নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হুমায়ূন আহমেদের বই যখন পড়ি, তখন আমার লেখার ইচ্ছাটা জেগে উঠে। আপাতত ছোট গল্প দিয়ে না হয় শুরু করলাম..

রব্বানী রবি

রব্বানী রবি

রব্বানী রবি › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবনযাত্রা

০৩ রা জুন, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৫

আমি আকবর আলীর একমাত্র ছেলে। ছোটবেলা থেকে কখনো খেতে পারতাম,কখনো বা উপোস হয়ে, উদোম হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। আমার কয়েজন বন্ধুও আছে। সবারি একই অবস্থা। আমরা কখনো খেতে পাই, কখনো পাই না। এই নিয়ে আমাদের কখনো মাথা ব্যথাও থাকে না।

মা-বাবা উপোস থাকলেও, আমরা বিচ্ছুরা, আমাদের কখনো উপোস থাকতে হয় নি। কারণ, কার বাগানে কোন ফল কখন ধরে, সব আমাদের মুখস্ত। কিন্তুু আমিসহ আমাদের বন্ধুদের কাছে, এই খবরগুলা খুব গোপনীয়। যদি একবার এইসব খবর আমাদের বাবা-মা'রা জানে, তাহলে মেরে আস্ত রাখবে না।

আমরা সীতাকুন্ডের পন্থিছিলা পাহাড়ে বাস করি। মেইন রোড এখান থেকে অনেক দূরে। সপ্তাহে দু একবার বন্ধুরা মিলে ঘুরে আসি। ব্র্যাকের একটা স্কুলে আমরা ক্লাস সিক্সে পড়ি। একটা ম্যাডাম আমাদের ক্লাস নেয়। প্রতিদিন আমরা ক্লাসে যেতাম। কারণ,ক্লাস করলেই ম্যাডাম আমাদের অনেক ভালো ভালো খাবার খেতে দিতেন।

মাঝে মাঝে যেদিন আমাদের ক্লাস থাকতো না। সেদিন আমরা ভ্রমণপিয়াসুদের গাইড হতাম। কারণ, শহর থেকে অনেক মানুষ ঝর্ণা এবং ক্যাসকেড দেখতে পন্থিছিলায় আসতো। আমরা গাইড হলে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পেতাম। কেউ কেউ আমাদের খাবার দিতো। অনেক মজাদার খাবার সেগুলা। আমাদের এখানে এসব খাবার পাওয়া যায় না, আর থাকলেও হয়তো কিনে খাবার সাধ্য নেই। মাঝে মাঝে মনে হতো, আল্লাহ আমাদের বড়লোক বানালে ভালো হতো। অনেক মজাদার খাবার খেতে পারতাম।

গাইড হিসেবে মজা লাগতো। অনেক মানুষের সাথে মিশতে পারতাম। কিন্তুু অনেক মানুষ আমাদের তুচ্ছ ভাবতো। ভাবতো,উদোম পিঠের এই ছোট ছোঁকড়ারা কি বা বুঝে ! অথচ আমরা অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম।

আমার বাবা করতেন কলা বাগান। পাহাড়ী কলার চাহিদা অনেক বাজারে। বাবা সারা বছর মাঠে কাজ করতেন। এমনকি ঈদের দিনও। আসলে, আমাদের ঈদ বলতে কিছু ছিলো না।

একবার শহরে গিয়েছিলাম বাবার সাথে। শুনছি, সে শহরের নাম চিটাং শহর। পরে ক্লাসে ম্যাডাম থেকে জেনে নিছি। সেই শহরের ভালো নাম চট্টগ্রাম।

ওখানের, আমার বয়সী ছেলেগুলা, কতো সুন্দর সুন্দর জামা পড়ে ! আমার হাফ প্যান্টের চেইন ই নাই, অথচ তারা লম্বা প্যান্ট পড়ে, প্যান্টের সাথে বেল্টও পড়ে। অথচ আমার প্যান্ট আছে দুইটা।যেগুলা ঢোলা,কোমরের কাছে প্যান্ট উঠিয়ে ছেড়ে দিলে, পড়ে গিয়ে ইজ্জতের হানি করে। তাই দঁড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়।

