নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাহমুদকলী

সবাই ভাল থাকুন এবং অন্যকে ভাল থাকতে িদন।

মাহমুদকলী › বিস্তারিত পোস্টঃ

নষ্ট সময়ের কষ্ট

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৩৭

মাল্টি কালার কষ্টের ফেরিঅলা কবি হেলাল হাফিজ অনেক রকম কষ্টের বর্ণনা দিলেও সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের ফলে সমাজবদ্ধ সচেতন মানুষের হৃদয়ে কষ্টের যে নীল আবরণ তৈরি হয়, তার উল্লেখ করেননি। আজ থেকে প্রায় ৩২ বছর আগে লেখা তার ‘ফেরিঅলা’ কবিতায় আজকের এই নষ্ট সময়ের কষ্টের বর্ণনা নেই, কারণ ওই সময় পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের এত বেহাল দশা ছিল না। রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবন পর্যন্ত কোথাও কোনো সুখবর নেই আজ। পত্রিকার পাতা উল্টালে যত খবর চোখে পড়বে তার শতকরা নব্বই শতাংশই হতাশাজনক। নিষ্ঠুর সময়ের নির্মম ঘটনাপ্রবাহ সব মানুষের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। মানুষ আজ শুধু পুরনো সময়ের সুখস্মৃতি রোমন্থন করে উহ্.. আহ্.. করছে।

রাজনীতির ময়দানে আজ অহংকার করার মতো কোনো নেতা চোখে ভাসছে না। মওলানা ভাসানীর মতো সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত অসাধারণ নেতা, মানুষের মাঝে আর ফিরে আসবে না। আমরা হারিয়েছি বঙ্গবন্ধুর মতো উদার রাষ্ট্রনায়ককে, যিনি সদ্য স্বাধীন দেশে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সবুর খানের মতো নেতাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। শুধু রাজনৈতিক কারণে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় নিয়ে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল সবাই মিলে দেশটাকে সোনার বাংলায় পরিণত করা। ঘাতকের বুলেট তার সব স্বপ্নকে কেড়ে নিল। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আমরা পেয়েছিলাম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মতো সৎ একজন রাষ্ট্রনায়ক, যার সততার ব্যাপারে তার চরম নিন্দুকরা আজও কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি। যার চোখে স্বপ্ন ছিল স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার। অথচ আমরা তাকেও বুলেটের নিশানা করতে ভুল করিনি। এখন রাজনীতিতে আমরা পেয়েছি পারস্পরিক অবিশ্বাস, হিংসা, বিদ্বেষ আর দুর্নীতির মাধ্যমে কালো টাকার পাহাড় গড়ার প্রতিযোগিতা। দেশের শান্তি, স্থিতি ও উন্নয়নে সবাই উদাসীন। এমতাবস্থায় দেশপ্রেমিক সাধারণ জনগণকে বুকের কষ্ট বুকে চেপেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে।

