![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দক্ষিণ এশিয়ায় কিশোরী নির্যাতনের শীর্ষে বাংলাদেশ, আর সারা বিশ্বে সপ্তম। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)’র গবেষণায় একরকমই তথ্য পাওয়া গেছে । ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘হিডেন ইন প্লেইন সাইট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রদান করা হয়েছে। ১৯০ টি দেশ থেকে এই গবেষণার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারের এত উদ্যোগ এত আইন থাকা সত্ত্বেও এই অবস্থা চরম উৎকন্ঠার বিষয়। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯, যোৗতুক নিরোধ আইন ১৯৮০, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩), এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২ (সংশোধনী ২০১০), নারীর প্রতি সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, জাতীয় নারী নীতি ২০১১, মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম, আরো কত শত দেশী-বিদেশী উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগ কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না এই নারীর প্রতি সহিংসতা। এক ধরনের সহিংসতা কমলেঅন্য ধরনের সহিংসতা বেড়ে যায়। কিন্তু কেন? ###গবেষণায় বলা হচ্ছে স্বামী বা সঙ্গীর নিপীড়নের ক্ষেত্রে এশিয়ারদেশগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। আর দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবার শীর্ষে। একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ, বন্ধু যাই বলি না কেন সেটা হলো তার স্বামী/স্ত্রী। আর সেই সম্পর্কের জায়গাতেই সমস্যার শীর্ষে আমরা। কিন্তু কেন? বিষয়টা ভাবনার উদ্রেক নিশ্চয়ই করবে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে ২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ শিশু-কিশোরের (১৯ বছর পর্যন্ত) মধ্যে একজন হত্যাকান্ডের শিকার হয়। এতো শুধু শিশু-কিশোরের হিসাব। সকল বয়সের নারীর উপর সহিংসতার গবেষণা করলে এর হার আরো বহুগুণেবেড়ে যাবে। আবারো সেই একই প্রশ্ন কিন্তু কেন? খবরগুলো কি আমাদের ভাবায় না? ২০০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে এনএম নূরুল হক লিখেছিলেন বাংলাদেশে প্রতিঘন্টায় ১ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়। ২০০৬ সালে আইসিডিডিআরবি’র এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৫০থেকে ৬০ ভাগ নারী বিভিন্œ ধরনের পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব পপুলেশন রিসার্স অ্যান্ড ট্রেনিং (নিপোর্ট) কর্তৃক ২০০৭ সালে পরিচালিত ‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে’ নামক গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে প্রায় ৬০ ভাগ নারী বিবাহিত জীবনে তার পরিবারে স্বামী কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের এক গবেষণায় দেখা যায় শুধুমাত্র ২০০৯ সালেই ৪৫৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয় যার মধ্যে ২১১ জন পূর্ণ বয়স্ক নারী আর ২৪৩ জন শিশু। অর্থাৎ প্রতিদিন ১ দশমিক ২৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর নারীর প্রতি সহিংসতা সার্ভে প্রতিবেদন যা ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৮৭ ভাগ নারী জীবনের কোন না কোন সময় পরিবারের ভেতরেই কোন না কোন সদস্যের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন। এরকম আরো বহু গবেষণার বহু উদাহরণ হাজির করা সম্ভব এই বিষয়ে। কিন্তু কেন এই সহিংসতা? ###আসলে মানুষে মানুষে সম্পর্কটা হলো ‘ক্ষমতার সম্পর্ক’। আর নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে তা শতভাগ কার্যকর। পুরুষ এখানে সামাাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে প্রতিটি জায়গাতে নারীর চেয়ে ক্ষমতাবান। নারী-পুুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুরুষ অধিকতর শক্তিশালী হওয়ার কারণে এই সহিংসতা ঘটে থাকে। পুরুষতন্ত্রের আরেক নাম ক্ষমতা। এর মধ্যে দুইটি বিষয় কাজ করে। একটি হলো নিজের ক্ষমতা জাহির করা আর অন্যটি হলো ক্ষমতা জাহির করে অন্যকে আরো ক্ষমতাহীনে পরিণত করা। তবে শুধুমাত্র অধিকতর ক্ষমতাবান হওয়ার কারণেই যে সহিংসতা ঘটে তা নয়। আসলে পৃথিবীতে বিরাজিত এক মতবাদ অন্য মতবাদকে সহ্য করতে পারে তা এমন ঘটনা বিরল। যেদিন থেকে পুরুষের হাতে ক্ষমতা সেদিন থেকেই সহিংসতার সূত্রপাত। নারীর প্রতি হাজার বছর ধরে চাপিয়ে রাখা হয়েছে নানান নিয়ম আর শর্তের বেড়াজাল। আর নারী তা নীরবে মেনে নিয়েছে। এই মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি যতদিন অব্যাহত ছিল ততদিন ছিল তথাকথিত ‘শান্তি’! পুরুষতন্ত্র যদিও একে শান্তিই মনে করে, কিন্তু তা কি আদৌ শান্তির প্রতীক ছিল? প্রশ্ন থেকেই যায়। অন্যায়কে নীরবে মুখ বুঁজে সহ্য করার মধ্য দিয়ে কি আর শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়? ফলে তথাকথিত শান্তির ঘরের ছাঁদ একদিন ভেঙ্গে পড়বে তাই ছিল স্বাভাবিক। চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম কানুনের বেড়াজাল ভাঙ্গতে একদিন জেগে উঠে নারীরাও। বলে উঠে মানি