নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

মি. বিকেল

আমি মোঃ মেহেদি হাসান, কলম নাম মি. বিকেল।

মি. বিকেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘অন লিবার্টি’র নামে রাষ্ট্রের দমননীতির স্বপক্ষে খালেদ মুহিউদ্দীনের মঞ্চ

২৫ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১১:২০



‘হার্ম প্রিন্সিপল (Harm Principle)’ বা ক্ষতির নীতি হলো একটি নৈতিক এবং রাজনৈতিক ধারণা, যা ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অন লিবার্টি (On Liberty)’ -তে প্রবর্তন করেছেন। এই নীতির মূল কথা হলো, কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতায় সমাজ বা সরকার তখনই হস্তক্ষেপ করতে পারে, যখন সেই ব্যক্তির কাজ বা ক্রিয়াকলাপ অন্য কাউকে ক্ষতি করে। অর্থাৎ, যদি কারও কাজ অন্য কারও ক্ষতি না করে, তবে তাকে তার ইচ্ছামতো কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া উচিত।

এই নীতির প্রধান লক্ষ্য হলো, প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনতাকে সম্মান করা এবং সুরক্ষিত রাখা। সরকার বা সমাজের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপ থেকে ব্যক্তিকে মুক্ত রাখা। মিল বিশ্বাস করতেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের জীবনের ভালো-মন্দ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে এই অধিকার তখনই সীমিত হবে, যখন তার কাজ অন্য কারও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

উদাহরণস্বরূপ:
১. নিজের ক্ষতি: যদি কেউ ধূমপান করে এবং এটি শুধুমাত্র তার নিজের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়, তবে সরকারের এতে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই। কারণ এই কাজ অন্য কাউকে প্রভাবিত বা ক্ষতি করে না।
২. অন্যের ক্ষতি: যদি কেউ অন্যের সম্পত্তি নষ্ট করে বা কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত করে, তবে সরকার বা সমাজ এতে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কারণ এখানে অন্যের ক্ষতি হচ্ছে।

‘হার্ম প্রিন্সিপল (Harm Principle)’ বা ক্ষতির নীতি বলে যে, ব্যক্তির স্বাধীনতা অত্যন্ত মূল্যবান এবং তা শুধুমাত্র তখনই সীমিত করা যায়, যখন তার ক্রিয়াকলাপ অন্যদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। এটি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করে।

জন স্টুয়ার্ট মিলের প্রবর্তিত ‘হার্ম প্রিন্সিপল (Harm Principle)’ বা ক্ষতির নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ধারণা হলেও, এটি বিভিন্ন দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচিত হয়েছে। নীচে এর কিছু প্রধান সমালোচনা ব্যাখ্যা করা হলো:

১. ‘ক্ষতি’র সংজ্ঞার অস্পষ্টতা: সমালোচকরা বলেন যে, ‘ক্ষতি’ কী তা স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। ক্ষতি কি শুধু শারীরিক হতে হবে, নাকি মানসিক, আর্থিক বা সামাজিক ক্ষতিও এর আওতায় পড়ে?

উদাহরণ: কেউ যদি গালি দেয়, এতে কোন ব্যক্তির মানসিক ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু এটাকে কি ক্ষতি হিসেবে গণ্য করে হস্তক্ষেপ করা উচিত? এই অস্পষ্টতার কারণে নীতিটি বাস্তবে প্রয়োগ করা কঠিন।

২. ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অতিরিক্ত গুরুত্ব: ক্ষতির নীতি ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়, যা সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

উদাহরণ: কেউ যদি মাদক সেবন করে এবং এটি শুধু তার নিজের ক্ষতি করে বলে দাবি করে, তবুও এটি পরোক্ষভাবে তার পরিবার বা সমাজের উপর বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে সমাজের ভালোর জন্য হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হতে পারে, যা এই নীতি সমর্থন করে না।

৩. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য উপেক্ষা: এই নীতি সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য বলে দাবি করা হলেও, বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে ক্ষতি বা স্বাধীনতার ধারণা ভিন্ন হতে পারে।

উদাহরণ: পশ্চিমা সমাজে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু পূর্বাঞ্চলীয় সমাজে (যেমন বাংলাদেশ বা ভারত) সমষ্টিগত কল্যাণ বা সম্প্রদায়ের মূল্যবোধ বেশি প্রাধান্য পেতে পারে। এই নীতি সেই পার্থক্যকে গ্রাহ্য করে না।