শহুরে সমাজে কিছুটা দলাদলি, গালাগালি থাকলেও গ্রামীণ সমাজ জীবন ছিল শান্তিতে ভরপুর। মানুষের জীবনে এত গতি ছিল না বটে, তবে সুখ, শান্তি ও পারস্পরিক ভালোবাসার বন্ধন ছিল। সুখে, দুঃখে সবাই সবার পাশে ছিল। ছোটদের স্নেহ, বড়দের সম্মান আর বয়োজ্যৈষ্ঠদের নির্দেশ মেনে চলায় সমাজ সুশৃঙ্খল ছিল। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে শুক্রবারে জুমার নামাজের পর মহল্লায় বিচারপ্রার্থী হলে ন্যায়বিচার থেকে কেউই বঞ্চিত হতো না। গ্রামের মসজিদগুলোয় সকালবেলা শিশুদের সূরা-ক্বেরাতসহ ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হতো। তারপর শিশুরা স্কুল-মাদরাসায় যার যার মতো যেত। বড়রা সারাদিন ক্ষেত-খামারে কাজ করলেও মনে আনন্দ ছিল। কাজের ফাঁকে কিংবা অলস সন্ধ্যায় আমাদের এলাকার বয়স্করা শীতালং শাহ’র রাগ (গান) গাইতেন। প্রায়ই শোনা যেত কারো ভরাট গলার সুরে ‘রে নাগর রসিয়া নদীয়ার কূলে বসিয়া, ডাকি গো বন্ধু কলঙ্কিনি হইয়া...’। এখন সবকিছু বদলে গেছে। মানুষের মধ্যে এসেছে গতি। হারিয়ে যাচ্ছে সামাজিক বন্ধন। সবাই যার যার। শিশুরা আর আগের মতো খুব ভোরে উঠে মসজিদভিত্তিক মক্তবে যায় না। এর বদলে এখন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে যায়। কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাড়িতে মৌলভী রেখে বাচ্চাদের সূরা-ক্বেরাত শেখান। মসজিদভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের সম্পর্কটাও শিথিল হয়ে গেছে। গ্রামেও এখন শহরের মতো কেউ কারো কথা শোনে না। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের অভাবে গ্রামে মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে কৃষির প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। সবাই ছুটছে শহরে অধিক রোজগারের আশায়। সবকিছু মিলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। গ্রামের সহজ, সরল, অনাড়ম্বর অথচ সুখ-শান্তিতে পরিপূর্ণ জীবন, গ্রাস করে নিচ্ছে কৃত্রিমতা। সামাজিক জটিলতা বেড়েছে। আগের মতো মনের আনন্দে সবাই মিলে সবকিছু করা হয় না। তাই তো শাহ আব্দুল করিমের কণ্ঠে শোনা যায়, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম, গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান, একসাথে বাউলা গান আর মুর্শীদি গাইতাম...’।

সামাজিক জীবনের এই দুর্দশার মধ্যে আমাদের পারিবারিক জীবনেও বয়ে গেছে এক টর্নেডো। যার আঘাতে যৌথ পরিবার ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। এখন যৌথ পরিবারের সন্ধান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। পারিবারিক মূল্যবোধের অবনতির সাথে সাথে বাস্তব কিছু সমস্যাও এর জন্য দায়ী। এসব একক পরিবারের বাবা-মা যার যার ব্যবসা-চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। সন্তানরা লালিত-পালিত হচ্ছে কাজের মেয়ের হাতে। সময় কাটছে টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখে আর ইন্টারনেটে ব্রাউজিং করে। মায়া-মমতাহীন পরিবেশে অপসংস্কৃতির ছোঁয়ায় আজকের শিশুরা বড় হচ্ছে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আমাদের মধ্যে থেকেও এরা অচেনা ভিন্ন মানুষ হিসেবে বড় হচ্ছে। কিছুটা বড় হওয়ার পর মাদক তাদের সঙ্গী হয়। এরপর তারাই মাদকের সঙ্গী হয়ে পরিবার-সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে ভাই-বোন, বাবা-মা কেউ আপন নয়- মাদকই আপন। এভাবেই পরিবারের মধ্যে বেড়ে উঠছে ঐশীর মতো প্রজন্ম যারা বাবা-মাকে নিজ হাতে জবাই করতেও দ্বিধাবোধ করে না, মাদক ও অনৈতিক আনন্দ উপভোগের জন্য। ঐশীর বিপরীত চিত্রও মাঝে মাঝে খবরের কাগজে আসে। বাবা-মার অনৈতিক জীবন যাপনের বলি হতে হয় অনেক সময় শিশু সন্তানকে। যেমন সামিউলকে জীবন দিতে হয়েছিল মায়ের পরকীয়ার বলি হয়ে। এসবই হচ্ছে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সামাজিক এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি? বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী কারা? আসলে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি, কেউই এর দায় এড়াতে পারে না। ভোগের নেশায় মত্ত হয়ে আমরা সবকিছুকে নষ্ট করে দিয়েছি। বর্তমান নষ্ট সময়ের কষ্টের প্রতিফলন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর কেমন হবে, আমরা ঠান্ডা মাথায় একবারও চিন্তা করার সময় পাচ্ছি না। অথচ সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। এখন হয়ত বিচ্ছিন্নভাবে ঐশী, সামিউলরা নৃশংস আচরণ করে কিংবা নৃশংসতার শিকার হয়ে আমাদের পরোক্ষভাবে সচেতন করার চেষ্টা করছে, অদূর ভবিষ্যতে চতুর্দিকে এসব নির্মমতার ছড়াছড়ি শুরু হলে আমরা আমাদের সন্তানদের রক্ষা করার শেষ সুযোগটিও হারাবো। এজন্য রাজনীতিকদের জন্য অপেক্ষা না করে শিক্ষক, সাংবাদিক, অভিভাবক ও সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গকে সম্মিলিতভাবে শিশু-কিশোরদের সুন্দর মানস গঠনে এখনই কাজ শুরু করতে হবে। শিক্ষকরা শুধু পাঠ্যবইয়ে অবস্থান না করে শিশু-কিশোরদের সুস্থ মানসিক বিকাশে সহযোগিতা করতে পারেন। ছাত্রদের মধ্যে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধ জাগিয়ে তুলতে হবে, শুধু পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস রেজাল্ট নয়, তাদের গোল্ডেন মানুষ হওয়ার রাস্তাও দেখিয়ে দিতে হবে। বেশিরভাগ শিক্ষক এই দায়িত্ব পালন থেকে বিচ্যুত হলেও অনেক শিক্ষক সত্যিকার মানুষ গড়ার এ কাজটি করে যাচ্ছেন।

