলতে পারছেন না। আদরের ছেলেটা এত শখ করে একটা আবদার করল, না-ই বা করেন কি করে!

মন খারাপ ভাবটা লুকিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে সোবহান সাহেব বললেন, 'আজকে বিকালে কিনে দিব, ঠিক আছে বাবা?'
শুভ্র তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে গালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে হাসি হাসি মুখে মায়ের কাছে চলে যাচ্ছে। মাকে বলতে হবে তো বাবা কিনে দেবে বলেছে!

সোবহান সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন; কী সামান্য চাওয়া ছেলেটার, আর সেটা মেটাতেও তার হিমশিম খেতে হচ্ছে! মধ্যবিত্ত হয়ে জন্মানো যেন পাপের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে; না পারা যায় ফকিরের চলতে কারন আত্মসম্মানবোধে লাগে, আবার না পারা যায় আগ-পিছ না ভেবে নিজের শখের কিছু কিনতে। সব কিছুতেই দোটানায় পড়ে থাকতে হয়। সোবহান সাহেব ভাবছেন আপাতত নিউ মার্কেট থেকে কম দামের মধ্যে সুন্দর একটা সোয়েটার কিনে ছেলেকে খুশি করবেন। মাস শেষে বেতন হলে নাহয় ভাল দেখে আরেকটা কিনে দেবেন। আগেতো শখটা পূরন করতে হবে। থাকলো দু'টা সোয়েটার... নষ্ট তো হবে না। পরের বছর আবারও পরা যাবে।

.

'একটু দেখে শুনে যেও, দেশের যা অবস্থা!' উদ্বেগের স্বরে বলল নিশা।
নিশার কাঁধে হাত রেখে অভয় দেয়ার স্বরে সোবহান সাহেব বললেন, 'আরে ধুর! টেনশন করো না, কিছু হবে না। এই দেশের জন্য এ আর এমন কি! রোজই তো এমন থাকে।' এই বলে বের হয়ে গেলেন। নিশা দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে সোবহান সাহেবের দিকে। মানুষটা যেভাবে নির্ভয়ে হেঁটে যাচ্ছে, দেখে মনেই হয় না ভয়-ডর কিছু নেই। অথচ মাঝরাতে পানি খেতে উঠলেও নিশাকে ডেকে তুলে 'একা ভাল লাগে না' বা 'চল কিছুক্ষন গল্প করি' বলে।

.

বিকেলে অনেক খোঁজা খুঁজি হল। এ দোকান সে দোকান করে করে শেষমেশ নিউ মার্কেট থেকে অনেক দেখে শুনে সাড়ে তিন'শর মধ্যে মোটামুটি একটা সোয়েটার জোগাড় করে ফেলেছেন সোবহান সাহেব। এখন সোবহান সাহেবের মুখের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে সাড়ে তিন'শ টাকায় বিশ্বজয় করে ফেলেছেন। অনেকদিন পর বোধয় কিছু কিনে এতটা খুশি হয়েছেন তিনি। এখন শুধু ছেলের হাতে তুলে দিয়ে তার হাসিমুখ দেখার অপেক্ষা।

সোবহান সাহেবের আর তর সইছে না, তাড়াতাড়ি একটা বাসে চেপে বসলেন। মানুষ জন কম। বাস ছুটছে প্রতিদিনের মত, থেমে থেমে। সোবহান সাহেব মনে মনে ঠিক করছেন কিভাবে এই সোয়েটারটা ছেলেকে হাতে দেবেন? এমন কোন ভাবে দেবেন যেন ছেলে অবাক হয়ে যায়। প্রথমে মন খারাপ করে ঘরে ঢুকলে কেমন হয়? এমন ভান করবেন যেন ছেলে দেখে বুঝে নেয় যে বাবা কিনতে পারে নি। পরে খাবারের টেবিলে ছেলের হাতে তুলে দেবেন, অথবা কাল সকালে স্কুল যাওয়ার আগে! নাকি অন্য কোনভাবে ছেলেকে অবাক করা যায়? নাহ, মাথায় আসছে না নতুন কিছু। সোবহান সাহেবের চোখ আনন্দে চকচক করছে। চারপাশের কোলাহল তার কানের আশপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে আর তিনি মনে মনে ছেলেকে অবাক করার নাটকের ছক আঁকায় ব্যস্ত! আর ভাবছেন তার ছেলেটা কিভাবে খুশি প্রকাশ করবে। ইশ! আদরের ছেলেটা কতই না খুশি হবে! আর এই সামান্য সাড়ে তিন'শ টাকার জিনিসটা কত না আনন্দময় স্মৃতির সাক্ষী হবে! শুভ্র এক সময় বড় হবে; এইসব ছোট ছোট ঘটনা মনে করে মুচকি হাসবে। কেমন হবে শুভ্র বড় হলে? চুলগুলো কি কোঁকড়াই থাকবে? লম্বায় কি সে আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে! সোবহান সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, ইশ কি আনন্দ, কি আনন্দ! ভাবতেই আনন্দে চোখে পানি চলে আসছে তার।