যেদিন ক্লাস থাকতো না,বাবার সাথে মাঠে কাজ করতাম। আমি বেশী পছন্দ করতাম, কোদাল দিয়ে ড্রেন কাটা, যেনো পানি কলাবাগানে জমে থাকতে না পারে।

বিভিন্ন পাখি কলা ছোট অবস্থায় খেয়ে নষ্ট করে ফেলতো। আমরা বন্ধুরা মিলে একটা কাঁকতাড়ুয়া বানিয়ে ফেললাম। যা দেখতে অবিকল মানুষের মতো।

বাবা এতে অনেক খুশি হয়েছেন। আমার বন্ধুদেরকে দোকান থেকে গোল্লা কিনে দিয়েছে। আমার বন্ধুরা গোল্লা পেয়ে অনেক খুশি। আমাদেরকে বাবার গোল্লা কিনে দেওয়ার পেছনে কারণ হলো, আগে বদমাইশ পাখিদের বাবা নিজে তাড়াতেন। কিন্তুু কাঁকতাড়ুয়ার অদ্ভুত ক্ষমতায় পাখিরা এমনিতেই কলা বাগানে আসে না। তাই আগের তুলনায় কলার ফলনও বেশী হয়।

সবচেয়ে কষ্ট হয় বাবা যখন কলা নিয়ে মেইন রোড পর্যন্ত যায়। কাঁধে করে প্রায় দেড় ঘন্টা পায়ে চলার পর মেইন রোডে যাওয়া যায়। এতে যে কি পরিমাণ কষ্ট হয়, তা ভাবতেও কষ্ট লাগে। তখন বাবাকে বলি, আমাকে কিছু দেন, আমিও কলা নিয়ে আপনার সাথে যাবো। তখন বাবা বলে, তুই এখন অনেক ছোট। বড় হলে নিস।

আর যখন খদ্দেররা কলার দাম অনেক কম হাঁকায়, তখন মনে হয়, এতো কষ্ট করে আমার বাবার কলা উৎপাদন করা বৃথা। খদ্দেররা জানে না, কতো দুঃখ, কতো সুখ স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই পরিশ্রমের পেছনে। খদ্দেররা টাকা দিলে আমরা খাবারে, একটু ভালো কিছু খেতে পারবো। এর বেশী কিছু না।

মা যে শেষ কবে, ভালো কাপড় পড়েছেন কে জানে ! দুইটা শাড়ি আছে,দুইটাতেই তালি দেওয়া। একটু ছিঁড়লে মা সুঁই-সুতা নিয়ে বসে যেতেন। ছেঁড়া অংশ জোড়া লাগানোর জন্য।

বইয়ে পড়েছি শহরে নাকি গ্যাসের চুলা দিয়ে রান্না করে। এই গ্যাসের চুলা দেখতে কেমন, তা আমাদের কারোই জানা নেই। আমাদের মাটির চুলা আছে। এজন্য আমাকে প্রতিদিন কিংবা একদিন অন্তর অন্তর, বিকালে বস্তা ভরে কাঠ কুঁড়িয়ে আনতে হতো পাহাড় থেকে। এই কাজটা মাঝে মাঝে আমরা দলগতভাবে করতাম,বন্ধুরা মিলে। মাঝে মাঝে যখন ঝিরি পথ দিয়ে ছুটতাম, তখন মাথার উপর ঝোপের মাঝে সাপ বসে আমাদের দেখতো। আমরা ভয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতাম।

পাহাড়ের পথ আমাদের সকলের চেনা। কোনখান দিয়ে গেলে, কোথায় যাওয়া যাবে,সব যেনো আমাদের মুখস্ত।

