নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৃষ্টিসুখের উল্লাসে

মোঃ ইয়াসির ইরফান

পৃথিবীর সব রাজনীতিবিদ যদি কবিতা ভালোবাসতেন অথবা সব কবি যদি রাজনীতিবিদ হতেন তাহলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর ও বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারত। -জন এফ কেনেডী

মোঃ ইয়াসির ইরফান › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ ছোঁয়াচে ভালোবাসা

০১ লা অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৬



এক.
বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে বলেই হয়তো খুকুমণি বড় আহলাদি হয়েছে। এই নিয়ে ছয় বছরে পড়লো। কিন্তু অতি আদর-সোহাগে যেন মনে হয়, এখনো তার তিন-চার বছর বয়স। বাবার সাথে ভাব তার গলায় গলায়। আহলাদটাও তাই বাবার সাথেই বেশী। বৃষ্টি পড়বে মনে হচ্ছে। মাকে লুকিয়ে বাবার সাথে ছাদে যাবে, বৃষ্টিতে ভিজবে এসব বলার জন্য বাবার কাছে ছুটে আসে খুকুমণি। ‘আব্বু শোন’ বলে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায় খুকুমণি। তার আব্বুকে সে কখনো এমন অবস্থায় দেখেনি। ভীত গলায় সে জিজ্ঞেস করে, ‘আব্বু, কি হয়েছে তোমার?’
ইহসান মেয়ের দিকে তাকায়। আরো ভয় পেয়ে যায় খুকুমণি। ধীরস্বরে বলে, ‘মা, তোর মাকে গিয়ে বল, ব্যাগ গোছাতে। আমরা এখনই গ্রামের বাড়ি যাবো।’
এই খবর ‘বার্তাবাহক’ খুকুমণির মাধ্যমে ইহসানের স্ত্রী সুমাইয়ার কান অবধি পৌছল। আর খবরটা শুনতেই তেলে জল পড়ার মতোই ছ্যাৎ করে উঠল সুমাইয়া। উঠারই কথা। সে তখন কড়াইতে তেলই ঢালছিল। চুলার আগুন আর কড়াইয়ের উত্তাপ সব নিয়ে ইহসানের সামনে এসে দাঁড়াল সুমাইয়া। ‘কি শুনছি, এসব? তুমি নাকি বলছ যে... ’ কথা শেষ করা হয়ে উঠে না সুমাইয়ার। ইহসানের দিকে তাকাতেই তার সব উত্তাপ-আগুনে কে যেন বালতি বালতি জল ঢেলে দিল। কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও হয় না। শুধু আস্তে করে বলে, ‘হ্যাঁ যাচ্ছি। কখন রওনা হবো আমরা?’
‘এখন।’ ছোট্ট করে জবাব দেয় ইহসান।
জবাব শুনেই দ্রুতপদে ব্যাগ গোছাতে চলে যায় সুমাইয়া।
কিন্তু কি ছিল ইহসানের চোখে-মুখে, চেহারায়? যা দেখে খুকুমণি ভয় পেয়ে যায়? সুমাইয়ার মতো তেজস্বী রমণীও চুপসে যায় এক পলকে? গ্রামে যাওয়ার কথা উঠলেই যে সুমাইয়া সবসময় বেঁকে বসে, সে-ই বিনা বাক্যে গ্রামে যাওয়ার জন্য গোছগাছ গুরু করে দেয়?
বলা কঠিন, কি ছিল! বিধাতা মনে হয় সে ভাষা বোঝার সক্ষমতা কাউকে দেননি। তবে সেটা যে ভয়ংকর কিছু সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। সে জন্যেই হয়তো, ইহসানের স্ত্রী-কন্যার অমন আচরণ! তার মানে ভাষাটা পুরো বোধগম্য না গেলেও অনুধাবন করা যায় হয়তো!
নিজের মুখাবয়বের ভয়ংকর গতি প্রকৃতির কথা ইহসানের জানার কথা নয়। তাই সে এটাও জানে না, কেন সুমাইয়া কোনরুপ প্রতি আক্রমণ ছাড়াই গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য অনায়াসে রাজী হয়ে গেছে। অন্য সময় হলে হয়তো সে এসব নিয়ে ভাবতো, গভীরভাবে ভাবতো। চেষ্টা করতো পেছনের কারণ খুঁজে বের করার। কিন্তু ইহসান এখন অতসব ভাববার মতো অবস্থায় নেই।
কেমন এক ঘোরের মধ্যেই বাসা থেকে বেরিয়ে, গ্রামের বাড়ি যাওয়ার বাসে উঠে বসে সে। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে জীবন্ত দৃশ্যের মতো ভেসে উঠে একটি ছবি...।

