নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমাজ বদলাতে হবে। অনবরত কথা বলা ছাড়া এ বদ্ধ সমাজ বদলাবে না। প্রগতিশীল সকল মানুষ যদি একসাথ কথা বলতো তবে দ্রুতই সমাজ বদলে যেতো। আমি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে অনবরত বলতে চ

মুজিব রহমান

মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ

মুজিব রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

একযুগ আগের হুমায়ুন আজাদের আক্রান্ত হওয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যা ঘটেছিল

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৩৩

২০০৪ সালের বই মেলার একটি বিষয় হুমায়-ন আজাদ লক্ষ্য করেন এবং আগামী প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী ওসমান গণিকে জিজ্ঞাসা করেন, মৌলবীরা এবারের মেলায় আমাদের স্টলে এতো ভিড় করছে কেনো? বিষয়টি তাঁর চোখে পড়েছিল মেলার শুরু থেকেই। ইউনিভার্সিটিতে তার রুমে শুকনো হাড় পেয়েছিলেন বইমেলা চলাকালেই। তখন ওটাকে খুব গুরুত্ব দেন নি। আসলে এটা ছিল সিম্বলিক। কিন' তাকে হত্যা করার উদ্যোগ নেয়া হতে পারে এটা কখনো ভাবেন নি। ২৭ ফেব্রুয়ারী ০৪ হুমায়-ন আজাদ অন্য দিনের মতো বইমেলার আগামীর স্টলে বসেছিলেন। স্টল থেকে তিনি বের হন সম্ভবত রাত ৯টার দিকে। তারপর হাঁটেন, কয়েকজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন। লেখক চত্বরে রফিক আজাদ ও মোহন রায়হানসহ কয়েকজন লেখক ছিলেন। তাঁরা তাঁকে বসতে বলেন। তিনি তাঁদের সঙ্গে বসেন, একটু সিগারেট খান। সেখানে ছবি তোলা হয়। তারপর আমি যাব বলে বের হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তাটি পার হওয়ার চেষ্টা করেন। এরপর তাঁর কিছু মনে নেই।
আক্রমন করেই ঘাতকরা বোমা ফাটিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দিয়ে পালিয়ে যায়। প্রথমে তাকে পুলিশ ও উৎসাহী জনতা ঘিরে রাখে। উপুর হয়ে থাকায় কেউ চিনতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সদস্য হাসান শরীফ মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদকে তোলেন। তিনি চিনতে পারেন হুমায়ুন আজাদকে। রক্তে ভেজা মুখ দেখে চিৎকার করে উঠেন। সা্যারের এক পাশের গাল দুই ভাগ হয়ে দুদিকে চলে গিয়েছিল। পুরো মুখটা হা হয়ে ছিল। তিনি দুপাশে চাপ দিয়ে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেন। তারা হাসপাতালে নেয়ার জন্য রিক্সায় উঠানোর চেষ্টা করেন। সম্ভব না হওয়াতে গাড়ির চেষ্টা করেন। কেউ রাজি হয়নি। এরপর পুলিশের ট্রাকে করেই তাকে হাঁসপাতালে নেয়া হয়। ট্রাকে উঠানোর আগে হাসান শরীফের বন্ধু ও সিনিয়র জনাব বিটু ট্রাকে উঠেন। উঠানোর আগে সাংবাদিক জনাব পাভেল ছবি তোলেন। সেই ছবিই পরদিন পত্রিকায় আসে। হুমায়ুন আজাদের পাশেই ছিলেন হাসান শরীফ; পত্রিকায় তার ছবিও আসে। এ নিয়ে তিনি ভোগান্তির মধ্যেও পড়েন। ট্রাকে উঠালে স্যার জিজ্ঞাসা করেন, বাবা আমাকে কই নিয়ে যাও? হাসান শরীফ বলেন, হাসপাতালে। স্যার বলেন, আমার চশমা কই? হাসান শরীফ বলে, স্যার