নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবন কেবলই ফুরিয়ে যায়।

মোঃ মাইদুল সরকার

একদিন জীবন শেষ হয়ে যাবে তবুও অনেক কিছু করার সাধ জাগে..............

মোঃ মাইদুল সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

কিছু স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে।

১৭ ই মে, ২০২৩ সকাল ১১:৫৫





১৯৯৩ সাল বাবা আমাদের তার চাকরি স্থলে নিয়ে গেলেন দিনাজপুর সেনানিবাসের কোয়াটারে। তার আগ পর্যন্ত আমরা গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। ফিরে যাই ১৯৯১ কিংবা ১৯৯২ সালগুলোতে। প্রতিবছরই শীতের আগে গম খেতের ফসল বুনার জন্য গম ছিটিয়ে দেওয়া হতো। আমার মত ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর এ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা সূর্য উঠার আগেই কুয়াশা ভোরে সেই গম খেত পাহারা দেওয়ার জন্য রওনা হতো। সঙ্গে থাকতো শীতের পোশাক হিসেবে কারো সুয়াটার, কারো বা শাল, কারো বা মাফলার। সাথে হালকা নাস্তা চিড়া, মুড়ি কিংবা খই অথবা মোয়া আর এক জগ পানি।

বাবা- মারা ভোর বেলা নামাজ পড়ে ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দিত খেতে। সফল বুনার সময় খেতেই যেতে হতো অন্য সময় আরবি শিক্ষা করার জন্য মসজিদে। সূর্য ওঠার পরপরই পাখিরা ভিড় জমাতো এইসব গম জাতীয় শস্য দানা খাওয়ার জন্য। বিশেষ করে শালিক পাখি ও কাক এই গম খেয়ে ফেলত। তাই পাখি থেকে ফসল রক্ষায় পাহারা দেওয়ার জন্য ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাই ছিল একমাত্র হাতিয়ার।

চাচতো ভাই- বোন, পড়ার অন্যান্য ছেলেমেয়েরা যার যার খেতের লাইনে বসে থাকতাম। পাখি আসলেই কিংবা খেতে বসতে চাইলেই মাটির ঢেলা দিয়ে ঢিল দিতাম। পাখিরা ভয়ে চলে যেত। কাকাগুলো বড়ই বদ। বেশি ভয় পেতে না, ঢিল খেয়ে দূরে গিয়ে আবার সবত। তখন দৌড়ে গিয়ে তাড়াতে হতো।

বেলা বাড়লে শীতের কাপড় খুলে খেতের আইলের উপর বেড়ার গায়ে ঝুলিয়ে রাখতাম তারপর শুরু হতো খেলাধুলা। সবাই ঝিনুক বা শামুক কুড়িয়ে মাটির ঢেলাতে সুনিপুণভাবে গর্ত করে হারি পাতিল বানাতাম। মেয়েরা তাদের পুতুল নিয়ে আসতে সাথে রান্নাবান্না শুরু করতো আর ছেলেরা খাল বা পুকুর থেকে পানি আনতাম, পাতা বা ফুল বাজার হিসেবে নিয়ে আসতাম। দুই তিন দলে ভাগ হয়ে পুতুলের বিয়ে দেওয়ার খেলা শুরু হতো। খেলতে খেলতে কারো কারো পুতুল চুরি হয়ে যেত। কে চুরি করেছে তা কেউ স্বীকার করতো না। এটা ঝগরা ও মারামারি লেগে যেত।।

তখন যে যার খেতে ফিরে গিয়ে মাটির ঢেলা দিয়ে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঢিল মেরে ঘায়েল করার চেষ্ঠা করা হতো। তারপর কথা বলাবলি বন্ধ হয়ে যেত এমনকি মুখ দেখা দেখিও। আবার একটা সময় মিটমাট হয়ে যেত। নাস্তার সময় হলে একজন বাড়িতে গিয়ে নাস্তা নিয়ে আসত। নাস্তা হিসেবে থাকতো কারো রুটি, আলু ভাজি, কারো গরম ভাত, ডাল, তরকারি আবার কেউ নিয়ে আসতো গরম গরম ভাপা পিঠা যেটাকে আমাদের এলাকায় বলতে ডুপি পিঠা।

