![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা এবং প্রকোপ এতই বেশি যে তা অন্য যেকোন দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। নারীর প্রতি সহিংসতার রূপগুলোর মধ্যে বলা যায়, খুন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, এসিড নিক্ষেপ, হুমকি, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, পারিবারিক সহিংসতাসহ আরো অনেকভাবেই সহিংসতার স্বীকার হতে হয় আমাদের দেশের নারীদের। বর্তমান সময়ে বিশেষ করে গত দুই মাসে গণমাধ্যমগুলো থেকে আমরা ধর্ষণসহ বিভিন্ন প্রকার নারীর প্রতি সহিংসতার খবর জানতে পারছি যা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এই সহিংসতা এখন মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে। তবে এই পরিস্থিতি কখনো কম আবার কখনো তীব্র মাত্রায় আমাদের রাষ্ট্রে এবং সমাজে বিরাজিত। তা আমরা অনেক গবেষণা থেকেই দেখতে পেয়েছি। দক্ষিণ এশিয়ায় কিশোরী নির্যাতনের শীর্ষে বাংলাদেশ, আর সারা বিশ্বে সপ্তম। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)’র গবেষণায় একরকমই তথ্য পাওয়া গেছে । ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘হিডেন ইন প্লেইন সাইট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রদান করা হয়েছে। ১৯০ টি দেশ থেকে এই গবেষণার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারের এত উদ্যোগ এত আইন থাকা সত্ত্বেও এই অবস্থা চরম উৎকন্ঠার বিষয়। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯, যোৗতুক নিরোধ আইন ১৯৮০, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩), এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২ (সংশোধনী ২০১০), নারীর প্রতি সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, জাতীয় নারী নীতি ২০১১, মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম, আরো কত শত দেশী-বিদেশী উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগ কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না এই নারীর প্রতি সহিংসতা। এক ধরনের সহিংসতা কমলেঅন্য ধরনের সহিংসতা বেড়ে যায়। কিন্তু কেন? গবেষণায় বলা হচ্ছে স্বামী বা সঙ্গীর নিপীড়নের ক্ষেত্রে এশিয়ারদেশগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। আর দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবার শীর্ষে। একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ, বন্ধু যাই বলি না কেন সেটা হলো তার স্বামী/স্ত্রী। আর সেই সম্পর্কের জায়গাতেই সমস্যার শীর্ষে আমরা। কিন্তু কেন? বিষয়টা ভাবনার উদ্রেক নিশ্চয়ই করবে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে ২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ শিশু-কিশোরের (১৯ বছর পর্যন্ত) মধ্যে একজন হত্যাকান্ডের শিকার হয়। এতো শুধু শিশু-কিশোরের হিসাব। সকল বয়সের নারীর উপর সহিংসতার গবেষণা করলে এর হার আরো বহুগুণেবেড়ে যাবে।
অধিকার নামে একটি মানবাধিকার সংস্থার এক গবেষণায় দেখা যায় শুধুমাত্র ২০০৯ সালেই ৪৫৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয় এর মধ্যে ২১১ জন পূর্ণ বয়স্ক নারী আর ২৪৩ জন শিশু। নারীর প্রতি সহিংসতার অনেকগুলো ধরনের মধ্যে এই একটির দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পারি যে এর রূপ কত ভয়াবহ। প্রতিদিন ১.২৪জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিট আব পপুলেশন রিসার্স এন্ড ট্রেনিং (নিপোর্ট) কতৃক ২০০৭ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে প্রায় ৬০ ভাগ নারী বিবাহিত জীবনে তার পরিবারে স্বামী কতৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। ২০০৬ সালে আইসিডিডিআরবি কতৃক পরিচালিত অপর এক গবেষণায় দেখা যায় বাংদেশের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ভাগ নারী বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়। নির্যাতনের শিকার নারীদের সহায়তা দানকারী একটি এনজিও ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের হিসাব মতে নারীরা যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় তার ৭০ ভাগই ঘটে নিজেদের পরিবারের মধ্যে। এরকমই হলো আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র। সুতরাং এসকল তথ্য এবং বর্তমান সময়ের গণমাধ্যমের খবরগুলোই আমাদের জানিয়ে দেয় যে আমাদের সমাজের চিত্র কি ভয়াবহ? এই সামাজিক এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নারীর অবস্থা কতটা নাজুক তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক এক আলোচনায় একদিন একজন সাংবাদিক বলছিলেন যে, নারীর প্রতি সহিংসতার খবরটা হলো গৌণ খবর। যে সময় রাজনীতির মাঠ অতটা গরম না থাকে সেসময় এই খবরগুলো গণমাধ্যমে বেশি প্রাধান্য পায়। উনার কথাটা উপেক্ষা করবার মতো নয়। কারণ রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হলে এই খবরগুলো এবং আন্দোলনগুলো যে চাপা পড়ে যাবে এটা খুব অমূলক কথা নয়। হাজারো অঘটনের দেশ এই বাংলাদেশ। প্রতিদিনই এখানে এত দুর্ঘটনা আর দুঃসংবাদ থাকে যে, আজকের ঘটনাটি গতকালের ঘটনাকে চাপা দিয়ে দিতে বাধ্য করে। তাই এখানে অন্যায় করে পার পাওয়াটাও খুব সহজ। আর নারীর প্রতি সহিংসতা তো আমাদের সমাজে ডালভাতের মতো। এখানে প্রায় প্রতিটি পরিবারের ভেতরে এই সহিংসতা বিরাজমান। আবার জীবনে একবারও রাস্তা-ঘাটে, শিক্ষাক্ষেত্রে অথবা কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের শিকার হননি এরকম নারী বোধ করি একজনও খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