আছে। স্যার বলে, আমি পুলিশের গাড়িতে যাবো না। হাসান শরীফ বলেন, ঠিক আছে স্যার আমরা নেমে যাবো এখুনি। হাসান শরীফ তার ব্লগে লিখেছেন, আহত রক্তাক্ত অবস'ায় আমি কোন মানুষকে এতো শক্ত থাকতে দেখিনি। অন্য কেউ হলে এতো ব্যাথা নিয়ে চিৎকার করতো। ভয় পেতো, কিন' স্যার খুব শক্ত দৃঢ় চিত্তে বসে আছেন যেন কেউ কোন ভুল করেছে। কেউ যেন ভুল করে তাকে কুপিয়ে গেছে। ট্রাক ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগের সামনে গিয়ে থামে। তারা স্যারকে জরুরী বিভাগে নিয়ে গেলেন। আক্রান্ত হওয়ার পওে পার হয়েছে মাত্র ১১ মিনিট। তারা ৫টাকা দিয়ে স্লিপ কাটলেন। ওয়ার্ডে নিয়ে গেলে চিকিৎসক স্লিপ চাইলেন। সেটা ততক্ষণে রক্তে ভিজে গিয়েছিল। ডাক্তার আবারো স্লিপ আনতে বললে তারা আবারো স্লিপ আনেন। শুরু হয় হুমায়ুন আজাদের চিকিৎসা।
হুমায়ুন আজাদের তারপরও যা মনে পড়েছে তা হল তিনি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তাঁর মেয়ে স্মিতা আজাদকে দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা এখানে এলে কী করে? তার আগে তাঁর পকেট থেকে মোবাইল, মানিব্যাগ ও হাতঘড়ি তাকে দেন। এরপর আর কিছু তাঁর মনে নেই। পরে যখন তিনি জেগে উঠেন তখন ৩ মার্চ। মাঝখানের সময় তাঁর কিছু মনে নেই। তাঁর সম্ভবত তখন খুবই প্রশ্রাবের প্রয়োজন হয়েছিল। বাংলা একাডেমিতে লেখকদের জন্য এর আলাদা কোন ব্যবস'া নেই বলে সম্ভবত রাস্তা পেরিয়ে ওই পাশে গিয়ে প্রশ্রাব করেন। তারপরে পূর্ব দিকের ফুটপাত ধরে তিনি এগোতে থাকেন। সম্ভবত যখন তিনি অটমিক এনার্জির বিপরীত দিকে আসেন তখন মৌলবাদী অপশক্তির পরিকল্পনা অনুযায়ী শায়খ আঃ রহমানের ছোট ভাই আতাউর রহমান সানীর নেতৃত্বে কয়েকজন উগ্র মৌলবাদী তাঁকে আক্রমণ করে। কিন' এসব কিছুই তাঁর মনে নেই। এ অংশে তিনি সম্পূর্ণ স্মৃতিভ্রষ্ট। তাঁর তখন মনে পড়েছিল যে, তিনি চিৎকার শুনছেন ছাত্রদের, তারা বলছে: হুমায়-ন আজাদ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর- পুলিশ; তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, তাঁকে একটি কাটা পাঙ্গাস মাছের মতো টেনে পুলিশের গাড়িতে তোলা হচ্ছে।
তিনি আক্রান্ত হওয়ার পরে সুস'্য হওয়ার পরেও ঐ দৃশ্যের কথা মনে করতে পারেন নি। যারা তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল তারা তাকে প্রথমে গলার দিক থেকে কেটে ফেলতে চেয়েছিল; না-পেরে তারা মুখের উপর ঘা দিয়েছিল, এবং তারপরেও না-পেরে হয়তো মাথায় ঘা দিয়েছে এবং তিনিতো অদম্য মানুষ- সেজন্যই হয়তো তারা সম্পূর্ণ সফল হতে পারে নি; এবং খুব অবাক ব্যাপর যে, তার হাত কাটেনি কিন' বাহুর অংশ কেটেছে। বই মেলা থেকে ফেরার সময় প্রতিদিন দুটো করে বই নিয়ে আসতেন। তিনি হয়তো সেই বই দিয়ে ফিরিয়েছিলেন, ফলে তাঁর হাত কাটেনি কিন' বাহুতে তারা আক্রমণ করতে পেরেছে। পত্রিকায় যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে রক্তাক্ত; ঝরঝর করে তাঁর মুখমন্ডল থেকে রক্ত পড়ছে এবং নিজের চিবুক নিজে চেপে ধরে আছেন: তিনি তখন হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর চিবুক-মুখমন্ডল শরীর থেকে খসে পড়ছে। পুলিশই তাকে উদ্ধার করে। পুলিশের গাড়িতে করে প্রথমে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
