নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী।কূপমণ্ডুকতা ঘৃণা করি।ভালোবাসি সাহিত্য।

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল

বলার মত কিছুই নই আমি।একজন মহামূর্খ।

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ অস্পৃশ্য

০৮ ই জুন, ২০২০ রাত ১:৪৫

অস্পৃশ্য

সকাল থেকেই হাঁটছে সে। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত। তবুও হাঁটছে। হাঁটা থামানোর উপায় নেই তার। পা দুটো টনটন করছে ব্যাথায়। তারপরও হাঁটতে হবে। রোজগার হয় নি তেমন। তাকে দেখে লোকজন এড়িয়ে যাচ্ছে। সে রাস্তার যে পাশ দিয়ে হাঁটছে, তাকে দেখার পর লোকজন রাস্তা পার হয়ে অন্য পাশে চলে যাচ্ছে। তারপরও সে যাকে পাচ্ছে তাকেই ধরে টাকা আদায় করছে। টাকা না দেয়া পর্যন্ত তাকে ছাড়ছে না। কেউ কেউ টাকা দেয়। যদিও বেশির ভাগ লোকই বড়োসড়ো ঝটকা দিয়ে তার হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। ছাড়ানের পরও আবার ধরতে যায় সে। কিন্তু ততক্ষণে তারা দ্রুত হেঁটে নাগালের বাইরে চলে যায়। সে আবার সামনে এগিয়ে যায়। আবার কাওকে ধরতে যায়।কেউ টাকা দেয়। কেউ আবার গালিগালাজ করে।

"সামনেত্তে সর,বাঁইদ্যানি মাগী।"

বলে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো এক মহিলা। রাগ হলো তার। সেও চিৎকার করে ওঠে-

"চেহারাখান তো বড় নুকের, কথাখান রাস্তার মাগীগো মতো ক্যা?"

বলে রাগে কাঁপতে লাগলো সে। কথাটা সেই মহিলার কানে গেল। মহিলা তাকে মারার জন্য তেড়ে এলো। সে এবার আর মহিলার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাইলো না। অতীত অভিজ্ঞতা ভালো না তার এ ব্যাপারে। এরকম একটা ঘটনায় প্রচণ্ড মার খেয়ে খুপরি তে পড়ে ছিলো কয়েকদিন। তাই মহিলা তার নাগাল পাওয়ার আগেই রাস্তা পার হয়ে অন্যপাশে চলে গেল সে।

সে মূলত বেঁদেনি। তার উপার্জনের উৎস হবার কথা ছিল সাপের খেলা দেখানো,তুকতাক ঝাঁড়ফুক,তাবিজ বিক্রি এসব।কিন্তু এসবের দিন শেষ। কেউ এখন আর সাপ খেলা দেখতে আগ্রহী নয়। সে তার মায়ের কাছে শুনেছে তাদের পূর্ববর্তী জৌলুসের কথা।সাপ খেলার খুব চাহিদা ছিল একসময়। তাদেরও খুব চাহিদা ছিল। কিন্তু সে শুধু শুনেছেই এসব। দেখেনি কখনো। সবকিছু পরিবর্তিত হয়েছে। বিনোদনের মাধ্যমও পরিবর্তিত হয়েছে। আগে লোকে তাদেরকে সাপ ধরতে ডাকতো। এখন ডাকে না। সাপে কামড়ালে আগে তাদের ডাক পড়তো। এখন আর পড়ে না। সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যায়। এগুলোর চল নেই এখন আর। কিন্তু এগুলো ছাড়া তারা আর কিছু পারে না। কয়েক প্রজন্ম ধরে এইকাজ করে আসছে তারা। স্কুল,কলেজে পড়াশোনা করারও রেওয়াজ নেই তাদের মধ্যে। কিন্তু খেয়ে পরে তো বাঁচতে হবে। তাই সকালবেলা সবাই বের হয়। তারা যেভাবে টাকা আদায় করে সেটাকে ভিক্ষাই বলা যায়। মানুষকে ধরে প্রথমে বলে সাহায্য করেন। দিতে না চাইলে তার হাত অথবা কাপড় টেনে ধরে। এতে লজ্জার খাতিরে হলেও টাকা দিয়ে দেয় কেউ কেউ।অন্যেরা ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়।বাকিরা গালিগালাজ করে। টাকা উপার্জনের জন্য এত কষ্ট করতে ইচ্ছা করে না তার। হিজড়াদের দেখে হিংসা হয় তার। হিজড়াগুলো কতটাকা কামাই করে। যদিও তারাও গালি খায়। তবুও টাকা পায়। কিন্তু বেঁদেনিগুলো তো শুধু গালিই খায়। হিজড়াগুলো টাকার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠে মাঝে মধ্যে। টাকা না দিলে কাপড় খুলে উদোম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন লোকে টাকা না দিয়ে পারে না। কিন্তু এটা তো করতে পারবে না সে। তার অন্ততপক্ষে হায়া লজ্জা আছে। কপালে যা আছে তাই হবে। ভেবে হাঁটতে থাকে সে। দুপুরের তপ্ত রোদে ঘর্মাক্ত হয় সে।ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর।

