নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী।কূপমণ্ডুকতা ঘৃণা করি।ভালোবাসি সাহিত্য।

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল

বলার মত কিছুই নই আমি।একজন মহামূর্খ।

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রতিকার

০৬ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:০৪



সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিলো। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। মুষলধারে নয়। একটি ছাতা হলেই সহজে পথ চলা যায়।বৃষ্টিত তীব্রতা নেই। তাই প্রতিদিনের মতো আজও ভিক্ষে করতে বের হয়েছে হাবিল। রাস্তায় পানি জমে নি। কিন্তু মাটির রাস্তাটি বৃষ্টির কারণে পিচ্ছিল হয়ে আছে। চলতে গিয়ে দুবার আছাড় খেলো হাবিল। দ্বিতীয় বারের আছাড়ে কোমরে একটা তীব্র ব্যাথা অনুভব করে সে। মমে মনে ভাবতে থাকে,তার অবস্থা আগের মতো থাকলে সে জীবনেও আছাড় খেতো না এই রাস্তায়। এই মাটির রাস্তাতেই সে দৌড়ে বেড়িয়েছে আজীবন রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে। সাহাপুর গ্রামে তার মতো বলিষ্ঠ তাগড়া জোয়ান আর কেউ ছিলো না। তার ভাই কাবিল ছিলো।তবে তার চেয়ে একটু কম। ভেবে মনে মনে একটু কৌতুক বোধ করে সে। পরক্ষণেই তার মন আবার বিষাদে ছেয়ে যায়। তার সেই বলিষ্ঠ দেহ এখনও আছে। শুধু চোখ দুটো নেই বলে তাকে ভিক্ষে করতে হচ্ছে। ডাক্তার যেদিন বললো তার এই চোখ আর কোনোদিন ভালো হবে না,সেদিন তার চেয়ে বেশি কেঁদেছিলো তার বোন হালিমা।হালিমা যতদিন বেঁচে ছিলো ততদিন তার কোনো চিন্তা ছিলো না। হালিমা তাকে নিজ সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলো।খাওয়া-পরা নিয়ে কখনো চিন্তা করতে হয় নি। কিন্তু এখন তাকে ভিক্ষে করে চলতে হচ্ছে। এসব কথা চিন্তা করতে করতে পথ চলতে থাকে হাবিল। কোমরের ব্যাথাটা ভোগাচ্ছে খুব। হাঁটতে পারছে না। তখনই আবার হঠাৎ করে বৃষ্টির তেজ বেড়ে গেল।

সে যেখানে ছিলো সেখান থেকে অল্প দূরত্বেই মনু মিয়ার চায়ের দোকান। দোকান খোলাই ছিলো।সেখানে অনেক লোকের সমাগম হয়েছে।বেশির ভাগই দোকানে ঢুকেছে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে। তাদের কথার শব্দে গমগম করছিলো দোকান। এতো লোক দেখে খুশিই হয় মনু মিয়া। লোক বেশি হলে বিক্রিও বেশি।চা এর সাথে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে নানা কিসিমের আলাপ হবে। শুধু ঝগড়া না লাগলেই হলো। দোকানের কোলাহল অনুসরণ করতে করতে সেইদিকে যায় হাবিল। তাকে আসতে দেখে দোকানের লোকজন। সে আস্তে আস্তে দোকানের ভেতরে ঢোকে। ভেতরে ঢোকা মাত্রই-

"ঐ কানার বাইচ্চা কানা,গায়ে প্যাঁক লাগাইলি ক্যা আমার??"

বলে চিৎকার করে ওঠে একজন। চোখে দেখতে না পেলেও হাবিলের কানে শোনার ক্ষমতা ছিলো তীব্র। গলার স্বর শুনে বুঝতে পারে এটা শহীদ মাঝি। আছাড় খেয়ে পড়ে যাওয়ার পর কাঁদা লেগে গিয়েছিলো হাবিলের পায়ে,পাছায়,হাতের কনুইতে। সেখান থেকে শহীদ মাঝির গায়ে কাঁদা লেগে গেছে হয়তো। হাবিলতো সেটা ইচ্ছা করে লাগায়নি। আজ যদি সে দেখতে পেত তাহলে কি কাঁদা লাগতো? বেশ রাগ হয় তার। শহীদকে জব্দ করার জন্য একেবারে শহীদের দূর্বল জায়গায়ই আঘাত করে হাবিল-

"কানা কছ কারে???তর বউয়ের ডাইন বুকের নিচের লাল তিলডা তর আগে আমি দেখছি।অস্বীকার যাইতে পারবি??"