.

বাসটা চলতে চলতে শাহবাগ মোড়ে এসে থামল। ক'টা লোক উঠল, ক'জন নেমে গেল। বাসটা আবার চলতে শুরু করল। কিছু দূর আগাতেই হঠাৎ কি হল কে জানে, বাসটা হার্ড ব্রেক কষলো। চারিদিকে খুব হই হুল্লোড়, চিল্লাচিল্লি হচ্ছে। কারা যেন হঠাৎ কয়েকটা পেট্রোল বোমা ছুড়ে দিয়েছে বাসের ভেতরে। মুহূর্তেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল, ছড়িয়ে পড়ছে সম্পূর্ন বাসে। সবাই যে যার মত ছুটছে জীবন বাঁচাতে। বাসের দরজা বন্ধ থাকায় বেশ ক'জন জানালার কাঁচ ভেঙ্গে লাফ দিয়ে বের হচ্ছে। এর মধ্যেই আগুন আরও ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাসে। বাসের পনের থেকে বিশ জন যাত্রী এখনও আটকে আছে বাসের ভেতরেই। কারও গায়ে আগুন লেগে গেছে, কেউ হুড়োহুড়ির মাঝে পরে আহত হয়ে পড়ে আছে; সোবহান সাহেবও তাদের মধ্যে একজন। মানুষের হুড়োহুড়িতে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেননি। পায়ের হাঁড় ভেঙ্গে গেছে, মাথায় আঘাত পেয়েছেন। ব্যাথার কারণে চোখে অন্ধকার দেখছেন। চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। যেভাবেই হোক বের হতে হবে এখান থেকে কিন্তু উঠে দাঁড়াতেও পারছেন যে এই অগ্নিকুন্ড থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করবেন!

সোবহান সাহেব পেপারে মোড়ানো সোয়েটারটা বুকে চেপে বসে আছেন আর অপেক্ষা করছেন কেউ যদি তাকে বাঁচাতে আসে। তার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। এইবার বুঝি ছেলেটাকে আর তার শখের নীল সোয়েটারটা দেয়া হল না! ছেলেটা তো অপেক্ষা করে থাকবে। এই তো কিচ্ছুক্ষন আগেই চকচকে চোখে ছেলের হাসির ছবি আঁকছিলেন আর এখন মনে হচ্ছে আদরের ছেলেটার মুখে হাসি ফোটানো হল না! গোলা জড়িয়ে ধরে ছেলের গালে চুমু খাওয়া হল না!

আগুনের উত্তাপ বাড়ছে খুব দ্রুত। কেউ এগিয়ে আসছে না তাকে বাঁচাতে। ঘরে রেখে আসা ছেলে আর স্ত্রীর কথা ভেবে সোবহান সাহেব কাঁদছেন অঝর ধারায়। হয়ত বা আর দেখা হবে না তাদের সাথে। শেষ কিছু সময়ের জন্য মনে করার চেষ্টা করছেন কিছু সুখের স্মৃতি; ছেলের প্রথম হাঁটতে শেখা, তার মুখে প্রথমবারের মত বাবা ডাক শোনা, ছোটখাটো খুনসুটি, নিশাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া, হঠাৎ ভয় দেখানো, অবাক করে দেয়া। নাহ, কিছুই মনে করতে পারছেন না তিনি। চোখের সামনে আগুন ছাড়া আর কিছুই আনতে পারছেন না। প্রকৃতি হয়ত চাচ্ছে না এ অগ্নিস্নান কোন সুখস্মৃতি দিয়ে শেষ হোক।