দুই.
অতি অল্প বয়সেই ইহসান তার বাবাকে হারিয়ে ফেলেছিল। মিথ্যা-অভিযোগে দন্ড পেয়ে সরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তার পদ থেকে চাকরিচ্যুত হন তিনি। হতে পারে, অভাবের তাড়না সইতে না-পেরে অথবা অন্য যে কোন কারণে, কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যান তিনি । ইহসানের ‘মা’ মনোয়ারা বেগম প্রথম প্রথম অনেক খুঁজেছিলেন। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন, যে মানুষ ইচ্ছে করে হারিয়ে যায়, তাকে খুঁজতে যাওয়া বৃথা। সে ফেরার হলে নিজেই ফিরবে। ইহসান আজও জানে না, তার বাবা বেঁচে আছেন নাকি নেই।
বাবার নিরুদ্দেশ যাত্রার পর থেকেই, মনোয়ারা বেগমের সংসার সংগ্রামের সূচনা। ইহসানের দাদী যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তারা গ্রামের বাড়িতেই ছিল। যেভাবেই হোক জীবন অতিবাহিত করছিল, দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু দাদী যেদিন মারা গেলেন, সেদিন থেকে গ্রামের বাড়িতে থাকাও কঠিন হয়ে গিয়েছিল। রাত-বিরাতে বাড়িতে ঢিল পড়তে শুরু করেছিল। যুবক-বৃদ্ধ সকল পুরুষের অতি দরদ যেন উথলে উঠছিল, স্বামী-শাশুড়িহীন একলা-অসহায় এক নারীর জন্য। সকলেই তার ভাল চায়, তাকে সাহায্য করতে চায়, তবে তাদের এই ভালমানুষির পেছনে কি নোংরা-নির্লজ্জ অভিলাষ ছিল, তা মনোয়ারা বেগম ভালোভাবেই বুঝতেন। তাই আড়াই বছরের শিশু ইহসানকে নিয়ে, বাধ্য হয়ে গ্রামের বাড়ি ছাড়েন তিনি।
যতদূর গিয়েছেন, যতক্ষণ বাড়িটা দেখা গিয়েছে, ততবার বারবার পেছন ফিরে তাদের কুঁড়েঘরটিকে দেখছিলেন তিনি। ইহসানের মনে হয়, যখন তার ‘মা’ বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছিল, তখন সে বাড়ির ছাদের উপর বসে ছিল। আর মাকে জড়িয়ে ধরে যে ছোট্ট একশিশু ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিল, তা যেন স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে সে।
পেছনে কুঁড়েঘর রেখে শিশু ইহসানের মাকে আঁকড়ে ধরা, দৃশ্যটা তার কাছে এত জীবন্ত যে, তার মনেই হয় না ঘটনা ঘটার সময় তার বয়স ছিল মাত্র আড়াই বছর!

