নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

মি. বিকেল

আমি মোঃ মেহেদি হাসান, কলম নাম মি. বিকেল।

মি. বিকেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

মানুষ যন্ত্র হতে চায়, যন্ত্র মানুষ হতে চায়—কে হারাচ্ছে নিজেকে?

২২ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ১:২৯



আমি প্রায়ই একটা বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি। যখন দুটি মানুষ, প্রতিষ্ঠান বা ধারণার মধ্যে কোনো সংঘাত বা প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখন আমাদের মনে হয় এর পরিণতি হবে জয়-পরাজয়। আমরা ধরেই নিই, এই লড়াইয়ের শেষে একজন বিজয়ী হবে, শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরবে, আর অন্যজন পরাজিত হয়ে হারিয়ে যাবে। কিন্তু আমি আমার চারপাশের পৃথিবীটাকে দেখে যা বুঝেছি, তা হলো—বাস্তবতা এর চেয়েও অনেক বেশি জটিল এবং করুণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই দ্বন্দ্বের ফলে কেউ জেতে না; বরং যা হয়, তা হলো উভয়েরই স্বকীয়তার অপমৃত্যু। জন্ম নেয় এক নিষ্প্রাণ, গড়পড়তা বাস্তবতা।

আমার এই ভাবনাটা আরও স্পষ্ট হয় যখন আমি আমাদের চারপাশের ব্যবসায়িক জগতটাকে দেখি। ধরুন, একটি ওয়েব হোস্টিং কোম্পানি তাদের কিছু অনন্য ফিচার দিয়ে গ্রাহকদের সেবা দিচ্ছে। হঠাৎ বাজারে আরেকটি নতুন কোম্পানি এলো, যারা সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু ফিচার নিয়ে হাজির হলো। স্বাভাবিকভাবেই, কিছু গ্রাহক সেই নতুনত্বের দিকে ঝুঁকল। পুরোনো ও বড় কোম্পানিটি তাদের বাজার হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে দ্রুত সেই নতুন ফিচারগুলো নিজেদের পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত করে নিল।

মজার ব্যাপার হলো, কিছুদিন পর ছোট কোম্পানিটিও ভাবল, বড় কোম্পানির মতো হতে পারলেই হয়তো আরও সাফল্য আসবে। তাই তারাও বড় কোম্পানির পুরোনো ফিচারগুলো নিজেদের মধ্যে নিয়ে এলো। এই যে এক অন্তহীন ‘ফিচার যুদ্ধ’, এর শেষ কোথায়? শেষটা হলো এমন এক জায়গায়, যেখানে দুটি কোম্পানির মধ্যে আর কোনো পার্থক্যই রইল না। তাদের স্বতন্ত্র পরিচয়, যা দিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেছিল, তা এক পর্যায়ে পুরোপুরি মুছে গেল।

আরেকটি উদাহরণ দিই। ধরুন, বাজারে একটি খুব মিষ্টি কোমল পানীয়ের ব্র্যান্ড রাজত্ব করছে। একটি নতুন ব্র্যান্ড এলো, যারা কিছুটা কম মিষ্টি স্বাদের পানীয় তৈরি করল। সমাজের একটি অংশ, যারা বরাবরই কম মিষ্টি পছন্দ করেন কিন্তু এতদিন কোনো বিকল্প পাননি, তারা সানন্দে নতুন ব্র্যান্ডটি গ্রহণ করল। বড় কোম্পানিটির জন্য এটি ছিল এক সতর্কবার্তা। তারা তাদের বাজার ধরে রাখতে নিজেদের পানীয়ের মিষ্টতা কমিয়ে আনল।

অন্যদিকে, ছোট কোম্পানিটি আরও বেশি গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর লোভে তাদের পানীয়ের মিষ্টতা বাড়িয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াল? দুটি ব্র্যান্ডেরই স্বাদ প্রায় একই রকম হয়ে গেল। যে গ্রাহকগোষ্ঠী ভিন্নতার জন্য নতুনকে বেছে নিয়েছিল, তারা আবার সেই গড়পড়তা স্বাদের বৃত্তেই বন্দী হয়ে গেল।