দ্রুতই খবর রটে যায়। আগামী প্রকাশনীর সত্তাধিকারী ওসমান গণি খবর পেয়ে হুমায়ুন আজাদের স্ত্রীকে খবর দেন। সেখান থেকে খবর পান আরেক ভাই সাজ্জাদ কবীর বাদল। তাঁর কাছ থেকে খবর পান ছোট ভাই মঞ্জুরুল কবীর মাতিন। তবে কি ঘটেছে তখনো তাদের কাছে ছিল অজানা। ছোট ভাই জেনেছে তিনি বই মেলায় অসুস' হয়ে পড়েছেন। তিনি রিক্সা নিয়ে মো:পুরে তার ঔষধের দোকান থেকে ওদিকেই যাচিছলেন। কাঁটাবন এলাকায় এসে খবর পান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নেয়া হয়েছে। সেখানে চিকিৎসা করছে। হুমায়ুন আজাদের স্ত্রী, দুই কন্যা ও পুত্র ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান। ডাক্তার ঔষধের একটি ফর্দ ধরিয়ে দেয় তাঁর বড় মেয়ে মৌলির হাতে। সেটা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছোটতে থাকেন ঔষধের সন্ধনে। সামনে দেখতে পান ছোট কাকা মাতিন কে। তিনি কয়েক দোকান খুঁজে ঔষধ কেনার সময় লোকজনের কথা বার্তায় বুঝতে পারেন হুমায়ুন আজাদকে কোপানো হয়েছে। দ্রুত ফিরতেই দেখেন এ্যাম্বুলেন্স হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে যাচ্ছে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের দিকে। হুমায়ুন আজাদের স্ত্রী লতিফা কহিনুর তাকে ঐ এম্বুলেন্সে উঠে পড়তে বলেন। একই এম্বুলেন্সে উঠেন হুমায়ুন আজাদের ফোলার রোডের বাসার দাড়োয়ান। মাতিন নিজের কোলে আজাদকে শুইয়ে দেন। তিনি কথা বলতে থাকেন। তাঁর স্ত্রী সন্তানদের কথা জিজ্ঞাসা করেন। একসময় তিনি মাথার নিচে দেয়ার জন্য একটি বালিশ চান। দাড়োয়ান তাঁর মোটা সার্টটি খুলে দেয়। হুমায়ুন আজাদের মাথার ব্যান্ডেজ ভিজে রক্ত ঝরতে থাকে। তাঁর মুখ দিয়েও রক্ত বের হচ্ছিল। ডাক্তার মাতিনকে হাত দিয়ে রক্ত মুখ থেকে বের করে দিতে বলেন, যাতে রক্ত মুখের ভিতরে না যায়। তিনি তাই করতে থাকেন। জাহাঙ্গীর গেইট পর্যন্ত হুমায়ুন আজাদের জ্ঞান থাকে। এর পর তিনি জ্ঞান হারান।
সিএমএইচে ডাক্তাররা রক্ত চান রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজেটিভ। রক্ত দেয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষ সম্মতি জানায়। এমনকি গার্মেন্টস শ্রমিক ও রিক্সা চালকরাও রক্ত দিতে চান। রাত জেগে থাকেন পরিবারের লোকেরা। তারা ভয়ে থাকেন ও আশঙ্কা প্রকাশ করেন রাতে হুমায়ুন আজাদের লাশ সরিয়ে ফেলতে পারে কর্তৃপক্ষ। ডাক্তাররা জানান ঔষধপত্র কিনে আনতে হবে নিজেদের। পরে একসাথে বিল পরিশোধ করবেন। পরদিন তাদের জানানো হয়, বিল সরকার দিবে। হুমায়ুন আজাদের বড় বোনের বড় ছেলে পিজির সার্জন। তিনি অনুমতি নিয়ে ওটিকে থাকেন। তার কাছ থেকে খবর পেতে থাকেন পরিবারের সদস্যরা। তিনি আশ্বস্ত করেন হুমায়ুন আজাদ সুস'্য হয়ে উঠছেন। দীর্ঘ-অপারেশন শুরু হয়। ভোর রাতের দিকে অপারেশন শেষ হয়। বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে জানা যাবে তিনি বেঁচে উঠবেন কিনা। পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘতম রাতটি অতিবাহিত হয় হাসপাতালে।