তিন.
সুমাইয়া বার কয়েক ইহসানের দিকে তাকায়, বোঝার চেষ্টা করে তাকে। ইহসানের চোখ বন্ধ, ঘুমিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। খুকুমণি কখন যেন কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। ইহসানের কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করে না সুমাইয়া, সাহসে কূলোয় না। যে মূর্তি আজ সকালে সে দেখেছে, তা গত নয় বছরের বিবাহিত জীবনে আর কখনো দেখেনি। কি যে ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ কি এমন ঘটল তার শ্বশুর বাড়িতে? শাশুড়ি কি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? নাকি তিনি... ইয়া আল্লাহ সে আর ভাবতে পারে না, ভাবতে চায় না।
নাহ, তিনি বেঁচে আছেন। অবশ্যই বেঁচে আছেন। সুমাইয়া যেন নিজেকেই শান্ত করার চেষ্টা করে, প্রবোধ দেয়। সে তার স্বামী ইহসানকে ভালোভাবেই চেনে। মা-অন্তঃপ্রাণ ছেলে, ইহসান। অথচ গত দুই বছর ধরে সে মায়ের সাথে দেখা করতে পারেনি। সুমাইয়ার জন্যেই পারেনি। গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা উঠলেই বারবার বেঁকে বসেছে সে। শেষবার যখন ইহসান ‘একা’ গেল তখন শাশুড়ি কিছু একটা হয়তো বলেছিলেন। এরপর থেকে যাওয়ার কথা উঠলে সুমাইয়া বলেছে, ‘তোমার যেতে ইচ্ছে হয় যাও, আমরা যাবো না।’
নীচু স্বরে ইহসান জবাব দিয়েছে, ‘তোমাদের ছেড়ে যাওয়া মানে তো আমার দেহের তিনটি অংশের দুটি রেখে, একটি নিয়ে যাওয়া। ওভাবে যাওয়া বোধহয় আম্মার পছন্দ না। থাক, তোমরা না গেলে আমি আর গিয়ে কি করবো!’
সুমাইয়া বোঝে, ইহসান মায়ের জন্য কতটা অনুভব করে। সুযোগ পেলেই মায়ের কথা বলা শুরু করে দেয়। “আমার আম্মা এই তরকারিটা ভাল রাঁধেন।”
“বুঝলে, একবার কি হলো। ঘরে কোন তরকারি নাই। আম্মা আমাকে বাজার করতে বললেন। আমি তো আলস্য-সম্রাট। আমি বললাম, ‘আম্মা, আপনি তো ম্যাজিক জানেন। কিছু একটা করে ফেলেন না!’ ওমা, খাওয়ার সময় দেখি আম্মা এক আলু দিয়েই তিন ধরণের তরকারী রেঁধে ফেলেছেন! হা হা হা।” এসব বলার সময় ইহসানের মুখে চোখে, এক অন্যরকম ঔজ্জ্বল্য খেলা করে, সুমাইয়া দেখেছে।
সুমাইয়া কিছুতেই ভাবতে পারে না, তার শাশুড়ির কিছু হয়েছে। তাহলে সে ইহসানের সামনে বড্ড ছোট হয়ে যাবে। ভীষণ খাটো হয়ে যাবে সে। সে মনে মনে বলতে থাকে, ‘ইয়া আল্লাহ, এবারের মতো রক্ষা করো!’
ইহসান এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। তবে ঘুমায়নি, জেগে আছে। তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, বুক চাপড়ে আকাশ কাঁপিয়ে, উথাল-পাতাল করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চোখ দিয়ে হু হু করে নোনাজল গড়িয়ে নামতে চাইছে, বন্যার অবারিত জলের মতো। বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে সে।

চার.
যন্ত্র চালিতের মতো দুই হাতে দুই ব্যাগ নিয়ে বাস থেকে নামে ইহসান। একটা রিকশা ডাকে, উঠে পড়ে ব্যাগ সহ। খুকুমণিকে কোলে নিয়ে, পায়ের কাছে দুটি ব্যাগ রেখে রিকশায় বসা বেশ কষ্টসাধ্য। সুমাইয়া অন্য সময় হলে তেজ দেখাত এসবের জন্য। সিএনজির জন্য অপেক্ষা করতে বলতো। কিন্তু এখন কিছুই বললো না। জানে, বলে লাভ হবে না। ইহসান সব করছে ঠিকই, সে আসলে এই জগতে নেই। কোথায় যে আছে বুঝতে পারছে না সুমাইয়া। বুঝতে পারলে কথা বলার চেষ্টা করা যেত।
এক পায়ের উপর খুকুমণিকে কোলে নিয়ে, অন্য পা দিয়ে ব্যাগের একটা পাশ ঠেকিয়ে রেখেছে ইহসান। ইটের রাস্তায় ঝাঁকুনিও খাচ্ছে। তবু যেন ওর কোন বিকার নেই। সামনের দিকে চেয়ে আছে। কোন এক ঘোরের জগতে যেন ডুবে আছে।
ইহসানের মনে পড়ে প্রথম গ্রামে আসার কথা। ইহসান তখন সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তবে বয়সের তুলনায় অনেক পরিণত হয়ে গিয়েছিল, সময়ের তাগিদেই। মনোয়ারা বেগম চেয়েছেন ছেলেকে বাস্তববাদী করে গড়ে তুলতে। সব দুঃখ কষ্টের সাথে তাই পরিচয় করে দিয়েছিলেন সেই ছোট থেকে।
তখন ইটের রাস্তা হয়নি, মেঠো পথে তাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌছতে ভয়ংকর কষ্ট হয়েছিল মা-ছেলের। তবু সে দেখেছিল, মা যেন কি এক খুশীতে উচ্ছ্বল কিশোরীর মতো ছটফট করছিল।

