![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘একাকীত্ব’ সাধারণ বিষয় নয়। একা থাকা মানে অজস্র চিন্তার স্রোত মাথায় প্রবাহিত হওয়া। একা থাকা মানে নিজের সাথে থাকা। নিজের চিন্তা ও স্মৃতির সাথে একাকীত্ব আমাদের বেশি করে পরিচয় করিয়ে দেয়। ঘটে যাওয়া সমস্ত স্মৃতির সাথে ঘটমান চিন্তার মিশ্রণে ভবিষ্যৎ দেখাও কিন্তু এই একাকীত্বের অংশ। স্মৃতিগুলো যদি ভয়ানক হয়, চিন্তাগুলো যদি শুধুই ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিতার কারণ হয় তাহলে আমরা ডিপ্রেশনের (হতাশা’র) শিকার হতে পারি। আর ডিপ্রেশন হলো এমন এক অসুখ যা আমাদের ভেতর থেকে ঘুণ পোকার মত করে শেষ করে দেয়।
একাকীত্ব সবার জীবনেই কমবেশি এসে থাকে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে একা হয়ে যাবার ভয় কিন্তু বাড়েও। একাকীত্ব মানে কিন্তু শুধুমাত্র ‘একা’ থাকা নয়; একাকীত্ব মানে নিজের সাথেও থাকা। একাকীত্ব মানে নিজের সাথে সময় কাটানো। নিজের স্মৃতিভাণ্ডারে ঘুরে বেড়ানো, নিজের চিন্তা নিয়ে সচেতন ভাবে ভাবা। কিন্তু আমরা একা থাকতে ভয় পাই, আমাদের একা থাকতে খারাপ লাগে, একা থাকতে একঘেয়েমি লাগে। অনেকসময় একা থাকলে নিজেকে অসহায় লাগে।
একটি গবেষণা (American Journal of Public Health, ২০২০) দেখায়, নিয়মিত সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, এমনকি ছোট মাত্রায় হলেও, একাকীত্ব কমাতে এবং আত্মহত্যার ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়ক হতে পারে।
অত্যাধুনিক টেকনোলজি যেমন ‘স্মার্টফোন’ এর মত ডিভাইস আমাদের জীবনকে একদিক থেকে সহজ করলেও ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আমাদের অনেক একা করে দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে পুরনো বন্ধুদের সন্ধান মিলেছে। বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। যোগাযোগ সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তার পরিবর্তে আমাদের সবার মাঝে দুরত্ব বাড়িয়েছে, আমাদেরকে একে-অন্যের থেকে অনেক বেশি আলাদা করে দিয়েছে, দিনশেষে আমরা ‘একা’ হয়ে পড়েছি।
American Journal of Preventive Medicine (2007)-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি সময় ব্যয় করা তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে একাকীত্ব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি বাড়ায়।
এই সমস্যার শুরু হতে পারে আমাদের পরিবার থেকেও। একটি বিষয় আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, পৃথিবীতে কোনো পরিবার আদর্শ পরিবার নয় ঠিক তেমন করে আমার পরিবারও আদর্শ পরিবার নয়। এই পৃথিবীতে কোনো আদর্শ পরিবারের অস্তিত্ব নাই। প্রতিটি পরিবারেই কিছু না কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যা উপস্থিত থাকে। এ সমস্ত সমস্যা কিছুটা কাছের বন্ধুর সাথে ভাগাভাগি করা গেলেও মন খুলে সবটুকু ভাগাভাগি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং কাজের ব্যস্ততা একটি বড় কারণ আমাদের ‘একা’ হয়ে যাবার, একাকীত্ব নামক অসুখে ভুগবার। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া এবং শহুরে জীবনের ব্যস্ততা আমাদের প্রিয়জন থেকে দূরে রাখে। ২০২১ সালে ডিব ও ফস্টারের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৪% প্রাপ্তবয়স্ক সঙ্গীর অভাবে একাকীত্বে ভোগেন, এবং ২৭% প্রাপ্তবয়স্ক নিজেদের বিচ্ছিন্ন অনুভব করেন। বিশেষ করে ১৬-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৪০% বিভিন্ন সময়ে একাকীত্ব অনুভব করেন।
