নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

Mahmudur Rahman Razu

writerrazu.com

মাহমুদুর রহমান রাজু

I am noone

মাহমুদুর রহমান রাজু › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: ওই চরনের দাসের যোগ্য নই

২৮ শে মার্চ, ২০১১ সকাল ১০:১২

আমি ওই চরনের দাসের যোগ্য নই

নইলে মোর দশা কি এমন হয়

কেন, বয়াতির কি-এমন খারাপ দশা? সে কোন চরনের দাসের যোগ্য নয়? বয়াতি যে ফুটখানেক উচু মঞ্চে বসে গান গাইছে, তার সামনে পাঁচ ফুটের মত ফাঁকা এক খানা জায়গা, তার সামনেই তিন থাক ওয়ালা সিমেন্টের গ্যালারী। গ্যালারীর মাঝ বরাবর মাঝের থাকে কফি হাতে বসে আছে একটি তরুণ যুগল। এই মেয়েটির মত সুন্দর মেয়ে কি বাউল জীবনে কখনও দেখেছে? মনে পড়ছে না। বাউলের চোখ বার বার আটকে যাচ্ছে মেয়েটির শরীরে। না! সে বাউল! এখানে গান করতে এসেছে। এভাবে তাকানো উচিৎ হচ্ছেনা। জানাজানি হলে মান-সম্মান বলে আর কিছু থাকবেনা। এমনওতো হতে পারে মেয়েটি আয়োজকদেরই কেউ হয়। মেয়েটি গায়ে পড়েছে গাঢ় খয়েরি স্লিভলেস শর্ট কামিজ আর কালো জিনসের প্যান্ট। পোষাকের বাইরে বের হয়ে থাকা হাত, পা, গলা, উপরের বক্ষ আর মুখের যে অংশ গুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আর শরীরের বাকি যে অংশ গুলি আটোসাটো পোষাকের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে, তারা তাদের আকার আকৃতি ফুটিয়ে তুলে নিজেদের গৌরব প্রকাশ করছে। বাউলের চোখ আটকে যাচ্ছে, বাউল জোর করে চোখ বন্ধ করে গান গাইছে। মেয়েটির গায়ের রং মাঝ দুপুরের কড়কড়ে রোদের মত উজ্বল সোনালী। চাঁদের মত স্নিগ্ধ মেয়েদের দিকে অপলক চেয়ে থাকা যায়। কিন্তু এমন ঝাঝালো রোদেলা গনগনে সূর্যের মত মেয়েদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ পুড়ে যায়। আবার চোখ ফিরিয়েও নেওয়া যায় না। রোদেলা নেশায় রাংতা কাগজের উপর চোখ পুড়ে পুড়ে ধোয়া ওঠে। সেই ধোয়া নতুন কচকচে টাকা পেঁচিয়ে বানানো পাইপ দিয়ে টেনে নেয় বাউল। পোড়া চোখের নেশায় বাউল কাহিল হয়। টলতে থাকে। কিন্তু গান থামেনা। গান তখন উসাইন বোল্টের মত দৌড়ায়। নেশার ঘোরে গান গায় বাউল।