বহু বছর পর তার ‘মা’ গ্রামে আসতে চেয়েছিল সেবার। নানান ঘাত, ঠোকর খেয়ে মনোয়ারা বেগম তখন পোঁড় খাওয়া এক মধ্যবয়সী মহিলা। জীবন সংগ্রামে অনেকটাই সফল। একটা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা তিনি। ছেলেটাকেও মোটামুটি মানুষ করে তুলেছেন ততদিনে।
মনোয়ারা বেগম বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর প্রাপ্য তাকে অর্জন করে নিতে হবে। কেউ তাকে দেবে না। এই দুনিয়াকে যত ‘বিনয়’ দেখাবে, দুনিয়া ভাববে সে দূর্বল, সে অবলা, সে অক্ষম। নিজের সক্ষমতার ব্যবহার তিনি তাই পূর্ণমাত্রায় করেছেন। গ্রামের স্কুলে বদলি হয়েছেন, বিস্তর ছোটাছুটি করে। বাড়ির দখল নিয়েছেন। নিজের অস্তিত্বকে সাড়ম্বরে ঘোষণা করেছেন, পুরো গ্রামে। কে কি বললো, না-বললো তার তোয়াক্কা করেননি। করার প্রয়োজন মনে করেননি।
প্রথম প্রথম গ্রামে তাকে খুব একটা সাদরে গ্রহন করা হয়নি, বাঁকা চোখে দেখতো সবাই। একজন মহিলা হয়েও এখান থেকে সেখানে ছুটছেন, ঘুরছেন, ফিরছেন, এর সাথে বসছেন, ওর সাথে হাঁটছেন... এসব যেন ভয়ংকর ছোঁয়াচে। তাই তাঁর ছোঁয়াচ অনেকদিন এড়িয়ে চলেছিল গ্রাম। তবে একটা সময় এসে সেই পরিবেশ আর থাকল না। গ্রামের মানুষ যেন ভুলেই গেল, মনোয়ারা বেগম বহু বছর পর এই গ্রামে ফিরেছিলেন।
এখন তো মনোয়ারা বেগমকে ‘মনু আপা’ বলেই চেনে, জানে সবাই।

পাঁচ.
মনোয়ারা বেগমের সংগ্রামী জীবনকাল অনেকটা দীর্ঘ। এই দীর্ঘ সংগ্রামে তিনি অনেক সহৃদয়, ভালমানুষের দেখা পেয়েছেন, তাদের সাহায্য গ্রহন করেছেন অকাতরে। আবার এর চেয়ে বহুগুণ বেশী পেয়েছেন নষ্ট, বদ, লোভী, নির্লজ্জ ও বেহায়া মানুষের দেখা। গ্রাম ছাড়ার আগে তিনি যেমন কতগুলো মানুষের নোংরা দিকটা দেখে ফেলেছিলেন, ঠিক তেমনি পেয়েছিলেন কিছু সত্যিকার ভালমানুষের দেখাও। যদিও সেসব ভালো মানুষেরা তাঁর কোন উপকারে আসেনি। কারণ, একাকী-যুবতী একজনকে সাহায্য করতে চাওয়ার মধ্যে ভালো কিছু কেউ দেখতে পায় না বা দেখতে চায় না।
কিন্তু এখন তো আর তিনি মনোয়ারা বেগম নন। সকলের প্রিয় মনু আপা। তাই তাকে সাহায্য করার লোকের আজ অভাব নেই, তাঁর আশেপাশে আজ অনেক অনেক মানুষ। নোংরা অভিলাষিরাও আছেন, তবে মানব-মনের সেই দিকটা সযতনে লুকিয়ে ‘ভালোমানুষি’ বেশ নিয়ে তারা আছেন। আজ তারা সত্যিকার অর্থেই মনু আপাকে সাহায্য করার জন্য আছেন।
তাই ইহসানদের রিকশা থামতেই অনেকেই এগিয়ে আসে। ব্যাগগুলো তুলে নেয়, ছোকরা গোছের দু’জন। একজন অনায়াসে খুকুমণিকে কোলে তুলে নেয় ‘মা’ ডাকতে ডাকতে। ভেতর থেকে কয়েকজন বয়সী মহিলাও বেরিয়ে আসেন খবর পেয়ে। ‘বউ আসো’ বলে তাঁরা হাত ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে যায় সুমাইয়াকে।
ইহসান ধীরে সুস্থে বের হয়ে চলে আসে। ওর খোঁজ করে কেউ কেউ, পিছু ডাকে কেউ, মুরব্বীরা ডাকেন ‘বাবা, একটু শুনে যাও’ বলে। কারো ডাকেই থামে না ইহসান। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে সরে আসে সে।
হয়তো সে শুনতেই পায়নি কারো কোন ডাক!