তাঁর আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রচারের সাথে সাথেই তাঁর অনুরাগী ও মুক্তচিন্তার মানুষেরা উদ্বেলিত হয়ে পড়েন। তারা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের উপর ব্যাপক চাপ প্রদান করেন। সরকার বাধ্য হয় তার সুচিকিৎসার ব্যবস'া করতে। পরদিন ভারতীয় টিভি চ্যানেল ‘তারা বাংলা’ একটি ভুল খবর প্রচার করে যে, ড. হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুবরণ করেছেন। খবরটি মুহূর্তের মধ্যেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আবার বাংলাদেশের মিডিয়া সঠিক সংবাদ পরিবেশন করায় বিভ্রান্তি কেটেও যায়।
তাঁকে মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে এনেছে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, কিন' সেখানে তাঁর দেহটিকে নানাভাবে বিকৃত করা হয়েছে- তাঁর মুখমণ্ডলে কোনো দাঁত ছিল না, ঠিক মতো খেতে পারতেন না, এবং তার শরীরের ভেতরে আরও অনেক ব্যধি এই আক্রমণের ফলে জন্ম নিয়েছিল। তাঁর বাঁদিকের যে স্নায়ু রয়েছে সেগুলো নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল, সেগুলো তাঁর মাংসকে এবং অন্যান্য জিনিসকে টানতো না; ফলে তাঁর মুখটি বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। তিনি উপরের দিকে তাকাতে পারতেন না- মাথা ঘুরতে থাকতো- বালিশে শুতে গেলে মাথা ঘুরতো, মাথা তুলতে গেলেও মাথা ঘুরতো। খুব সি'র হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না। সামরিক হাসপাতাল তাঁর চিবুকের ভিতরে ধাতব পাত ঢুকিয়ে দিয়ে এটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে, তাঁর মুখের ভেতরে তারা তিনটির মতো স্ক্রু লাগিয়েছিল জোড়া দেয়ার জন্য; মাথায় অন্তত ৫০ টি সেলাই ছিল। তাঁর ঘাড়ের পেছনে একটি বেশ বড় গভীর ক্ষত ছিল। জীবনতো তাঁর ফিরে পেয়েছিলেন কিন' অনেক সমস্যা রয়ে গিয়েছিল। তাঁর বাঁ চোখ দিয়ে সব সময় পানি ঝরতো। তাঁর বাঁ দিকের দুপাটি দাঁতই পড়ে গিয়েছিল। স'ায়ীভাবে দাঁত বাঁধানোর জন্য এক বছর লাগতো, কিংবা খোলা ও লাগানো যায় এমন দাঁতের জন্য লাগতো চার মাস। বা গালে সিএমএইচ এ যে তিনটি অস্ত্রোপাচার হয়েছে তার তিনটির গভীর দাগ রয়েছিল। সেগুলো ৬ মাসের আগে অস্ত্রোপাচার করা সম্ভব ছিল না।
হুমায়-ন আজাদকে ব্যাংককের বুমরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ২২ মার্চ ০৪ তারিখে। সাথে যান আগামী প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী ওসমান গণি এবং হুমায়ুন আজাদের ছোট ভাই মঞ্জুরুল কবীর মাতিন। কয়েকদিন পরে ওসমান গণি ফিরে আসেন দেশে। মাতিন থাকেন শেষ পর্যন্ত। সিএমএইচ তাঁকে বাঁচিয়ে তুললেও তিনি অধিকতর সুস'্য হয়ে উঠেন বুমরুনগ্রাদ হাসপাতালে। সেখানকার ডাক্তার, নার্স তাঁর বিশেষ যত্ন নিয়েছে। তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণেই ধীরে ধীরে সুস'্য হয়ে উঠেন। এরপরেও তাঁর গালে বড় গভীর দাগ সেসব ঠিক করতে হলে তাঁকে ছয় মাস পরে আবার যেতে হতো ব্যাংকক। তারপরে রয়েছে প্লাস্টিক সার্জারী। ব্যাংকক থেকে দাঁত লাগাতে অনেক খরচের কথা চিন্তা করে পরবর্তীতে ঢাকাতেই নিজস্ব চিকিৎসকের কাছ থেকে দাঁত বাঁধান।
