নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৃষ্টিসুখের উল্লাসে

মোঃ ইয়াসির ইরফান

পৃথিবীর সব রাজনীতিবিদ যদি কবিতা ভালোবাসতেন অথবা সব কবি যদি রাজনীতিবিদ হতেন তাহলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর ও বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারত। -জন এফ কেনেডী

মোঃ ইয়াসির ইরফান › বিস্তারিত পোস্টঃ

বেলা যে যায়... : ০২

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৪১

এই বয়সেই আরিফের ছেলেটা বেশ কথা শিখেছে। মাশাআল্লাহ, তার কথা খুব স্পষ্ট। আমার সাথে বসে খুব সমঝদারের মতো কথা বলে। যেন আড়াই বছর নয় আমি আশি বছরের কোনো বুড়োর সাথে কথা বলছি।
“দাদ্দাভাই তুমি বই পড়ো?” আদো আদো মুখে বলে। প্রতিটি শব্দে যেন মিশে থাকে এক ধরণের মিষ্টতা। ইচ্ছে হয় সবগুলো শব্দসমেত বাচ্চাটাকেও খপখপ করে খেয়ে ফেলি। আমি ওর গালে আমার গাল ঠেকিয়ে বলি, “হ্যাঁ দাদা আমি বই পড়ি। তুমি পড়বে?”
“আমি তো বাচ্চা। বাচ্চারা কী বই পড়ে?” ওর কথা শুনে আমি হাসি। “বড় হলে পড়িও কেমন!” জানি ও বুঝবে না। তবুও বলতে থাকি, “বই পড়া খুব ভালো। বুঝলে দাদা, যখন বড় হবে খুব বই পড়বে। শুধু বই না, যখন যেখানে যা পাবে তা পড়বে। এই জীবনটা পড়ার জন্য খুব খুব কম। কত কী জানার বাকী আছে!” সে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন আমি যা বলছি তার প্রতিটি বর্ণ সে বুঝতে পারছে। উৎসাহিত হয়ে বলতে থাকি, “ধুম করে দেখবে একদিন মরে যাবে। তার আগে যত পারো পড়বে। জানবে। ভাববে। শিখবে। পৃথিবীতে পড়ার মতো মজার আর কিছুই নেই, যদি তুমি তেমন পাঠক হতে পারো। বুঝলে দাদাভাই!” সে হাই তোলে। “দাদ্দাভাই আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাবো।” ওর তুলতুলে গালটা একটু টেনে দিই। “যাও দাদা, আম্মুর কাছে যাও।” সে দু’পাশ মাথা নেড়ে বলে উঠে, “আমি এখানেই ঘুমাবো। বইয়ের মাঝে।” বলেই টুস করে শুয়ে পড়ে।

কী বিচিত্র এই পৃথিবী! এই আদো আদো কথা থেকে সে একসময় খুব সেয়ানা সেয়ানা কথা বলবে। তারপর একসময় হঠাৎ দেখা যাবে তার ঘাড়টা খুব চওড়া হয়ে গেছে। পুরো একটা পরিবার কিংবা দু-চার, পাঁচটা পরিবারও হয়তো তার ঘাড়ে সওয়ার হবে। তার বিয়ে হবে, বাচ্চা হবে। সেও নাতির সাথে এমন গল্প করবে হয়তো। অথবা হয়তো না...। সে এতকিছু করার আগেই ধুম করে মরে যাবে। তার বাবা-মা ক’দিন খুব কাঁদবে। তারপর তারাও হয়তো মরে যাবে। অদ্ভুত! এই দুনিয়ায় মৃত্যুটাই কেবল সত্যি, আর সব কেমন যেন আবছা আবছা, হয়তো বা হয়তো না...।

আমাকে ভাবন-রোগ এখন পেয়ে বসেছে। বাচ্চাটাকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে ভাবতে বসবো। আশাপূর্ণা দেবী কোন একটা বইয়ে লিখেছিলেন, “নিভৃত চিন্তায় নিমগ্ন হবার গভীর আনন্দ থেকে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সবাই।” আমার কাছে অঢেল অর্থ না থাকলেও আছে অঢেল সময়। আমি তাই নিভৃত চিন্তায় নিমগ্ন হতে পারি। গভীর আনন্দ লাভ করতে পারি। উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে হয় না আমার।