ছয়.
মা তাকে বারবার বলেছেন, তার সংগ্রামের কথা। গল্পচ্ছলে শুনিয়ে গেছেন ফেলে আসা কঠিন অতীতের কথা। সংকটের কথা, তা থেকে উত্তরণের কথা, পদে পদে বাঁধার কথা, সে বাঁধা কিভাবে ডিঙিয়েছেন সে কথা... সব তিনি বলেছেন। ছেলের কাছে কিছুই লুকাননি। মনোয়ারা বেগমের জীবনটা তাই ইহসানের কাছে একটা খোলা বইয়ের মতো। মনোয়ারা বেগমের সবকিছু জানে, ইহসান। মনোয়ারা বেগমের কোথায় কি আছে কি নেই, তাকে কে কি বলেছে না-বলেছে, কে তাঁর সাথে নষ্টামী করতে চেয়েছে, কে তাঁর উপকার করেছে, সবটা জানে ইহসান। দেখা না-থাকলেও মা-ছেলের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। ফোনে কথা হলেও তাতে ঠিক সুখ পেতেন না মনোয়ারা বেগম, ইয়া লম্বা লম্বা চিঠি লিখে ইহসানকে গ্রামের খবর সব জানাতেন তিনি। ইহসানও সেসব চিঠি গভীর মনযোগ দিয়ে পড়তো, হয়তো মুখস্তও করে ফেলতো।
মনোয়ারা বেগম সবচেয়ে বেশী করতেন, আড়াই বছরের ছেলে ইহসানকে নিয়ে গ্রাম ছাড়ার সেই দিনের গল্প। চিঠিতেও কতবার যে সেই গল্প উল্লেখ করেছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই। কুমিরের খাঁজকাটা গল্পের মতো মায়ের সব গল্প শেষ হতো সেই দিনে গিয়ে। ইহসানের কখনো বিরক্তি লাগত না, বারবার একই গল্পের অবতারণায়। অথচ বিরক্ত হওয়ার কথা ছিল। অন্য যে কেউ হলেই হতো, কিন্তু ইহসানকে যে মনোয়ারা বেগম তৈরীই করেছিলেন নিজের মনের মতো করে। মনোয়ারা বেগম যেমন এই গল্প করে আশ্চর্য্য প্রশান্তি পেতেন, তেমনি ইহসানও বারবার সেই গল্প পড়ে-শোনে অদ্ভুত তৃপ্তি পেত।
বারবার চর্বিত চর্বণে এমন অবস্থা হয়েছে যে, ইহসানের মনে হয় সেদিনকার দৃশ্য তার চোখের সামনেই ঘটেছিল। তাদের সামান্য কিছু জিনিসপত্র নেয়ার জন্যেও ঘরে কোন ব্যাগ ছিল না, শেষে মনোয়ারা বেগম খুঁজে পেয়েছিলেন একটা ঝুড়ি। যেটা কি না কোন একসময় গরুকে খড়-কুটো খাওয়ানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। সেটাতেই জিনিসগুলো চাপিয়ে ইহসানকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন ঘর ছেড়ে, অজানার উদ্দেশ্যে। ইহসান ঘরের চালের উপর থেকে বুঝি দেখেছিল, ছোট্ট ইহসান মাকে জড়িয়ে ধরে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে!
অনেকেই মনোয়ারা বেগমকে তখন বলেছিলেন বাবার বাড়ি যেতে। কেউ বলেছিলেন, ভাই বা সেরকম কাউকে কাছে রেখে এ বাড়িতেই থেকে যেতে। প্রচন্ড স্বাধীনচেতা মনোয়ারা বেগম একটাও করেননি। তিনি বলতেন, ‘আমার রিযিকের ব্যবস্থা আল্লাহ করবেনই, এর জন্য কারো দয়া চাই না আমার। সৃষ্টিকর্তার দয়া পেলেই হলো।’ পেয়েছিলেনও বুঝি, নইলে এক জীবনে গ্রামছাড়া হওয়ার পর আবার ফিরে এসে ‘মনু আপা’ উচ্চতায় উঠলেনই বা কিভাবে?
কত কিছু মনে পড়ে ইহসানের। মায়ের কথা, চিঠি, হাসি, রাগ, অভিমান... সব পরপর যেন ভেসে উঠে তার চোখের সামনে। খোলা আকাশের নীচে উপুড় হয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে ইহসান।