নষ্ট সময়ের কষ্ট লাঘবের প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন সাংবাদিকরা। এখন মিডিয়ার যুগ। মিডিয়াই মানুষের চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করছে সবচেয়ে বেশি। দিনের হাজারো নেতিবাচক সংবাদের মধ্যে যে দু-একটি ভালো খবর থাকে, সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে মানুষকে আশাবাদী হতে সাহায্য করতে পারে মিডিয়া। শুধু রাজনীতিবিদ আর নষ্ট মানুষগুলোকে প্রিন্ট মিডিয়ার প্রথম পৃষ্ঠা কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লিড নিউজে স্থান না দিয়ে কিছু ভালো মানুষের খবরও স্থান পেতে পারে। যাদের জীবন, কর্ম ও চেতনা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে সুন্দর জীবন গঠনে।

জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায় না। সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষা ও পরিবেশ দিতে ব্যর্থ হলে, জন্মদান ও লালন-পালন করা সত্ত্বেও সন্তানের বাবা-মার জায়গা দখল করে নেয় মাদক, ভুল রাজনৈতিক নেতা, গডফাদার ছাড়াও অনেক সমাজবিরোধী শক্তি। পারিবারিক শিক্ষাই এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। তবে সব পরিবার একসাথে সচেতন না হলে সমস্যা থেকে যায়। এক পরিবারের ভালো সন্তান অন্য পরিবারের নষ্ট সন্তানের সাথে মিশে বখাটে হতে পারে। বর্তমান পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় বিভিন্ন অপশক্তি ও অপসংস্কৃতির হাত থেকে নিজের সন্তানদের রক্ষা করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। আমার দুই শিশু সন্তানের চেহারার দিকে তাকিয়ে প্রায়ই আমি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি, আমি কি আমার সন্তানদের রক্ষা করতে পারব? আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম কাজ এটা হলেও আমাকে পারতেই হবে।

আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে নষ্ট সময়ের গতি পরিবর্তনে সবাইকে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। নতুবা গায়ক হায়দরের মতো একসময় গাইতে হবে- ‘আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া, করিতে পারিনি চিৎকার। বুকের ব্যথা বুকে চাপায়ে নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার!’ হায়দর গেয়েছিলেন সেনাহত্যার বীভৎসতা দেখে আর আমাদেরকে গাইতে হবে নিজ নিজ সন্তানের নষ্ট হওয়ার দৃশ্য দেখে। তখন কবি হেলাল হাফিজ হয়ত তার ফেরিঅলার ঝুড়িতে নতুন করে তুলে দেবেন ‘নষ্ট সময়ের কষ্ট’। -

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৪২

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: হেলাল হাফিজের কথা শুনে এলাম।

ভালো বলেছেন।

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৪৩

মাহমুদকলী বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.