![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিজের বিবেক যা কিছু সত্য বলে তা অকপটে স্বীকার করা এবং লিখে অন্যকে জানানোই আমার অঙ্গীকার
সবাইকে কাঁদিয়ে সত্য নির্ভিক কলমযোদ্ধা, সকলের কাছে যিনি সমান গ্রহনযোগ্য ছিলেন সেই প্রিয় মানুষটি এখন মর্গের হিমে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। বাইরেও প্রচন্ড শীত। শীতের তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আদ্রর্তা ৮৭%। তার পরেও ঘরে কেউ বসে নেই। কারো উদ্দেশ্য তোপখানায় তার চিরচেনা পার্টি অফিসে, আবার কারো উদ্দেশ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবে আবার কারো উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। যেখানেই যাক না কেন, সকলের উদ্দেশ্যেই এক, তাদের প্রিয় ও শ্রদ্ধার মানুষটিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। অবহেলা, অযত্নে, সঠিক চিকিৎসার অভাবে তিনি সবাইকে কাদিয়ে বিদায় নিলেন। বিদায়ের পর বেদনার সুর খুব বেশী করে সকলেই বাজাতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিরোধী দলীয় নেতা থেকে শুরু করে শোক জানায়নি এমন কেউ নেই। কিন্তু মৃত্যুর আগে এই প্রিয় মানুষটির উন্নত চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্র যদি একবার রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশে নিযে যেত তা হলে হয়তো এখন এই আক্ষেপটুকু থাকতো না।
মৃত্যুর আগেই তিনি তার ভিটা-মাটি টুকু দান করে দিয়ে গেছেন কলেজ নির্মানের জন্য। নিজের দেহটাকে দান করেছেন মানুষের কল্যানের জন্য। নিজের জন্য তিনি হয়তো নিষ্ঠুর “মৃত্যু” অবশিষ্ট রেখেছিলেন। ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’—এমন শিরোনামে প্রকাশিত যাঁর লেখা একসময় স্লোগানে পরিণত হয়, সেই নির্মল সেন, সবার প্রিয় নির্মলদা চলে গেলেন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী, নিরহংকার ও নির্লোভ এই সাংবাদিক জীবনভর অবিচল ছিলেন বাম ও প্রগতিশীল আদর্শে।
গত ২২ ডিসেম্বর থেকে নির্মল সেন রাজধানীর বেসরকারি ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মৃত্যু তাঁকে আলিঙ্গন করে। অকৃতদার এই সংগ্রামী মানুষটির বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। আজকে তার শবদেহতে ফুলে ফুলে ভরে যাবে, শোক বানী আর বিবৃতি প্রেসক্লাবের অফিস পাড়াগুলো ব্যাস্ত হয়ে পড়বে। শোক জানাতে এসে অনেকেই বিভিন্ন মিডিয়াতে বলবেন “চলে গেলেন সময়ের একজন সাহসী যোদ্ধা, আমরা তার বড়ই অভাব অনুভব করছি।” হয়তো বিভিন্ন কলমসৈনিকরা তার জীবনের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্যদিক নিয়ে ফিচার লিখবেন, একসময়ে সবকিছুই থেমে যাবে। আবারো আগের নিয়মে সবকিছুই চলবে। সেখানে শুধু থাকবেনা আমাদের প্রিয় নির্মলদা।
প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ গতবছর চলে গেছেন। এখন আর তার কথা তেমন ভাবে কেউ মনে করিনা। মনে করিনা, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনিরের কথা। আন্দোলনের স্বার্থে বার বার সাগর-রুনির কথা উচ্চারণ করলেও ফরহাদ খাঁ দম্পতি নিষ্ঠুর হত্যার কথা ভুলেই গেছি। ভুলে যাওয়াই আমাদের স্বভাব। তা নাহলে আমরা স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও দিন দিন সামনের দিকে না এগিয়ে পেছনের দিকে যেতাম না।
আমাদের নির্মলদা’র সাথে খুব কাছাকাছি গা ঘেসে ঘেসে দাড়িয়েছিলাম জাতীয় প্রেসক্লাবের ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিকদের সাগর-রুনি হত্যার প্রতিবাদে একসমাবেশে। সেখানে তার প্রিয় ভাইপো চন্দন সেন ও ছিলো। আজ সকালে চন্দনকে যখন মোবাইলে ফোন করলাম তখন সে বুকফাটা চিৎকার করে বললো, মঞ্জুভাই সবশেষ হয়ে গেছে। আমাদের মাথার উপরে আর কোন বটবৃক্ষ রইলো না। আপনি তারাতাড়ি কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে চলে আসেন। সকাল ৯নায় জেঠু’র শবদেহ দলীয় কার্যালয়ে নেয়া হবে, ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এবং ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। আমি এই কথাগুলো যখন লিখছিলাম কান্নায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছিলো। একটি যন্ত্রনার তীব্রতা অনুভব করছিলাম। অনেক স্মৃতি সামনে ভেসে উঠছিলো। কিন্তু সময় গড়িয়ে তখন ৯টা ৪০ বাজে। এখনই ঘরথেকে না বেরুলে শেষ শ্রদ্ধাটুকু জানাতে পারবো না। তাই আর দেরী না করে আমার প্রিয়মানুষের শবদেহে শ্রদ্ধার শেষ ফুলটুকু নিবেদন করে মহান আল্লাহর কাছে এইটুকু প্রার্থনা করি। সকলের উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই। সেই সত্য, ন্যায় নিষ্ঠ মানুষটিকে আল্লাহ তুমি তার আত্মার শান্তি দান করো।
আবারো শুরু করলাম আজ ১০ই জানুয়ারী সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে। যে সময়ে প্রিয় নির্মলদার শবদেহ তার দীর্ঘদিনের সঙ্গীদের পাশে নিথর হয়ে দাড়িয়েঁ আছে। সবার চোখে বেদনার অশ্রু, প্রিয়জন হারার বিরামহীন কান্না। তারপরেও অশ্রুসিক্ত নয়নে ফুলের শেষ শ্রদ্ধাটুকু জানাতে কেউ ভুল করছে না। এখানে কোন ঠেলাঠেলি নেই, যে যার মত তার প্রিয় মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। বড় বড় দলগুলোর শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে দেখাযায় শ্রদ্ধার আগে ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত, অনেকসময় ধাক্কা না সমালাতে পেরে শ্রদ্ধার ফুলটুকু ভেঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার পরেও সেখানে তাদের লজ্জা হয় না। বরং ভাঙ্গা ফুলের তোড়া নিয়ে বেশ দাম্ভিকতার সাথে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সেখানে চোখে মুখে অশ্রু তেমন পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু এখানে ভিন্ন পরিবেশ। নির্মলদা বলে কথা।
দুদিন আগে থেকেই চোখে যে অশ্রু জমা হয়েছে তা এখন রিতীমত অশ্রুবৃষ্টিতে পরিনত হয়েছে। একই বলে ভালবাসা। প্রিয়জন হারানোর প্রকৃত বেদনা অনুভব করা। সাকী, মিশুরা নির্বাক হয়ে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। ওদিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সবুজ-আবদাল-গনি ভাই সহ সকলে তাদের গুরুকে শ্রদ্ধা জানাতে কনকনে শীতের প্রভাতেই এসে প্রেসক্লাবের আঙ্গিনায় হাজির হয়েছে। তাদেরও চোখে মুখে একরাশ বিষন্নতা। সবার হৃদয়ে বোবা কষ্ট। হয়তো মনে মনে উচ্চারন করছে নির্মলদা আমাদের যে ঐক্য দেখে যাওয়ার কথা বলেছিলেন ও ভেবেছিলেন আমরা কি সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকদের অধিকার সংরক্ষনের জন্য সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারবো? না কি বড় বড় রাজনৈতিক দলের ক্রিয়ানক হয়ে নিজেদের ভিতর বিভেদ সৃষ্টিকরে অনৈক্য গড়ে তুলবো।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও প্রস্তুত। সকাল থেকে মাইকে আওয়াজ দিচ্ছে নির্মলদার আগমনের বার্তা। যারা শেষ শ্রদ্ধা জানাবে তাদেরকে সারিবদ্ধ ভাবে শৃঙ্খলা বজায় রেখে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। নির্মলদা তুমি নেই, এখন তোমার প্রতি এত শ্রদ্ধা আর ভালবাসা দেখে আমার কান্নার চেয়ে হাসি পাচ্ছে। যখন ল্যাবএইড হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে অপেক্ষা করছিলে তখন রাষ্টের বা আমাদের কর্তব্য ভালবাসা কতটুকু সম্পূর্ন করেছিলাম? তুমি আমাদেরকে খুব ভালোভাবেই চিনতে, এবং জানতে। তাইতো যাওয়ার আগে তোমার নিজের হাতের লেখা চারটি প্রতিশ্রুতি কিংবা জীবনের পরর্বতী শেষ ইচ্ছা জাতিকে আর একবার তাদের বিবেক কে জাগ্রত করার জন্য ব্যাক্ত করে লিখে রেখে গেছ।
অসুস্থ হয়ে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় রওনা হওয়ার আগে তিনি পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে জীবনের শেষ চার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এগুলো হচ্ছে: নিজ গ্রামের বাড়ি দিঘীরপাড়ে একটি মহিলা কলেজ নির্মাণ করা। মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ কোনো মেডিকেল কলেজে দান করা। সাংবাদিকতা পেশায় অবদানের জন্য তাঁর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো পুরস্কার দেওয়া হলে তা গ্রহণ না করা। এ ছাড়া মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তাঁর মৃত্যুর সময় নির্মল সেনকে যেসব কথা বলে গেছেন, তা বাম রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে সংবাদ সমেঞ্চলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা।