সাত.
এত মানুষ দেখে প্রথমে কিছুটা ভড়কে গিয়েছিল সুমাইয়া। পরে আস্তে আস্তে সব সয়ে আসে তার। ঘর-দোর দেখে ভাল লাগে। আগে যখন এসেছিল তখন বাথরুম আর বারান্দাটা এত ভাল ছিল না। মানুষে গিজগিজ করলেও ঘরে একটুও দম বন্ধ হয়ে আসছে না । পূর্বমুখী ঘরে দখিনা জানালা দিয়ে হু হু করে ঢুকছে বাতাস। বেশ ভাল লাগছে তার।
তার শাশুড়ি মনোয়ারা বেগম একপাশে শুয়ে আছেন। নিশ্চল, প্রাণহীন। এমন কিছু আন্দাজ করলেও শাশুড়িকে এই অবস্থায় দেখে, প্রথমে কেমন একটা শিউরে উঠেছিল সুমাইয়া। পরে অবশ্য সামলে নিয়েছে। এই মহিলার অপরিসীম মমতা পেয়েছে সে। বহুবার বলেছিল, তিনি যেন ছেলের কাছে গিয়ে থাকেন। যাননি মনোয়ারা বেগম। বলতেন, ‘আমার শাশুড়িকে আমি দেখেছি, এই ভিটেমাটিকে কি অসম্ভব ভালবাসতেন তিনি! আসলে মা, হয়েছে কি জানো, ভিটেমাটির প্রতি ভালবাসা একটা নেশার মতো। ভয়ংকর নেশা। তুমি যদি দেখতে তোমার দাদী শাশুড়ি এই মাটিকে, এই ঘরটাকে কি প্রচন্ড ভালবাসতেন, তাহলে বুঝতে আমি কেন তোমার কথায় রাজী হতে পারছি না! আমার শাশুড়ি মৃত্যুর আগে ভিটেমাটির ভালবাসাটা ছোঁয়াচে রোগের মতো আমার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তোমরা থাকো সেখানে, মাঝে মধ্যে এসো। কেমন!’ সব কথা পরপর মনে পড়ে সুমাইয়ার।
চারপাশে কোরআন শরীফ পড়ছে, ছোট ছোট ছেলেরা। অনেক মহিলাও মৃতদেহের পাশে বসে আছেন। একটু কান্না করছেন আবার কোরআন পড়ছেন। সব দেখেশুনে ইহসানকে খুঁজতে লাগলো সুমাইয়া। ঘরের যে অবস্থা তাকে দরকার ছিল। কিন্তু অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না ইহসানকে।
অবশেষে কারও তোয়াক্কা না করে, ঘরের পূর্ণ কর্তৃত্ব নিয়ে ফেলল সে-ই। না হলে যে হবে না। শাশুড়ীর সাজানো-গোছানো সংসারে হুটহাট মানুষ ঢুকে যাবে, ঘরের অন্দরে যে কেউ এসে হম্বিতম্বি করবে, মহিলাদের ঘরে কথা নেই বার্তা নেই ঢুকবে-বেরোবে, তা তো হবে না। সুমাইয়া তার দায়িত্ব বুঝে, ব্যবস্থা নেয়া শুর করে দিল।
কয়েকজন শাশুড়ি স্থানীয়ার সাথে আলাপ করলো, কথা বললো আরো কয়েকজন চেনাজানার সাথে, তারপর একের পর এক নির্দেশ দিতে লাগল কাকে কি করতে হবে। শাশুড়ির এখনও গোসল হয়নি শুনে ব্যবস্থা করল গোসলের। দেবর-সম্পর্কীয় এক কিশোরকে দায়িত্ব দিল, যেখান থেকে পারে সে যেন ইহসানকে ধরে আনে। দরকার পড়লে লোক নিয়ে যাবে, কোলে করে নিয়ে আসবে তাকে।
এতক্ষণে যেসব মানুষেরা বুঝতে পারছিল না কি করবে, কিভাবে করবে। অস্থির হচ্ছিল দুশ্চিন্তায়। তারা এখন বুঝতে পারল, ঘরের কর্ত্রী এসে গেছে। তাদের দুশ্চিন্তার আর কোন প্রয়োজন নেই।