কার বাড়ি থেকে কি নাস্তা এলো সেটা দেখার পর নাস্তাগুলো সবাই ভাগাভাগি করে খেতাম। এটা ছিল খুবই মজার একটা ব্যাপার যে অনেক রকমের নাস্তা এক সাথে খাওয়া হচ্ছে।

খুব আনন্দের ছিল দিনগুলো। দুই বা তিন মাস পর এই গম পেকে গেলে কেটে বাড়িতে আনা হতো। তারপর বাড়ির মহিলারা গম কাটতে বসত। গমেরর আগাটা কেটে আলাদা করে রেখে দিত আর বাকি অংশ রান্নার জন্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা হতো। কমের শীষ বা আগা কাটা হয়ে গেলে রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে অনবরত বাড়ি দিয়ে গুড়া করা হতো। তারপর চালুন দিয়ে চেলে গমগুলো আলাদা করা হতো।

রোদের মধ্যে এসব কাজ করতে করতে ঘাম বেরিয়ে যেত আর তৃষ্ণায় বুকের ছাটি ফেটে যেত তখন এক গ্লাস লেবুর শরবত যেন অমৃত মনে হতো। গমগুলো পর পর কয়েক দিন রোদে শুকিয়ে বস্তায় ভরা হতো। পরে সুবিধা মত সময়ে মেশিনে ভাঙ্গিয়ে আটা করে রুটি খাওয়া হতো ও বিক্রি করা হতো। গিরস্তি করা মানেই পরিশ্রমের কাজ।

তো একদিন গম রোদে শুকাতে দিয়ে আমরা দুই ভাই-বোন উঠানে বসে পাহারা দিচ্ছি পাখি কিংবা হাঁস মুরগিতে গম না খেয়ে ফেলে। হঠাৎ কি কারনে যেন আমরা গম ফেলে অন্যদিকে চলে গিয়েছি (সম্ভবত সাপুড়ের সাপের খেলা দেখতে) কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দেখি একপাল মুরগি কম খাচ্ছে। ঠিক তখনই মা একটা লাঠি নিয়ে মুরগিগুলো তাড়িয়ে দিলেন। আমাদের দুই ভাই বোনকে চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘কেন আমাকে অন্য কাজ ফেলে আসতে হলো। তোরা কি করছিলি ? এত কষ্টের ফসল মুরগি খেয়ে ফেলল। আজ তোদের খাবার বন্ধ। দরকার নেই তোদের কাজ করার, চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা।’

সত্যি সত্যি সেদিন আর আমাদের খাওয়া হলনা। দুপুর গড়িয়ে যায় মা ভাত খেতে ডাকেনা। আমরাও ভয়ে যাই না, যদি মাইর দেয়। আমার চাচা তিনি তখন আমাদের সাথেই থাকতেন। তিনি কোন কাজই করতেন না। খাওয়ার সময় খেয়ে বাকিটা সময় বাজারে কিংবা অন্য জায়গায় আড্ডা মারতে চলে যেতেন। সেদিন দুপুরে তিনি খেয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন আমরা দুই ভাই বোন পাশের ঘরের চিপায় দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আমাদের অভুক্ত দেখেও খাওয়ার কথা না বলে বললেন, ‘হারামজাদাগুলো কোন কাজই ঠিক মতো করে না। যা ঘরে যা।’
চাচা যদি ধরে নিয়ে যায় তাই ভয়ে আমরা দৌড়ে অন্য জায়গায় চলে গেলাম। বিকালের দিকে দাদী এসে আমাদের হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ভাত খাওয়ালেন। আমাদের চোখে তখন জল ছল ছল করছে।

আসলে এখন বুঝি যে সংসারে বাবা কাছে থাকে না, সে সংসারে ছেলেমেয়েদের মূল্যায়ন কম হয়। মাকে একা হতে পুরু সংসার সামলাতে হতো । তার উপর দাদী ও কাকার থাকা- খাওয়ার দায়িত্ব পালন করতে হতো। তার উপর ষোল আনা গিরস্তি ছিল। আরও একটি ছোট ভাই ছিল মায়ের কোলে। এত কাজ করতে গিয়ে, সব দিক ঠিক রাখতে না পেরে মা সেদিন রাগ সামলাতে পারেননি। চাচা বা দাদীকে তো কিছু বলতে পারেননা তাই হয়তো আমাদের এরকম শাস্তি দিয়েছিলেন।