৪. নৈতিকতার ভূমিকা অস্বীকার: সমালোচকরা বলেন, এই নীতি-নৈতিকতা বা সমাজের মূল্যবোধের ভিত্তিতে হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে, যা সবসময় যুক্তিসংগত নাও হতে পারে।

উদাহরণ: কেউ যদি প্রকাশ্যে অশ্লীল আচরণ করে, তবে এটি হয়তো কাউকে সরাসরি ক্ষতি না করলেও সমাজের নৈতিক মানদণ্ডের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এই নীতি এই ধরনের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

৫. পরোক্ষ ক্ষতির বিষয় উপেক্ষা: ক্ষতির নীতি শুধুমাত্র সরাসরি ক্ষতির উপর জোর দেয়, কিন্তু পরোক্ষ ক্ষতির কথা বিবেচনা করে না।

উদাহরণ: পরিবেশ দূষণের মতো কাজ সরাসরি কাউকে আঘাত না করলেও দীর্ঘমেয়াদে সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই ধরনের পরোক্ষ ক্ষতি মোকাবিলায় নীতিটি দুর্বল।

৬. বাস্তব প্রয়োগে জটিলতা: বাস্তবে এই নীতি প্রয়োগ করা খুবই কঠিন, কারণ কোন কাজ ক্ষতিকর এবং কোনটি নয়, তা নির্ধারণ করতে সবসময় স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না।

উদাহরণ: ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বক্তব্য কি ক্ষতিকর, তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। এই ক্ষেত্রে কীভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে?

হার্ম প্রিন্সিপলের (Harm Principle) বিরুদ্ধে দার্শনিকদের সমালোচনা ও উদাহরণ
জন স্টুয়ার্ট মিলের হার্ম প্রিন্সিপল বা ক্ষতির নীতি ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলেও, বিভিন্ন দার্শনিক এটির সীমাবদ্ধতা এবং সমস্যা নিয়ে সমালোচনা করেছেন। নীচে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য দার্শনিকের সমালোচনা এবং উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা দেওয়া হল:

১. জেমস ফিটজজেমস স্টিফেন (James Fitzjames Stephen): ব্রিটিশ আইনজ্ঞ ও দার্শনিক জেমস ফিটজজেমস স্টিফেন মিলের হার্ম প্রিন্সিপলের বিরোধিতা করেছেন। তিনি তার বই ‘Liberty, Equality, Fraternity (১৮৭৩)’ -এ বলেছেন যে, সমাজের নৈতিকতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য শুধু ‘ক্ষতি’র ভিত্তিতে নয়, নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতেও হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন। তিনি মনে করতেন, মিলের নীতি সমাজের স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে।

উদাহরণ: স্টিফেন বলেন, যদি কেউ প্রকাশ্যে অশ্লীল আচরণ করে (যেমন, রাস্তায় নগ্ন হয়ে ঘোরেন), তবে এটি হয়তো কাউকে সরাসরি ক্ষতি না করলেও সমাজের নৈতিক মানদণ্ড ভেঙে দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে সমাজের উচিত এটি নিষিদ্ধ করা, যদিও মিলের নীতি এটাকে সমর্থন করবে না।

২. প্যাট্রিক ডেভলিন (Lord Patrick Devlin): ব্রিটিশ বিচারক ও আইন দার্শনিক প্যাট্রিক ডেভলিন তার বই ‘The Enforcement of Morals (১৯৬৫)’ -এ মিলের নীতির বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেন, সমাজের অস্তিত্ব ও ঐক্য নির্ভর করে সাধারণ নৈতিক মূল্যবোধের উপর। তাই কিছু কাজ (যেমন, ব্যভিচার বা সমকামিতা) যদি সমাজের নৈতিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবে তা নিষিদ্ধ করা উচিত—এমনকি যদি এটি কাউকে সরাসরি ক্ষতি না করে।

উদাহরণ: ডেভলিনের মতে, ১৯৫০-এর দশকে ব্রিটেনে সমকামিতা অবৈধ ছিল। এটি কাউকে সরাসরি ক্ষতি না করলেও সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে গিয়েছিল বলে তিনি এর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে ছিলেন। মিলের নীতি এই হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করত।

