![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা এমন একটি বিষয় যেখানে জনগণের সম্পদ বন্টনে এবং নীতি নির্ধারণে জনগণের অংশীদারিত্ব থাকে। কেন্দ্রয়ী এবং স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রায়ন এবং গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের অভীষ্ট লক্ষ্যে দেশকে দেখতে চাইলে এই প্রক্রিয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পরে একটা দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পাশাপাশি আমাদেরকে সংগ্রাম করতে হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য। আর এই গণতন্ত্রায়নের শুরু করা সম্ভব স্থানীয় পর্যায় থেকে। যেহেতু তৃণমূলের সবচেয়ে কাছের স্থানীয় সরকার হলো ইউনিয়ন পরিষদ তাই সরকার- অর্থনীতিবিদ- বুদ্ধিজীবী সকলেই মনে করেন এই কাজটি স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ থেকেই শুরু হওয়াটা প্রয়োজন। তাই স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩-৭ নং ধারাগুলোতে ওয়ার্ড সভার কথা বলা হয়েছে। এখানে ইউনিয়ন পরিষদ প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে ওয়ার্ড সভা গঠনের মাধ্যমে ৬ মাস অন্তর জনগণের সাথে সভা করে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও ১০ম অধ্যায়ের ৫৭ নং ধারার ১ ও ২ উপধারায় জনঅংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। ৫৭(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ইউনিয়ন পরিষদ সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটি এবং স্থানীয় জনগণের উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে বাজেট অধিবেশন অনুষ্ঠান করিয়া বাজেট পেশ করিবে এবং পরিষদের পরবর্তী সভায় পাসকৃত বাজেটের অনুলিপি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট প্রেরণ করিবে।’ এছাড়াও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চিয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধান ও আইন দুটোতেই জনঅংশগ্রহণের কথা থাকবার পরও স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন পরিষদে কার্যকর জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অনেক কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক এনজিও স্থানীয় সরকারকে গণমূখী করবার লক্ষ্যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে সফলতার পরিমাণ খুব স্বল্পই।
জানা যায়, ১৯৯০ সালে ব্রাজিলের পোর্ত আলেগ্রে শহরে প্রথম শুরু হয় এই অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা ও বাজেট প্রক্রিয়া। এরপর তা দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে শুরু করে। কিছু কিছু আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের এনজিও স্থানীয় সরকারকে গণমূখী করতে এবং স্থানীয় সরকারের কাজকে জনঅংশগ্রহণমূলক করতে কার্যক্রম হাতে নেয়। গত এক দশকে এই কার্যক্রম খুব অল্প মাত্রায় হলেও তৃণমূলে যেমন পরিবর্তন আনতে পেরেছে একই সাথে নীতি নির্ধারণী পর্যায়েও এর প্রভাব পড়েছে। প্রভাবগুলো মধ্যে অন্যতম হলো বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ আইনে (২০০৯) উপরিউল্লিখিত ধারাগুলো সংযোজন করা হয়েছে। এই বিষয়ে কারো দ্বি-মত নেই নেই যে তৃণমূলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর সুশাসনের মূল ভিত্তিই হলো জনগণের অংশগ্রহণ। আমরা তৃণমূলকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করতে নানারকম পদক্ষেপ নিচ্ছি, যেন কার্যকর জনঅংশগ্রহণের মাধ্যমে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা তৈরি হয়। কিন্তু এতে আসলে কতটা অগ্রগতি হচ্ছে আর কতটা হওয়া সম্ভব আর কি কি ঝুঁকি রয়েছে তা আমাদের বিবেচনায় নেওয়া দরকার। আমাদের স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদকে প্রায় শ’খানেক রেজিস্টার পূরণ করতে হয় তার বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়ে যেমন- টিআর কাবিখা, ভিজিডি, ভিজিএফ, এলজিএসপি প্রভৃতি সকল কার্যক্রম মিলিয়ে প্রায় শ’খানেকের কাছাকাছি চলে যায়। এরপর রয়েছে বিচার-সালিশ থেকে শুরু করে সকল ধরনের কাজ। কাজের বোঝাটা এতই যে তার আর অন্য কোন (পরিবার থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সকল) দিকে তাকানোর সুযোগ থাকেনা। তৃণমূলের সবচেয়ে কাছের সরকার হবার ফলে তাদেরকে (চেয়ারম্যান/মেম্বার) যে পরিমাণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয় তা অন্য যেকোন স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের চেয়ে অনেক বেশি। সেই হিসেবে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ব্যতীত পরিষদে সচিব ছাড়া ঐ অর্থে আর কোন কর্মকর্তা নেই বললেই চলে। অনেকে বলতে পারেন, ইউনিয়ন পরিষদের তো আয় নেই কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়োগ হবে কিভাবে? বিষয়টি নিশ্চয়ই আলোচনার দাবি রাখে। তাহলে এই প্রশ্নও যথার্থ যে, বাংলাদেশের কতগুলো সরকারি বা পাবলিক প্রতিষ্ঠানে