নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী।কূপমণ্ডুকতা ঘৃণা করি।ভালোবাসি সাহিত্য।

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল

বলার মত কিছুই নই আমি।একজন মহামূর্খ।

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ ইট

০৫ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১২:৪১

খালেক মিয়ার ইটের কথা পুরো এলাকা জানে। যারা এলাকায় নতুন আসে তারাও দু-এক দিনের মধ্যে তার শ্যাওলা ধরে সবুজ হয়ে যাওয়া ইটের ব্যাপারে জেনে যায়। তাতেও খালেক মিয়ার মন ভরে না। তার মনে হয় তার ইটগুলো কম গুরুত্ব পাচ্ছে। সারা পৃথিবীর জানা উচিৎ তার ইট সম্পর্কে। কত কষ্ট করে কত বছর ধরে সে এই তিন হাজার ইট কিনেছে!

প্রথম পাঁচটি ইটের বয়স তার বড় ছেলের চেয়ে পনের দিন বেশি। এই পাঁচটি ইট সে গামছায় বেঁধে পিঠের পেছনে ঝুলিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো। তার পোয়াতি বউটা ইটগুলো দেখে খুশি হবে ভেবেছিলো। কিন্তু হলো হিতে বিপরীত। শেষ ধাপের পোয়াতি হওয়ায় মেঝে থেকে ঝাঁটাটা তুলতে পারে নি তার বউ। তুলতে পারলে আর রক্ষা থাকতো না। অনেক দিন আগে ছোটবেলায় মায়ের হাতে ঝাঁটার বাড়ি খেয়েছিলো সে খুব সামান্য একটা কারণে। পাশের বাড়ির ছমিরদের আমগাছের নিচে ছমিরসহ আরও কয়েকজনের সাথে খেলছিলো সে। তখনই গাছ থেকে একটা পাঁকা আম টুপ করে পড়ে খালেকের সামনে। খালেক সেটা লুকিয়ে ফেলে লুঙ্গির মধ্যে,পরে খাবে বলে। কিন্তু ছমির সেটা দেখে ফেলে। এরপর ছমির গিয়ে আম চুরির নালিশ করে খালেকের মায়ের কাছে। দারিদ্র্যপীড়িত সংসারে মানসম্মানটাই সবচেয়ে বড় অবলম্বন। নিজের ছেলেকে চোর বলায় তিনি রাগে দুঃখে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়েছিলো তার মা। সে অনেকদিন আগের কথা।তার মা মারা গেছে কয়েক বছর হলো। আজ হঠাৎ বউয়ের ঝাঁটা তোলার চেষ্টায় তার মায়ের কথা মনে পড়লো। মনের অজান্তেই বলে উঠলো "বড় ভালা মানুষ আছিলো আমার মায়ে।" কিন্তু হঠাৎই তার বউয়ের ঝামটায় সম্বিত ফিরে পায় সে। বউ তার রাগে কাঁপছে।

"ঘরে চাইল নাই,গোলামের পুতে ইট লইয়া আইছে। আহেন আপনেরে ইট ভাইজ্যা খাওয়াই।"

আসলেই তো। ঘরে চাল নেই।সে এটা ভুলে গেল কী করে? কাছে তো টাকাও নেই।ইট কিনে ফেলেছে।এখন কী হবে? বউয়ের হাতে ঝাঁটাটা তুলে দেবে ভাবলো একবার। তাকে পিটিয়ে যদি বউয়ের রাগ কমে তাহলে শান্তি। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো,রাগ কমলে তো আর পেট ভরবে না। শেষ বেলার পোয়াতি ক্ষিদা সহ্য করতে পারবে না।তাছাড়া এই বয়সে বউয়ের হাতে ঝাঁটার বাড়ি খাওয়াটা ভালো কিছু না।মানসম্মান কিছু থাকবে না। এসব ভেবে কিছু না বলেই সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এক পোটলা চাল নিয়েই সেদিন ফিরেছিলো ঘরে। সেদিন আরেকজনের কাছ থেকে ধার করে বউয়ের ক্রোধ থেকে সে বেঁচে গিয়েছিলো।

দিন, মাস, বছর চলে যেতে থাকে।এভাবে তিনটি,চারটি করে অনেকগুলো ইট জমিয়ে ফেলে সে।প্রতিটা ইট কেনার পর সে তার মাটির ঘরের দেয়ালে দাগ কাটতো। কিছুদিন আগে সে গুণে দেখেছে প্রায় দেড় হাজার ইট হয়েছে।এর মধ্যে তার চারটি ছেলে দুটি মেয়ে হয়েছে। বড় ছেলেটা বিএ পরীক্ষা দিয়েছে। চাকুরিতে ঢুকবে কিছুদিন পরে। সবাই বলে ছেলে নাকি পড়াশোনায় অনেক ভালো। দ্বিতীয় ছেলেও এবার ইন্টার পরীক্ষা দেবে। সে গর্বিত পিতা। গ্রামের চায়ের দোকানে যখন সে যায়,তখন গ্রামের অনেকের ঈর্ষান্বিত মুখ দেখে সে আরাম পায় মনে। কিন্তু ছেলেদের চেয়ে তার ইটের গল্প করতেই সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

"জানো নি মিয়ারা?? এইগুলি এক্কেরে এক নম্বর ইট। আমি নিজে বাইছ্যা লইয়া আইছি। আমারে ঠকানো এত সহজ না। আমার বাপে আছিলো……."