হাঁটতে হাঁটতে সে চলে আসে ফেরি ঘাটে। সেখান থেকে অনেক লোক যাতায়াত করে। হয়তো বেশি টাকা পাওয়া যাবে সেখান থেকে।ফেরি ঘাটে ভিড়েছে মাত্র। অনেক লোক নামছে। তাদের কাছে যায় সে। টাকা পায় কিছু। কিন্তু যা আশা করেছিল তার চেয়ে অনেক কম। হঠাৎ তার চোখে পড়লো দূর থেকে এক লোক আসছে। হাতে এবং কাঁধে ব্যাগ। ব্যাগের ভারে একদিকে কাত হয়ে গেছে লোকটা। সে হাঁটছে আস্তে আস্তে। তার পায়ের সাথে বাড়ি খাচ্ছে তার ব্যাগ। সে ভাবলো এটাই সুযোগ। একেই গিয়ে ধরতে হবে। চোখের পলকে ভেগে যেতে পারবে না। সামনে গিয়েই লোকটার হাত চেপে ধরলো সে। তার সাথে আরও একজন এসে যোগ দিলো। হাত ধরেই বললো,

"বইনের বিয়া,টাকা দে দাদা।"

লোকটা কোনো উচ্চবাচ্চ না করে দশ টাকা দিয়ে দিলো।

"এত পুরান নোট!!! নতুন নোট দে। সাপে ছিড়া লাইবো।"

লোকটা এবার বলে ওঠে আর কোনও নোট নেই।তার কাছে ভাংতি নেই। পাশের জন বলে ওঠে -

"ভাংতি দিতাছি।"

লোকটা সরলমনে একশো টাকার নোট দেয়। আগের দশ টাকা এবং পরের একশো টাকা কৌটায় ভরে লোকটাকে বলে-

"বেজার মনে দিলি নি টাকা ডা?"

লোকটা আকাশ থেকে পড়লো।

"আপনের তো ভাংতি দেয়ার কথা আছিলো।পুরা টাকা তো দিই নাই আমি।"

এবার সে বলতে লাগলো,

"টাকা ফেরত চাইস না দাদা।আল্লায় ভালো করব তর।"

লোকটা বেশি উচ্চবাচ্চ না করে বললো,

"নব্বই টাকা ফেরত দেয়া লাগবে না।পঞ্চাশ দ্যান।"

একটু কাকুতিমিনতি করে লাভ হলো না।শেষে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দিলো লোকটাকে। ষাট টাকা উপার্জিত হলো লোকটার কাছ থেকে। মনে মনে খুশি হয় সে। লোকটার বোকামিতে মজা পায়।

এখন ঘাটে লোক নেই তেমন। তাই দোকানে দোকানে গিয়ে টাকা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। হঠাৎ করে সামনে একটা চায়ের দোকান পরে যায় তার। বিভিন্ন ধরণের লোক চা খাচ্ছে সেখানে। পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে কেউ লেবার,কেউ ফিটফাট বাবু,হকারও দেখা যাচ্ছে। আছে ভিক্ষুকও। সে দোকানে গিয়ে টাকা চায়। তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে সবাই।

"মাগীর শইল্যে খুব রস হইছে। চাওয়া মাত্রই ট্যাহা।এহ!!! জানোছ? ট্যাহা কামাইতে কতো কষ্ট করা লাগে?হারাদিন গতর খাইট্যা কয়ডা ট্যাহা কামাই।হ্যানতেও তরা ট্যাহা চাস।" বলে ওঠে লেবার।

"হারাদিন চিল্লাইয়া কিছু ট্যাহা পাই।ক্ষিদা লাগলেও খাই না। এই মাগী আবার ফ্রি ফ্রি ট্যাহা কামাইতে আইছে।যা মাগী এহান থিক্যা।" হকার কথা বললো এবার।

ফিটফাট চশমা পরা বাবুটিও কথা বললেন ।

" বুঝলা মহিলা?? দেশের উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু লোকের আয় বাড়ছে না।ধনী মানুষ ধনী হচ্ছে।গরীব আরও গরীব হচ্ছে। ব্যাংক লুট হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে টাকা নেই। টাকা সব ব্যবসায়ীদের কাছে। তাদের কাছে যাও।"

এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল সে। এত অপমান সহ্য করার লোক সে নয়।

"ফকিন্নির পুতেরা ফাও খরচের বেলায় ট্যাহা থাকে।গরীবরে দেয়ার বেলায় ট্যাহা থাকে না। আমি কী চুরি করছি,ট্যাহা চাইয়্যেই তো নিচ্ছি।"