রাষ্ট্র অবশ্য এই সকল বিষয়কে বিচ্ছিন্ন ঘটনাই মনে করে বলে ধারণা করা যায়। কিছু কিছু ঘটনায় স্থানীয়ভাবে বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও সামগ্রিকভাবে সরকারকে এই ঘটনাগুলো কোনভাবেই নাড়া দেয়না। তাই প্রতিদিন চলন্ত বাসে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে অর্থাৎ ঘরে-বাইরে সকল জায়গায় কোন না কোন নারী অথবা শিশুর ধর্ষণের খবর প্রকাশের পর এমনকি গত কয়েক মাসের নাজুক পরিস্থিতির পরও সরকারের কোন তরফ থেকে কোন উৎকষ্ঠা প্রকাশ করা হয়না, সামগ্রিক কোন ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়না কখন ধরেই নেওয়া যায় এসকল ঘটনায় সরকারের তেমন মাথা ব্যাথা নেই। যদিও অনেক ব্যক্তি এবং সংগঠন নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছেন। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ জোট স্থানীয়ভাবে হরতালের ডাকও দিয়েছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে হচ্ছে। ব্যক্তি এবং সংগঠন যারা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তারাও একত্রিত নন। ফলে এই আন্দোলন থেকে পজিটিভ রেজাল্ট পাওয়াটা খুবই মুশকিল। অনেকেই কাজ করে যাচ্ছেন নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে। কিন্তু যে যার মতো করে। কিছু কিছু জোট তৈরি হয়েছে সেগুলোও আবার ইস্যুভিত্তিক। নারীর প্রতি সহিংসতা করেন এমন পুরুষের সংখ্যা বাংলাদেশে খুব কম নয়। তারা সংখ্যায় অনেক। এই অনেককে মোকাবেলার জন্য এই সহিংসতা প্রতিরোধে যারা কাজ করেন তাদের একত্রিত হওয়া জরুরী। চেতনার জায়গাগুলো পরিষ্কার করা জরুরী। অন্যায়কে সমাজ থেকে তাড়াতে হলে সমাজের যে সকল জায়গাগুলো নারীর প্রতি সহিংসতা সৃষ্টিতে উৎসাহ যোগায় তার প্রত্যেকটি অনুঘটককে ‘না’ বলাটা জরুরী। কারণগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়না। একটি কথা হয়তো অনেকেই মানতে চাইবেন না যে, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের সামাজিক সম্পর্কটি হল শতভাগ ক্ষমতার সম্পর্ক। এখানে পুরুষ ক্ষমতাবান আর নারী ক্ষমতাহীন। ক্ষমতাহীনকে আরো ক্ষমতাহীন করা অথবা ক্ষমতাবানে ক্ষমতা জাহির করা যেকোন একটি অথবা দুটি কারণের মিলনেই সংঘটিত হয় এই নারীর প্রতি সহিংসতা। সমাজ বিজ্ঞানী মিশেল ফুঁকো বলেছিলেন, যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানেই প্রতিরোধ আছে। পুরুষের দীর্ঘদিনের ক্ষমতা কাঠামো এবং ক্ষমতার চর্চাকে ‘না’ বলাটাকেই এই নারীর প্রতি সহিংসতার অন্যতম মূল কারণ বলেই আমরা ধরে নিচ্ছি। আমরা যারা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করি তারা গৎবাঁধা লাইনের বাইরে যেতে পারিনা। ক্ষতস্থানকে ভেতর থেকে উপশমের ব্যবস্থা না করে উপরে মলম লাগাই। তিন থেকে ছয়মাস ভাল থাকে তারপর আবার আগের মতো হয়ে যায়। অধিকার আদায়ের জন্য এখানে সংগ্রাম করাটা জরুরী। এই সংগ্রামে অনেকেই শত্রু শিবিরে অবস্থান নিবে। তাদেরকে মোকবেলা করতে হবে। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাটা অনেক কঠিন কাজ। এই কঠিনকে জয় করতে পারলেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। এই কাজে নারীকে ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন করতে হবে আর সহযোগী পরিবর্তনকামী পুরুষ থাকবে তাদের পাশে। তাহলেই এই সংকট উত্তরণ করা সম্ভব। আর এই সংগ্রামে অবশ্যই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। এই উদ্যোগটি শুধুমাত্র সমাজের কোন বিশেষ শ্রেণীর একার উদ্যোগ হলে চলবেনা। এখানে সমাজকর্মী এবং রাজনীতিকদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ সমাজ সংস্কারের অথবা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন রাজনীতিকদের সদিচ্ছা এবং সমাজকর্মীদের প্রচেষ্টা এই দুটোর সমন্বয় হলেই কাঙ্খিত ফল লাভ করা সম্ভব আর বিলোপ করা সম্ভব নারীর প্রতি সহিংসতা নামক নোংরা অধ্যায়ের। এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে হবে এখনই, কারণ সহিংসতা এখন যেকোন সময়ের চেয়ে চরমে।
১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:১১
কবীর মামুন বলেছেন: ধন্যবাদ @ বিজন রয়
©somewhere in net ltd.
১|
১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৯
বিজন রয় বলেছেন: ভাল লিখেছেন।
++।