ব্যাংকক থেকে ২০ এপ্রিল ০৪ দেশে ফেরার পরে মানবাধিকার ও লেখকের স্বাধীনতা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বলেন, আমি ছেলে বেলায় একটি বাংলা ব্যাকরণ পড়েছি। সেখানে গোপাল নামে একটি অসাধারণ চরিত্র ছিল। সেই ব্যাকরণটি জানিয়েছে, গোপাল কলা খায়। গোপাল অন্য কিছু খায় না, শুধু কলা খায়। সুশীল বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝি একটি দুর্বল মানুষ। ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। সুন্দর ইস্ত্রি করা পোষক পরে, মাথায় প্রচুর পরিমাণে তেল দেয় এবং মাঝখানে সিঁথি কাটে- এই ধরনের একটি মানুষ। এই সুশীল সমাজকে দিয়ে আসলে কোন কাজ হবে না। আমাদের জন্য আসলে অশীল সমাজ প্রয়োজন। যে অশীল সমাজ চিরকাল সমাজকে রূপান্তরিত করেছে, যে শব্দগুচ্ছের বাংলা অনুবাদ সুশীল সমাজ তা হচ্ছে সিভিল সোসাইটি। বাংলাদেশে এর একটি সর্বজনগ্রাহ্য বাংলা রূপ থাকা দরকার। সামরিক সমাজের বিপরীত হচ্ছে সিভিল সমাজ। আমি এক্ষেত্রে যে বাংলা শব্দটি প্রস্তাব করতে চাই তা হতে পারে জনসমাজ। বাংলাদেশে মানবাধিকার আছে কি না সেটা বোধ হয় খুব বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। একটি বাক্য যথেষ্ট যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার নেই। দেশে ফিরে পূর্বের মতোই সাহসী ছিলেন।
মৃত্যু থেকে কয়েক সেকেণ্ড দ-রে নামে বই লেখা বিষয়ে পত্রিকায় সংবাদ বের হলে তিনি নিশ্চিত করেছিলেন, বইটির নাম হবে মৃত্যু থেকে এক সেকেন্ড দূরে। তিনি বলেছিলেন, মে মাসের মাঝামাঝি আমি আবার লিখতে শুরু করবো। বিষয়বস' হবে আমার মৃত্যু অভিজ্ঞতা। জীবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। মৃত্যু হচ্ছে অভিজ্ঞতাহীন একটি ব্যাপার। হামলাকারীদের শাস্তির ব্যাপারে বলেছেন, আমি বিন্দুমাত্র আশাবাদী নই। কারণ বাংলাদেশ অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয় না। সাঈদীকে ধরতে হবে, মৌলবাদীদের ধরতে হবে তারাই আসলে আমার খুনি।
জুলাই মাসের ২ তারিখ; আক্রান্ত হওয়ার পরে প্রথমবার এবং শেষবার নিজ গ্রামে আসেন। তাঁকে প্রথমে বিক্রমপুরের ভাগ্যকুলের তরুণ অনুরাগীদের পক্ষ থেকে এবং বিকেলে আমরা রাড়িখাল বাসীর পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। তিনি তাঁর অনুরাগীদের প্রথা ভাঙ্গার আহবান জানান। এখানেও বুঝা যায় আক্রমণ তাকে শারীরিকভাবে কাবু করলেও মানসিকভাবে তিনি ছিলেন আগের হুমায়-ন আজাদ। এরপর শুধু সমাধিস' হতে রাড়িখাল আসেন। চিরনিদ্রায় শায়িত আছে পৈত্রিক ভিটায়। বর্তমানে পাক সাদ জমিন সাদবাদ উপন্যাসের প্রচ্ছদ আঁকা হয়েছে সমাধীতে, যা জ্যোতির্ময় আঙিনা নামে পরিচিত।