এই একই খেলা, আরও ভয়ানক এবং বিধ্বংসী রূপে, আমরা দেখি আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে। একটি বড় দেশের সেনাবাহিনীতে হয়তো ৩০ লক্ষ সৈন্য আছে। তার প্রতিবেশী ছোট দেশটির সৈন্য সংখ্যা ১৫ লক্ষ। ছোট দেশটি সারাক্ষণ এক অজানা ভয়ে কাঁপে—যদি আক্রমণ হয়! সেই ভয় থেকে তারা নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়িয়ে ৩০ লক্ষে উন্নীত করে। এই ঘটনা দেখে এবার বড় দেশটি আতঙ্কিত হয়। তারা ভাবে, ছোট দেশটির উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ভালো নয়। তারাও নিজেদের সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে ৫০ লক্ষ করে।

এই অন্ধ অনুকরণ আর শক্তির প্রতিযোগিতা চলতেই থাকে। পরিণতিতে তৈরি হয় এক ভয়ের ভারসাম্য, যেখানে দুটি দেশই একে অপরের কার্বন কপিতে পরিণত হয়, কিন্তু শান্তি বা নিরাপত্তা কোনোটাই প্রতিষ্ঠিত হয় না।

তবে আমার মতে, এই গড়পড়তা হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী এবং প্রাসঙ্গিক উদাহরণটি আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব—মানুষ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) মধ্যে ফুটে উঠছে।

একবার ভেবে দেখুন, বছরের পর বছর ধরে আমাদের কী শেখানো হয়েছে? আমাদের শেখানো হয়েছে ‘পেশাদার’ হতে। ভিডিও বানাতে গেলে, উপস্থাপনা করতে গেলে আমাদের হতে হবে নিখুঁত ও যান্ত্রিক। তাতে কোনো ভুল উচ্চারণ থাকা চলবে না, ইতস্তত করা চলবে না, কাশির শব্দও যেন না থাকে। আমরা আমাদের মানবীয় ত্রুটি গুলোকে লজ্জার বিষয় বলে মনে করতাম। আমরা যন্ত্রের মতো নিখুঁত হওয়ার জন্য নিজেদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি।

আর আজ দেখুন কী আশ্চর্য এক বৈপরীত্য! মেশিন বা AI এখন মানুষের মতো হওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা যখন ভিডিও বানাই, তখন ভুল লুকানোর চেষ্টা করি। আর AI যখন ভিডিও তৈরি করে, তখন সে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু ভুল যোগ করে, কিছু অসম্পূর্ণতা রেখে দেয়, যাতে তাকে বেশি ‘মানবীয়’ এবং বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। মানুষ যন্ত্র হতে চাইছে, আর যন্ত্র মানুষ!

আমার ভয়টা ঠিক এখানেই। এই প্রক্রিয়ায় অনিবার্যভাবে এমন একটি দিন আসবে, যখন মানুষের তৈরি সৃজনশীল কাজ আর মেশিনের তৈরি কাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। আর এর জন্য শুধু মেশিনের প্রযুক্তিগত উন্নতি দায়ী থাকবে না। দায়ী থাকবে আমাদের নিজেদের অনন্যতাকে বিসর্জন দেওয়ার মানসিকতা। আমরা নিজেরাই নিজেদের মূল্য কমিয়ে মেশিনের মতো গড়পড়তা হয়ে উঠছি।