“মা, ও মা, কোথায় গেলি! তোর বাচ্চাটাকে একটু নিয়ে যা তো মা! ঘুমিয়ে গেছে যে!” হন্তদন্ত হয়ে কোত্থেকে ছুটে আসে আরিফের লক্ষীমন্ত বউটা। “আপনার এখানেই ঘুমিয়ে গেছে। দেখলেন কান্ড!” বলেই তড়িঘড়ি করে বাচ্চাটাকে নিয়ে যায় সে। এবার আরাম করে কিছুক্ষণ ভাবতে বসবো এমন সময় আবার হাজির আরিফের বউ।

“চাচা, আপনার গরম পানি দেয়া হয়ে গেছে। আজ আর ঠান্ডা পানিতে গোসল করবেন না।” আমি হেসে বলে উঠি, “কি দরকার ছিল মা! মাথায় ঠান্ডা পানি না পড়লে তো গোসল করেছি বলে মনেই হয় না। তাই...” মুখের কথা মুখেই থেকে যায়। ধমক দিয়ে বলে উঠে, “ঠান্ডা বাঁধানোর পাঁয়তারা করবেন না। এমনিতে চাচী আম্মা নেই বলে যা খুশী তাই করে বেড়াচ্ছেন।”
“আমি আবার কখন কী করলাম, মা?” বলেই আরো একটা রাম ধমক খেলাম। “আহ, তর্ক করবেন না। মায়ের সাথে তর্ক করতে নেই। সুবোধ ছেলের মতো বাথরুমে যান। সেখানে তোয়ালে-লুঙ্গী রাখা আছে। গরম পানি দেয়া হয়েছে। গোসল সেরে নিন। আর হ্যাঁ, বাথরুমে ঢুকে কোনো ভাবাভাবিতে যাবেন না, সোজা গোসল। ঠিক আছে?” আর কথা না বাড়িয়ে “হ্যাঁ ঠিক আছে।” বলেই বাথরুমে ঢুকে গেলাম।

আরিফের বউয়ের নামটা কী যেন! ভুলে গেছি। প্রায়ই ভুলে যাই। আজকাল বড্ড ভুলোমনা হয়েছি। অনেক কিছুই ভুলে যাই। সেদিন তো গরম পানি বালতিতেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। বাথরুমে ঘন্টাখানেক বসে থেকে ঝর্ণার পানিতেই গোসল সেরে বেরিয়েছিলাম। আরিফের বউ সে কী বকাটাই না দিল! মেয়েটা যতই বকা দেয় ততই হাসি পায়। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে কেঁদেই দিয়েছিল। “অসুখ বাঁধিয়ে আমাদের আবার এতিম করার উপায় খুঁজছেন, না?” আমি হায় হায় করে উঠি, “এই যে মা কান ধরছি। এমনটা আর হবে না।” ছোটো ছেলের মতো আমাকে কানে হাত দিতে দেখে ফিক করে হেসে দিয়েছিল ও।

মেয়েটা আসলে বড্ড মায়াবতী। মায়া-টায়া এড়াবো বলেই এই গাঁ-গঞ্জে পালিয়ে এসেছিলাম। এখন দেখছি এখানেও রেহাই নেই। কথাবার্তায় আবার বেশ টনটনে। ঠাশ ঠাশ উত্তর দেয়। একেকটা উত্তর তো পিলে চমকে দেয়ার মতো। তার সপ্রতিভ ভাব দেখে একবার রসিকতা করে বলেছিলাম, “মা, তুই এই যুগে কেন জন্ম নিলি বলতো?”
“কেন? এই যুগে জন্মে কী এমন অপরাধ হয়েছে, চাচা?” পালটা রসিকতার সুর তার কথায়। “তোর উচিৎ ছিল শরৎ-যুগে জন্ম নেয়া। তাহলে কী হতো জানিস?” বাঁকা স্বরে জিজ্ঞেস করি।
আমাকে চমকে দিয়ে সে বলে উঠেছিল, “জানিই তো। তাহলে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নায়িকা হতাম।” মুখ চাপা হাসির উত্তরটা সত্যিই আমাকে অবাক করেছিল। আমাকে চুপ থাকতে দেখে সে নিজেই বলেছিল, “না চাচা, এই ঠিক আছে। আমি আরিফ যুগে জন্মেছি। আরিফ সাহেবের নায়িকা হয়েছি, এই ঢের।” কেমন একটা তৃপ্তি আর গর্বের সুর ছিল তার কথায়।