বিদ্রুপের সুরে কথাটি বলেই খ্যাক খ্যাক করে জানোয়ারের মতো হাসতে থাকে হাবিল।হাসতে হাসতেই আবার বলে ওঠে-

"হেই রাইতে তো এমন বৃষ্টি আছিলো!! না রে???"

কথার সাথে সাথে হাসির মাত্রা বেড়ে যায় তার। তার এই হাসি দেখে ক্রোধে উন্মাদ হয়ে যায় শহীদ মাঝি।

"চোরের বাচ্চায় কয় কী!!!"

বলেই হাবিলকে মারতে যায় সে।আশেপাশের লোকজন তাকে জাপটে ধরে নিবৃত্ত করে। চোর বলায় হাসি থেমে যায় হাবিলের।তার আঁতে ঘা লাগে।ক্ষেপে গিয়ে বলে ওঠে-

"হারামির বাইচ্চা,চোর কছ আমারে? চোর তো তুই। জাইল্যাগো মাছ চুরি কইরা হাট্র বেচছ।আমি সবার সামনেত্তে কাইড়্যা নিতাম।সবার সামনেত্তে যারা কাইড়্যা খায় হ্যাগো ডাকাইত কয়,ডাকাইত!!! বুঝছছ নি আহাম্মকের বাইচ্যা???"

সে এক নিঃশ্বাসে শহীদ মাঝিকে লক্ষ করে কথাগুলো বলে ফেলে। বলার পর মনে একটু শান্তি পেলো সে। হাবিলের কথার প্রতিবাদ করে না কেউ।কারণ হাবিলের সব কথাই সত্যি। হাবিল ও কাবিল পুরো থানার ত্রাস ছিলো। এত বছর পরে এতকিছু হয়ে যাবার পরও হাবিলের তেজ এতটুকু কমে নি দেখে অবাক হয় দোকানের লোকেরা। লোকজন এখনও মনে রেখেছে সেই আতঙ্কের দিনগুলো।ধনী,স্বচ্ছল গৃহস্থেরা রাতে ঘুমোতে পারতো না জানমালের নিরাপত্তার কথা ভেবে। এই দুইভাই ছিলো সাক্ষাৎ আজরাইল। হিংস্র,নৃশংস। তারা যে বাড়িতে আক্রমণ করতো সে বাড়ির ধনসম্পদ লুট তো করতোই, সামনে যাকে পেত তাকেই জবাই করে হত্যা করে রেখে যেত। জবাই করার কাজটা কাবিল খুব ভালো করতো। মানুষগুলোর গলা কাটার পর সেগুলো যখন ডাঙায় তোলা মাছের মতো লাফাতো সেটা দেখে একটা পৈশাচিক আনন্দ লাভ করতো কাবিল।নারী,শিশু কেউই বাদ যেত না তাদের নিষ্ঠুরতার অনুশীলন থেকে। কচি নারী শরীরের প্রতি দুর্বলতা ছিলো হাবিলের। অল্প বয়সী নারী দেখলেই তাকে ভোগ করতে চাইতো হাবিল। ভোগ করার উদ্দেশ্যেই সে শহীদ মাঝির নববিবাহিতা বউকে অপহরণ করেছিলো। এমনই বৃষ্টি ছিলো সেদিন। অমাবস্যার রাত।চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বউকে নিয়ে শহীদের বরযাত্রার নৌকা মাত্রই ঘাটে ভিড়েছিলো। ঠিক তখনই গামছা দিয়ে মুখ ঢাকা দশ-বারো জনের একটি দল রামদা হাতে আক্রমণ করেছিলো তাদের।ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে সকলে। যখন সম্বিত ফিরে পায় তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক। সবাই আছে।কেউ আহত,কেউবা নিহত।শুধু শহীদের বউটা নেই। একথা মনে পড়লে এখনও মরে যেতে ইচ্ছা করে শহীদের। ঘটনার ধরণ দেখে কারোই বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা হাবিলের কাজ। সকালবেলা গ্রামবাসী মিলিত হয়ে নালিশ নিয়ে গিয়েছিলো চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবিরের কাছে। হাবিল-কাবিলকে চেয়ারম্যান সাহেবই গোপনে পালতেন নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার উদ্দেশ্যে। সেটা সকলেই জানতো।কিন্তু না জানার ভান করে থাকতো। চেয়ারম্যান সাহেব গর্জে উঠলেন। তার গ্রামে এরকম ন্যাক্কারজনক কাণ্ড!!তিনি এর একটা বিহিত করেই ছাড়বেন।শহীদকে বললেন, "চিন্তা কৈরো না।।আইজকা রাইতের মইদ্দেই তোমার বউরে খুঁইজ্যা বাইর করমু,ওগো পুলিশে দিমু।"