ভাব জানিনে, প্রেম জানিনে

দাসী হতে চাই চরনে

হুহ! চাইলেইকি আর দাসী হওয়া যায়। এই রোদেলা মেয়েটি তাকে দাসী হিসেবে নেবে? সে পারবে পাশের ঐ ছেলেটির মত হতে? বাউল তখন অনেক ছোট, ১২/১৩ বছর হবে বয়স। লালনের আখড়ায় গিয়ে ভরা পূর্ণিমার সারা রাত গান শুনে মুখস্ত করেছিল “বাড়ির পাশে আড়শি নগর সেথায় পড়শি বসত করে..........”। বাড়ি ফিরে উদাস দুপুরে দীঘির পাড়ে বসে যখন বাউল ঐ নতুন শেখা গানটিই গলা ছেড়ে গাইছিল, তখন ভেজা শরীরে কলসি কোলে হেটে যাচ্ছিল সখিনা। সখিনার ভেজা শরীর সে বাউলের গলাটাকেও ভিজিয়ে দিয়েছিল গোলাপজলে, তা বাউল যেমন টের পেয়েছিল, তেমনি সখিনাও। সখিনার সারা শরীরে গোলাপজল- কলসি ভরা গোলাপজল। একটু এগিয়ে গাছতলায় দাড়িয়ে গা শুকানোর নামে সখিনা ততক্ষনই দাড়িয়েছিল, যতক্ষণনা গানটা শেষ হয়। সে দাড়িয়েছিল বাউলের দিকে পিঠ দিয়ে। সখিনা গান শেষ হলে আস্তে আস্তে রওনা দিল। বাউল যা বোঝার বুঝে নিল। সেদিন বিকালেই বাউল গুরুর পায়ে কদমবুচি করে জানিয়ে দিল সে ব্রহ্মচারী হবে, বাউল হবে। গুরু ভেবেছিল কিশোর বোধহয় লালনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাউল হতে চায়। কিন্তু কিশোরের মনের মাঝে যে লালন নয়, এক কৃষ্ণবর্ন ললনা খেজুর পাতার পাটিতে বসে উকুন বিলি দিচ্ছিল সে খবর কি গুরু রাখে? কিশোরের উদ্দেশ্য উদাস দুপুরের বেকারত্ব আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে সখিনার গা শুকানোর সময়টাকে লম্বা করে সেই অবসরে সখিনার অন্তরে মিরাজ করে আসা। আর কে-না জানে, মনের দখল পেলে, শরীরের দখল নিতে কোট-কাছারি লাগেনা। তা পেয়েছিল বটে, শরীর-মন দুটোর দখলই পেয়েছিল বাউল। সেই সাথে পেয়েছিল অতি অল্প বয়সে গায়ক হবার স্বীকৃতি-সম্মান-সংবর্ধনা। তার বন্ধুরা যখন বই খাতা বগলে নিয়ে স্কুলে গিয়ে মাস্টার মশাইয়ের জাদুর আয়নায় গাড়ি-ঘোড়ার স্বপ্ন দেখে, বাউল তখন রীতিমত স্টার। গুরু বলেছিল “তুই অনেক অল্প বয়সে শুরু করেছিস, তুই অনেক এগিয়ে যাবি। আর কি মধুর গলা তোর।” বাউল কি আসলেই এগিয়ে গেছে? সে কি আসলেই সফল? এইযে এখানে, যেখানে এসেছে সে গান করতে, সেখানে তার মূল্য কতটুকু? তার যে বন্ধুরা পড়ালেখা করেছে, ব্যবসা করেছে, অনেক টাকা, তারা সফল নাকি সে সফল? নাকি আজ যা এগিয়ে যাওয়া, কাল সেটাই পিছিয়ে পড়া?

সখিনা হয়তো গা শুকানোর জন্য সারা জীবন দাড়িয়ে থেকে স্টাচু অফ লিবার্টি হতে রাজী ছিল। কিন্তু কন্যার সচেতন পিতা প্রতিভাবান গায়কের চেয়ে কোর্টের কেরানীর হাতে কন্যাকে সম্প্রদান কারকে অর্পণ করবে, এটাতো জানা কথা। আর তা না হলে বাউলের গলাতেই বা রক্তগন্ধা ফুটবে কিভাবে? আচ্ছা কবিরা সব সময় কালো মেয়েদের প্রেমে পড়ে কেন? কালো চেহারায় কি এমন নন্দনতত্ব চাপা পড়ে আছে যা কেবল কবি-শিল্পী-গায়কের পক্ষেই খুড়ে বের করা সম্ভব? না কি চাল-চুলো হীন শিল্পী কুলের ফর্সা মেয়েদের দিকে তাকানোর সাহস নেই, ফর্সা মেয়েদের পাবে রাজা-সেনাপতি-উজিরেরা। বাউল চোখ খুলে কড়কড়ে রোদেলা মেয়েটির দিকে তাকায়, তার চোখ ঝলসে যায়, ধোয়া বের হয়, বাউল সেই ধোয়া টেনে নিয়ে নেশা করে।