সাংবাদিকতা ছাড়াও জীবনভর ছাত্ররাজনীতি, সাংবাদিক ইউনিয়ন, শ্রমিক আন্দোলন এবং জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন নির্মল সেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি। স্বাধীনতাত্তোর ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত সাংবাদিক সমাবেশে হুইলচেয়ারে এসে তিনি বিভেদ ভুলে অবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯৩০ সালের ৩ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার দিঘীরপাড় গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারে নির্মল সেনের জন্ম। পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। মাতার নাম লাবণ্যপ্রভা সেনগুপ্তা। ছয় ভাই, তিন বোনের মধ্যে নির্মল সেন ছিলেন চতুর্থ।
১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সময় ছাত্ররাজনীতির হাতেখড়ি। তখন রেভলুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির (আরএসপি) কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম হন। আরএসপি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের নীতিতে বিশ্বাসী ছিল।
নির্মল সেন বরিশালের বিএম কলেজে পড়াশোনা করছেন। ভাষা আন্দোলন এবং ছাত্র আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রথম গ্রেপ্তার হন ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট। দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। আরএসপির নির্দেশে ১৯৫৬ সালে ছাত্রলীগ ছেড়ে দেন। যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়নে। এরপর জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ এবং পথচলা।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর অনেকটা বাধ্য হয়ে নিজেকে রক্ষার জন্য সাংবাদিকতা শুরু করেন নির্মল সেন। সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাক-এ। কিন্তু জেল থেকে রক্ষা পাননি। প্রায় পাঁচ বছর পর জেল খাটার পর ১৯৬২ সালে মুক্তি পেয়ে যোগ দেন জেহাদ পত্রিকায়। এরপর সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৬৪ সালের ৬ অক্টোবর দৈনিক পাকিস্তান (পরে দৈনিক বাংলা) আত্মপ্রকাশ করে। প্রায় ৩৩ বছর ধরে দৈনিক পাকিস্তান-এর প্রথম সংখ্যা থেকে দৈনিক বাংলার শেষ সংখ্যা পর্যন্ত কাজ করেছেন তিনি।
জীবনভর অসংখ্য কলাম লিখেছেন নির্মল সেন। এগুলোর মধ্যে ‘হাশেম চৌধুরী একটি লাশ চায়’, ‘লজ্জা দিলে তো আবরণ দিলে না কেন?’, ‘জান দেব তো গ্যাস দেব না’ উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতাত্তোর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলেন ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’।
নির্মল সেনের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: মানুষ সমাজ রাষ্ট্র, বার্লিন থেকে মস্কো, পূর্ব বঙ্গ-পূর্ব পাকিস্তান-বাংলাদেশ, মা জন্মভূমি, লেনিন থেকে গর্ভাচেভ, আমার জবানবন্দী, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই, আমার জীবনে ৭১-এর যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৯ সালে আদমজী জুটমিলে রুহুল আমিন কায়সার, খান সাইফুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন গঠন করেন। একই বছর অগ্নিযুগের বিপ্লবী অতীন্দ্রমোহন রায়, মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, নেপাল নাহা, রুহুল আমিন কায়সার, খান সাইফুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৮ সালে নির্মল সেন এই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সভাপতি।
©somewhere in net ltd.