চেয়ারম্যানের আশ্বাসের পর আর কোনো কথা থাকে না।চলে গেল সকলে।বউটাকে পাওয়া গিয়েছিলো অবশেষে।তবে সেদিন রাতে নয়।পরদিন ভোরে বাড়ির পেছনের ঝোঁপে।হাত-পা বাঁধা।অজ্ঞান।শরীরে গভীর ক্ষতচিহ্ন।তবে শরীরের চেয়ে মনের ক্ষতটাই বেশি ছিলো। চিকিৎসার পর বউ সুস্থ হয়েছিলো। কিন্তু আশেপাশের মানুষ,এমনকি শ্বশুরবাড়ির মানুষের কটু কথা, টিটকারি সহ্য করতে না পেরে বউটা একদিন গলায় ফাঁস দিলো।বাড়ির পেছনে যেখানে তাকে পাওয়া গিয়েছিলো,ঠিক সেখানে একটা আমগাছ ছিলো।সেই আমগাছের ডালেই গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়েছিলো সে গভীর রাতে,যখন সবাই নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলো। এসব ঘটনা গ্রামবাসীর স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল। এসব ঘটনা হাবিলের মনে অনুশোচনা জাগ্রত করেনি কখনো বরং গ্রামবাসীর ভয়ের কারণ হতে পেরে গর্ববোধ করতো হাবিল।

তার এই মনোভাব এখনও যায় নি। মনে মনে ভাবে আচ্ছা জব্দ করা গেছে শহীদকে।এমন ধারালো জিহ্বা থাকতে চোখের কী দরকার!! তার মনে জেগে ওঠে অতীতের তেজোদ্দীপ্ত সময়ের কথা। গ্রামের চেয়ারম্যান তাদের সমীহ করতো। গ্রামবাসী তাদের ভয় করতো। শেষবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কথা মনে পড়ে তার। সেবার সে,কাবিল,হালিমা ও তার দলবল মিলে হুমায়ুন চেয়ারম্যানকে জিতিয়ে দিয়েছিলো। সেদিন সকালেই গ্রামবাসী জড়ো হয়েছিলো ভোটকেন্দ্রে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এনামুলের দুই চ্যালা হালিমার সামনে পড়ে যায়। হালিমাকে দেখে তারা ভয় পেয়ে যায়। তারা এসেছিলো মূলত ভোট কাটতে। হালিমা তাদের পথ আটকায়। সাথে সাথেই তারা গ্রেনেড মেরে ভোটকক্ষে ঢুকে গিয়েছিলো। গ্রেনেডের শব্দে সবাই পালিয়ে গিয়েছিলো।হালিমা শুয়ে পড়েছিলো মাটিতে। পরক্ষণেই আসল ব্যাপারটা টের পেয়েছিলো সে।কোনও রক্তের দাগ নেই।কেউ হতাহত হয় নি। সাথে সাথেই চিৎকার করে ওঠে হালিমা-

"কুত্তার বাইচ্চারা!! সাউন্ড গ্রেনেড মাইরা আমারে ডর দ্যাহাছ???"

বলেই রামদা নিয়ে ছুটে গিয়েছিলো ভোটকক্ষের দিকে।হালিমার রুদ্রমূর্তি দেখে এনামুলের লোকজন সব ফেলে পালিয়েছিলো। পথিমধ্যে একজনের লুঙ্গি খুলে যায়। সেটা না নিয়েই পালিয়েছিলো তারা।
নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতেছিলো হুমায়ুন।আসলে ভোট দিয়েছিলো হাবিলের লোকেরা।

হাবিল-কাবিলের চাইতে কোনও অংশে কম ছিলো না তাদের বড় বোন হালিমা। ডাকাত বাড়ির মেয়ে বলে তাকে বিয়ে করতে রাজি হয় নি কেউ। তাতে কী? সে ভাইদের সাথে দিব্যি আছে। একদিন খালের পাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলো সে। তখন দেখে দুজন জেলে নৌকায় করে মাছ নিয়ে এসেছে। একটা পাঙাশ ও একটা আইড় মাছ।দুটোই প্রকাণ্ড আকারের। জেলেদের ডেকে মাছের দাম জিজ্ঞাসা করলো হালিমা।মহিলা দেখে একটু দাম বেশি চাইলো তারা। বললো দুট মাছের জন্য সাড়ে চার হাজার টাকা দিতে হবে। হালিমা বলেছিলো-