ভাব দিয়ে ভাব নিলে মনে

সেই সে রাঙা চরন পায়

“রাঙা চরন পায়?” বাউল চমকে ওঠে, সখিনার পা কি রাঙা ছিল? প্রশ্নই আসেনা। গুরু বলেছিলেন “এই চরন পরমেশ্বরের, আমরা তার চরনে ঠাঁই খুজি মাত্র।” পরমেশ্বরের চরন যে রাঙা তা কে দেখেছে? রাঙা চরন অবশ্যই এই রোদ্দুর মেয়েটির। কোন সন্দেহ নেই। ঐযে জিন্সের প্যান্টের নিচে বেরিয়ে আছে। লালনও নিশ্চই এই মেয়েটিকে দেখেছিল। বা এমনই কাউকে।

সখিনা-বাউলের প্রেমের কথা আর কেউ জানতনা। সখিনা এমনিতেই বাউলের চেয়ে বছর তিনেকের বড়, তার উপর বাউলের এমন কোন সাহস ছিলনা যে তারা পালিয়ে যাবে। সুতরাং সখিনার বিয়ে হয়ে গেল। এর অনেক বছর পর বাউল বিয়ে করেছিল জরিনাকে। জরিনার রূপও যেমন ছিল, তেমনি রাগও। বাউলের জীবনটাকে তেজপাতা করে দিতে তার বেশী দিন সময় লাগেনি। তারপর কোন এক অমাবস্যার রাতে গৃহত্যাগী হল বাউল। হায়, সারা জীবন যে মানুষটা ভরা পূর্ণিমার পূজা করল, গাঢ় অমাবস্যাই তাকে মুক্তি দিল।

আজ বিকালে গুলশানের ৭১ নম্বর রোডের ‘রোড হাউস’ নামের এই অভিজাত রেষ্টুরেন্টে কিছুক্ষণ আগে একজন লেখকের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হল। লেখককে দেখে মোটেই লেখক লেখক মনে হচ্ছিল না। মনে হল বড় কোন চাকরি করে। বাউল লেখাপড়া জানেনা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের ছবি দেখে কবি-লেখক সম্পর্কে তার যে আইডিয়া হয়েছে তার সাথে এনার কোন মিল নেই। রেষ্টুরেন্টের সামনের খোলা জায়গাটায়ই আয়োজন করা হয়েছে অনুষ্ঠান। এর পরই শুরু হল বাউল গান। এক সন্ধায় গানের জন্যে ২০ হাজার টাকা পাবে তার দল। এত সম্মানী কোন একদিনে বাউল জীবনেও পায়নি। কিন্তু বাউল একটু থমকে গিয়েছিল। সামনের গ্যালারী, রেষ্টুরেন্টের এই দিকটা এবং দোতালার বারান্দা মিলিয়ে প্রায় ৪০/৫০ জনকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কেউই গান শুনছেনা। যে যার কাজে ব্যস্ত। কিংবা হয়তো শুনছে। শুধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলেই তো আর গান শোনা হয় না! বাউলের চোখে ভেসে ওঠে গ্রামের আসর গুলির কথা। শত শত নিষ্পলক চোখ হুতুম পেঁচার মত তাকিয়ে থাকে বাউলের দিকে। তারা গান শোনেনা। গান খায়। চিবিয়ে চিবিয়ে খায়, চুমুক দিয়ে পানকরে। আর এখানে কেউ গান খায়না, শোনেনা শুধু সাজিয়ে রাখে। গান এখানে ফুলের টবের মত। মধ্যে দুপুরের মত প্রখর মেয়ে এখানে এই একটি নয়, আরও অনেক আছে। তবু এই মেয়েটি একটু বেশীই প্রখর, বেশী কড়কড়ে, বেশী চকচকে, বেশী গরম।



