নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রুমে শুয়ে আছি,ফজর পরে এসে কেবল পিঠটা বিছানায় ঠেকিয়েছি। শীতকাল মানে এখন আনুমানিক ভোর ৬টা বাজে। দরজায় ধুম ধুম করে আওয়াজ হতে লাগল। এত ভোরে কে দরজায় আবার? সিনিয়র ব্যাচের কেউ নাকি? এত ভোরেতো জরুরী তলবের কথা না। ভয়ে ভয়ে হুড়মুড় করে দরজা খুললাম। চট্টগ্রাম টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ৪০৪ নম্বর রুম থেকে বলছিলাম। দরজা খুলতেই দেখি একটা মেরুন কালারের স্যুটকেস আর একটা গোলাপি কালারের ব্যাগ, সম্ভবত কাপড়ের ব্যাগ। মাথা বের করে ডানে তাকাতে দেখতে পেলাম এক ছেলে মোবাইলে কথা বলতে বলতে জুতা খুলছে।
--আচ্ছা মা এখন রাখো। আমি পৌঁছে গেছি। এখন যাও ঘুমাও। সারারাত জেগে আছো। আরে রুমমেট ভাল হবেনা কেন? চিন্তা করোনা। তোমার ছেলে ভালই থাকবে ইন-শা-আল্লাহ।
আমি হা করে আগত ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছু জিজ্ঞাস করার আগেই বলতে শুরু করল।
“আমিতো এখানেই থাকব তাইনা? আপনার বেড কি ডান পাশেরটা? তাহলে আমি বাম পাশেরটায় আমার আস্তানা গাড়লাম। রুমে কি খাওয়ার কিছু আছে? খুব খিদা লেগেছে। আচ্ছা চলো বাইরে থেকে নাস্তা করে আসি।“
আমি কিছুক্ষন তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটা অপরিচিত ছেলে একগাদা বস্তা স্যুটকেস নিয়ে রুমে এসেই বিছানা দখল করেছে। আবার আপনি থেকে এক সেকেন্ডে তুমিতে চলে এসেছে। কাহিনী কি, হচ্ছেটা কি? কিছু জিজ্ঞাস করতে যাব তখনই বলে উঠল, “আমি ফারহান তোমার নতুন রুমমেট চিন্তা করোনা। আমি খুব ভাল ছেলে। রুমমেট হিসাবে আমাকে পছন্দ করতে বাধ্য তুমি।“
এটা ছিল ফারহান আর আমার চট্টগ্রাম টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজর ৪ বছর রুমমেট এবং ক্লাশমেট হিসাবে পথ চলার শুরু। আমি নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এক ছেলে। বাবার ছাপোষা সংসারে অভাব অনটনে বড় হওয়া ছেলে আমি। সকালে নাস্তা খাওয়াটা আমার কাছে বিলাসিতা। আমি মানতেই পারিনা যে, সকালেও খেতে হবে। ফারহান সম্পূর্ণ আমার বিপরীত। সকালে ডিম পোচ, পরাটা, সবজি দিয়ে পূর্ণ নাস্তা। দুপুরে একেবার দুপুর একটার ভিতরে লাঞ্চ এবং রাতের ৮ টার ভিতরে ডিনার। এরপর ঘড়ি ধরে ৫ মিনিট মায়ের সাথে কথা সপ্তাহে দুই বা তিনদিন।
আমি এইদিক দিয়ে উলটো। আমি মায়ের সাথে প্রতিদিন কমপক্ষে আধা ঘন্টা কথা বলি, ঘুমানোর আগে। ক্লাশ টুতে যখন পড়তাম তখন স্কুলে কি কি ঘটেছে , চয়ন, কামরুল, অভি কি কি বলেছে আমার ছেঁড়া ব্যাগটা নিয়ে, মিস কিভাবে আদর করে দিয়েছে সব যেরকমভাবে বলতাম এখনও ভার্সিটিতে ক্লাশে কি কি হয়েছে , টিউশনিতে কি কি খেতে দিয়েছে সব বলি আম্মাকে।
একদিন রাতে রুমে আট-দশ জন ফ্রেন্ড মিলে আড্ডা দিচ্ছি। আম্মার ফোন এলো। সবাইকে হাতের ইশারায় বললাম সাইলেন্ট হতে। একটু আড়ালে গিয়ে কথা বলতে লাগলাম। কিন্তু হৈহুল্লোড়ের শব্দে বিরক্ত হয়ে রুমে এসে ধমক দিয়ে উঠলাম। এই তোরা থামবি? সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে মনে যে, মাম্মাস বয় বলে একচোট ক্ষোভ ঝাড়ল সেটা চেহারার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলাম। কথা শেষ করে রুমে আসলাম। সবাই চলে গেলে ফারহান আমাকে জিজ্ঞাস করল।