কথা শেষ করতে পারে না সে। শ্রোতাদের একজন জিজ্ঞাসা করে বসে,

"এক নম্বর তো বুঝলাম।দামও তো বেশি নিছে মনে হয়।"

খালেক গর্বের সাথে তার কথার উত্তর দেয়,

"আরে মিয়া আগেই তো কইছি আমারে ঠকানো সহজ না। প্রত্যেকটা ইটে দাম বেশি চাইছে।খাচ্চরের মতো মুলাইয়া মুলাইয়া দাম কমাইয়া তারপর আনছি। আপনেরা দুই নম্বর ইটে যেই দাম দেন আমি এক নম্বর ইট হেই দামে আনছি।"

তখন পাশ থেকে একজন ফোড়ন কাটে,

"তাইলে দ্যাহেন গা গিয়া।দুই নাম্বার ইটই দিছে আপনেরে।আপনে বুঝতে পারেন নাই।"

এবার চটে যায় খালেক।

"আমার বুদ্ধি লইয়া খোঁচা মারছ হালার পুত!!"

বলেই সে মারামারি শুরু করে দিলো। এরপর থেকে কেউ আর ইট নিয়ে খালেক মিয়াকে চটাতে চাইতো না। এলাকায় জনশ্রুতি ছিল, খালেক মিয়া তার বউয়ের চেয়ে আর ইটগুলোকে বেশি ভালোবাসে। তারা আসলে মিথ্যা কথাও বলতো না। খালেক মিয়াকে প্রতিদিন দেখা যেত তার ইটে পানি ছেটাচ্ছে। যখন ইটের সংখ্যা কম ছিলো তখন সে প্রতিদিন সেই ইটগুলোকে ধৌত করতো। তার বউয়ের হাজার চিৎকার চেচামেচি তাকে ফেরাতে পারে নি। কিন্তু ইট বেড়ে যাওয়ার পর সে একটা একটা করে ইট ধৌত করতে পারছিলো না সে তার বাক্সের মতো করে সাজিয়ে রাখা ইটগুলোতে বালতির পর বালতি পানি ঢালতো। সে নিশ্চিত হতো যাতে তার সব ইটে পানি পৌঁছায়। সেখান থেকে কোনও ইট সে কাওকে স্পর্শ করতেও দিতো না। একবার বন্যার সময় তার এক প্রতিবেশি তার কাছ থেকে কিছু ইট ধার চেয়েছিলো। সে মানা করে দিয়েছিলো। কিন্তু তার বউ অনুমতি দিয়ে দেয়। প্রতিবেশি যখন খালেকের বউয়ের কথা শুনে ইট নিতে যায় তখনই সে উঠোনে নেমে এসে গগণবিদারী চিৎকার করে বলে ওঠে,

"আমার হ্যানতে যে একখান ইট নিবো,আল্লায় হ্যার মাতায় ঠাডা হালাইবো।"

একথা শুনে প্রতিবেশি তাড়াতাড়ি ইট ছেড়ে বাড়িতে চলে যায় খালেক মিয়ার ঠাডার হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে।

খালেক মিয়া এভাবেই সারাজীবন তার ইটগুলোকে আটকে রেখেছে। সে সব মিলিয়ে দু হাজার ইট কিনেছিলো। সে যখন মৃত্যুশয্যায় ছিলো তখন তার ছেলেমেয়েরা সকলে প্রতিষ্ঠিত। তার মাটির ঘরের জায়গায় এখন বিল্ডিং হয়েছে। ছেলেরা তার ইটগুলো বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করে নি পুরনো বলে।তাছাড়া তাকে চটাতেও চায় নি কেউ। কিন্তু তার মনের কথা কেউ জানতো না। প্রথমবার যখন তার বউ পোয়াতি হয়েছিলো তখনই সে মনে মনে স্বপ্ন দেখেছিলো একটা বাড়ি হবে তার। প্রথমে ইট কিনবে, তারপর রড,তারপর বাকি জিনিস। কিন্তু এজীবনে ইট ছাড়া আর কিছু কিনতে পারে নি। ছেলেরা বাড়ি করেছে।সেই বাড়িতেই সে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে।তার এই অত্যধিক ইটপ্রীতির কারণ জানা গিয়েছিলো ঠিক তার মৃত্যুর আগে। তার অস্পষ্ট শব্দের অস্পষ্ট কথা তার বউ শুনতে পেয়েছিলো পাশে বসে,

"ইটাডি কিনছিলাম বাড়ি কইরা থাকমু হেল্লিগা।আর অইলো না থাহা।"

একথা বলার পরেই সে শুধু বউকে বলেছিলো,

"বালা থাহিস।যাই গা।"

