![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জুন ৩০, ১৮৫৫ সাল। সেদিন জেগে উঠেছিল সাঁওতালরা। সাঁওতালদের নিজেদের অস্তিত্বের সংগ্রামে সেদিন কেঁপে উঠেছিল ভারতের বৃটিশরাজ। সাঁওতাল হুল হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় দোসর, শোষক, সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। সাওতাল বিদ্রোহে সিদু, কানহু, চাঁদ ও ভায়রো এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে সাঁওতালসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই সাঁওতাল বিদ্রোহই ছিল প্রথম কোনো সংগঠিত প্রতিবাদ। বিদ্রোহে ওই এলাকার দরিদ্র বাঙালি ও হিন্দু মুসলমান কৃষকেরাও অংশ নেন।
বৃটিশ শাসনামলে ভারতের দামিন-ই-কোহ অঞ্চলের কটক, ডালভূম, মানভূম, ছোটনাগপুর, পালামৌ, হাজারীবাগ, মেদনীপুর, বাকুরা, বীরভূম জেলায় সাঁওতালদের বসবাস বেশী ছিল। সেখানে বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ করে বেশ শান্তিতেই সাঁওতালরা বসবাস শুরু করেছিল। যে যতটুকু চাষাবাদ করতে পারে জমির উপর তার ভাগ ততটুকুই ছিল। আজকের মতো জমির কোন মালিকানার প্রয়োজন তখন ছিলনা। এক ধরনের সমষ্টিগত বা সামাজিক মালিকানা এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ও সৌহার্দ্যই ছিল সে সময়ের বড় দলিল। কিন্তু সাঁওতালদের এই সুখ-শান্তির উপর ব্রিটিশ সরকার ও তার দেশীয় দালালদের চোখ পড়ে যায়। জমিদারি প্রথা চালুর মধ্য দিয়ে জমির উপর খাজনা বসিয়ে দেয় ব্রিটিশ সরকার। দলে দলে ব্যবসায়ীরা ঐ অঞ্চলে ঢুকে পড়ে এবং ব্যবসার নামে সাঁওতালসহ অন্য আদিবাসীদের ঠকাতে শুরু করে। শুধু তাই নয় সুদখোর মহাজনদের খপ্পড়ে পড়ে সাঁওতালরা ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আর একবার যে ঋণ নিয়েছে সে কোনদিনই সেই ঋন পরিশোধ করতে পারেনি। ঋণের বোঝা চক্রবৃদ্ধি হারে শুধু বেড়ে গেছে। ঋণের দায় মেটাতে শেষ পর্যন্ত সাঁওতালদের ক্রীতদাসের জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সাঁওতাল নারীদের ওপর ব্রিটিশ রাজপুরুষ ও জমিদার-মহাজনদের পাশবিক অত্যাচার ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই ধরনের ঘটনাগুলো শুধু সাঁওতালদের ক্ষেত্রেই ঘটেনি বরং সেখানকার সকল নিম্নবর্গের মানুষের উপরই এমন অত্যাচার চালানো হয়েছে। মূলত সেদিনের সেই জুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবার জন্যই ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সিদু, কানহু, চাঁদ, ভায়রো এবং তাদের দুই বোন ফুলমনি মুর্মু ও ঝানো মুর্মুদের আহ্বানে ৪ শতাধিক গ্রামের প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল ভারতের দামিন-ই-কোহ অঞ্চলের বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের ভগনাডিহি গ্রামে জমায়েত হয়েছিল এবং ব্রিটিশ সরকার ও তাদের দেশীয় দালালশ্রেণি জমিদার, সুদখোর, মহাজন, ব্যবসায়ী, কন্ট্রাকটর, পুলিশ, ভূমি অফিসারের কর্মচারি এবং বরকন্দাজদের জুলুম-অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তির সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল। স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে ন্যায্যতার গণজাগরণ সৃষ্টি করে সাঁওতালসহ অন্য আদিবাসী নিম্নবর্গীয় মানুষেরা বিদ্রোহের শপথ পাঠ করেছিল। এই বিদ্রোহই ইতিহাসে সান্তাল ’হুল’ নামে পরিচিত। প্রায় দুই বছরব্যাপী চলে এই বিদ্রোহ। পরবর্তীতে বিদ্রোহী নেতৃত্বকে খুঁজে বের করে ফাঁসি দিয়ে বিদ্রোহ দমন করে ব্রিটিশ সরকার। সাঁওতাল বিদ্রোহে অন্ততঃ ৩০ হাজার সাঁওতালকে হত্যা করা হয়েছিল।
১৯৭৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সাঁওতালসহ ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষকদের অধিকারে প্রথম আঘাত আসে। সেসময়ে সাঁওতাল কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের মাধ্যমে ভূমির সাথে তাদের সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ানো হয়েছিল। যার মধ্য দিয়ে কৃষকদের জমির একচ্ছত্র মালিক হয়ে ওঠে রাষ্ট্র। আদিবাসী জ্ঞান, ভূমির সাথে গড়ে ওঠা জনগণের ঐতিহাসিক সামাজিক মালিকানার পরিবর্তে সৃষ্টি হয় ব্যক্তি মালিকানা। জমিদার-জোতদারদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে তারা। যার ফলাফল ছিল ঐ সান্তাল বিদ্রোহ বা হুল।
