![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চারদিকে শুধু শুকনো মাটি আর ফাটা ধরা জমি। রাফি দাঁড়িয়ে আছে তার ছোট্ট জমির মাঝখানে। বরিশালের কাউনিয়ার এই গ্রামে বর্ষা এবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আকাশ নীল, কিন্তু মেঘের ছায়া নেই। জমিতে ধানের চারা শুকিয়ে খড় হয়ে গেছে। একটা কাকও উড়ছে না। শুধু ধুলো আর বাতাসে শুকনো পাতার শব্দ। রাফি হাত দিয়ে একটা শুকনো গাছ ছুঁলো। মুখে বিড়বিড় করে বলল, “মাটিতে রস নেই, হায় জননী, তুমি কি শুকিয়ে গেলে?”
দূরে তার ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির পাশে আমগাছটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তবে পাতা ঝরে গেছে। রাফির বউ তানিয়া সকালে বেরিয়েছে বরিশাল শহরে। কিছু কাজের সন্ধানে। ঘরে চাল-ডাল ফুরিয়ে এসেছে। তানিয়া বলে গেছে, “আমি না গেলে কী খাবে তুমি আর রিমি? পেটের জ্বালা ঢাকা যায় না।” রিমি, তাদের ছোট্ট মেয়ে। মাত্র ছয় বছর বয়স। রাফি ভাবে, রিমির জন্যই তো এই লড়াই।
জমির এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে আজিজ মিয়া। গ্রামের বড়লোক। সে এসেছে রাফির জমির খড় কিনতে। হাতে একটা লাঠি, গায়ে ফতুয়া, আর মুখে হাসি। “রাফি ভাই, এই খড় আর কী কামে লাগবে? পাঁচ কেজি চাল দিচ্ছি, বেচে দাও। গরুতে খাবে না এই শুকনো খড়।” রাফি দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। আজিজ আবার বলল, “দেখো, আকাল আসছে। এখন বেচে দিলে হাতে কিছু থাকবে। পরে তো সব নষ্ট হয়ে যাবে।”
রাফির মনে ক্রোধ জ্বলে উঠল। “আমার জমি আমি বুঝি না? তুমি চোখ দিও না, আজিজ। তোমার চোখের নজরে সব ভাগাড় হয়ে যায়।” আজিজ হেসে উঠল, “আচ্ছা, আচ্ছা, ভেবে দেখো। আমি তো ভালোর জন্যই বলছি।” বলে সে লাঠি ঠুকে হাঁটা দিল।
রাফি জমির মাঝে বসে পড়ল। হাতে একটা শুকনো ধানগাছ। সে ভাবে, এই জমি তার বাপ-ঠাকুরদার আমানত। এখানে ধান ফলত, মুগ ডাল হতো, তিলের আবাদ হতো। এখন শুধু খড় আর ধুলো। দূরে রিমি ছুটে আসছে। খালি পায়ে, পরনে একটা ফ্রক। “বাবা, খিদে পেয়েছে। মা কখন আসবে?” রাফি মেয়েকে কোলে তুলে নিল। “আসবে, রিমি। মা তোর জন্য পড়তে-লেখতে পিঠা আনবে।”
রিমির চোখ বড় বড়। “বাবা, মাটি এমন শুকনো কেন?” রাফি হাসল, “জল হলে ঝাড় খেলবে। দেখিস, আবার সবুজ হয়ে যাবে।” কিন্তু তার বুকের ভেতর তরাস। আকাশে মেঘ নেই। নদীর জল শুকিয়ে গেছে। কাউনিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কীর্তনখোলা নদী এখন শুধু বালি আর কাদা।
সন্ধ্যা নামল। তানিয়া ফিরল। হাতে একটা থলি। “দুই কেজি চাল আর একটা ডালের প্যাকেট পেয়েছি। কাল থেকে একটা দোকানে কাজ শুরু করব।” রাফি তাকাল তানিয়ার দিকে। “তুই এত দূর যাবি? রিমি কী করবে?” তানিয়া জবাব দিল, “তোমার জমি আর আমাকে খাওয়াতে পারছে না। আমি না গেলে কী খাবে? ইজ্জত দিয়ে পেট ভরে না।”
রাতে রাফি ঘুমাতে পারল না। বাইরে উত্তরের হাওয়া বইছে। শীত আসছে। সে উঠে জমিতে গেল। রিমি ঘুমিয়ে আছে। জমির মাঝে দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকাল। “জল দে মা, একটু জল দে।” হঠাৎ দূরে একটা শকুন উড়তে দেখা গেল। রাফির বুক কেঁপে উঠল। “আকাল আসছে।” সে বিড়বিড় করে বলল।
পরদিন সকালে আজিজ আবার এল। “রাফি ভাই, দশ কেজি চাল দিচ্ছি। খড়টা বেচে দাও।” রাফি চুপ। তানিয়া পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “দিয়ে দাও। ঘরে কিছু নেই। রিমি কী খাবে?” রাফির মনে যুদ্ধ। শেষে সে বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু জমি আমার থাকবে।” আজিজ হাসল, “ঠিক আছে, ভাই।”
রিমি এসে বলল, “বাবা, তুমি কাঁদছ?” রাফি মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। “না রে, আমি আছি না। তুই আছিস। জল হলে আবার আবাদ হবে।” কিন্তু তার চোখে জল। আজিজ চলে গেল। খড় নিয়ে গেল। রাফি ভাবল, “আমার জননী, তুই কি আমাকে ছেড়ে দিলি?”
দিন গেল। তানিয়া কাজে যায়। রাফি জমিতে বসে থাকে। রিমি খেলে। একদিন রিমি এসে বলল, “বাবা, ওই দেখ, শকুন!” রাফি তাকাল। আকাশে দুটো শকুন ঘুরছে। সে রিমিকে কাঁধে তুলে নিল। “ভয় পাস না। আমি আছি। তুই বড় হবি। এই মাটি আবার ফল দেবে।” কিন্তু তার গলা ভারী।
শেষে একদিন বৃষ্টি এল। ছিটেফোঁটা। রাফি জমিতে ছুটল। রিমি লাফাল। “বাবা, জল!” রাফি হাসল। “দেখলি, মা শুনেছে।” তানিয়া ফিরে এল। “আবাদ হবে। আমরা বাঁচব।” রাফি ভাবল, আকাল এলেও তার রিমি আছে। মাটি আছে। আশা আছে।
শকুন উড়ে গেল। জমিতে জলের গন্ধ। রাফি বলল, “এই মাটি আমার জননী।”
©somewhere in net ltd.
১|
২৮ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:৩১
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর গল্প।