--কিরে মামুন তুই এখন ইয়াং একটা ছেলে। এখনও সেই ক্লাশ অন টুয়ের বাচ্চার মত ব্যবহার করিস কেন? মায়ের সাথেতো আমরাও কথা বলি। কই এত লুতুপুতুতো করিনা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। বললাম, “ শোন তাহলে দেখাই যে মা কেমন হয়? আমার বয়স যখন ১৩/১৪ তখন আমার ছোট বোন আমার মায়ের পেটে আসে। মানে আমার ছোটবোন আমার থেকে প্রায় দশ বছরের ছোট। আমরা সবাই খেতে বসেছি তিন ভাইবোন আব্বা আর আম্মা। আম্মা সকালে থেকে রান্নাবান্না করে সবার সাথে বসেছে। আমরা খাচ্ছি আম্মাও খাবার নিয়েছেন পাতে। ঠিক তখন আমার পিচ্চি বোন মায়ের পেটের ভিতরে পা দিয়ে জোরে ধাক্কা দিয়েছে তখনই মা খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এরকম একদুইদিন না অনেকদিন, অনেকবার। রাতে মাঝে মাঝে আমার ঘুম ভেংগে যেত, প্রশাব করতে গিয়ে দেখতে পেতাম। সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে সারাদিন খাটাখাটনি করা মা রাতেও ঠিকমত ঘুমাতে পারছেননা কারন পিচ্চি পেটের ভিতর নড়াচড়া করছে। ঠান্ডা লেগেছে , নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু ঔষধ খেতে পারছেননা কারন বাচ্চার ক্ষতিহবে এতে। আমার ছোট বোন জন্মের পর দেখেছি কতবার মা ঘুম থেকে উঠে গেছে। কতবার খেতে বসে খাবার ছেড়ে উঠে যেতে হয়েছে। সারাদিন না খেয়ে থেকেছে সংসারের কাজ করেছে। বাচ্চাকে কোলে রেখেছে সারাদিন অসুস্থ্য হলে। বাসায় বরবটি ভাজি রান্না হয়েছে। ছোটছোট করে আলু কেটে বরবটি একটু ভাজা ভাজা রান্না করেন আম্মা যেটা আমার এবং আম্মার খুব পছন্দের। সেদিন আমার এতই পছন্দ হয়েছে যে, আমি আম্মার কাছে আবার চেয়েছি ভাজি। আম্মা নিজের পাতেরটু্কু সব আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। সেদিনের ঘটনা আমার মনে থেকে গেল। এরপর এমনি এমনি আম্ম যাই খাইত আমি বলতাম আম্মা আমাকে একটু দেও। সাথে সাথে নিজের পাত থেকে সবটুকু আমাকে দিয়ে দিতেন।
আল্লাহ কি বলেছেন জানিস, “আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে।আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার শুকরিয়া ও তোমার মা-বাবার শুকরিয়া আদায় করো- (সুরা লুকমান : ১৪)।“
সেদিন অনেকরাত পর্যন্ত ফারহান মন্ত্রমুগ্ধের মত আমার গল্প শুনল। দেলওয়ার হোসেন সাইদীর মা নিয়ে করা ওয়াজ দিলাম। সেদিন রাতে দেখি ফারহান ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সকালে জিজ্ঞাস করলাম কিরে বোকা কি হয়েছে। বলল, আজই বাড়ি যাবরে অনেক দেনা জমে আছে মায়ের কাছে। বৃহঃস্পতিবার বাড়ি গেল আর ফিরে আসল শনিবার। এবার একটা ব্যাগ আরও বেড়েছে নতুন। রুমে এসেই সেই মেরুন কালারের স্যুটকেসটা খুলল। দেখলাম সেই স্যুটকেসে শুধু খাবার। শুকনা পিঠা, ভাজা ইলিশ মাছ, চানাচুরের প্যাকেট, নারিকেলের নাড়ূ , চিড়া ভাজা। এরপর থেকে ফারহান প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার বাসায় যেত আর স্যুটকেস ভর্তি করে খাবার নিয়ে আসত। সেই মেরুন কালারের স্যুটকেসটা থাকত আমার আর ওর বিছানার মঝখানে। আন্টি আমাদের দুইজনের জন্য খাবার পাঠা্তেন। প্রথম প্রথম সংকোচ লাগলেও পরে আর সংকোচ কাজ করেনি। যখনই মন চাইত খুলে খাওা শুরু করতাম। যখন আন্টির হাতের বানানো খাবারগুলো খেতাম তখন মনে হোত আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
