নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মনের বিপরীতে পার করে এসেছি সহস্রকাল, হঠাৎ এক উদ্ভ্রান্ত অবয়বে বেঁচে থাকি এপার ওপার।
আমাদের এলাকায় দুইটা সেলুন ছিল। চুল কাটার জন্য দুইটা সেলুনই বিখ্যাত আমাদের এলাকায়। মুন্নার সেলুন আর শহীদের সেলুন। শহীদের মামা ছিলেন ইব্রাহিম বিহারি, উনি ওই সময় সেলুনে চুল কেটে টাকা জমায়ে পবিত্র হজ্ব পালন করে এসেছিলেন,তাই এলাকার মুরুব্বি আর ভদ্রলোকেরা শহীদের সেলুনেই বেশি ভিড় করতেন।সিরিয়াল দিয়ে আসা লাগতো শুক্রবারে সকালে যেন জুম্মার আজানের আগেই চুল কাটা শেষ করে নামাজে যেতে পারে সবাই। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তা হয়ে উঠতো না।
সে সময়,মানে অনেক আগে খুব বেশি চুলের কাটিং স্টাইল বা এতো আধুনিক সেলুন ছিল না।
যারা চুল কেটে দিতেন তারাও এখনকার মতো আধুনিক বিউটিশিয়ান বা রূপলাবণ্য স্পেশালিস্টদের মতো ভংচং কাটিং দিয়ে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিতেন না বা বিভিন্ন ধরণের রূপ সৌন্দর্য সম্পর্কিত বিষয়ে সিডিউসিং করে ফাঁদে ফেলতেন না। তারা জিজ্ঞেস করতেন এই ভাবে,''চুল দাড়ি দুইটাই কাটমু নাকি খালি চুল ছাটবেন?'' যদিও তখন দাড়ি-মুছ উঠেই নি তাই আমার চুল কাটার বিষয়ে পরে আসতেছি।
সে সময়ের সেলুনে বসে থাকা এক দুই ঘন্টা সময়ে দুনিয়ার অনেক কিছু জানতে পারতাম, তবে সেগুলো সত্য না মিথ্যা তা বুঝতাম না তবুও কেন জানি সেসব শুনতে খুব ভালো লাগতো। বড়দের সেভিং করা দেখতাম খুব আগ্রহ নিয়ে, সেভিং শেষে যখন স্টিলের গেলাসে রাখা পানির ভেতর থেকে ভেজা ফিটকিরি নিয়ে গালে ঘষে দিতেন কেন জানি সে সময় খুব ভালো লাগতো। জেল, ফোম এসবতো তখন আসেইনি বাংলাদেশের জেলা শহরগুলোতে।ঐ যে সেভিং ব্রাশ আর কিরিম দিয়ে কত যত্ন করে গালে থুতনিতে ঘষিয়ে ঘুরিয়ে ফেনা উঠাইতে এসব এখন অতীত। তবে কিছু গ্রামের হাটে এখনো অনেক মুরুব্বিদের দেখা যায় ''হাঁটুর তলে কাল্লা '' দিয়ে দাড়ি কামাচ্ছে আগের দিনের সেই ব্রাশ আর কিরিম দিয়ে ফেনা তুলে। চুল দাড়ি কাটা শেষে হাত উচা করে দিতো কিছু কিছু মানুষ। কি কাটতো তা না হয় নাই বললাম, বুঝে নিয়েন।
এবার আসি আমার ঘটনায়। তার আগে বলে নেই, ছোটদের চুল কাটার জন্য চেয়ারের ওপর একটা সাহায্যকারী চওড়া আর লম্বা কাঠ ব্যবহার করতো নাপিতেরা। অনেকেই বুঝতে পারবেন হয়তো। আমার বাবা ছিলেন এক কথার মানুষ। জীবনে তার সাথে আমার যত কথা কাটাকাটি হয়েছে তার মধ্যে প্রায় ৯৮ ভাগ চুল কাটা নিয়ে। আমার চুল কাটানো হতো শহীদের সেলুন থেকে। শহীদ মামা বলেই ডাকতাম নাপিতকে। আব্বুর কড়া নির্দেশ ছিল আর্মি কাটিং দেওয়ার জন্য। এলাকায় সমবয়সী সবাই আর্মি কাটিং দেওয়ার পরে মজা করে বলতো ''চাম ছাট'' দিছে। সে সময় এটা মেনে নেওয়াও খুবই কষ্টকর ছিল।
