নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

.।

মোস্তাকিম হায়দার শাকিল

এক আশ্চর্য জীবন চেরাগে বন্দি কবি ।

মোস্তাকিম হায়দার শাকিল › বিস্তারিত পোস্টঃ

মাইরের উপর ওষুধ নাই !

১৭ ই জুন, ২০১৬ রাত ২:২১

প্রাচীনকাল হতে বর্তমান সময়ে মানব সভ্যতার উন্নতির ক্রমবিকাশের মূলে রয়েছে প্রজন্ম হতে প্রজন্মে পূর্বের আহরিত জ্ঞান, বিজ্ঞান ও নানাবিদ কৌশল পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া । প্রাচীন কালে যে মানব সর্বপ্রথম আগুন জ্বালানোর কৌশল রপ্ত করেছিলেন কিংবা অজানা আকরিক হতে কয়লার জারণে লৌহ বা তামা উৎপাদন করেছিলেন , তিনি তা গোপন রাখেননি বরং ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সবার মাঝে । এভাবেই একজনের উদ্ভাবিত বিদ্যা বা কৌশল অন্যজনের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমেই গড়ে উঠে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক । এ সম্পর্কের হাত ধরে যুগ হতে যুগে নানা প্রাচীন কলা, বিদ্যা, কৌশল বহু রূপান্তর, পরিবর্ধন, পরিমার্জনের পথ পেরিয়ে বর্তমান আধুনিক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে । মহান দার্শনিক সক্রেটিসের জীবন দর্শনের অনেক তথ্যই তাঁর শিষ্য প্লেটোর লেখনীর মাধ্যমেই জানতে পারি , তা না হলে অক্ষর জ্ঞানহীন এই মহান মনীষীর সম্পর্কে অনেক কিছুই হয়তো অজানা রয়ে যেত । গুরু-শিষ্য কিংবা শিক্ষক-ছাত্র যাই বলি না কেন, এ পারস্পরিক সম্পর্ক সবসময় সহজ সাবলীল হওয়া বাঞ্ছনীয়, ব্যতিরেকে জ্ঞানের পূর্ণ ও স্বাভাবিক বিনিময় ব্যাহত হয় ।
সেই প্রাচীন কাল হতেই শিক্ষকতা সব সমাজেই একটি মর্যাদাপূর্ণ পেশা হিসেবেই সমাদৃত হয়ে এসেছে । কিন্তু আমাদের দেশের অনেক শিক্ষকই, বিশেষত যারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তারা ছাত্রদের মনে-মস্তিস্কে মর্যাদার বদলে প্রবল আতঙ্ক ও ভয়ের আসনে অধিষ্ঠিত । একজন শিশুর সামাজিক ও মানসিক বিকাশের প্রারম্ভিক পর্যায়ে "প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের " ভূমিকা অন্যতম প্রধান । এ সময় যে কোন একটি মানসিক কিংবা শারীরিক আঘাত, তাঁর আজীবনের মানসিক বা শারীরিক বিকৃতির কারণ হতে পারে । আমাদের দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই ছাত্রদের মাঝে বিলিত বিদ্যা আদায়ের বা অবাধ্য ছাত্রের চরিত্র সংশোধনের হাতিয়ার হিসেবে শ্রেণীকক্ষে বেত ব্যবহার করে থাকেন । তাছাড়াও বিকৃত মস্তিষ্ক প্রসূত নানাবিদ শারীরিক ও মানসিক শাস্তি ছাত্রদের উপর প্রয়োগ করেন । কিন্তু এসব নিকৃষ্ট শাস্তি একজন ছাত্রকে মানসিক ভাবে কতটা পর্যুদস্ত করতে পারে, সে ব্যাপারে তাদের ঘুণধরা মস্তিষ্কে কিঞ্চিৎ ধারণাও বোধহয় নেই । যুগ হতে চলে আসা এ অমানবিক ছাত্র বেতানো কিংবা পারিবারিক ভাবে শিশু-কিশোরদের মারধর করাকে এদেশে সামাজিক রীতি হিসেবেই দেখা হয় । শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক ভাবে লাঞ্ছনা করাকে এ সমাজে পথ্য হিসেবে গণ্য করা হয়, যা হা করিয়ে বিদ্দে গলধঃকরনে এবং যাবতীয় অসামাজিক ক্রিয়া হতে নিবারণের ফলপ্রসূ মাধ্যম ; প্রচলিত ভাবে যা "মাইরের উপর ওষুধ নাই " প্রবাদেই সার্বজনের মনে গৃহীত ও বিঁধিত। কিন্তু এই ভ্রান্তিয় প্রবাদের সদুরপ্রসারি নেতিবাচক প্রভাব কেমন হতে পারে, তাঁর উদাহরণসরূপ একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ্ করা হল -
ভুক্তভোগীর নাম - ফারুক হাসান ( তাঁর স্বীয় অভিজ্ঞতা উত্তম পুরুষে দেয়া হল )
"" ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ১০ বছর পূর্বের । আমি তখন ঢাকার এক স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে পড়ি । এ সময় আমার বাবা, যিনি একজন সরকারী চাকরিজীবী ছিলেন , ঢাকা হতে অন্যত্র বদলী হওয়ায় মা আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে মাস দুয়েকের জন্য গ্রামের বাড়ি চলে আসেন । । সেখানেই এক বিদ্যালয়ে আমার পড়াশুনার বন্দোবস্ত করা হয় । বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া শুরুর কয়েকদিন পরের এক প্রাত্যহিক সমাবেশে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় আমি হয়তোবা কোন কারণে হাসছিলাম । একজন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রের জন্য এটি এমন কোন অমার্জনীয় গুরু পাপ হবার কথা নয় কিন্তু এই লঘু পাপেই আমার গুরু দণ্ড ভোগ করতে হল । একজন শিক্ষক আমার কলার ধরে টেনে সবার সামনে নিয়ে গেলেন এবং বেত দিয়ে তিনি ক্লান্ত হবার আগ পর্যন্ত বেধড়ক পেটালেন । আমার শাস্তির সেখানেই সমাপ্তি হলেই বোধহয় ভালো হতো কিন্তু অতৃপ্ত সম্মানিত শিক্ষক আমাকে কান ধরিয়ে দুপুরের তীব্র রোদের মধ্যে দাড় করিয়ে রাখলেন । আমি প্রচণ্ড ভয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকি এবং কিছুক্ষণ পরই অচেতন হয়ে পড়ি । তারপর প্রায় পাঁচ থেকে ছয়দিন প্রচণ্ড জ্বরে ভোগার পর আমাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসা হয় । অসম অভিজ্ঞতার দরুণ আমার মানসিক অসুস্থতার দেখা দেয় এবং আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় সাথে কিছু নিষ্ঠুর-বর্বর দাগ আমার ঘাড়ে-পিঠে আজীবনের সঙ্গী হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠায়, পরবর্তী বছর আমি পুনরায় ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হই । পরে জানতে পারি, ঐ শিক্ষক আমার আত্মীয়স্বজনের রোষানলে পড়ে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেন এবং কিছুদিন পরেই তাকে অন্যত্র বদলী করা হয় । যাই হোক, এত বছর পরেও সেই ভয়ার্ত স্মৃতি আমি কখনো মন থেকে বিতাড়িত করতে পারিনি এবং ঐ অভিজ্ঞতার নিদারুণ প্রভাব আমায় যথেষ্ট ভুগিয়েছে । পরবর্তী সময়ে আমি কোন শিক্ষকের সাথেই সহজ হতে পারিনি, তিনি যতই সহনশীল হোন না কেন । শিক্ষকদের কাছ থেকে দূরে থাকতে আমি সবসময় পেছনের দিকে বসতাম এবং শ্রেণীকক্ষের বাইরেও কোনো শিক্ষকের শ'হাতের মধ্যে আমায় পাওয়া যেত না । ফলে ধীরে ধীরে শিক্ষকদের প্রতি আমার ভয়, দুরুত্ব ও নেতিবাচক মনোভাব বাড়তেই থাকে । কোন শিক্ষক পড়া জিজ্ঞেস করলে আমি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়তাম। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় বদরাগী ইংরেজি শিক্ষকের হাত হতে রেহায় পাবার জন্য স্কুল পালানো শুরু করলাম । সে সময়টায় স্কুল আমার কাছে ছিল বিভীষিকারই নামান্তর । পরবর্তীতে পরিবার ও বিদ্যালয়ের কিছু সুহৃদ শিক্ষকের সহায়তায় আমি আমার সমস্যার মোটামুটি সমাধান করতে সম্ভব হই কিন্তু কখনোই তা পুরোপুরি ভাবে নয়। ""
উদ্দিষ্ট এই ঘটনাটি আমাদের জোরজবরদস্তির শিক্ষা ব্যবস্থার একটি খণ্ড চিত্র মাত্র । আমাদের সমাজে শিশুদের সব শিক্ষাই - তা প্রাতিষ্ঠানিক, নীতি কিংবা ধর্ম শিক্ষাই হোক, গেলানো হয় ভয়ের মাধ্যমে । ছাত্র পড়া পারেনি, দুটা কষে বেত লাগান - কালই দেখবেন পড়া হাজির; কিশোর ছেলে পাড়ায় মারামারি করেছে , ধরে লাঠি, বেত বা যা হাতের কাছে পাবেন তাই দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে পেটান, পিঠে দাগ বসে যাক - ছেলে ভালো হয়ে যাবে ; মেয়ে ভালো রেজাল্ট করেনি, পাঁশের বাড়ির ভালো রেজাল্ট করা মেয়েটির নমুনা টানুন, জোরে গালে চড় বসান, পড়াশুনা বন্ধের হুশিয়ারি দিন - মেয়ে ভালো রেজাল্ট করবে, তাঁর পরও মন ভরছে না ? আপনিই তো জনকজননী বা তাদের পরই আপনার স্থান ... আরো পেটান, লাথি দিন, কুৎসিত গালি দিন, টেনে চুল ছিঁড়ে ফেলুন ...বাচ্চা মানুষ... শুধরে যাবে ? ...... ভুল ।
একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র, যে সবে পরিবারের চেনা গন্ধ পেরিয়ে জানা-অজানার বৃহৎ বিশ্বমঞ্চে মাত্রই পা রাখল, এ রহস্য মণ্ডিত পৃথিবী, নানা জ্ঞান-বিজ্ঞান যেখানে তাকে ক্ষণে ক্ষণে মোহিত করার কথা, যখন তার ব্যক্তিত্বের দোর আবছা ভাবে খুলতে শুরু করার কথা ...তখনি তা কঠিনভাবে অবরুদ্ধ করে দেয়া হয় । তাকে বলে দেয়া হয় কিভাবে সে অন্য গোষ্ঠীদের থেকে আলাদা, ভিন্ন লিঙ্গের প্রতি তাঁর অধীনতা বা ঊর্ধ্বস্থতা , তাঁকে মেধার ক্রম শেখানো হয়, তাঁকে উচ্চ শব্দ করে পড়তে বলা হয় এর ব্যতিরেক হলেই শুরু হয় ভয় দেখানো... বেতের ভয়, পিছিয়ে পড়ার ভয়, পরজন্মের ভয় । ভয়ের মাঝে কখনোই প্রকৃত শিক্ষার- সৃজনশীলতার চর্চা সম্ভব হয় না, ভয়ের মাঝে জন্ম নেয় কিছু কীট-পোকা ... অবসাদের পোকা, জীর্ণ মানসিকতার পোকা, অসুস্থ প্রতিযোগিতার পোকা । এই পোকারা সবই শিখে ... তারা ইথিক্স শিখে, গনিত-বিজ্ঞান শিখে, তারা ভালো ছাত্র হিসিবেও পরিচিতি পায় কিন্তু এই পোকারা কোন কিছুই মন-মস্তিস্ক দিয়ে উপলন্ধি করতে জানে না ...... তারা শুধুই শিখে ।
প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক শিক্ষার আবহ ভয়-ডরহীন হওয়া বাঞ্ছনীয় কিন্তু আমাদের অনেক শিক্ষকই ছাত্র পিটানোকে তাদের পেশাগত ঐতিহ্য এবং বেতকে সোনার জাদুর-কাঁঠি ভাবেন, যার পরশে পরশে ছাত্রের জীবন সোনা হয়ে উঠবে । জাতিসংঘের ২০০৮ সালের "চিলড্রেন'স অপিনিওন পোল-২০০৮" এর এক জরিপ অনুযায়ী -এদেশের শতকরা ৯১ শতাংশ ছাত্র বিদ্যালয়ে শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয় । ২০১১ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট সকল ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তিকে "অবৈধ এবং অসংবিধানিক " ঘোষণা করে কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইনে এমনকি ২০১৩ সালের শিশু আইনেও শিক্ষা ব্যবস্থায় "শারীরিক শাস্তির" ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ নেই । ২০১৩ সালের শিশু আইনের ৭০ অনুচ্ছেদে শিশু নির্যাতনকারীর শাস্তির ব্যাপারে (৫বছর কারাদণ্ড বা ১লক্ষ টাকা কিংবা উভয়ই ) উল্লেখ থাকলেও , শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তির বিষয়ে এবং অভিযুক্ত শিক্ষকের শাস্তির ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট বিধানের উল্লেখ নেই। তাছাড়াও বাস্তব ক্ষেত্রে এসব আইন এবং সাংবিধানিক বিধিনিষেধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক নির্যাতন কতোটা নিবৃত করতে পারছে তাও প্রশ্নবিদ্ধ । এখনও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শারীরিক শাস্তি প্রদান নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এসব অগোচরেই রয়ে যায় তাছাড়াও শুধুমাত্র আইনের দোহাই দিয়ে শিক্ষকদের তাদের বুনো ঐতিহ্য থেকে নিবৃত রাখা অনেকটা হিংস্র শ্বাপদের পায়ে শিকল পরিয়ে দেবার মতো ; আইন-বিধিনিষেধের সংস্কারের পাশাপাশি দরকার শিক্ষক ও সমাজের মূল্যবোধের পরিবর্তন । শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক ভয় বা আতঙ্কের নয় বরং বন্ধুত্বময় এবং পারস্পরিক মর্যাদার হওয়া উচিত। ইতিবাচক মূল্যবোধের বিকাশেই আশা করি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সমাজ হতে ছাত্র- শিশু বেতানোর প্রথা দূরীভূত হবে এবং পরিবার, শিক্ষক সবার মাঝেই এই শুভবুদ্ধির উদয় ঘটুক যে- ভয়, আতঙ্ক আর অসুস্থ প্রতিযোগিতার দ্বারা জাতি কীট-পোকা ভিন্ন অন্য কিছু উৎপাদন করতে সক্ষম হবে না ... এই কীটদের নিন্মস্তরীয়রা দেশকে বর্তমানের মতো কুরেকুরে খাবে এবং উচ্চশিক্ষিত কীটেরা পাখা গজানোর পর অন্যত্র গিয়ে সুষম পরিবেশে স্বীয় বংশবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করবে ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.