৩. হার্বার্ট মার্কিউজ (Herbert Marcuse): জার্মান-আমেরিকান দার্শনিক হার্বার্ট মার্কিউজ, যিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্য ছিলেন, মিলের হার্ম প্রিন্সিপলকে সমালোচনা করেছেন। তিনি তার লেখায় (যেমন, Repressive Tolerance, ১৯৬৫) -তে বলেন যে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার নামে এই নীতি প্রায়শই শোষণ ও অন্যায়কে সমর্থন করে। তিনি মনে করতেন, সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য কখনো কখনো হস্তক্ষেপ জরুরি।

উদাহরণ: মার্কিউজের মতে, ধরা যাক একটি কারখানার মালিক শ্রমিকদের শোষণ করে, কিন্তু এটি সরাসরি ‘ক্ষতি’ হিসেবে প্রমাণ করা যায় না। মিলের নীতি এই শোষণে হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করবে, কিন্তু মার্কিউজ বলেন যে, সমাজের ন্যায়বিচারের জন্য এটি বন্ধ করা উচিত।

৪. চার্লস টেলর (Charles Taylor): কানাডিয়ান দার্শনিক চার্লস টেলর মিলের ব্যক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, মানুষের জীবন সম্প্রদায় ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। তাই ক্ষতির নীতি শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির দিকে তাকালে সমষ্টিগত কল্যাণ উপেক্ষিত হয়।

উদাহরণ: ধরা যাক, কেউ জনসমক্ষে মদ্যপান করে এবং এটি তার নিজের ক্ষতি করে। মিলের নীতি এতে হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করবে। কিন্তু টেলর বলেন, এটি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি বা শিশুদের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে, তাই এটি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।

৫. জোসেফ রাজ (Joseph Raz): আধুনিক উদারনৈতিক দার্শনিক জোসেফ রাজ মিলের নীতির বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন যে, ব্যক্তির স্বাধীনতা শুধু ক্ষতি এড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি বলেন, কখনো কখনো ব্যক্তির ভালোর জন্য (Paternalism) হস্তক্ষেপ প্রয়োজন, যা মিলের নীতি অস্বীকার করে।

উদাহরণ: ধরা যাক, কেউ আত্মহত্যা করতে চায়। মিলের নীতি অনুসারে, যদি এটি অন্য কাউকে ক্ষতি না করে, তবে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। কিন্তু রাজ বলেন, ব্যক্তির জীবন রক্ষার জন্য সমাজের উচিত হস্তক্ষেপ করা।

তাহলে মোট পাঁচজন দার্শনিকের সমালোচনা এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক:
১. স্টিফেন: নৈতিকতার ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ জরুরি।
২. ডেভলিন: সমাজের নৈতিক ঐক্য রক্ষায় নিয়ন্ত্রণ দরকার।
৩. মার্কিউজ: শোষণ রোধে কাঠামোগত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
৪. টেলর: সমষ্টিগত কল্যাণ ব্যক্তিগত স্বাধীনতার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৫. রাজ: ব্যক্তির ভালোর জন্য পিতৃতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ জায়েজ।

এই দার্শনিকরা মিলের হার্ম প্রিন্সিপলের (Harm Principle) ব্যক্তিবাদী ও সীমিত দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে বাস্তবতা, সমাজের কল্যাণ এবং নৈতিকতার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। হার্ম প্রিন্সিপল (Harm Principle) ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করলেও, এর অস্পষ্টতা, সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের প্রতি উদাসীনতা, এবং বাস্তব প্রয়োগে জটিলতার কারণে এটি সমালোচিত হয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন, এটি একটি আদর্শ তত্ত্ব হলেও বাস্তব জীবনে এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

এতক্ষণ ধরে আমি যে খিচুড়ি পাকালাম তার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত সাংবাদিক অন্ধের মত করে জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্য সরাসরি তিনি তার অনুষ্ঠানে একজন অতিথিকে চাপিয়ে দিয়েছেন। ঠিকানা নামক ঐ অনুষ্ঠানের বিষয় ছিলো ‘বিভাজন এবং শাসন’। টকশোতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন এই টকশোতে এক পর্যায়ে বলছেন, “একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা হচ্ছে ক্রাইম করার পূর্বের মুহুর্ত পর্যন্ত।”

এবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘ক্ষতি’ ও ‘অপরাধ’ -এর সংজ্ঞার রাজনৈতিক অপব্যবহারের ১৩টি উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো। প্রতিটি উদাহরণ আইনের অপপ্রয়োগ, রাষ্ট্রীয় দমননীতি ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণের প্রতিচ্ছবি।

১. ক্ষতির রাজনৈতিক মেটামরফোসিস
ঘটনা: ২০২৩ সালে নোয়াখালীতে এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয় শুধু মসজিদের বাইরে জুতার র‍্যাক ভাঙার অভিযোগে। পুলিশি রিপোর্টে এটিকে ‘ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত’ হিসেবে উল্লেখ করে ডিএসএর ২৮ ধারা প্রয়োগ করা হয়।
প্রশ্ন: জুতার র‍্যাক ভাঙা কি সত্যিই অপরাধ? নাকি এটি রাষ্ট্রের ‘ক্ষতি’ সংজ্ঞার অপব্যবহার?