"ট্যাকা তো লগে কইরা আনি নাই।আপনেরা মাছ দুইডা লইয়া আমার লগে আহেন।বাইত গিয়া ট্যাকা দিতাছি।"

জেলেরা তার পেছনে পেছনে মাছ নিয়ে তার বাড়িতে চলে গিয়েছিলো।বারান্দায় মাছ দুটো রেখে তারা টাকার আশায় দাড়িয়ে ছিলো।মনে মনে হয়তো ভেবেছিলো মহিলাকে ভোদাই বানিয়ে দিয়েছে তারা।কিন্তু এরপর যা ঘটলো তার কথা এর হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না।হালিমা টাকা আনার কথাবলে ঘরে ঢুকেছিলো। কিন্তু বের হয়েছিলো হাতে রামদা নিয়ে।টাকা নয়।জেলেরা ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিলো। হালিমা কঠিন কণ্ঠে বললো-

"এহনো ট্যাকা চাছ? কোন বাইত ঢুকছছ ঠিক পাছ নাই???"

কথা শুনেই ভোঁ-দৌড় দেয় জেলেরা।তাদের আর কখনো দেখা যায় নি এদিকটায়।

তারা তিন ভাইবোন বেশ প্রতাপের সাথেই বাস করছিলো। তাদের কিছু করার সাহস ছিলো না কারও। একবার গ্রামের জব্বার মিয়া সর্বহারা পার্টির দশজন লোককে ভাড়া করে এনেছিলো তাদের মারার জন্য। দিন প্রতি দশ হাজার টাকার কন্ট্রাক্ট ছিলো। তারা স্টেনগান হাতে পাঁচদিন ধরে খুঁজেছিলো হাবিল,কাবিল ও হালিমাকে।কিন্তু তাদের টিকিটিও দেখা যায় নি।খরচে কুলোতে না পেরে সর্বহারাদের ফেরত পাঠিয়েছিলো জব্বার। আট নম্বর দিনই জব্বারের বাড়ি আক্রমণ করে তাদের সবাইকে জবাই করে হাবিল কাবিল। তারপর থেকে তারা সম্পূর্ণ নিরাপদে ছিলো।

মানুষের সুখ কখনোই চিরস্থায়ী হয় না। হাবিলদেরও হয় নি । হুমায়ুন চেয়ারম্যানের মৃত্যুর খবরে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো।তারা বুঝতে পেরেছিলো গ্রামবাসী প্রতিশোধ নেবে এবার। তাদের আশ্রয়দাতা আর নেই। অনেক দিনের চাপা ক্ষোভের এবার ভয়াবহ উদগীরণ ঘটবে। হাবিল আর কাবিল সেদিন রাতেই পালাতে উদ্যত হয়। তারা পালানোর সময়ই কিভাবে যেন গ্রামবাসী উপস্থিত হয়ে যায় সেখানে। হাবিল আর কাবিল ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাচ্ছিলো।গ্রামবাসীর মধ্যে কেউ একজন একটি মাছ ধরার কোঁচ ছুড়ে মারে তদের লক্ষ্য করে। সেটা গিয়ে আঘাত করে একেবারে কাবিলের বুক বরাবর পিঠের দিকে। আঘাতে লুটিয়ে পড়ে কাবিল। চোখের সামনে ভাইকে লুটিয়ে পড়তে দেখলেও তাকে সাহায্য করার মতো সময় বা সুযোগ হাবিলের ছিলো না।কাবিলকে রেখেই সে অন্ধকারে কাঁদতে কাঁদতে হারিয়ে গিয়েছিলো লোকচক্ষুর অন্তরালে।

পরবর্তী সময়ে সে সবকিছু জানতে পেরেছিলো হালিমার কাছ থেকে। কাবিল তখনই মারা গিয়েছিলো।গ্রামবাসী তাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে দিয়ে এসেছিলো দুই ক্রোশ দূরের নদীতে,যেখানে ঘূর্ণাবর্তের স্রোত ধরে জলের অতলে হারিয়ে গিয়েছিলো তার ভাই কাবিল। গ্রামবাসীর কাছ থেকে পালিয়ে হাবিল আশ্রয় নিয়েছিলো এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেদিন রাতেই গ্রামবাসী সেই আত্মীয়ের বাড়িতে হানা দেয়। কিন্তু হাবিলকে পায় না। সকলে উদ্বিগ্ন ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