আট.
আসরের নামাযের পর মনোয়ারা বেগমের নামাযে-জানাযা হয়েছে। অনেক মানুষ হয়েছে জানাযায়। ইহসান চমকে গিয়েছে এত মানুষ দেখে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসেছে জানাযায় অংশ নিতে। যে ‘মনু আপা’ নারী শিক্ষার জন্য দূর-দূরান্ত হেঁটে বেড়ান, তার জন্য তো অনেক দূর থেকে মানুষ আসবেই! তাকে ভালবাসে বলেই আসবে, শ্রদ্ধা করে বলেই আসবে।
ইহসান মা’র হয়ে ক্ষমা চেয়েছে। লেনদেন থাকলে তার সাথে যোগাযোগ করতে বলেছে। যদিও সে বিশ্বাস করে, এসবের কোন দরকার ছিল না।
মাগরিব গেল, এশার নামাযের পরও তাকে মসজিদে বসে থাকতে দেখে, শোয়াইব চাচা এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘ঘরে বউ মা একা। যাও, ঘরে যাও।’
‘বউ মা একা’ কথাটায় বেশ চমকে উঠল ইহসান। সারাদিন ওরা কি করেছে না-করেছে কোন খবর নেয়নি সে। তাই মসজিদে রাত কাটানোর প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও বাড়ির দিকে পা বাড়াল ইহসান। বাড়ির কাছে আসতে আসতেই সে ভুলে গেল, তার করণীয়। সারা বুক জুড়ে কেমন এক হাহাকার যেন! বারান্দায় গিয়ে বসে পড়ে সে।
এই বারান্দাতেই শেষবার মায়ের সাথে কথা বলেছিল ইহসান। মা তাকে গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তোকে আমার মতো করে মানুষ করতে চাইলেও পুরোপুরি পারিনি। তোর বাবার কিছু ছায়া তোর মধ্যে আছে। তোর বাবা কঠিন সময়কে এড়িয়ে যেতে চাইত সবসময়। যখন এড়াতে পারেনি, তখনি পালিয়ে গেছে। তুই কখনো পালাস না, বাবা! পরিবারকে কখনো ছাড়বি না। কঠিন সময় আসুক, বনিবনা না-হোক, অভাব-অনটন যাই হোক, পরিবার ছাড়বি না। জীবনটা কখনো সোজা-মসৃণ পিচঢালা রাস্তা হবে না। এতে বাঁক থাকবে, উঠানি-নামানি থাকবে, থাকবে খানাখন্দ, গর্ত, ভাঙাচোরা, তাই বলে তাকে অস্বীকার করে পালাবি, তা হবে না। যেমন আছে তেমনকেই জয় করার চেষ্টা করবি, পরিবারকে সাথে নিয়ে। বুঝলি!’
ইহসান বুঝেছিল। তাই পরিবার ছাড়া আর কখনো মায়ের কাছে আসেনি সে।
হঠাৎ পেছনে হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে দেখে সুমাইয়া এসে দাঁড়িয়েছে। ‘খাবে, এসো।’ আস্তে করে বললো সুমাইয়া।
খাওয়ার জন্য বসতে গিয়ে ‘তুমি খাবে না?’ বলার সময় সুমাইয়ার দিকে তাকাতেই চমকে উঠল ইহসান। কি চেহারা হয়েছে এই মেয়ের! চোখ-মুখ ফুলে একাকার। মনে হচ্ছে, কান্নার মহাসাগরে বিশাল এক ডুব দিয়ে এইমাত্র উঠেছে সে।
‘ব্যপার কি, তোমার চেহারার এই অবস্থা কেন?’ জানতে চায় ইহসান।
একটু হেসে সুমাইয়া জবাব দেয়, ‘শুধু কি তোমারই মা মারা গেছে? খুকুমণির দাদী মারা যায়নি? আমার শাশুড়ী মা মারা যায়নি? কান্না কি শুধু তোমারই আসে? আমাদের আসে না?’
কিছু বললো না ইহসান। সে তো আর জানে না, সারাটা দিন সুমাইয়ার উপর দিয়ে কি ঝড় গেছে। শোক করার চেয়ে সবদিক সামাল দিতেই বেশী ব্যস্ত ছিল সে। একটু ফাঁকা হতেই হঠাৎ ভেতরটা মুচড়ে এমন কান্না আসলো যে, আর নিজেকে সামলাতে পারেনি।
ইহসান তো উদাস-পুরুষ হয়েই সারা!