একবার একটি দল এসেছিলো ঘুরতে,ঢাকা শহর থেকে। তারা কোন গাইড ছাড়াই ঝর্ণা দেখতে গেলো। কিন্তুু তারা হারিয়ে গেছে পথ ভুলে। এই হারিয়ে যাওয়া বিষয়টা আমি বুঝতে পারি তখন, যেদিন আমি বন্ধুদের ছাড়াই একা কাঠ কুঁড়াতে গেছিলাম পাহাড়ে। পাহাড়ে উঠে দেখি, এক জায়গায় ৪-৫ জন বসে আছে, তাদের সাথে একজন মেয়েও ছিলো।তখন সন্ধা নেমে আসছিলো। মেয়েটার চোখে জল ছিলো। সবাই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। যদি তারা সন্ধ্যার আগে পাহাড় থেকে বের হতে না পারে !

আমাকে দেখে তাদের মাঝে যেনো প্রাণ ফিরে আসে। আমি তাদের পথ দেখিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসি। তখন অন্ধকার নেমে আসে।

পরে আমার বাবা তাদের মেইন রোড পর্যন্ত দিয়ে আসে। বাবার থেকে হাঁটা পথে, তারা আমাদের পরিবারের গল্প শুনেছিলো।

তাই পন্থিছিলা বাজার থেকে তারা আমাদের জন্য অনেক কিছু কিনে দেয়। বাবার জন্য পান্জাবী, মায়ের জন্য একটা শাড়ি আর আমার জন্য একটা গেন্জি আর কিছু চকলেট। বাবা প্রথমে নিতে চায় নি কিছুই। পরে বললো,আমার প্রতি তারা খুশি হয়েই দিলো সব।

বাবা তার জীবনে প্রথম পান্জাবী পড়লো। এক শুক্রবার মা-বাবা দুজনি নতুন জামা কাপড় পড়লো, তাদের দেখতে কি যে ভালো লাগছিলো !

আমরা হয়তো এই পৃথিবীর অনেক খবরই রাখি না। কারণ,এই পৃথিবীর অনেক খবরই আমাদের এই পাহাড়ী জীবনে এসে পৌছায় না। তারপরও আমরা অনেক ভালো আছি। হয়তো টাকার কারণে, স্কুল শেষ করে কখনো কলেজে যাওয়া হবে না। বাবার সাথে মাঠে কাজ করে কাটিয়ে দিতে হবে সারাজীবন।

যেমন কাটিয়ে দিয়েছিলেন আমার দাদা-দাদী। তারা আজ আর কেউ বেঁচে নেই। আমি যখন ক্লাস থ্রীতে পড়তাম। সে বছরেই দুজন একসাথে, পাহাড়ী ঢলে মৃত্যু বরণ করেন। তাদেরকে এই পাহাড়েই কবর দেওয়া হয়েছে। একদিন আমাকেও হয়তো এই পাহাড়ের মাটির সাথে মিশে যেতে হবে। পাহাড়ী বৃষ্টির জলে আমার শরীর হয়তো ভিজে যাবে, শুধু টের পাবে না আমার এই শরীর।

আমরা পাহাড়ীরা বিছিন্ন এক পৃথিবীতে আছি। হয়তো সুখেই আছি, ভালোই আছি।






মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১০

রাজীব নুর বলেছেন: বর্ষার আরম্ভে গঙ্গা যেমন প্রতিদিন দেখিতে দেখিতে ভরিয়া উঠে, কুসুম তেমনি দেখিতে দেখিতে প্রতিদিন সৌন্দর্যে যৌবনে ভরিয়া উঠিতে লাগিল। কিন্তু তাহার মলিন বসন করুণ মুখ শান্ত স্বভাবে তাহার যৌবনের উপর এমন একটি ছায়াময় আবরণ রচনা করিয়া দিয়াছিল যে, সে যৌবন সে বিকশিত রূপ সাধারণের চোখে পড়িত না।
ঘাটের কথা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

০৩ রা জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২৯

রব্বানী রবি বলেছেন: Wow!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.