এরপর সামাজিক প্রত্যাশা, অর্থনৈতিক চাপ এবং বেকারত্ব আমাদের আরো বেশি চাপে ফেলে দিতে পারে। বিশেষ করে করোনা ভাইরাস পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক চাপ ও বেকারত্ব ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তার উপর ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)’ অনেক চাকুরী তে মানুষের বিকল্প হিসেবে দাঁড় হতে শুরু করেছে। ফলে এক ধরণের ব্যাপক অনিশ্চয়তা আমাদের সবার সামনে উপস্থিত।
এখন যদি শুধুমাত্র সামাজিক প্রত্যাশা নিয়ে কথা বলতে হয় তাহলে বিষয়টি এরকম দাঁড়ায়: যেহেতু আমরা মোটামুটি/ভাল-মন্দ একটি সমাজে বসবাস করি সেহেতু এই সমাজ আমাদের কিছু পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য নির্ধারণে পরোক্ষ ভূমিকা রাখে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও একরকম প্রত্যাশা দেখা যায়।
আমি ধরে নিচ্ছি, “আপনার সমাজ আপনাকে একজন বিসিএস ক্যাডার হিসেবে দেখতে চান। কারণ আপনি যথেষ্ট মেধাবী।” কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে আপনি আপনার সমাজের এই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলেন না। আমরা মুখে যতই বলে বেড়াই যে, আমি এই সমাজ কে মানি না/প্রত্যাখ্যান করলাম... কিন্তু দিনশেষে বারবার এই সমাজ আপনাকে ব্যর্থ মানুষের নজরে দেখতে পারেন। এই সমাজ বারবার আপনাকে মনে করিয়ে দিতে পারেন, “আপনি একজন ব্যর্থ মানুষ”।
ফলে সঙ্গত কারণেই আপনি ‘একা’ থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারণ বাইরে পা রাখলেই ‘ব্যর্থ’ শব্দটি বারবার আপনাকে শুনতে হয়। বিরুক্ত লাগতে পারে। এখন আপনি একটু এই ‘ব্যর্থতা’ থেকে দূরে থাকতে চান। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার সমাজের অনেক মানুষকে আপনার জীবন থেকে আংশিক হলেও বাদ দিতে হয়। ফলাফল হিসেবে আপনি আপনাকে ‘একা’ হিসেবে খুঁজে পেতে পারেন।
আর এই একা হওয়া থেকে একাকীত্ব বাসা বাঁধতে পারে আপনার মনের মধ্যে। আপনি একধরণের ‘FOMO = Fear of Missing Out’ -তেও ভুগতে পারেন। নিজেকে অসামাজিক বলেও মনে হতে পারে। আর এই একাকীত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হতে পারে সমাজের নির্দিষ্ট ফতোয়া অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হওয়া; যা সবসময় তো সম্ভব নয়।
এবার বেকারত্ব থেকে বের হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক চাপের দিকে একটু চোখ রাখা যাক। আপনি নিশ্চয় লক্ষ্য করে দেখেছেন, শিক্ষাজীবনে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউকে না কাউকে ‘একা’ থাকতে। ক্লাসের সবাই যখন বন্ধুদের আড্ডায় মত্ত, ভ্রমণ পরিকল্পনায় ব্যস্ত, নতুন নতুন প্রেমে মুগ্ধ, বস্তুবাদী অর্জন নিয়ে ব্যাপক প্রতিযোগীতা, রেজাল্ট নিয়ে এবং খেলাধূলা থেকে সংস্কৃতি অঙ্গনের পুরষ্কারের গলাবাজি করছে তখন কেউ না কেউ এসবের মানে খুঁজে পাচ্ছে না অথবা এসব অর্জন তার নেই তাই সে ‘একা’ বসে আছে।
আমরা অনেকেই এই ধরণের ছেলে/মেয়ে কে নিশ্চয় দেখেছি। ওরা কেমন যেন অদ্ভুত, চুপচাপ এবং মনে হয় ভীষণ একা। এই ধরণের পরিস্থিতিতে দুটি বিষয় আমাদের মাথায় আসতে পারে। এক, সে হয়তো সবাই যা করছে তারমধ্যে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে না। দুই, তার হয়তো ইচ্ছা আছে সবার সাথে মানিয়ে চলতে কিন্তু পারছে না। কিছু ব্যতিক্রমও থাকে, যারা আবার সবকিছুতেই নিজের স্বীকৃতি খুঁজে বেড়ায় না।