এরপরই মানুষটা মৃতের দেশে চলে যায় তার সাধের ইটগুলোকে রেখে।

খালেক মিয়া মারা যাওয়ার পর তার ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়েছিলো। তার ছেলেরা বুদ্ধিমান ছিলো। একেবারে তার মতো। তারা সেই দুই হাজার ইট দিয়ে খালেক মিয়ার কবরটা খুব সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিয়েছিলো।সেখানকার একটা ফলকে খালেক মিয়ার নামটা স্পষ্ট দেখা যায় সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে।

সমাপ্ত

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১:৫৫

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: এন্ডিংটা এমনই মর্মস্পর্শী হবে, তা বুঝতে পেরেছিলাম। একটা চমৎকার প্লট, চমৎকার শুরু। সাবলীল বর্ণনা। তবু মনে হলো, মাঝখানে আরেকটু বিস্তৃতির দরকার ছিল।

একজন স্বপ্নবাদী দরিদ্র খালেক মিয়ার গল্পটা খুব করুণ বিষাদে মন ভিজিয়ে দিয়েছে। অসাধারণ।

০৫ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ২:০৩

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আসলেই আরেকটু বিস্তৃতির দরকার ছিলো মাঝখানে।কিন্তু লেখার সময় সেদিকটা মিস করে গেছি কিভাবে যেন।পরেরবার চেষ্টা করবো যাতে এরকমটা না হয়।

২| ০৫ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ২:০৯

রাজীব নুর বলেছেন: ঘরে চাইল নাই, গোলামের পুতে ইট লইয়া আইছে। আহেন আপনারে ইট ভাইজা খাওয়াই- ডায়লগটা সেই হইছে।

০৫ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ২:১১

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।এই সংলাপটা লেখার সময় আমি নিজেও মজা পেয়েছি খুব।

৩| ০৫ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:০১

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: প্রথম পাতায় আপনাকে অভিনন্দন। বাস্তবে এমন একটি ঘটনা খুব সম্ভবত যশোরে ঘটেছিলো। তবে বাস্তবের শেষটা ভালো ছিলো। তিনি জীবিত ছিলেন।

০৫ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:১০

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।এমন ঘটনা কোথাও ঘটেছিলো কি না এ সম্পর্কে জানা নেই আসলে।জেনে ভালো লাগলো যে বাস্তবের জন জীবিত ছিলেন। স্বপ্ন পূরণ হবার ব্যাপারটা ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি করে।

৪| ০৫ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:৪৩

সৈয়দ মোজাদ্দাদ আল হাসানাত বলেছেন: অনেক ভালো লাগলো, চমৎকার গল্প ।

০৫ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:২০

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

৫| ০৫ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:৩৭

অশুভ বলেছেন: গল্পটা ভাল লেগেছে। আপনার লেখা বেশ সাবলিল। আরও লিখুন।

০৫ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:৫৩

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।

৬| ০৫ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:১৮

শেরজা তপন বলেছেন: অন্যরকম গল্প কিংবা কাহিনী। ভাল লাগল- আপনার লেখায় ধার আছে ভায়া। লিখতে থাকুন(।
( অফটপিকঃ আমার আব্বার নাম কিন্তু 'খালেক মিয়া';)

০৫ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:২৭

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ অনুপ্রেরণাদায়ক মন্তব্যের জন্য। চরিত্র কাল্পনিক। আপনার আব্বার নাম খালেক মিয়া জানলে হয়তো অন্য নাম দিতাম। :)

৭| ৩১ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ১০:১৯

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
ইটপ্রীতিময় গল্পটা যেমন সুন্দর তেমনি মর্মস্পর্শী।+++++

৩১ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:৪৩

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।একটি বৃহৎ পরিকল্পনার শুরু হিসেবে ইট তার কাছে যক্ষের ধনের মতোই ছিলো।

৮| ১৮ ই অক্টোবর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩৮

খায়রুল আহসান বলেছেন: মানুষের মনে কত সাধ থাকে! সে সাধ বাস্তবায়নের মত শক্তি ও প্রাচুর্য না থাকলেও মানুষ মনে মনে কত পরিকল্পনা করে রাখে। গল্পের আসল কথাটি আপনি সর্বশেষ প্রতিমন্তব্যটিতে খুব সুন্দর করে বলে দিয়েছেনঃ
"একটি বৃহৎ পরিকল্পনার শুরু হিসেবে ইট তার কাছে যক্ষের ধনের মতোই ছিলো।"

চমৎকার গল্পে চতুর্থ 'লাইক'!

১৮ ই অক্টোবর, ২০২১ রাত ১১:৫৬

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: "মানুষের মনে কত সাধ থাকে! সে সাধ বাস্তবায়নের মত শক্তি ও প্রাচুর্য না থাকলেও মানুষ মনে মনে কত পরিকল্পনা করে রাখে।"
সাধ পূরণের আকাঙ্ক্ষাই হয়তো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।চমৎকার মন্তব্যে ভালোলাগা জানিয়ে গেলাম। মন্তব্য ও প্লাসে অশেষ কৃতজ্ঞতা রইলো আপনা্র প্রতি।
এবারো নোটিফিকেশন পাই নি।তাই দেরিতে প্রতিমন্তব্য করায় দুঃখপ্রকাশ করছি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.