বাবা যেহেতু সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন তাই ছুটিছাটা খুব কমই পেতেন এবং বাড়িতে কম আসতেন। তাই আমরা বাবার হাত ধরে স্কুলে প্রথম দিন ভর্তি হতে যেতে পারিনি। আপন চাচা ও সেই দায়িত্ব পালন করেনি। বাড়ির অন্য এক চাচার হাত ধরে আমারা যমজ ভাই বোন প্রথম স্কুলে যাই ও ভর্তি হই।

এভাবেই আনন্দ-বেদনায় শৌশবের রঙিন দিনগুলো পেরিয়ে গেছে। আজ তা কালের আবর্তে স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে।


ছবি-নেট থেকে নেওয়া।

মন্তব্য ২৪ টি রেটিং +১২/-০

মন্তব্য (২৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই মে, ২০২৩ দুপুর ১:৩০

রাজীব নুর বলেছেন: এখন যারা শৈশব পার করছে অসহায় ও দরিদ্র অবস্থার মধ্যে তাদের কথা ভাবেন? তাদের জন্য কিছু করেছেন?

১৭ ই মে, ২০২৩ বিকাল ৩:৩৭

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: অবশ্যই ভাবি। ধন্যবাদ।

২| ১৭ ই মে, ২০২৩ দুপুর ২:০১

আমি সাজিদ বলেছেন: আপনার সেই চাচার পরে কি হলো?

১৭ ই মে, ২০২৩ বিকাল ৩:৩৯

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
তাকে আমার বাবা সেনাবাহিনীতে চাকরির সুযোগ দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি চাকরিতে যোগ দেননি। আমার বাবার টাকায় জার্মানীতে পাঠিয়েছিলেন তিনি চলে এসেছেন শেষ পর্যন্ত তিনি জীবনে কিছুই করতে পারেননি। ধন্যবাদ।

৩| ১৭ ই মে, ২০২৩ বিকাল ৩:২৩

জ্যাক স্মিথ বলেছেন: স্মৃতি কথা পড়ে ভালো লাগলো।

১৭ ই মে, ২০২৩ বিকাল ৩:৩৯

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
ধন্যবাদ।

৪| ১৭ ই মে, ২০২৩ বিকাল ৪:৪০

নাজনীন১ বলেছেন: গম পাহারা দেয়া, এটা একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা। আমি মনে হয় কখনো গমের ক্ষেত কাছ থেকে দেখিনি! আপনি পাটের ক্ষেত দেখেছেন?
আপনার এই ব্লগ পড়ার সময় আমার একটা গানের কথা মনে পড়ে গেল!

ও পাখি তোর যন্ত্রণা!

১৭ ই মে, ২০২৩ রাত ৮:০৫

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: আপনি গ্রামে গেলে হয়তো গম ক্ষেত দেখতে পাবেন। কি যে বলেন আপু পাট ক্ষেত দেখবো না। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন প্রায় বর্ষার আগে প্রতিটি জমিতেই পাট লাগানো হতো। গাছ বড় ও লম্বা হয়ে গেলে বর্ষার পানি খেতে প্রবেশ করত। আর তখন আমরা গোসল করতে গেলে এই পাট লুকোচুরি খেলতাম। মেয়েরা পাট ক্ষেতের কাছ দিয়ে যেতে ভয় পেত কারণ অসংখ্য বিচ্ছু কিলবিল করতো পাট পাতার উপর। গানটা শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ । ভালো থাকবেন।

৫| ১৭ ই মে, ২০২৩ বিকাল ৫:০২

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:
শৈশবের স্মৃতিমাখা কথামালা শুনে ভাল লাগল ।
এত কষ্টের ফসল মুরগীতে খেয়ে ফেলল, মাকে
বলতে পারতেন আমরা যে মুরগীকে খেয়ে ফেলি
তার কি হবে !!!