একবার ঈদের আগে আব্বুর নিষেধ অমান্য করে মায়ের থেকে অনুমতি নিয়ে গিয়েছিলাম মুন্নার সেলুনে। ঈদের মধ্যে অনেক ছেলেরাই রাহুল কাট বা টাইটানিক কাট দিতো। যারা একটু বয়সে বড়ো তারা সব সময়ই এসব কাট দিতো। আমার খুব ইচ্ছে হতো রাহুল কাট দেওয়ার জন্য বা টাইটানিক কাট দেওয়ার। ঈদের দুইদিন আগে মায়ের থেকে ১০ টাকা নিয়ে গেলাম মুন্নার সেলুনে, প্রচুর ভিড়। মুন্নাকে যেয়ে বললাম রাহুল কাট দিয়ে দেওয়া লাগবে। মুন্না আমাকে দেখে বললো আপনার আব্বাকে লিয়ে আসেন তারপর চুল কাটমু। সে জানে আমি শহীদের সেলুনে চুল কাটি তাই ভয়ে চুল কাটতে চাচ্ছিলো না। পরে বললাম আব্বুই টাকা দিয়ে পাঠাইছে চুল কেটে দেওয়ার জন্য। হাতের মধ্যে টাকা দেখে তারপর বসাইছে চুল কাটার জন্য। অবশেষে আমার প্রতীক্ষিত রাহুল কাট দিয়ে দিলো। খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ি এলাম। আব্বু বাড়িতে নেই। মা সাবান আর ঝিঙের খোসলা দিয়ে ডলে গা মাথা ঘুসে গোছল করিয়ে দিলো। মাকে বললাম আব্বু দেখলে যদি মারে তখন তুমি আটকাবে। মা বললো ঠিকাছে আসলে আমি বুঝিয়ে বলবনি। সন্ধ্যায় ইফতারের আগে আব্বু বাসায় আসলো। আমি আব্বুর সামনে আসছিনা। শীতের সময় ছিল তাই মাথায় মাফলার দিয়ে পেঁচিয়ে ইফতার করতে বসলাম। আজান দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে আব্বুর চোখ পড়লো আমার চুলের দিকে। মুখে পানি না দিয়েই বললো মাফলার খুলো।আমি উঠে দৌড় দিতে নিয়েছি আর খপ করে ধরে ফেলছে। মাফলার খুলে দেখে চুলের অবস্থা বেহাল (তার ধারণা অনুযায়ী )। কিসের ইফতার কিসের রোজা আগে আমার চুল ধরে টানাটানি। মা উঠে আগেই সরে গেছে। আমি তো ভয়ে দিয়েছি চিৎকার। পাশের বাড়ি থেকে আমার মায়ের খালা দৌড়ে আসছে। এসে বুঝে শুনে আব্বুর মাথা ঠান্ডা করে ইফতার খাওইলো। আব্বু জিজ্ঞেস করলো কে চুল কাটছে এইভাবে। আমি ভয়ে শহীদের নাম বলছি। যদি শুনে মুন্নার সেলুনে গিয়েছিলাম তাইলে প্রহারের মাত্রা বেড়ে যাবে। নামাজ শেষ করেই আমাকে নিয়ে রওনা দিলো শহীদের সেলুনের দিকে।বেচারা মাত্র ইফতার করে উঠেছে আর আব্বু যেয়ে হাজির আমাকে সাথে নিয়ে।
-এই বালসিরুখা (আব্বু খেপে গেলে এই গালিটা ব্যবহার করতেন) এ কি চুল কাটছো ?
-ভাই, এই চুল তো আমি কাটিনি (তিন পা পেছনে যেয়ে শহীদ মামার উত্তর)।
-তো কে কাটছে?