না, মানবো না। শুরু হয় দ্বন্দ্ব। ত্বরান্বিত হতে থাকে সমাজের বিকাশ প্রক্রিয়া। তবে এই বিকাশ প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত নির্মম হয়ে ফুটে উঠে আমাদের সামনে। আধুনিক বিশ্বের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় শতশত আধুনিক নিপীড়নের হাতিয়ার নিয়ে হাজির হয়েছে পুরুষতন্ত্র। মোটাদাগে এই সহিংসতাকে শারীরিক, মানসিক, যৌন আর অর্থনৈতিক এই চারভাগে ভাগ করা হলেও এর ভেতরে রয়েছে হাজারো কৌশল আর ধরন। শিশু বিবাহ, যৌতুক, মারপিট, হুমকি, টিজিং, তালাক, খোরপোষ না দেওয়া, বন্দীত্ব বরণে বাধ্য করা, বিক্রি করা, জোরপূর্বক যৌন কর্মে বাধ্য করা, দখলি স্বত্ত্ব কেড়ে নেওয়া, সম্পত্তি না দেওয়া, ধর্ষণ, হত্যা, এসিড সহিংসতা আরো কত হাজার ধরন। ###এই নারীর প্রতি সহিংসতা কি কোন দিন বন্ধ হবে না? না হলে কেন হবে না। আর হলে তা কোন পথে হবে? উপায়গুলো কি হবে? এই রকম শত সহ¯্র প্রশ্নের উত্তর কোথায়? আইন তো অনেক আছে। অনেকে বলে থাকেন যে, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ হলে সহিংসতা বন্ধ হবে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই বলে? এই ধরনের সহিংসতা ঘটানোর কারণে অনেকের ফাঁসি হয়েছে, অনেকে সাজা খেটেছেন এবং খাটছেন, অনেকেই জরিমানা গুনেছেন। তাও কেন বন্ধ হচ্ছে না। এর উত্তরের বীজ সমাজের অনেক গভীরে প্রথিত। ###আধুনিকতাকে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি ক্ষমতাবানদের মধ্যে নেই। ক্ষমতার আধার পুরুষতন্ত্র তাই নারীর উত্থানকে মেনে নিতেই পারেনি। আমাদের মধ্যে অনেকেই বলে থাকেন যে, নারীরাতো অনেক ক্ষমতায়িত হয়েছেন। তারা এখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যাঁ এটা সত্য যে, দীর্ঘ আন্দোলনের আর নারী জাগরণের ফলে নারীর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু নারীর অবস্থানের কি কোন পরিবর্তন এসেছে? সিডো সনদের পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন আজও আমাদের রাষ্ট্র দিতে পারেনি। নারীনীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনো দীর্ঘ পথ অতিক্রমের ব্যাপার। বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করেও একজন পুরুষের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে তা নির্ভর করে পুরুষের উপরেই। যে সমাজ অথবা রাষ্ট্রে এখনো মানুষ পড়ালেখা করে শুধুমাত্র চাকুরি করবার জন্য, শিখবার জন্য কিংবা মানুষ হবার জন্য নয়, সেখানে ক্ষমতাবাজির বাইরে এসে নারী-পুরুষের সমতা বা মানুষে মানুষে সমতার রাস্তা অনেক পিচ্ছিল এবং কন্টকাকীর্ণ। নানান মানুষ এবং সংগঠন ছোট ছোট পরিসরে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক ধরনের সুপারিশ বের করেছেন। কেউ শিশু বিবাহ নিয়ে, কেউ যৌতুক নিয়ে, কেউ পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু বৃহত্তরভাবে সমন্বিত প্রচেষ্টা খুব কমই লক্ষণীয়।###নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। আর এই কর্মসূচির লক্ষ্য হতে হবে কারণগুলোর মূলোৎপাটন করা। কিন্তু কিভাবে সম্ভব এই কাজ? মোট দাগে তিনটি ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করা যায়। যে ক্ষেত্রগুলোকে ধরে কাজ করলে কোন পরিবর্তন দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বয়েছে বলেই মনে করা যায়। প্রথমতঃ প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন। আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের সমাজের ক্ষয়ে যাওয়া রূপটাকেই রিপ্রেজেন্টে করে। এই ব্যবস্থায় ভাল মানুষ হয়ে উঠার কোন উপকরণ বিরাজিত নেই। ফলে শিক্ষা গ্রহণ করে একজন মানুষ নিজের পরিবর্তন ঘটাবে তা প্রায় অসম্ভব। যারা পরিবর্তিত হয়েছেন অথবা হচ্ছেন, তারা নিজেদের প্রচেষ্টায় পেরেছেন। দ্বিতীয়তঃ প্রয়োজন একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের। যার মধ্য দিয়ে সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব। আর এই সামাজিক পরিবর্তনই বর্তমান অবস্থার নিয়ে আসবে। আর তৃতীয়তঃ প্রয়োজন একটি বড় ধরনের প্রতিরোধ আন্দোলনের। যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে নারী সমাজকে। আর নারী বান্ধব পুরুষদের থাকতে হবে তাদের পাশেই। যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে মাত্র। আর তা এখনো রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে। প্রাথমিক পর্যায়ের আন্দোলনকে পরিণত আন্দোলনে রূপদান করতে হবে। এই তিনটি ক্ষেত্র নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারলেই কেবল নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ সম্ভব। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে যে, এটি একটি অসম্ভব চিন্তা। আদৌ কি সম্ভব? কিন্তু মানুষের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, হাজারো অসম্ভবকে সম্ভব করেই মানুষ এতদূর এসেছে। আর সকল অসম্ভবই একসময় সম্ভবে রূপান্তরিত হয়। যদিও এই পথ অনেক কঠিন তবু হাটতে হবে আমাদের। উল্লিখিত পদক্ষেপগুলোই নিয়ে আসবে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন আর বন্ধ হবে নারীর প্রতি সহিংসতা। শুরু হবে এক নতুন যুগের, নতুন সভ্যতার।
©somewhere in net ltd.