বাসের ছাঁদ থেকে আগুনের একটা শিখা এসে পড়েছে সোয়েটারটায়। শিখাটা ঝেড়ে ফেলে সোবহান সাহেব সোয়েটারটা বুকে চেপে ধরে রেখেছেন। আর যাই হোক, এটাকে হাত ছাড়া করা যাবে না। যদি কোনভাবে বেঁচে ফেরা হয় তবে... প্রচণ্ড উত্তাপে দরদর করে ঘামছেন সোবহান সাহেব। চোখে সবকিছু ঝাপসা দেখতে শুরু করেছেন তিনি। হাল ছেড়ে দিয়েছেন। শরীরের সব অণুগুলো যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। বাম পাশ থেকে হঠাৎ কিছু একটা ভাঙ্গার শুনেছেন বলে মনে হল। সোবহান সাহেব জ্ঞান হারালেন।

.

রাত বাজে সাড়ে এগারোটা। শুভ্রকে কোলে নিয়ে নিশা বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা এতক্ষন করছে কেন বাসায় ফিরতে? কখনও তো এমনটা হয় না। দেরি হলে আগে থেকে ফোন করে জানিয়ে দেয় 'দেরি হবে, টেনশন করো না'। আজকে ফোনও করে নি। ফোন করেও নাম্বার বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সেই যে বিকেলে বের হল আর কোন খোঁজ নেই। কি হল মানুষটার? মনের মধ্যে আজে বাজে চিন্তা আসছে। নিশা সেগুলোকে পাত্তা না দেয়ার চেষ্টা করছে। মানুষটা যেখানে আছে, ভাল আছে নিশ্চই; হয়ত মোবাইলে চার্জ শেষ বলে ফোন করতে পারছে না এই আর কি। চলে আসবে একটু পর।

শুভ্র কোল থেকে নেমে নিচে দাঁড়িয়েছে। প্রায় বারোটা বাজতে চলল। পাশ থেকে শুভ্র জিঙ্গেস করল,
- মা, বাবা কোথায়?
- তোর জন্য সোয়েটার কিনতে গেছে
- নীল?
- হ্যাঁ। তুই না বলেছিস নীল কিনতে।
শুভ্রর চোখে আনন্দ ঝলমল করে উঠল। যাক, বাবা তাহলে সত্যি সত্যি-ই কিনে দিচ্ছে। কাল তাহলে নীল সোয়েটারটা পরেই স্কুলে যাবে শুভ্র।
- কখন আসবে বাবা?
- এইতো একটু পর চলে আসবে রে বাবা।

শুভ্র অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করছে তার মা ও। শুভ্রর অপেক্ষা আনন্দময় আর নিশার অপেক্ষায় শংকা। কখন ফিরবে মানুষটা?

নিশা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। অপেক্ষায়, এই বুঝি মানুষটা আসলো। হঠাৎ টেবিলে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠেছে। নিশা মোবাইলের কাছে গিয়ে দেখল অপরিচিত নাম্বার। কল রিসিভ করতে ভয় ভয় করছে নিশার। কলটা ধরবে নিশা...?

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:৩৮

আরিফা হক বলেছেন: উনাদের কিছুই যায় আসে না, তাদের সন্তানের সব শখ বলার আগে পূরণ হয়। তাদের কাছে মানুষের ছোট ছোট শখের কোনও দাম নেই। যে সব মানুষ সারা জীবন বডিগার্ডের পিছনে লুকিয়ে কাটায় তারা মানুষের জীবনের মূল্য বুঝতে পারে না।

ভালো লিখেছেন।

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৩৪

শব্দ যোদ্ধা বলেছেন: "যে সব মানুষ সারা জীবন বডিগার্ডের পিছনে লুকিয়ে কাটায় তারা মানুষের জীবনের মূল্য বুঝতে পারে না" - আপনার এই কথাটা খুব ভাল লাগছে :)

২| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৮

সুমন কর বলেছেন: খুব সমসময়িক অসাধারণ লিখা। পড়লাম, আর শাহবাগের কথা মনে করে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

৩০ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৪৩

শব্দ যোদ্ধা বলেছেন: ধন্যবাদ সুমন ভাই ^_^

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.