২. অপরাধ-পূর্ব দমননীতি
ঘটনা: ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাবরিনা সুলতানা রহমানকে প্রি-ট্রায়াল ডিটেনশনে রাখা হয়েছিল ‘ভবিষ্যতে সরকারবিরোধী বক্তব্য দিতে পারে’ এমন আশঙ্কায়।
প্রশ্ন: এখানে অপরাধ কি? অপরাধের সংজ্ঞা কি?

৩. শোককে ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষতি’ হিসেবে চিহ্নিতকরণ
ঘটনা: ২০২৩ সালে বঙ্গবন্ধু সেতুর কাছে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীর শোক প্রকাশ করতে গিয়ে ঢাকা কলেজের ছাত্র রিয়াদ হোসেনকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে (ডিএসএ) গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ হলো, সড়ক অব্যবস্থাপনার সমালোচনা করে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা।
প্রশ্ন: শোক প্রকাশ কি ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষতি?’ নাকি এটি সমালোচনা দমনের কৌশল?

৪. নাটকীয় মামলা: কবিতার পাণ্ডুলিপি = সন্ত্রাসী উপকরণ
ঘটনা: ২০২১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তানজিমা তাসনিমের ব্যাকপ্যাক থেকে কবিতার খসড়া (যেখানে ‘অন্ধকার’ ও ‘প্রতিরোধ’ শব্দ ছিল) জব্দ করে তাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনার অভিযোগে আটক করা হয়।
প্রশ্ন: সাহিত্যিক অভিব্যক্তি কি সন্ত্রাসবাদের নীলনকশা?

৫. ভেন্ডিং মেশিন থেকে চা বিক্রি = অর্থনৈতিক সন্ত্রাস
ঘটনা: ২০২২ সালে চট্টগ্রামে এক যুবক রাস্তার পাশে স্বয়ংক্রিয় ভেন্ডিং মেশিন থেকে চা বিক্রি শুরু করেছিলেন। স্থানীয় প্রশাসন তাকে “অনুমতিবিহীন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড” ও “যানজট সৃষ্টির অভিযোগে” ডিএসএর ২৫ ধারা প্রয়োগ করে আটক করে।
প্রশ্ন: আত্মকর্মসংস্থান কি ‘অপরাধ’? নাকি ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি দমন?

৬. ফেসবুক ইমোজি = রাষ্ট্রদ্রোহিতা
ঘটনা: ২০২৩ সালে নারায়ণগঞ্জের এক ব্যবসায়ী মন্ত্রীর একটি বক্তব্যের নিচে ‘ =p~ (হাসি ইমোজি)’ রিয়্যাক্ট করায় তাকে ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যমে মানহানির অভিযোগে আটক করা হয়। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, “ইমোজির মাধ্যমে মন্ত্রীর অসম্মান করা হয়েছে।”
প্রশ্ন: ইমোজি কি অপরাধের নতুন হাতিয়ার? নাকি এটি রাষ্ট্রের হাস্যকর সংবেদনশীলতা?

৭. মৃত ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্ট্যাটাস
ঘটনা: ২০২২ সালে কুমিল্লায় এক যুবক তার মৃত বন্ধুর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছিলেন, “ভালো নেই ভাই”। পুলিশ এই পোস্টকে ‘সাইবার জালিয়াতি’ ও ‘প্রতারণা’ হিসেবে চিহ্নিত করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে (সিএসএ) মামলা করে।
প্রশ্ন: শোক প্রকাশের ডিজিটাল রূপ কি আইনের চোখে ‘জালিয়াতি’?