আমি কান্না করতে করতে বললাম মুন্না মামা কাটছে। আর কই যাই, শুরু হয়ে গেলো মাইর। সেলুনের দুই একজন এগিয়ে এসে আমাকে মুক্ত করে নিলো। শহীদ মামা বললো ভাই আমি ভালো করে চুল কেটে দিচ্ছি, আপনে আর মাইরেন না। ওই সময়ই আমাকে আবার চুল কাটায়ে আর্মি ছাট দিয়ে বাসায় এনে মায়ের সাথে এক দফা ঝগড়া করে ক্ষান্ত হইছিলো আমার বাবা।পরবর্তী ১০ বছর ভুলেই গিয়েছিলাম এলাকায় আরো নতুন নতুন সেলুন হয়েছে।
বাবার বয়স হয়েছে এখন কিন্তু চুল কাটেন ওই শহীদ মামার কাছেই। জীবনের তাগিদে বাসা থেকে এখন বাহিরে। যদি কখনো মাকে বলি চুল কেটে এলাম বাবা পাশে থেকে মাকে বলে ভিডিও কল দাও, দেখি ওর কানের সাইডের চুল গুলো ঠিকমতো মিলাইতে পারছে কিনা নাপিত। মা হাসেন ভিডিও কল দিয়ে আব্বুকে দেখায় আমার চুল। আব্বু বলে হয়নি চুল কাটা। এসব নাপিতেরা চুলই কাটতে পারে না। গতবছর ঈদের সময় সুযোগ হয়েছিল আব্বুকে চুল কাট তে নিয়ে যাওয়ার।শহরের সবচেয়ে আধুনিক সেলুনে নিয়ে গিয়েছিলাম আব্বুকে। আমি মন খারাপ করবো বলে অনেক কষ্টে উনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে চুল কেটে দাড়ি সাইজ করে নিয়ে এসেছিলাম। মনে মনে ভাবলাম যাক আব্বু এবার তার নিয়ম থেকে বের হইছে। সব আত্মীয় স্বজনদের বলতে পারবো আব্বু অন্য সেলুনে গিয়েছিলো। পরদিন সকালে মা এসে বললো "তোর আব্বু রাতে শহীদের সেলুনে গিয়েছিলো, দাড়ি কাটা নাকি ঠিক হয়নি, ওখান থেকে ঠিক করে নিয়ে আসছে।''
২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:০৮
মায়াস্পর্শ বলেছেন: ধন্যবাদ এতো বড় লেখা পড়ার জন্য।
ভালো থাকবেন সবসময়।
২| ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:১২
এসো চিন্তা করি বলেছেন: ভালো লিখেছেন ভাই আমার লেখাগুলো পড়ার আমন্ত্রণ রইলো
ধন্যবাদ ভাই ☺️❤️
২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:১৩
মায়াস্পর্শ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে ।
৩| ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯
সৈয়দ মোজাদ্দাদ আল হাসানাত বলেছেন: আপনার বাবা তো আমার বাবার মতোই রাগি।
২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০
মায়াস্পর্শ বলেছেন: ধন্যবাদ। ওই সময় প্রতিটি বাবাই চুল কাটানোর জন্যএমন কড়াকড়ি থাকতেন।
ভালো থাকবেন।সবার বাবাই ভালো থাকুক।
৪| ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:১৩
আলমগীর সরকার লিটন বলেছেন: বেশ স্মৃতিময় লেখনি শুভ কামনা রইল
৫| ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৯
রাজীব নুর বলেছেন: আহ ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিলেন।
৬| ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০
মিরোরডডল বলেছেন:
স্মৃতিচারণ থেকে অনেক মজার কিছু অভিজ্ঞতা জানলাম।
যেটা ভালো লেগেছে, একটা সময়ের পর বাবা হয়ে যায় সন্তান, আর সন্তান হয়ে যায় বাবা।
ছোটবেলায় যে বাবার ভয়ে তটস্থ ছিলো, সেই বড় হয়ে বাবাকে আধুনিক সেলুনে নিয়ে গেছে।
বাবাও বাধ্য সন্তানের মতো সাথে গেছে, না বলেনি ছেলে মন খারাপ করবে বলে।
জীবনে ছোট ছোট বিষয় কত আনন্দময় হয়।
লেখাটা পড়ে আমার একটা স্মৃতি মনে পড়ছে।
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩৫
কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: স্মৃতিময় দিনগুলো। যে যাহাতে অভ্যস্ত সেটাতেই সে সুখ পায়।
ভালো লাগলো