মেয়েটার যে বেশ পড়াশোনা আছে তা আন্দাজ করলেও, এতটা আছে সেটা বুঝতে পারিনি। প্রথম প্রথম খুব সাধারণ কথা বলত। কথায় আন্তরিকতা থাকলেও একটা সংকোচও বুঝি কাজ করত। মাস দুয়েক পর একদিন হঠাৎ লাইব্রেরী ঘরে এসেছিলো। বলেছিল, “চাচা, আমি একটা অপরাধ করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করবেন।” আমি তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞেস করি, “কীসের অপরাধ বৌমা? কখন করলে?” আমার কথার জবাব না দিয়ে আবার নিজের কথায় ফিরে গেল। “তার আগে দুটো কাজ করতে হবে আপনাকে।” “কী কাজ? বলো?”
“প্রথমত আমাকে বৌমা ডাকা যাবে না, মা ডাকতে হবে। আর তুমি নয়, তুই করে বলবেন।” তার কথার দাপট আর আত্মবিশ্বাসে আমি অভিভূত হলেও প্রকাশ করলাম না সেটা। “এ আবার কেমন দন্ড! সম্পর্কটা প্রমোশন পেয়ে মা-তে উঠে গেল, আর ওদিকে সম্বোধনটা ডিমোশন নিয়ে তুমি থেকে নেমে গেল তুই তে!” হাসি হাসি মুখ করে বলেছিলাম। “অত শক্ত কথা বুঝি না। আর হ্যাঁ, আমার সাথে আপনার ওই কঠিন কঠিন কথাগুলোও বলা যাবে না।”
“ঠিক আছে, তাই হবে রে মা!”

কিশোরী যেমন তার কথা সব মেনে নেয়া হয়েছে দেখে বেণী দুলিয়ে খুশীতে ডগমগ করতে করতে পুরো বাড়িতে ছুটে বেড়ায়। আরিফের বউটাও তেমন উচ্ছলতায় পুরো বাড়িতে কেমন উচ্ছ্বসিত ভাব নিয়ে এসেছিল।

তার অপরাধটাও ছিল হাস্যকর। সে নাকি আমার বুক শেলফ থেকে চুরি করে বই নিয়ে যেত! শুনে অট্টহাসি দিয়ে বলে দিয়েছিলাম, যত ইচ্ছে বই নিতে পারবে সে। পড়ার জন্য যদি সবগুলো বইও চুরি করে তাহলে আমার বরং আনন্দই হবে। এখানে এসে আমি বই পেয়েছি, মেয়ে পেয়েছি, মা পেয়েছি, মমতা পেয়েছি। এবং পেয়েছি একজন সমঝদার পাঠকও। আরিফের বউ আসলে সত্যিকার পাঠক।

প্রথম পর্ব

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:৫৬

সচেতনহ্যাপী বলেছেন: একদম দূর্লভ না হলেও এমনটাই আমাদের সমাজের প্রানভোমরা।। আত্মিক সম্পর্ক এমন করেই আমাদের কাঁদায়-হাসায়।।
একটি প্রশ্ন, বাস্তব না গল্প!!

০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১২:১২

মোঃ ইয়াসির ইরফান বলেছেন: বাস্তব নয়, গল্প। :)
ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।

২| ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:৪৩

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: ইস্ । বাস্তবটাও যদি এমন হত। কতইনা ভাল হত।

নতুন বছর ভাল কাটুক।


ধন্যবাদ।

০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৪৪

মোঃ ইয়াসির ইরফান বলেছেন: একদম ভাই।

আপনার জন্যেও শুভকামনা।
ভালো থাকবেন, দোয়া রাখবেন। কেমন!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.