ফারহানের রুটিন চেঞ্জ হয়ে গেল এখন ওর মায়ের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে। কখন গোসল করেছে, কয়টা ক্লাশ হয়েছে, নামাজে কি ঘটেছে, আমার কথা, ভার্সিটির স্যারদের কথা। আমিও আন্টির প্রতি মায়া অনুভব করি। কখনও দেখিনি তাকে। আমারও খুব মন চায় আন্টিকে একটু দেখি। এভাবে কেটে গেল চারটা বছর। লাস্ট সেমিস্টারের পিএল চলছে। এই পড়াশোনার চাপেও ফারহানের কথা বলা কমেনি আন্টির সাথে একচুলও। প্রথমদিন ওয়েট প্রসেসিং-২ পরীক্ষা। আমরা সন্ধ্যা থেকে টেবিলে পড়তে বসেছি। যথারিতী ফারহানের মায়ের ফোন এল। ও বারান্দায় চলে গেল। কিছুক্ষন পর ধুপ করে শব্দ হোল। বুঝার চেষ্টা করছি কি হোল। দৌঁড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি ফারহান অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ফোনটা হাতে নিতে শুনলাম ওপাশ থেকে বলছে আগামীকাল যোহরের পর জানাযা। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পল। বুক চিঁড়ে কান্না আসল। সাথে সাথে ফারহানের চোখে মুখে পানি দিয়ে ছুটলাম ওর বাড়িতে। ওকে যে কিভাবে নিয়ে গেছি ওর বাড়িতে আল্লাহই ভাল জানেন। সারা রাস্তা দমকে দমকে কান্না, আকাশ ভারি করা দীর্ঘশ্বাস আর অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বারবার।
ফারহান হলে ফিরে আসল ৪ দিন পর। বিধ্বস্ত একটা রুপ, এ এক অন্য ফারহান। রুমেই শুয়ে বসে কাটাল আরও তিন চারদিন। আর দুইদিন পরই সেমিস্টার ফাইনাল। বললাম, এই বছর ড্রপ দিবি?
--না না ড্রপ দিব কেন? এই পড়াশোনার জন্যইতো মা এতদুরে পাঠিয়েছে।এই পড়াশোনার জন্যইতো মাকে ছেড়ে থাকতে হয়েছে। পরীক্ষা শেষ করার পর ফারহান বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য তোরজোড় শুরু করল। কানাডা চলে গেল এক বছরের মাথায়। আমিও একটা চাকরিতে ঢুকে গেলাম। যেদিন ফ্লাইট ওর সাথে এয়ারপোর্টে গেলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই মায়ের মেরুন কালারের স্যুটকেসটা দেখে রাখিস। ভাল থাকিসরে। জড়িয়ে ধরল আমাকে। আমার পিঠে ওর চোখের পানির অস্তিত্ব টের পেলাম। কাঁদিসনা বলতে গিয়েও নিজে কেঁদে ফেললাম।
আজকে ১২ বছর পার হয়েছে। ফারহান দেশে এসেছে। বনানীতে একটা ফ্ল্যাটে উঠেছে। নিজের স্ত্রী আর দুই কন্যা নিয়ে। এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যেতে পারিনি। গাধাটা আমাকে খবর না দিয়েই এসেছে। আমার স্ত্রী আর কন্যা সেই মেরুন কালারের ব্যাগটা ভর্তি করেছে খাবার দিয়ে। ওর বাসায় কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিল। আমার হাতে ব্যাগ দেখে কেমন বিষন্ন হয়ে গেল। ঘরে বসে, আমি স্যুটকেসটা খুলতে বসলাম। সেই ভার্সিটির হলের মত মেঝেতে বসে আমি স্যুটকেসটা আনজিপ করলাম। স্যুটকেসে উঁকি দিচ্ছে আমার বউয়ের তৈরী করা শুকনা পিঠা, ভাজা ইলিশ মাছ, চানাচুরের প্যাকেট, নারিকেলের নাড়ূ , চিড়া ভাজা। স্যুটকেসের খাবারগুলো দেখতেই হু হু করে কেঁদে উঠল ফারহান। আমাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। ওর দুই বাচ্চা আর আমার কন্যা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল দুই মধ্যবয়স্ক পৌঢ়ের কান্না দেখে।
©somewhere in net ltd.