২৪ জুলাই তার একমাত্র পুত্র অনন্য আজাদকে অপহরণের চেষ্টা করে ঘাতকেরা, ২৫ জুলাই বিকালে টেলিফোনে বোমার ভয় দেখিয়ে তাদের আতঙ্কিত করে তোলে। এর প্রেক্ষিতে ২৮ জালাই ০৪ বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও দেশবাসীর কাছে খোলা চিঠি লিখেন। শেষ করেন এভাবে, প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও দেশবাসী, এ সঙ্কট মুহ-র্তে, বিপন্নতার সময়ে আমার পরিবারের ও আমার জীবন আমি আপনাদের হাতে সমর্পণ করলাম; আপনারাই সি'র করবেন বাংলাদেশের রক্তের বন্যায় কি বিনিদ্র কাঁপতে থাকবো, এবং বিশ্ব শিউরে উঠবে বাংলাদেশকে দেখে, সময় বেশি নেই, এখনই আপনাদের কর্তব্য সি'র করার জন্য আবেদন জানাই।
তিনি ব্যাংকক থেকে ফিরে বলেছিলেন, আমি লিখবো, লেখাই হচ্ছে আমার জীবন, লেখাই হচ্ছে আমার আনন্দ। আমি যদি আরও ৩০ বছর বেঁচে থাকি, এবং তাহলে হয়তো আরো অন্তত ৬০ টি বই লিখবো, এবং এগুলো বিচিত্র ধরনের হবে; তাতে বক্তব্য বা কাহিনী বা আবেগ বহুরূপে প্রকাশ পাবে এবং সেগুলো বাঙ্গালিকে বিকশিত করবে। আমার কাজ কল্যাণে এসেছে, এবং আরো বহু বছর কল্যাণে আসবে।
তিনি তাঁর নিজ ভাষা এবং দেশকেই প্রচণ্ডভাবে ভালবাসাতেন। তিনি উদ্বাস' হয়ে দেশে দেশে ঘুরতে চান নি। তিনি বলেছিলেন, আমি চাই না দেশ ছেড়ে চলে যাবো, এবং বিদেশে একজন অত্যন্ত পুরস্কৃত সম্মানিত উদ্বাস' লেখক হিসাবে বাঁচতে চাই না। আমি বাঁচবো আমার নিজের দেশে, এবং বাংলাদেশে এবং এমন একটি বাংলাদেশ আমি চাই- যে বাংলাদেশ আলবদরমুক্ত, রাজাকারমুক্ত, মৌলবাদমুক্ত।
আন্তর্জাতিক সংগঠন পেন এর আমন্ত্রণে বিশ্বখ্যাত কবি হাইনরিশ হাইনের উপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান ৭ আগস্ট। পরিবারের লোকেরা এবং অনুরাগীরা কেউ তাকে একা যেতে দিতে চান নি। কিন' তিনি একাই যান। এর মাত্র ৫ দিন পর ১২ আগস্ট মিউনিখস' নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস'ায় পাওয়া যায়। তিনি চেয়েছিলেন ৩০ বছরের আরেকটি জীবন, দ্বিতীয় জীবন। তাঁর ইচ্ছাটা শরীর গ্রহণ করতে পারে নি। তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র ১৬২ দিন। আজও তার অনুরাগীরা তাঁকে সমানভাবে উপলব্ধি করে। তিনি নেই এটা আজ বড় বেশি অনুভব হয়।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৩৭

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: বাঁচতেন যদি আরও ত্রিশ বছর! আমরা পেতাম আরও ষাটটা অসাধারণ বই!
কতো কিছু হারালাম আমরা! তাদের ক্ষমা করতে পারবো না কোনোদিন।

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৫৫

মুজিব রহমান বলেছেন: তাদের ক্ষমা করা যায় না।

২| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:৪২

মারুফ তারেক বলেছেন: "আমি পুলিশের গাড়িতে যাবো না।"

একজন মানুষ ছিলেন হুমায়ুন আজাদ।
হুমায়ুন আজাদরা বছর বছর জন্মায় না।

ধন্যবাদ।

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৫৬

মুজিব রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ। আমরা আমাদের এক অমূল্য সম্পদ হারিয়েছি। মৌলবাদ এসবের মূল্য বুঝে না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.