এই ছেলে/মেয়ে একসময় বড্ড একা হয়ে যায়। দীর্ঘ শিক্ষাজীবন ঘিরে নাম নেবার মত বন্ধুও থাকে না। এই একা হয়ে যাওয়া থেকে একাকীত্বের রাস্তা খুব বেশি দূরে নয়। আমরা নিজের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এদের ‘একা’ ফেলে দিই। আমরা বেশিরভাগ সময়ে ভাবি, ওর একা হয়ে যাওয়ার দায়ভার একমাত্র ওর নিজের-ই। হতে পারে এ বিষয়ে আমাদের ধারণ-ই সঠিক বা সঠিক নয়। বন্ধুহীন জীবন আর যাই হোক কোনোভাবেই রঙীন জীবন হতে পারে না। এই ধূসর ও বিবর্ণ জীবনের একাকীত্ব অনেক ভয়ানক হতে পারে। একসময় এই ধরণের ব্যক্তি চরম ডিপ্রেশনে ভুগতে পারেন।
এরপরের ধাপ আরো কঠোর বাস্তবতার দিকে আমাদের নিয়ে যায়। শিক্ষাজীবনে অর্জিত সার্টিফিকেট দিয়ে আমরা কমবেশি সবাই ভবিষ্যতের রাস্তা মেপে থাকি। স্বাভাবিকভাবেই যার রেজাল্ট যত ভালো সে তত ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেতে পারেন। শিক্ষাজীবনের গ্রুপিং আর কর্মজীবনের গ্রুপিংয়ের মধ্যে ব্যাপক তফাৎ আছে। প্রতিষ্ঠান, জব টাইটেল, মাইনে ইত্যাদি নির্ধারণ করতে পারে আপনি কোন কমিউনিটির সাথে ওঠাবসা করবেন। কর্মজীবনে “আমি প্রতিষ্ঠিত” এই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ ও নিষ্ঠুর ভূমিকা পালন করতে পারে।
আর আমরা সবাই এমন একটি রাস্তা ধরেছি যেখানে ‘বন্ধুহীন’ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ‘একা’ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এখানে চরম আত্মকেন্দ্রীকতা ও স্বার্থের খেলা চলে। একসময় টাকার জন্য লড়াই হয়ে উঠতে পারে জীবনের মূখ্য বিষয়।
এই ব্যস্ত কর্মজীবন ও পুঁজিবাদী দুনিয়ায় আমাদের হাতে এক মিনিট সময় থাকে না নিজেকে নিয়ে ভাববার। বরং আমাদের মধ্যে একধরণের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়, টাকা উপার্জনের, পদ অর্জনের, জব প্রোমোশনের ইত্যাদি। এই ব্যস্ততা ও টাকার পেছনে ইঁদুর দৌড় ‘বার্ণ-আউট (Burnout)’ ও ‘স্ট্রেস (Stress)’ এর জন্ম দিতে পারে। আশেপাশে যে ভালো দুই-একজন কলিগ আছেন তারা কিন্তু ঐ ‘বন্ধু’ না! যে বন্ধুকে আপনি সময় সময় মিস করেন।
টেকনিক্যালি আপনি ইতিমধ্যেই ‘একা’ হয়ে গেছেন। কলিগ কখনোই বন্ধু হতে পারে না এবং বন্ধুকে কখনো কলিগ বানাতে নেই। খুব সম্ভবত এমন কথা আপনি নিশ্চয় শুনেছেন। এই ‘ওয়ার্ক পলিটিক্স’ এর ভিড়ে আমরা আমাদের অতীত ভুলে যাই। আর নতুনের মধ্যে নতুনত্ব কিছু খুঁজেই পাওয়া যায় না। কৃত্রিম একটি ভদ্রতার মুখোশ পড়ে সামনে এগোতে হতে পারে।
এই সবকিছু মিলে আমাদের সামনে যে নতুন বাস্তবতা উপস্থাপিত হয় বা হচ্ছে সেখানে একাকীত্ব নামক অসুখে ধরবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। এখানে স্রেফ দ্বন্দ্ব আছে, বন্ধুত্ব বা বুঝাবুঝি নাই। এই পরিস্থিতিতেও আমাদের হাতে অপশন থাকে দুটো। এক, মুখ বুজে এই একাকীত্ব সহ্য করা। দুই, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দ্বন্দ্ব থেকে বের হয়ে বা এসবের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে নিয়ে একটু ভাবা। সারাক্ষণ সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেতে হবে এমন চিন্তা ঝেড়ে ফেলা; যা কিন্তু আবার সহজ নয়।
এবার আসা যাক করোনা পরবর্তী সংকট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের যুগে। আমার তো মনে হয়, প্রজন্ম মিলেনিয়াম’রা সকাল-সন্ধ্যা উপর আল্লাহ্ কে গালি দিতে শুরু করে দিয়েছেন। প্রথমত, করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বেঁচে ফিরে শুকরিয়া আদায়। দ্বিতীয়ত, লকডাউন/শাট-ডাউনে বন্দি থেকে সময়ের ধারণা গুলিয়ে ফেলা। তৃতীয়ত, চাকুরী/কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার পর এআই বিপ্লবে ঐ চাকুরী/কর্মসংস্থান নিয়ে ফের চিন্তায় পড়ে যাওয়া।