নয়.
জীবন থেমে থাকে না। সংসার সংগ্রাম চালিয়ে যেতেই হয়, যত শোক-তাপ আসুক না কেন! ইহসানের ছুটি শেষ হয়ে আসে। মায়ের শোক ভুলে চাকরি বাঁচাতে ছোটার তাগিদ অনুভব করে সে। সুমাইয়াকে সে কথা বলতেই, সুমাইয়া বলে উঠলো, ‘তুমি যাও। আমরা এখানে থাকবো। এখানে বদলির চেষ্টা করো, যদি পারো। নইলে তো আবার ওখানে তোমার খাওয়া দাওয়ার বেশ অসুবিধে হয়ে যাবে।’
‘বলছো কি তুমি? এখানে থাকবে মানে কি?’ হতভম্ব ইহসান একটু উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করে।
‘যা বলেছি তা তো বুঝতেই পারছো।’ বাইরে তাকিয়ে জবাব দেয় সুমাইয়া। অনেকদিন আগে শোনা শাশুড়ির কথা মনে পড়ে তার। ‘বুঝলে মা, ভিটেমাটির প্রতি টান বড় অদ্ভুত। ছোঁয়াচে রোগের মতো।’ তাকেও মনে হয় সেই ছোঁয়াচে রোগে পেয়েছে। নইলে এই ঘর ছেড়ে একটুও নড়তে ইচ্ছে করছে না কেন তার?
কথা বাড়ায় না ইহসান। চুপচাপ ভাবতে থাকে।
যাওয়ার জন্য সুমাইয়াকে আর কিছু বলেনি ইহসান। যাওয়ার হলে এমনিই যাবে। যাবার দিন এলে, গোছানো ব্যাগটা হাতে নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়ে সে। একটু গিয়ে ফিরে ফিরে দেখছে, সুমাইয়া আর খুকুমণিকে। খুকুমণি হাত নাড়ছে জোরে জোরে। ইহসানের মা-ও ওভাবে হাত নাড়ত না? খুকুমণির মতোই একপাশ বাঁকা করে হেসে, ঠিক ওভাবেই, হ্যাঁ ঠিক ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকত!
ইহসান পেছন ফিরে ফিরে দেখছে ওদের। হয়তো দেখবে যতদূর দেখা যায়। রিকশা না পাওয়া পর্যন্ত কি এভাবেই চলতে থাকবে? বুঝতে পারে না, ইহসান। ওরা দু’জন কেমন করে যেন দাঁড়িয়ে আছে। বহু বছর আগে সে আর মনোয়ারা বেগমের একটা দৃশ্য জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠে তার সামনে।
একটা ছেলে মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আর মা মাথায় একটা ঝুড়ি নিয়ে হাঁটছেন, আবার পেছন ফিরে কুঁড়েঘরটাকে দেখছেন, একটু চোখ মুছছেন, আবার হাঁটছেন। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ইহসান । কে বলেছে তার মা মারা গেছে? ওই তো তার মা...।

____

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.