হাবিলের দুর্ভাগ্য শেষ হয় না। পরের দিন ভোরে বৃদ্ধ মজিবর মিয়া যখন মাঠে যাচ্ছিলো তখন দেখে কেউ একজন বোরখা পরে তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হাঁটার ধরণ দেখে সন্দেহ হয় মজিবর মিয়ার।তাই সে বোরখা পরা আগন্তুককে ডাক দিয়ে দাড় করায়।কিন্তু দাড় করানো মাত্রই লোকটি মজিবর মিয়ার পেটে ছুড়ি বসিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু পারে না। মজিবর মিয়া বোরখা টেনে ধরে এবং শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করতে থাকে। গ্রামবাসী জেগেই ছিলো।তারা জড়ো হয়ে যায় সাথে সাথে। হাবিল ধরা পড়ে যায় গ্রামবাসীর কাছে। তাকে বেঁধে রাখা হয় গ্রামের হাটের পাশের আমগাছের সাথে।

হাবিলের ধরা পড়ার খবর শুনেই হালিমা ছুটে গিয়েছিলো পুলিশের কাছে। তার ধারণা ছিলো পুলিশ দিয়ে হাবিলকে গ্রেপ্তার করালে হাবিল বেঁচে যাবে। কাবিলের পরিণতি বরণ করতে হবে না তাকে। সে থানায় যায়।গিয়ে দেখে সেখানে কেউ নেই।অফিসাররা কেউ আসেনি। কখন আসবে কেউ জানে না। হালিমা জানতো না যে গ্রামবাসী আগেই থানার অফিসারদের সাথে আঁতাত করে রেখেছিলো। থানার দারোগা গ্রামবাসীকে বলেছিলো-

"আমরা জানার আগেই কাজ সেরে ফেলেন।দুদিন সময় আপনাদের হাতে। গণপিটুনি বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।"

হালিমা দেরি না করেই হাটের দিকে ছুটেছিলো সেদিন। গিয়ে দেখে হাবিল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার কোটরে চোখ নেই। সেখান থেকে অঝোর ধারায় রক্ত ঝড়ছে। হালিমা কান্নায় ফেঁটে পড়ে-

"তগো সবাইরে দেইখ্যা লমু। আমি হাবিলের চিকিৎসা করামু।আমার একটা চোখ দিয়া দিমু।এরপর দেখমু তরা কই যাছ।"

হাবিল,কাবিল,হালিমা ছিলো গ্রামের অসুখ।গ্রামবাসী হালিমাকে ছেড়ে দিয়েছিলো মহিলা বলে।কাবিলকে মেরে আর হাবিলকে অন্ধ করে দিয়ে তারা গ্রামের অসুখের প্রতিকার করেছিলো।

পরবর্তী সময়ে হালিমা ঠিকই হাবিলের চিকিৎসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো। বাংলাদেশে কাজ হয় নি বলে ভারতেও নিয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু ডাক্তার যখন বললেন, "হাবিলের চিকিৎসা সম্ভব না।এসিড ঢেলে তার নার্ভ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।" তখন হালিমা বুক ফাঁটা আর্তনাদ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলো মেঝেতে। এরপর থেকে হালিমাই তার ভরণ-পোষণ করেছিলো।কিন্তু বছর দুয়েক আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হালিমা মারা যাওয়ায় এখন তাকে ভিক্ষে করে খেতে হচ্ছে। শহীদের মতো লোকও তাকে গালি দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। নিজের দুর্ভাগ্যের ওপর রাগ হয় তার। হঠাৎই তার ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে যখন মনু মিয়া বলে ওঠে-

"আহ!! বৃষ্টি থামছে।ঝামেলা গেছে।"

বৃষ্টি থেমে গেছে।তাকে ভিক্ষার জন্য বের হতে হবে এখনই।নইলে পেটে ভাত জুটবে না আজ।একথা চিন্তা করতে করতে দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে হাবিল। তাকে থামলে চলবে না।অতীতের সুখস্মৃতি রোমন্থন করে নষ্ট করার মতো সময় নেই তার।