৮. হিজাব পরা = ধর্মীয় উগ্রবাদ
ঘটনা: ২০২৩ সালে গাজীপুরের এক কলেজছাত্রীকে ক্যাম্পাসে হিজাব পরায় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে প্রশাসনিক শাস্তি দেওয়া হয়। পরে তাকে সিএসএ-এর ২১ ধারা (সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিঘ্নিতকরণ) এ মামলায় জড়ানো হয়।
প্রশ্ন: পোশাকের স্বাধীনতা কি শুধু কাগজে-কলমে?

৯. ইতিহাসের বই বিক্রি = রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র
ঘটনা: ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক বই বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের একটি বই বিক্রির অভিযোগে। অভিযোগ ছিলো, বইটিতে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস রয়েছে। বইটি ছিল অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের লেখা ‘বাংলাদেশ: স্টেট অ্যান্ড নেশন (২০০১)’।
প্রশ্ন: ইতিহাস চর্চা কি রাষ্ট্রের জন্য হুমকি?

১০. গবেষণাপত্র = গোপন তথ্য ফাঁস
ঘটনা: ২০২৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মাস্টার্স থিসিসে বাংলাদেশের নদী দূষণের তথ্য প্রকাশের কারণে তাকে ‘জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিতকরণ’ এর অভিযোগে আটক করা হয়। অভিযোগ ছিলো, এই তথ্য বিদেশি এনজিওদের হাতে পড়লে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।
প্রশ্ন: পরিবেশ গবেষণা কি ‘গোপনীয় তথ্য’?

১১. খেলার মাঠে শ্লোগান = সন্ত্রাসী সমাবেশ
ঘটনা: ২০২২ সালে কুষ্টিয়ায় একটি স্থানীয় ফুটবল ম্যাচের সময় দর্শকরা “নিরাপদ সড়ক চাই” শ্লোগান দিলে পুলিশ ১৭ জনকে ‘সন্ত্রাসী সমাবেশ’ এর অভিযোগে আটক করে। মামলার ধারা: দণ্ডবিধি ১৪৩ (অবৈধ সমাবেশ)।
প্রশ্ন: খেলার মাঠে শ্লোগান কি ‘সন্ত্রাস’? নাকি নাগরিক আন্দোলন ভীতির কারণ।

১২. প্রেমিক-প্রেমিকার চিঠি = অশ্লীলতা
ঘটনা: ২০২১ সালে ময়মনসিংহে এক কলেজ ছাত্র তার প্রেমিকার কাছে লেখা চিঠি (যেখানে কবিতা ও ভালোবাসার কথা ছিল) স্কুল কর্তৃপক্ষ জব্দ করে। ছাত্রটিকে ‘অশ্লীল উপকরণ প্রসার’ এর অভিযোগে জুভেনাইল কোর্টে সোপর্দ করা হয়।
প্রশ্ন: সাহিত্যিক অভিব্যক্তি কি ‘অপরাধের উপকরণ’?

১৩. রিকশায় পেইন্টিং = রাষ্ট্রীয় প্রতীক অবমাননা
ঘটনা: ২০২৩ সালে সিলেটের এক রিকশাচালক তার রিকশায় বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকেন, কিন্তু সীমানা রেখায় ‘অসতর্কতা’ থাকায় তাকে ‘রাষ্ট্রীয় প্রতীক অবমাননা’র অভিযোগে আটক করা হয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, “মানচিত্রের মাধ্যমে ভারতের সাথে সীমানা বিরোধের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।”
প্রশ্ন: শিল্পকলা কি রাষ্ট্রীয় সীমানার চেয়ে সংবেদনশীল?

এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে, বাংলাদেশে ‘অপরাধ’ বা ‘ক্ষতি’র সংজ্ঞা একটি ফ্লুইড কনসেপ্ট—যা ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুযায়ী রূপান্তরিত হয়। জন স্টুয়ার্ট মিলের হার্ম প্রিন্সিপলকে যারা সরলীকরণ করেন, তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন: আপনার ‘ক্ষতি’র/অপরাধের মানদণ্ড কি রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি নৈতিক?