বৃটিশ রাজ গেছে, বিদায় নিয়েছে পাকিস্তানি শোষণ। স্বাধীন বাংলাদেশেও সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসীদের উপর নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়নি নিম্নবর্গের মানুষর উপর শোষণ-পীড়ন। আজও আদিবাসীদের জমি জবর দখল হচ্ছে প্রতিদিনই। জাল দলিল, মামলা, হামলা, ভয় দেখিয়ে, হত্যা করে, ধর্ষণ করে আদিবাসীদের উচ্ছেদের মাধ্যমে তাদের জমি দখল করা হয় এখনো। ভূমিপুত্ররা এখানে শস্য উৎপাদনের সাথে যুক্ত অন্যতম জনশক্তি হওয়ার পরও জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হতে আজ ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সালে এসে সাঁওতালসহ বাংলাদেশের ৪৫টিরও অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় অবস্থার মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য নেই বললেই চলে। আদিবাসীরা আগেও শোষিত ছিল, এখনো আছে। এখনও তাদের উপর চলছে নানা রকম জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যার মত জঘন্য ঘটনা। প্রতিনিয়ত ভূমি দখল ও হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে এ দেশের আদিবাসীরা। পুরুষদের চেয়ে আরো নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে আদিবাসী নারীরা। প্রতিনিয়ত তারা হত্যা, ধর্ষণ, শারীরিকভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। বিচার কিন্তু হচ্ছে না কোন অপরাধেরই।
উপর আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে আত্মপরিচয়ের দাবিকে অস্বীকার করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধীনতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে আদিবাসীদের আখ্যায়িত করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬ (২)-
‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।’
এই অনুচ্ছেদ হতেই বুঝা যায় যে বাঙালি তার দেশে অন্য অন্যকোনো জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকারে স্বচ্ছন্দ নয়। এই রাষ্ট্র ১৯৭২ সালেই বাঙালি ছাড়া অন্যদেরকে অস্বীকার করেছিল। বঙ্গবন্ধু নিজেই পাহাড়ি আদিবাসী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে বলেছিলেন, ‘তোরা বাঙালি হয়ে যা।’ পঞ্চদশ সংশোধনীতেও তাদেরকে ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃ-গোষ্ঠী’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩ (ক)- ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা , নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ এই অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে অনেকেই বলেন, রাষ্ট্র তাদেরকে স্বীকৃতি তো দিয়েছেই। আদিবাসীদের জন্য ব্যবহৃত ‘উপজাতি’, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃ-গোষ্ঠী’ প্রভৃতি প্রত্যয়গুলো নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। একটি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীকে কেন উপজাতি হিসাবে আখ্যা দেওয়া হবে? পৃথিবীর সকল জাতিই কোনো না কোনো নৃ-গোষ্ঠীর অন্তর্গত। তাহলে কেন কাউকে ক্ষুদ্র হিসাবে বিবেচনা করা হবে? কে ক্ষুদ্র আর কে বৃহৎ এই ধারণা তৈরি করা হয় শুধুমাত্র ফায়দা হাসিলের জন্য। এগুলো আসলে উৎপীড়নের কৌশল। ক্ষমতাবানরা এভাবেই ‘হেজিমনি’ তৈরি করে এবং নানান কায়দা-কানুন করে নিপীড়ন চালাচ্ছে।
সাঁওতাল হুল হতে পারে আমাদের প্রেরণার উৎস। সাঁওতাল বিদ্রোহের শহীদ কৃষক-শ্রমিক জনতার নেতৃত্ব সিদু-কানহু-চাঁদ-ভায়রো-ফুলমনি-ঝানোর সংগ্রাম সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৬০-৬১ সালে নীল চাষিদের বিদ্রোহ, বর্তমান বাংলাদেশে (পাবনা ও বগুড়া) ১৮৭২ সালে ঘটে যাওয়া রায়ত অভ্যুত্থান, ১৮৭৫-৭৬ সালে দাক্ষিণাত্যের মারাঠা কৃষকদের অভ্যুত্থান, ১৯৪৬-৪৭ সালে বর্তমান বাংলাদেশের নাচোলের তেভাগা আন্দোলনসহ ইতিহাসের অন্যান্য কৃষক আন্দোলনও সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে প্রেরণা পেয়েছে। আজও আমাদের দেশে সংগ্রাম চলছে ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের। প্রতিনিয়ত মানুষ শিকার হচ্ছে নিপীড়নের। খুন-ধর্ষণ, হত্যা, রাহাজানি, সন্ত্রাস এদেশে নিত্যদিনের ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনা কাঙ্খিত নয় কখনোই। স্বপ্নের সেই বাংলাদেশে, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সেই দেশ গঠন করতে হবে আমাদের। তাই জাগতে হবে মানুষকে। রুখে দিতে হবে সকল অন্যায়কে। প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের। আর সেক্ষেত্রে সিদু-কানহু’র এই সাঁওতাল হুল হতে পারে আমাদের প্রেরণা।
০১ লা জুলাই, ২০১৭ রাত ১২:৩৬
কবীর মামুন বলেছেন: ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে জুন, ২০১৭ রাত ১১:৫৭
চাঁদগাজী বলেছেন:
সব যুগে কিছু বুদ্ধিমান ও ভালো মানুষ সবার হয়ে লড়ে যান।