নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কবীর মামুন

কবীর মামুন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আলফ্রেডের মৃত্যু হিমালয়সম!

১৮ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:৪৭

রেবেকা সরেন আমার সহকর্মী ছিল। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে অফিসের একটা প্রোগ্রামে একসাথে বসে আলফ্রেড সরেনের উপর একটি ডকুমেন্টারি দেখছিলাম। হঠাৎ পাশ থেকে হাউমাউ করে কান্নার আওয়াজ আসলো।আলফ্রেড সরেনের ছোট বোনই যে রেবেকা সরেন। সেই কান্নার আওয়াজ আজো মনে পড়ে। ১৮ আগস্ট এলে মনে পড়ে যায় আলফ্রেডকে। মনে পড়ে যায় আলফ্রেডের পরিবারের সদস্যদের অশ্রুভেজা নয়ন।

২০০০ সালের ১৮ আগস্ট সকালে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে মধ্যযুগীয় কায়দায় নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করে স্থানীয় ভূমিদস্যু গদাই লস্কর, হাতেম ও তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। এই হামলায় সমতলের আদিবাসীদের ভূমি আন্দোলনের নেতা আলফ্রেড সরেনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেদিনের সেই হামলায় নারী ও শিশুসহ আহত হয় আরো ১৭ জন। ভীমপুরের আদিবাসীদের কাছে দিনটি ভয়াল দিন হিসাবে চিহ্নিত। সেই দিনের কথা মনে হলে আজও তাদের শরীর শিউরে উঠে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে গ্রামবাসী প্রত্যক্ষদর্শীরা। ঘটনার বিচার কে করবে তা আজও বুঝে উঠতে পারেনি আলফ্রেডের স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন এবং গ্রামবাসীরা। এর শেষ কোথায় তা তারা জানে না।

আমি দেখেছি সে হাহাকার, শুনেছি সে কান্নার রোল। আলফ্রেডের ভাই মহেশ্বর আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিল সেদিন, কোথায় বিচার পাবো দাদা? সেদিন ছিল ১৮ আগস্ট ২০০৯। বৃষ্টিতে কাদা হয়ে গিয়েছিল ভীমপুরে যাবার রাস্তা। শান্তনা দিতে পারিনি। ওটা দেবার ভাষা আমার জানা নেই। সরকার আদিবাসীদের নাম দিয়েছে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’। কি উদ্ভট! জনসংখ্যার অনুপাতে ওরা যদি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হয় তবে কি বাঙ্গালি চীনের জনসংখ্যার অনুপাতে নিজেদেরকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসাবে মেনে নিবে? সরকার মানলে মানতে পারে কিন্তু বাঙ্গালি হিসাবে আমি এটা মানতে রাজি নই। এধরনের ক্ষমতাতান্ত্রিক হিসাব মেনে চলার কোন যোগ্যতাই আমার নাই। তাই সংবিধানের পঞ্চদশ অনুচ্ছেদের এই সংশোধনী গ্রহণের পক্ষে আমি নই। বাঙ্গালি ছাড়াও ৪৫টিরও অধিক ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময়তায় সমৃদ্ধ আমাদের সমতল ও পাহাড়ের এলাকা। তারা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক সত্তার অধিকারী। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে তাদের মৌলিক মানবাধিকারগুলো সুরক্ষিত থাকবে এটাই কাম্য। কিন্তু সমতল থেকে পাহাড়ে প্রায় প্রতিদিনই নিগৃহীত-লাঞ্ছিত-বঞ্চিত হচ্ছে কোন না কোন আদিবাসী। ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে তারা। শিকার হচ্চে ধর্ষণের। এ ধরনের আগ্রাসন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে গিয়ে জীবনও দিতে হচ্ছে কখনো কখনো।

কল্পনা চাকমা কিংবা পীরেন স্নাল অথবা আলফ্রেড সরেন কোন আদিবাসী হত্যার বিচার এখনো হয়নি। বিচার চেয়েও পাওয়া যায়নি। প্রতিবছর ১৮ আগস্টে জড়ো হয় ভীমপুরের আদিবাসীরা। বিচার চায়। তাতে কোন ফল হয় না। এরই মধ্যে চলে গেল ১৬টি বছর। আদিবাসীদের জমিগুলো আজও গদাই লস্করের দখলে। দখলদার হত্যাকারীরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ভীমপুরের আদিবাসীদের হুমকি দিয়ে যায় অনবরত। বিচার আজও হয়নি। কবে হবে কেউ জানে না। এই কি হবার কথা ছিল স্বাধীন দেশে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি এমন বিচারহীনতা? প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হলো যাকে তার বিচার হবে না এটা কোন সংস্কৃতির অংশ? ২০১০ সালের ১৮ আগস্ট আলফ্রেডের সমাধির সামনে আয়োজিত সভায় আলোচক হিসাবে দাবি তুলেছিলাম, মহাদেবপুরের নওহাটা মোড়ের নামকরণ ‘আলফ্রেড সরেন চত্ত্বর’ করা হোক। আজও সেই দাবি তুলছি। পাশাপাশি সরকারের নিকট অনুরোধ জানাচ্ছি, আলফ্রেড হত্যাকান্ডের বিচার যেন দ্রুত ত্বরান্বিত হয়।

বাংলাদেশের পাহাড় এবং সমতলের সব আদিবাসীই ভূমির সাথে সম্পৃক্ত। তাদের জীবন-জীবিকা-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সবই জড়িয়ে আছে ভূমির সাথে। ভূমিগ্রাসীদের আগ্রাসনে দিনে দিনে সেই ভূমি হারিয়ে তারা হয়ে পড়ছে প্রান্তিকেরও প্রান্তিক। ভূমির মালিকানা না থাকবার ফলে তাদের সংস্কৃতিও হারাতে বসেছে সমতলের আদিবাসীরা। ফলে রাষ্ট্রের সংস্কৃতির বৈচিত্র্যও বিলীন হচ্ছে দিনে দিনে।

সমতলের আদিবাসীদের ভূমির অধিকারের দাবিতে একত্রিত করেছিল আলফ্রেড সরেন। তাই ভূমিগ্রাসীদের প্রধান বাধা ছিল আলফ্রেড। তারা ভেবেছিল আলফ্রেডকে সরিয়ে দিতে পারলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে রাস্তা। তখন আর তাদের ভূমি দখলের উৎসব ঠেকায় কে? সেদিন সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত আলফ্রেড নিজের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলেও সেখান থেকে তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল তারা। যাতে আলফ্রেডের মৃত্যুর সাথে সাথে অন্যরাও এই আন্দোলন থেকে সরে যায়। সন্ত্রাসীরা এভাবেই ভাবে। তারা মনে করে মানুষকে ত্রস্ত করে দমিয়ে রেখে নিজেদের মতলব হাসিল করবে। কিন্তু অধিকারের সংগ্রামকে কখনো চিরতরে নিঃশেষ করা যায় না। সংগ্রাম টিকেই থাকে। আলফ্রেডের সংগ্রামও হারিয়ে যায়নি। হাল ছেড়ে দেয়নি ভূমিহীন আদিবাসীরা। শুধু আদিবাসী নয়, ভূমির অধিকার অর্জনে বাঙ্গালি ভূমিহীন প্রান্তজন অথবা পৃথিবীর যে প্রান্তে যে লড়ে যাচ্ছে তাদের নিকট আলফ্রেড একটা আদর্শ, একটা চেতনার নাম। আলফ্রেডের মৃত্যু হিমালয়সম!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.