বর্তমান বিশ্বে তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে ২৫-৩২ বছর বয়সী মিলেনিয়াল ও জেন-জি প্রজন্ম, অভূতপূর্ব মানসিক চাপ ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, এই পরিস্থিতিতে কোনো প্রজন্মের পক্ষে স্থিতিশীল, সুখী বা নির্ভার জীবনযাপন করা প্রায় অসম্ভব। সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে লেখা:
“Nobody is more stressed than a 25-32 yrs old thinking they are running out of time.”
এই বাক্যটি তরুণদের জীবনের নির্মম বাস্তবতাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। তারা কেন এত চাপে রয়েছে? আমি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে চারটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছি: করোনা মহামারী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) বিপ্লব, সামাজিক আন্দোলন (যেমন জুলাই বিপ্লব) এবং জলবায়ু পরিবর্তন। এই কারণগুলো তরুণদের মধ্যে সময়ের সংকট, একাকীত্ব ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। নিচে এই বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করছি।
১. করোনা মহামারী ও সামাজিক দূরত্ব
করোনা মহামারী (২০২০-২০২২) বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। তরুণ প্রজন্মের জন্য এটি ছিল বিশেষভাবে ক্ষতিকর। লাগাতার লকডাউন, শাটডাউন এবং সামাজিক দূরত্বের নিয়ম আমাদের সময়ের ধারণাকে গুলিয়ে দিয়েছে। অনেকে মনে করেন, মহামারীর সময়টুকু যেন জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এই সময়ে তরুণরা তাদের স্বপ্ন, ক্যারিয়ার পরিকল্পনা এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেননি।
UNESCO (২০২১) এর তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ১.৬ বিলিয়ন শিক্ষার্থী মহামারীর কারণে শিক্ষায় ব্যাঘাতের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে তরুণ প্রাপ্তবয়স্করা, যারা নতুন দক্ষতা অর্জন বা কর্মজীবন শুরু করার পর্যায়ে ছিলেন, তারা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনলাইন শিক্ষা বা দূরবর্তী কাজের সুযোগ থাকলেও, এটি সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর ছিল না। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ ও প্রযুক্তিগত সুবিধা সীমিত, তরুণরা নতুন দক্ষতা শেখার ক্ষেত্রে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।
এছাড়া, মহামারী আমাদের সামাজিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়েছে। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে যোগাযোগ অব্যাহত থাকলেও, এটি বাস্তব জীবনের সম্পর্কের গভীরতা ও আন্তরিকতা ধরে রাখতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, জন্মদিন বা উৎসব ভার্চুয়ালি পালন করা হলেও, সবাই যে যার ঘরে বসে তা উদযাপন করেছে। এই ভার্চুয়াল ও বাস্তব জীবনের পার্থক্য তরুণদের মধ্যে গভীর একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি তৈরি করেছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই একাকীত্ব তরুণদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহামারী শেষ হলেও, এর প্রভাব এখনো বিদ্যমান। অনেক তরুণ বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হিমশিম খাচ্ছেন। ক্যারিয়ারের শুরুতে যে গতি বা সুযোগ তারা প্রত্যাশা করেছিলেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই অধরা রয়ে গেছে। ফলে, তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও সময় হারানোর ভয় কাজ করছে।
২. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) বিপ্লব
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত অগ্রগতি তরুণদের জীবনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। OpenAI-এর ChatGPT-এর আগমনের পর থেকে একাধিক AI মডেল ও এজেন্ট তৈরি হয়েছে, যা তথ্যের প্রবাহকে অভূতপূর্বভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই তথ্যপ্রবাহ তরুণদের মধ্যে ‘টাইম স্কারসিটি’ (সময়ের অভাব) সৃষ্টি করছে। মনে হচ্ছে সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে, আর তারা পিছিয়ে পড়ছেন।
AI-এর এই বিপ্লব তরুণদের কর্মজীবন ও দক্ষতার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। LinkedIn’s Future of Skills Report (২০২৪) অনুসারে, ৭০% তরুণ পেশাজীবী (২৫-৩৫ বছর) মনে করেন তাদের অর্জিত দক্ষতা AI-এর যুগে দ্রুত অপ্রচলিত হয়ে যাচ্ছে। World Economic Forum (২০২৩) এর একটি প্রতিবেদন জানায়, ৬০% তরুণ তথ্যপ্রবাহ ও দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির কারণে নতুন দক্ষতা শিখতে তীব্র চাপ অনুভব করছেন।
AI অটোমেশনের কারণে চাকরির বাজারে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, AI ঠিক কী কী করতে পারে? এবং তাদের নিজেদের দক্ষতা কতটা প্রাসঙ্গিক থাকবে?
এই অনিশ্চয়তা তরুণদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা দক্ষতা অর্জনের পথকে জটিল করে তুলেছে। AI-এর দ্রুত প্রসার তাদের মধ্যে প্রাসঙ্গিকতা হারানোর ভয় তৈরি করছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন তরুণ পেশাজীবী যিনি কয়েক বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট দক্ষতা শিখেছেন, তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করতে পারেন যে AI সেই কাজটি আরও দ্রুত ও কার্যকরভাবে করতে পারে। এটি তাদের মধ্যে অপ্রতুলতার অনুভূতি এবং ক্রমাগত শেখার চাপ সৃষ্টি করে।
এছাড়া, AI-এর কারণে তথ্যের অতি-প্রবাহ তরুণদের মনোযোগের বিভ্রান্তি, FOMO (Fear of Missing Out), সিদ্ধান্ত গ্রহণের জটিলতা এবং সময়ের অভাবের অনুভূতি বাড়াচ্ছে। ফলে তারা মানসিক চাপ, উদ্বেগ, একাকীত্ব এবং উৎপাদনশীলতার হ্রাসের মুখোমুখি হচ্ছেন।
বাংলাদেশের তরুণদের ক্ষেত্রে এই প্রভাব আরও তীব্র। সীমিত সম্পদ, অপর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত অবকাঠামো এবং সামাজিক প্রত্যাশার চাপ তাদের জন্য AI-এর সঙ্গে তাল মেলানোকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
৩. জুলাই বিপ্লব ও সামাজিক আন্দোলন
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই আন্দোলন তরুণদের মধ্যে সামাজিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ও সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ ঘটালেও, এটি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। Social Science & Medicine (২০২১) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বড় সামাজিক আন্দোলনের পর তরুণরা প্রায়ই ‘পোস্ট-মুভমেন্ট ব্লুজ’ নামে একটি মানসিক শূন্যতার মুখোমুখি হন। এই শূন্যতা তাদের মধ্যে হতাশা, একাকীত্ব এবং লক্ষ্যহীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করে।