নিজ গুনে পদার বিন্দু

চরন দেন যদি সাঁই দিনবন্ধু

তবে তরি ভব সিন্ধু

আরতো না দেখি উপায়

বাউল আসলেই কোন উপায় দেখেনা। যা চেয়েছিল, তাকিসে পেয়েছে? যা পেয়েছে, তাকিসে চেয়েছে? চাওয়া-পাওয়ার ফলাফলের হিসেব মেলেনা। সখিনার দূঃখে বাউল ব্রহ্মচারী হয়েছিল। দুনিয়া ছেড়ে দিয়ে সাঁইজির সন্ধানে বেড়িয়েছিল। সাঁইজিকে সেকি পেয়েছে? দুনিয়াকেতো হারিয়েছেই। এখন কি সে আবার নতুন করে শুরু করবে, নাকি অনেক দেরী হয়ে গেছে। এই বয়সেকি শুরু করা যায়? বাউলের মাথা ঘোরে, গলা কাঁপে কিন্তু গান চলে। এই গান তার ভুল হবার নয়, ভুলে যাবার কথা নয়। প্রতিটি শব্দ তার মুখস্ত, কিন্তু আজ মূল্যহীন মনে হয়। এখানে আসার পর থেকে সে দেখছে, এখানে সবাই বড়োলোক, কেউ কারো কথা শোনেনা, ঘুরে ঘুরে গল্প করে, চা-কফি খায়, আড্ডা দেয়। এমনকি প্রধান অতিথি যখন ভাষণ দিচ্ছিল, তখনও অনেকেই হাসি ঠাট্টা করছিল। অথচ গ্রামের জনসভায়! উহ্ বাউলের হিসেব মেলেনা। সেকি উঠে চলে যাবে? নাহ্ এত গুলি টাকা! শুধুইকি টাকা? বিশ্বাস? দিলের উপর বিশ্বাস? গানের প্রতি ভালোবাসা? সাঁইজি? সব মিথ্যে? এতদিন সে যা জেনেছে সব মিথ্যে? মাথা টনটন করে। বাউলের নেশা দরকার, কঠিন নেশা, সে হারিয়ে যেতে চায়, ডুবে যেতে চায়। বাউল গনগনে সূর্যের দিকে তাকায়।



অহল্যা পাষানী ছিল

প্রভূর চরনধুলায় মানব হলো

লালন পথে পড়ে রল

এবার যা বারে সাঁই দয়াময়

সাঁই দয়াময় আর কি করবে? একদিন যখন বাউল স্কুল ছেড়ে সাঁই দয়াময়ের পিছনে ছুটেছিল তখন মনে হয়েছিল তার জীবন স্বার্থক, সে অনেক এগিয়ে গেছে। আর এখন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মনে হয় সামান্য রোদ্দুর স্পর্শ করার সামর্থও তার নেই। এই যে তার সামনের রাঙা চরন। বাউল তো আসলেই এই চরনের দাসের যোগ্য নয়।



মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে মার্চ, ২০১১ সকাল ১০:২৪

নষ্ট কবি বলেছেন: আহা কি লিখলেন.........

আমি ধন্য হলাম++++++++++

২| ২৮ শে মার্চ, ২০১১ সকাল ১০:৪১

পুংটা বলেছেন: alek shai....

৩| ২৮ শে মার্চ, ২০১১ সকাল ১০:৪৪

ফটো পাগল বলেছেন: Kothin + :)

৪| ২৮ শে মার্চ, ২০১১ সকাল ১০:৫০

মহান পংকজ বলেছেন: জঘন্য, অসাধারণ, চমৎকার, আর কি বলব এটা পড়ে ভাষাই হারিয়ে ফেলছি, সত্যি দারূন লিখেছেন।

৫| ২৮ শে মার্চ, ২০১১ সকাল ১০:৫৯

ম.শরীফ বলেছেন: ভাল লাগল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.