নিজেদের আয়ে পরিচালিত হয়? সরকারের বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব আয় থাকে না এবং সেগুলো কেন্দ্রীয়ভাবেই তা পরিচালিত হয়। শুধুমাত্র ইউনিয়ন পরিষদের বেলায় যত রকমের নিয়ম-কানুন। অনেকেই মনে করেন যে, স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে যারা চেয়ারম্যান মেম্বার থাকেন তাদের বেতনের প্রয়োজন নেই। কারণ তারা জনসেবা করবেন বলে স্বেচ্ছাব্রতী। কিন্তু তারাই আবার স্থানীয় সরকারের অন্যান্য ধাপ যেমন, উপজেলা চেয়ারম্যান অথবা অন্যান্য পর্যায়ের জন্য ব্যাপক বেতন-ভাতা-সম্মানীর পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকেন। কি সুন্দর স্ববিরোধীতা তাদের মধ্যে! শুধুমাত্র পরিকল্পনা করাটাই তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য। পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কিভাবে কতটুকু হবে তার হিসাব খুব কমই রাখা হয়। কিন্তু পরিকল্পনা যদি স্মার্ট না হয় তাহলে তার বাস্তবায়ন করা কতটুকু সম্ভব তা কেউ ভাবেন না। পরিকল্পনার ‘পরী’ উড়ে গেলে পরে কল্পনা, কল্পনাই থেকে যায়। এই হলো আমাদের স্থানীয় সরকারগুলোর অবস্থা। আমাদের দেশের সরকারও স্থানীয় সরকারে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে আইনের মধ্যেই অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা ও পদ্ধতির উপর জোর দিয়েছেন। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা যদি অংশগ্রহণমূলক না হয়, স্থানীয় সরকার কতটুকু এগিয়ে আসবে তার চিন্তা করার সুযোগ এখানে অল্পই।
আমাদের লক্ষ্য যদি হয় উন্নয়ন, সুশাসন ও গণতন্ত্র তাহলে সরকারের সকল পর্যায়ে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়ন আবশ্যক। আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে অনেক জায়গাতেই অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা প্রণয়ন শুরু হয়েছে আমরা জানি। কিন্তু এর জন্য সমন্বিত ব্যবস্থা উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী। সমন্বিত উদ্যোগ মানে হলো কেন্দ্রীয়ভাবে এই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা। বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো যে প্রক্রিয়ার শুরু করে অব্যাহতভাবে এগিয়ে নিয়ে এসেছে তা এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর তাহলেই সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে একযোগে বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব এই অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা আর এর বাস্তবায়ন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারেও চালু করতে হবে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি। স্থানীয় সরকার যেমন বাজেটের আগে ওয়ার্ড সভা করে চাহিদা যাচাইয়ের মাধ্যমে নিজেদের পরিকল্পনা প্রস্তুত করে থাকে ঠিক সেরকমভাবে কেন্দ্রীয় সরকারকেও জাতীয় বাজেট প্রণয়নে জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সরকার যদি বাংলাদেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদে জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বাজেট প্রণয়ন করে সেই চাহিদার ভিত্তিতে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করতে পারে তাহলেও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির একটা প্রয়োগ হবে। তবে স্থানীয় সরকার প্রস্তাবিত বাজেটে জনগণের মতামত নিয়ে তারপর বাজেট চুড়ান্ত করে থাকে আর কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট চুড়ান্ত হয় বাজেট প্রস্তাবনার পরবর্তী বছর মোট খরচের সমন্বয় করে সংশোধিত বাজেট আকারে। স্থানীয় পর্যায়ের চাহিদার ভিত্তিতে বাজেট প্রণয়ন করে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আর এভাবেই নিশ্চিত হবে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রকে শুধুমাত্র একদিনের জন্য না করে তাকে স্থায়ী রূপদানের জন্য অবশ্যই সকল উন্নয়ন কার্যক্রমে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের আরেকটি বড় বাধা হলো দুর্নীতি। উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রতিটি পর্যায়ে দুর্নীতি রাষ্ট্রের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে পদে পদে। উন্নয়ন কার্যক্রমে যদি অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তবে তবে দুর্নীতিও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে দুর্নীতি কমতে শুরু করবে, শক্তিশালী হবে গণতন্ত্র আর প্রতিষ্ঠিত হবে সুশাসন যা ছিল আমাদের আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গঠন করতে হলে অবশ্যই প্রয়োজন সুশাসন নিশ্চিত করা। আর সুশাসন নিশ্চিত করতে দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের জন্য চাই কেন্দ্রীয় আর স্থানীয় সরকারে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা ও এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন।
©somewhere in net ltd.