জুলাই বিপ্লবের সময় তরুণরা রাস্তায় নেমে পরিবর্তনের জন্য লড়াই করেছেন। কিন্তু আন্দোলনের পরে অনেকে মনে করছেন, তাদের প্রচেষ্টা পুরোপুরি ফলপ্রসূ হয়নি বা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। এই হতাশা তাদের মধ্যে মানসিক চাপ ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি আরও গভীর করেছে। এছাড়া, আন্দোলনের সময় সহিংসতা, আঘাত বা প্রিয়জন হারানোর অভিজ্ঞতা অনেক তরুণের মধ্যে ট্রমার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৪. জলবায়ু পরিবর্তন ও ভবিষ্যৎ উদ্বেগ
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলোর একটি, এবং এটি তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। তাপপ্রবাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো ঘটনাগুলো তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। এই উদ্বেগ, যা ‘জলবায়ু উদ্বেগ (Climate Anxiety)’ নামে পরিচিত, তাদের মধ্যে অসহায়ত্ব, হতাশা এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি তৈরি করছে।
বাংলাদেশ এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যা এবং তীব্র তাপপ্রবাহ আমাদের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতি তরুণদের মনে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতার অনুভূতি তৈরি করছে। তারা মনে করছেন, তাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা সমাধানে অপর্যাপ্ত। এই অসহায়ত্ব তাদের মধ্যে মানসিক চাপ ও হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, ফেনীর ইতিহাসে সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা অনেক তরুণের জীবনকে স্থবির করে দিয়েছে। বাড়িঘর, সম্পদ এবং জীবিকা হারানোর পাশাপাশি, তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। তীব্র তাপপ্রবাহও আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এই সবকিছু মিলে তরুণদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা ও সময় হারানোর ভয় তৈরি করছে।
এই ছিলো আমার আজকের আলোচনা। আমি চেষ্টা করেছি সমস্যাটা বুঝবার। কারণ আমার মনে হয়, সমস্যা ধরতে পারলে সমাধান দ্রুত আসবে।
২| ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৪৩
সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: আপনার লেখাগুলো দারুণ তথ্য ও তত্ত্ব সমৃদ্ধ। দুঃখের বিষয় হলো এতো সুন্দর লেখা পড়ার কেউ নেই আপনার ছুটছি উদ্ভট মরিচিকার পিছনে!
৩| ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:০৫
মহাজাগতিক চিন্তা বলেছেন: পড়ার মত অনেক কিছুই লিখেছেন। এমন দামী লেখা পড়ার ক্ষেত্রে আমাদের সময়গুলো অত্যন্ত স্বল্প।
৪| ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:০২
এইচ এন নার্গিস বলেছেন: খুব সুন্দর একটা মূল্যবান লেখা পরলাম। অনেক গবেষণা করে তথ্য দিয়ে লেখা। যা থেকে জানার যেমন অনেক কিছু আছে তেমন শেখারও আছে।
এমন লেখা আরও চাই ।
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:২৬
নতুন বলেছেন: বর্তমানের প্রযন্মের সবচেয়ে বড় সমস্যা এই সোসাল মিডিয়া। এতেই তাদের সময়কে নিয়ে ব্যবসা করছে বড় বড় কর্পারেসন গুলি।
তারাই আবার এআই ব্যবহার করে মানুষের চাকুরী কমাচ্ছে।
চ্যাটজিপিটির পেইড ভার্সন নেবো ভাবছি। কারন ফ্রী দিয়েই যা করতে পারছি সেটা এক রকমের ম্যাজিকের মতন। তাই পেইড ভার্সন ব্যবহার করে দেখতে হবে।
মানুষ আসলে কোন না কোন রকমের দাসত্যে বাধা, এটা থেকে কোন মুক্তি নাই আমাদের।
আমাদের জীবন চলে যায় সময় বিক্রি করতে করতে, নিজের জন্য খুবই কম সময় বেচে থাকে।