শুভেচ্ছা রইল

১৭ ই মে, ২০২৩ রাত ৮:০৭

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: সে কথা ওই মুহূর্তে বলার উপায় ছিল না। দেশি পালিত মুরগির মাংস খাওয়ার টেস্ট ই আলাদা। ধন্যবাদ ।ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।

৬| ১৭ ই মে, ২০২৩ বিকাল ৫:৪৩

ঢাবিয়ান বলেছেন: সহজ সরল গ্রাম্য জীবনের সুন্দর বর্ননা। খুব ভাল লাগলো পড়ে। +++++

১৭ ই মে, ২০২৩ রাত ৮:০৮

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: পাঠ ও মন্তব্যে কৃতজ্ঞতা জানবেন। অনেক ধন্যবাদ।

৭| ১৭ ই মে, ২০২৩ রাত ১০:৩০

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: আমার বাবা বিদেশে ছিলেন। বিপদেআপদে কোনো কাকা এগিয়ে আসেননি।

১৮ ই মে, ২০২৩ সকাল ১০:৩৪

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
সবার কাকা/চাচা ভাগ্য ভালো না। এ ব্যাপারে আপনার মত আমিও হতভাগা। ধন্যবাদ।

৮| ১৮ ই মে, ২০২৩ সকাল ১০:০১

কল্পদ্রুম বলেছেন: গম ক্ষেত পাহারা দেওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে নতুন। সম্পূর্ণ লেখাটাই খুব মায়াভরা। ভালো লাগলো মাইদুল ভাই।

১৮ ই মে, ২০২৩ সকাল ১০:৩৫

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
অনেক দিন পর দেখলাম আপনাকে। আশা করি ভাল আছেন ভাই। পাঠ ও মন্তব্যে আন্তরিক ধন্যবাদ।

৯| ১৮ ই মে, ২০২৩ সকাল ১০:৩৬

কিরকুট বলেছেন: শৈশব সব সময় মধুর হয় না ।কিছু স্মৃতি থাকে যা মানের ভেতর গভীর ভাবে দাঁগ কেটে যায় ।

২১ শে মে, ২০২৩ সকাল ১০:৫১

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
ঠিক ভাই, কিছু স্মৃতি দাগ কেটে যায়। ধন্যবাদ।

১০| ১৮ ই মে, ২০২৩ দুপুর ১২:০৫

শাওন আহমাদ বলেছেন: সেই চাচা তার পরবর্তী জীবন কিভাবে কাটিয়েছেন জানতে চাওয়া আমার মন। সুখ-দুঃখ মিলেই আমাদের স্মৃতি।

২১ শে মে, ২০২৩ সকাল ১০:৫৩

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
তিনি কিছুই করেননা। শুধু জমি বিক্রি করেন আর সেই টাকা দিয়ে চলেন। ধন্যবাদ।

১১| ২২ শে মে, ২০২৩ সকাল ১১:১৫

জটিল ভাই বলেছেন:
গম পাহারা দেয়া আমায় ধান পাহারা দেবার কথা মনে করিয়ে দিলো। হায়রে আমার মায়া ভরা ছোটবেলা!!!
লিখা বরাবরের মতোই সাধারণ নয় প্রিয় ভাই :)

২৪ শে মে, ২০২৩ রাত ৮:২৯

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: ধান পাহারা নিয়ে একটি স্মৃতি পোস্ট করুন। লেখাই উৎসাহ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ ভালো থাকবেন।

১২| ২৪ শে জুন, ২০২৪ রাত ৯:১৬

খায়রুল আহসান বলেছেন: হৃদয়স্পর্শী স্মৃতিকথা।
আমাদের ছোটবেলায় গম তেমন আবাদ হতে দেখিনি। চরাঞ্চলে কিছু লিছু হতো। এখন তো অনেক হয়।
আলস্য ও অকর্মণ্যতার প্রতীক আপনার সেই চাচা।

৩০ শে জুন, ২০২৪ দুপুর ২:০১

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
ধন্যবাদ। সেই চাচা জীবনে আর কিছুই করতে পারেননি, বাবা তাকে সেনাবাহীতে চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন, চলে এসেছে, বিদেশ পাঠিয়েছিলেন সেখান থেকেও চলে এসেছে। সারা জীবন অকর্মাই থেকে গেল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.