সমাপ্ত।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:০৭

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: একজন ভয়ঙ্কর ডাকাতের অপকর্ম ও তার প্রাপ্য পরিণতির গল্প। অনেক ভালো লিখেছেন।

একটু খটকা লাগলো, একজন ডাকাত, যে-এখন ভিক্ষা করে, তার এমন ধমকে ওঠার নৈতিক সাহস থাকার কথা না, আর সেই সাহস দেখালেও শহীদ মাঝির চুপসে যাওয়ার কথা না।

শুভ কামনা।

০৬ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:৪৭

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: ধন্যবাদ সুচিন্তিত মতামতের জন্য।লেখার সময় যেটা চিন্তা করেছি সেটা বলছি।

ডাকাতের নৈতিকতার ধার ধারার কথা না।নৈতিক সাহস হয়তো নেইও।কিন্তু চিরকালের আগ্রাসী স্বভাব থেকে এই কাজ করেছে সে।আর তাকে চোর বলায় হাবিলের রাগ উঠে গেছে।।শহীদ মাঝি চুপসে যায় নি।তাকে আশেপাশের লোকজন নিবৃত্ত করেছে হাবিল অন্ধ ভিক্ষুক বলে।তাছাড়া নারী ও স্পর্শকাতর ব্যাপারে কথা তোলায় মানসম্মানের ভয়ে কথা আর বাড়ায় নি শহীদ।য়েটা ছিল আমার ভাবনার দিক। অন্য দৃষ্টিভঙ্গী থেকেও দেখা যেতে পারে ব্যাপারটা।

২| ০৬ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:০১

রাজীব নুর বলেছেন: হাবিল কাবিলের জন্য আমার মায়া লাগছে।

০৬ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:০৭

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে। গ্রাম্য ডাকাতগুলো সারাজীবন যা করে তাতে এসব শাস্তি তাদের জন্য কম হয়ে যায় আসলে। কাবিলকে তো মেরে ফেললাম।কিন্তু হাবিলের বেলায় ইডিপাস ফলো করলাম। মেরে না ফেলে অন্ধ করে দিয়েছি।

৩| ০৬ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৪৪

ওমেরা বলেছেন: মানুষ কতটা খারাপ হলে খারাপ কাজের শাস্তি ভোগ করার পরও অনুশোচনা না করে, পাপের কথা বলে গর্ব করতে পারে !!

০৬ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:০৯

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: এ ধরণের মানুষেরা পাপগুলোকে অর্জন মনে করে।যার কারণে গর্ব করেই বলে। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

৪| ০৬ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:১০

রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে। গ্রাম্য ডাকাতগুলো সারাজীবন যা করে তাতে এসব শাস্তি তাদের জন্য কম হয়ে যায় আসলে। কাবিলকে তো মেরে ফেললাম।কিন্তু হাবিলের বেলায় ইডিপাস ফলো করলাম। মেরে না ফেলে অন্ধ করে দিয়েছি।

আপনি খুব নিষ্ঠুর।
কেউ তো আর শখ করে ডাকাত হয় না।

০৬ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:১৫

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: ডাকাত হবার কারণ তো আছেই। আমি নিষ্ঠুর ঠিক আছে।কিন্তু ডাকাতের চাইতে একটু কম আর কী!!

৫| ২০ শে অক্টোবর, ২০২১ রাত ১১:৪০

খায়রুল আহসান বলেছেন: সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: "একজন ভয়ঙ্কর ডাকাতের অপকর্ম ও তার প্রাপ্য পরিণতির গল্প। অনেক ভালো লিখেছেন।" - আমার কথাটাই উনি বলে দিয়েছেন।

১ নং প্রতিমন্তব্যটাও ভালো লেগেছে।

২১ শে অক্টোবর, ২০২১ রাত ১১:৫৩

মোঃমোস্তাফিজুর রহমান তমাল বলেছেন: আপনি সময় করে আমার পুরোনো পোস্টগুলোতে মন্তব্য রেখে যাচ্ছেন।এটা আমার জন্য অনেক বেশি অনুপ্রেরণাদায়ক। আমি কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি।
এই গল্পটিতে আরো একটি বিষয় আনতে চেয়েছিলাম। যদিও সেটা প্রচ্ছন্নভাবে এসেছে। মানুষের ক্ষমতা বেশিদিন থাকে না। ক্ষমতাসীন অবস্থায় তার কার্যক্রমের ফলাফল তাকে ক্ষমতাহীন অবস্থায় ভোগ করতেই হবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.