বলে চলে আসে সেখান থেকে। হাঁটতে হাঁটতে সামনেই একটি চালের আড়ত দেখতে পায় সে। দোকানে গিয়ে টাকা চাওয়া মাত্রই লোকটা পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে দিলো। দেয়ার পরই লোকটা বললো,

"আহিছ,রাইত দশটার পরে। তিনশো দিমু নে। "

লোকটির কথায় আশ্লীল ইঙ্গিত মিশে থাকে। সে এটা বুঝতে পারে। তারপরও কিছু না বলে একটা হাসি দিয়ে চলে আসে।

দুপুরবেলা সে তার খুপরিতে ফিরে আসে।টাকা বেশি রোজগার হয় নি তার। খুপরি তে অন্য কেউ নেই।তারাও বের হয়েছে। ফিরে আসেনি এখনো। ঘরে যা ছিল তা রান্না করে কিছু খেয়ে নেয় সে।বাকিটা অন্যদের জন্য রেখে সে আবার বের হয়। এবার আর সকালের জায়গায় যায় না সে। অন্যদিকে যায়। ফলাফল একই। সারা বিকেল সন্ধ্যা ঘুরে ঘুরে সকালে যা আয় হয়েছিল তার অর্ধেকের বেশি আয় হয় নি। হতাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরলো সে। হঠাৎই তার মনে পড়ে যায় সেই আড়তদারের কথা। তার কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।

আড়তদার আড়তেই ছিল। সে ছিল একা। কর্মচারীরা সবাই চলে গেছে কাজ শেষে। আড়তদার হয়তো তার অপেক্ষাতে ছিল। হয়তো ছিল না। এতকিছু ভাবতে চায় না সে। তাকে দেখেই দোকানদার ভেতরে ঢুকতে বললো তাকে। দোকানের শাটার একেবারে নামিয়ে দিলো সে। দুপুরের অশ্লীল ইঙ্গিতকে কাজে পরিণত করতে চাইলো আড়তদার। কিন্তু টাকার অঙ্কের বিরোধিতা করলো সে। সে বললো, তিনশোতে হবে না।পাঁচশো টাকা লাগবে। আড়তদার রাজি হলো নিমিষেই। কাজ শেষে টাকা চাইলো সে। আড়তদার চোখ কপালে তুলে বললো

"ট্যাহা তো দিছি।"

"কই দিলি? বদমাইশ!!"

"দুপুরে দিলাম না পঞ্চাশ ট্যহা।ঐডাই লইয়া যা।"

"এহন না কইলি পাঁচশো দিবি??"

"কই নাই।প্রমাণ আছে কোনও?"

"বদমাইশের বাচ্চা!!! আমার ট্যাহা দে!!”

গালিটা সহ্য হলো না আড়তদারের।সাথে সাথে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিল বেঁদেনির চেহারায়। গাল কেটে রক্ত পড়তে লাগলো। সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই আড়তদারের।

" চুন্নি মাগী।অক্ষণই বাইর হ আমার দোকান থিক্যা।রাইতের বেলা চুরি করতে আইছছ আমার দোকানে। আমি তরে হাতেনাতে ধরছি।অক্ষণই লোক ডাকমু আমি। সারারাইত মাইরা সকালে পুলিশে দিমু।যদি বাঁচতে চাস তো অক্ষণই যা সামনে থিক্যা।"

মানুষের নিষ্ঠুরতার সাথে পরিচিত সে।তাই আর কথা না বাড়িয়ে সে আড়ত থেকে বের হয়ে যায়। বের হয়ে বাড়ির পথ ধরে। চেহারা বেয়ে রক্ত ঝড়ছে। শরীর ক্লান্ত,অবসন্ন। চলতে কষ্ট হচ্ছে তার। চেহারায় প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করে সে। টলতে টলতে পড়ে যায় কখনো।তবুও সে উঠে দাঁড়িয়ে পথ চলতে থাকে।তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। কাল সকালে আবার তাকে বের হতে হবে।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:১০

অশুভ বলেছেন: আপনার সব গল্পগুলো কষ্টের গাথুনিতে বাঁধানো। তবে প্লটগুলো চমৎকার। আর লেখার সাবলিলতা অসম্ভব রকমের মনোমুগ্ধকর। আমি আপনার লেখার ফ্যান হয়ে গেলাম।

০৫ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:২০

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ।কষ্টের ব্যাপারগুলো কেন যেন আমাকে টানে খুব। এই গল্পটাতে আমিও আছি।মাঝখানে এক যুবকের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়।সেই যুবকটা আমি।

২| ২৮ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ১০:০৮

খায়রুল আহসান বলেছেন: কষ্টের কথা। গল্প ভালো লেগেছে। + +

২৯ শে আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৪:৪৯

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: পুরাতন পোস্ট পড়ে, মন্তব্য করে আপনি আবারো আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করলেন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা নেবেন। প্লাসের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.