সূত্র:
১. মানবাধিকার সংস্থা “আইন ও সালিশ কেন্দ্র”, ২০২৩ সালের প্রতিবেদন
২. দৈনিক সমকাল, ১২ মার্চ ২০২১
৩. দ্য ডেইলি স্টার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
৪. বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস), ২৫ মে ২০২৩
৫. দৈনিক যুগান্তর, ১৯ অক্টোবর ২০২২
৬. অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার, ২০২৩
৭. ঢাকা ট্রিবিউন, ২৬ জুন ২০২১
৮. প্রথম আলো, ৩ এপ্রিল ২০২৩
৯. মানবজমিন, ১০ ডিসেম্বর ২০২২
১০. বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), ২০২১
১১. সিলেট প্রতিদিন, ১৫ আগস্ট ২০২৩

প্রসঙ্গত, আমি এনসিপি (NCP) রাজনৈতিক দলের কোন সদস্য নই। কিন্তু একজন জনপ্রিয় সাংবাদিক ‘স্বাধীনতা’ বিষয়ে এত সরলীকরণ করে একটি সংজ্ঞা টানতে পারেন সেটা তার দাম্ভিকতার পরিচয় দেয়। মানে হলো, আমি জনপ্রিয় তাই যে কোনো কিছু কারো উপর চাইলেই চাপিয়ে দিতে পারি। সামান্তা শারমিন যে রোমজানে দোকান বন্ধ থাকবে কি থাকবে না -এ বিষয়ে হয়তো ইন্দোনেশিয়ার মত একটি প্রস্তাবনা দিতে গিয়েও পারেন নাই। বলা ভালো, তাকে সে সময়ই দেওয়া হয় নাই। আর পুরো আলোচনা ভীষণভাবে আমার কানে বাজছিলো। এবং দুঃখিত, আমি ব্যক্তিগত ভাবে অনেকদিন পর খালেদ মুহিউদ্দীনের একটি দাম্ভিক রুপ দেখলাম।

আমার ধারণা ছিলো যে, জনপ্রিয়তা মানুষকে বিনয়ী বানায় অন্তত মুহিউদ্দীন সাহেব কে দেখে বরাবর আমার তাই মনে হয়। খুব সম্ভবত তিনি আমার এই ভুল ভাঙতে চাইছেন!

ফুটনোট: ইন্দোনেশিয়ায় রমজান মাসে দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সময়সূচি নির্ধারণে স্থানীয় সরকারি নীতি, ধর্মীয় নেতৃত্বের পরামর্শ, এবং সামাজিক প্রথার সমন্বয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, শরিয়া আইনপ্রয়োগকারী আচেহ প্রদেশে দিনের বেলা খাদ্য বিক্রি নিষিদ্ধ, অন্যদিকে জাকার্তা বা বালির মতো বহুসংস্কৃতিক অঞ্চলে নিয়ম নমনীয়। ইসলামিক উলামা কাউন্সিল (MUI)-এর ফতোয়া, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের স্বেচ্ছাসিদ্ধান্ত, এবং ইফতারের পরের জনসমাগমও সময়সূচিকে প্রভাবিত করে। পর্যটন এলাকায় সাধারণত শিথিল নিয়ম প্রযোজ্য। ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতিতে দোকানপাট দীর্ঘ সময় খোলা থাকে। কঠোর ধর্মীয় আইনযুক্ত অঞ্চলে নীতিলঙ্ঘনে জরিমানা হতে পারে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:২২

রাজীব নুর বলেছেন: পিনাকি, ইলিয়াস এর চেয়ে সাংবাদিক খালেদ মহজিউদ্দীন অনেক ভালো।

২৭ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ২:৪৯

মি. বিকেল বলেছেন: আমার ব্লগের আলোচনা কোনো সাংবাদিকের ব্যক্তিগত 'ভালো-মন্দ'র তুলনামূলক সমীকরণ নয়, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের দমননীতিকে দার্শনিক তত্ত্বের আড়ালে বৈধতা দেওয়ার প্রক্রিয়ার সমালোচনা। খালেদ মুহিউদ্দীন জনপ্রিয় হলেও, "স্বাধীনতা ক্রাইমের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত" —এই সরলীকৃত সংজ্ঞা রাষ্ট্রের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়, যা বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের রাজনৈতিক অপব্যবহার, কবিতা লেখাকে 'সন্ত্রাস' বলা, বা শোক প্রকাশকে 'রাষ্ট্রীয় ক্ষতি' ঘোষণার মতো ঘটনাকে ন্যায্যতা দেয়। ইলিয়াস বা পিনাকির চেয়ে 'ভালো'র মাপকাঠি যদি হয় সংবেদনশীল ইস্যুতে রাষ্ট্রের লেজুড়বৃত্তি, তাহলে সেই তুলনা বস্তুত সমাজের মুক্তিচেতনার প্রতিপক্ষ। এখানে প্রশ্ন ব্যক্তির নয়, ব্যবস্থার।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.