কেন আমরা এমন করি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি বারবার আমাদের বিবর্তন আর সামাজিক কাঠামোর দিকে ফিরে তাকাই। যে মানুষটি ঐতিহ্যের প্রতি সবচেয়ে বেশি অনুগত, তাকে খেয়াল করলে দেখবেন, তার মধ্যে কল্পনাশক্তি প্রায় নেই। তাকে হয়তো জীবনের কোনো এক পর্যায়ে একটি রেডিমেড ‘বাক্স’ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই বাক্সে লেখা আছে—তার পরিচয় কী, তার ধর্ম কী, কাকে ভালোবাসতে হবে, কাকে ঘৃণা করতে হবে, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। সে সেই বাক্সটিকে এতটাই আঁকড়ে ধরে থাকে যে তার বাইরে আর কিছুই ভাবতে পারে না, কল্পনাও করতে পারে না। সে নিজেই ওই বাক্স হয়ে যায়।

এর শেকড় আমাদের আদিম প্রবৃত্তির মধ্যে। লক্ষ লক্ষ বছর আগে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য গোষ্ঠীবদ্ধ থাকাটা ছিল অপরিহার্য। জঙ্গলে হিংস্র পশুর সামনে একজন মানুষ ছিল একা এবং দুর্বল। তার আসল শক্তি ছিল তার সঙ্গীরা। তাই দলের সঙ্গে একমত হওয়াটা ছিল নিরাপত্তার সমার্থক। নিজের কোনো ভিন্ন চিন্তা বা দর্শন প্রকাশ করলে যদি দল থেকে বিতাড়িত হতে হয়, সেই ভয়টা ছিল মৃত্যুর চেয়েও বড়।

এই একই চাপ আজও আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। পাশের বাড়ির মানুষটি একটি নতুন মডেলের গাড়ি কিনলে আমার মধ্যেও সেই গাড়িটি কেনার জন্য এক অদৃশ্য চাপ তৈরি হয়। বন্ধুরা সবাই ইউরোপ ভ্রমণে গেলে, আমাকেও সেখানে যেতে হবে—এই ভাবনাটা মাথায় ঘুরপাক খায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই যা করছে, যা পরছে, যা খাচ্ছে, আমাকেও সেই স্রোতে গা ভাসাতে হয়। আমরা সবাই যেন এক অদৃশ্য সামাজিক দৌড়ে অংশ নিয়েছি, যার মূল লক্ষ্য হলো অন্যের মতো হওয়া, বা তার চেয়ে একটু ভালো ‘নকল’’ হওয়া।

তাহলে আমাদের করণীয় কী? এই সর্বগ্রাসী গড়পড়তার স্রোতের বিরুদ্ধে কি রুখে দাঁড়ানো সম্ভব? আমি বিশ্বাস করি, সম্ভব। যদিও এই পথটা কঠিন। আপনি যখন স্রোতের বিপরীতে চলবেন, তখন সমাজ আপনাকে হয়তো একঘরে করে দেবে, বোকা ভাববে বা অহংকারী বলে দাগিয়ে দেবে। কিন্তু আপনি যদি সাহসের সঙ্গে এই চাপকে প্রতিরোধ করতে পারেন, যদি নিজের স্বতন্ত্র সত্তা, নিজের পছন্দ-অপছন্দ, নিজের অসম্পূর্ণতাকে গ্রহণ করতে পারেন, তাহলেই ঘটবে আসল বিপ্লব।

আপনি যখন নিজেকে অন্যের কার্বন কপি হতে দেবেন না, তখন দেখবেন আপনার চারপাশে এমন কিছু মানুষ জড়ো হচ্ছে, যারা আপনার এই অনন্যতাকেই সম্মান করে। আমি মনে করি, আমাদের মানব সভ্যতার টিকে থাকার চাবিকাঠি এখানেই নিহিত। কিছু মানুষ যদি এই সাহসটা দেখাতে পারে, যদি আমরা সবাই মিলে এই গড়পড়তা হওয়ার দৌড় থেকে বেরিয়ে আসতে পারি, তবেই হয়তো আমাদের সভ্যতা কেবল আগামী শতক নয়, আগামী সহস্রাব্দ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে।

এই লড়াইটা বাইরের কারও সঙ্গে নয়, এই লড়াইটা আমাদের নিজেদের সঙ্গে, নিজেদের স্বকীয়তাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।

ছবি: KIMI K2

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.