নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

মি. বিকেল

আমি মোঃ মেহেদি হাসান, কলম নাম মি. বিকেল।

মি. বিকেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

Wuthering Heights: কেন ২০২৫ সালের বাংলাদেশে বসে এই উপন্যাসটি পড়বেন?

০৭ ই নভেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৮



কল্পনা করুন এক ধূসর, বুনো প্রান্তরের, যেখানে বছরের পর বছর ধরে একরোখা বাতাস বইছে আর আকাশটা সবসময় গোমড়া মুখে থাকে। এখানেই দাঁড়িয়ে আছে একটি বাড়ি, যার নাম ‘Wuthering Heights’। আপনি যদি এই বাড়ির গল্পকে নিছক এক প্রেমের কাহিনি ভেবে পড়া শুরু করেন, তবে বিশাল বড় এক ধাক্কা খাবেন। পড়া শেষে মনে হবে, কেউ আপনার আবেগের জগতে সজোরে এক ঘুষি মেরেছে।

এটি কোনো মিষ্টি প্রেমের আখ্যান নয়; বরং ভালোবাসার নামে বেঁচে থাকার এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ, যেখানে জেতার পরেও সব পক্ষই চূড়ান্তভাবে হেরে যায়। প্রশ্ন হলো, আজ থেকে প্রায় ১৮০ বছর আগে লেখা এমিলি ব্রন্টের এই কালজয়ী উপন্যাস কেন একুশ শতকের বাংলাদেশে বসেও আপনার পড়া উচিত?

ব্রন্টে এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন, প্রেম যখন শুধুমাত্র আবেগ বা Obsession-এ পরিণত হয়, তখন তা কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে। উপন্যাসের নায়িকা Catherine Earnshaw যখন তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে বলে,

“I am Heathcliff—he's always, always in my mind; not as a pleasure, any more than I am always a pleasure to myself.”

অর্থাৎ, “আমিই হিথক্লিফ—সে সবসময় আমার মনে থাকে;... আমি যেমন নিজের কাছে সবসময় আনন্দের কারণ নই, সেও তাই,”— তখন এটি ভালোবাসার সর্বোচ্চ প্রকাশ নয়, বরং নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলার এক গভীর সংকট। ক্যাথি যেন নিজের সত্তা থেকে বেরিয়ে হিথক্লিফের সত্তার সঙ্গে মিশে যেতে চায়। এই বিপজ্জনক সহনির্ভরতা (Co-dependency) তাদের দুজনকে তো বটেই, তাদের চারপাশের সবাইকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়।

সাহিত্যে নায়ক থাকে, খলনায়ক থাকে, আর থাকে Heathcliff-এর মতো ‘অ্যান্টি-হিরো’। অ্যান্টি-হিরোরা এমন চরিত্র যাদের উদ্দেশ্য হয়তো মহৎ নয়, কিন্তু তাদের যন্ত্রণার সঙ্গে পাঠক একাত্বতা বোধ করে। হিথক্লিফ ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং ভয়ঙ্কর অ্যান্টি-হিরো। আপনি তাকে তার নিষ্ঠুরতার জন্য প্রচণ্ড ঘৃণা করবেন, কিন্তু তার শৈশবের বঞ্চনার কথা ভেবে তার জন্য আপনার কষ্টও হবে।

তাকে শৈশবে ‘dark-skinned gipsy’ বা এক কালো ভবঘুরে বলে অপমান করা হতো। এই বর্ণবাদ ও শ্রেণিবিদ্বেষের শিকার হতে হতে তার ভেতরের শিশুটি মরে গিয়ে এক প্রতিশোধপরায়ণ দানবের জন্ম হয়। তার প্রতিশোধের কৌশলও ছিল অভিনব,

“The tyrant grinds down his slaves and they don't turn against him; they crush those beneath them.”

অর্থাৎ, “স্বৈরশাসক তার দাসদের পিষে ফেলে, কিন্তু দাসেরা তার বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়িয়ে বরং তাদের চেয়ে দুর্বলদের পিষে ফেলে।” হিথক্লিফ সরাসরি কাউকে খুন না করে এমন এক মানসিক অত্যাচারের পরিকাঠামো তৈরি করে, যেখানে তার শত্রুরা এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়। তার এই পদ্ধতি আজকের যুগের ‘psychological manipulation’ বা গ্যাসলাইটিং -এর এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

উপন্যাসের দুটি বাড়ি— Wuthering Heights এবং Thrushcross Grange—কেবল দুটি দালান নয়, দুটি ভিন্ন পৃথিবীর প্রতীক। Wuthering Heights হলো বন্য, আবেগপ্রবণ এবং প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক, যেখানে নিয়ম ভাঙে। অন্যদিকে, Thrushcross Grange হলো সভ্য, মার্জিত এবং সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতীক।

এই দুটি বাড়ির দ্বন্দ্ব আসলে আমাদের ভেতরের দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি। আমরা যতই সভ্য বা ‘ভদ্র’ হওয়ার চেষ্টা করি না কেন, আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এক বন্য, আদিম সত্তা ঘুমিয়ে থাকে। ব্রন্টে দেখিয়েছেন, এই দুই সত্তার মধ্যে লড়াই অনিবার্য এবং প্রায়শই আমাদের বন্য প্রকৃতিই জয়ী হয়।

‘Wuthering Heights’-এর গল্প আমরা শুনি দুজন ‘Unreliable Narrator’ বা অবিশ্বস্ত বর্ণনাকারীর মুখ থেকে— পরিচারিকা Nelly Dean এবং ভাড়াটে Mr. Lockwood। তাদের বর্ণনায় মিশে আছে ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব, শোনা কথা আর গুজব। ফলে পাঠক হিসেবে আপনাকেই গোয়েন্দার মতো সত্যটা খুঁজে বের করতে হবে। ধরুন, আপনি কোনো ঝগড়ার গল্প দুজনের কাছ থেকে শুনছেন এবং বুঝতে পারছেন যে দুজনেই নিজের মতো করে গল্পটা সাজিয়ে বলছে। ব্রন্টের এই কৌশল পাঠককে নিষ্ক্রিয় শ্রোতা না রেখে গল্পের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী করে তোলে, যা সেই যুগের জন্য ছিল এক বৈপ্লবিক ধারণা।

বইটিতে ভূতের গল্প আছে, অশরীরী আত্মার আনাগোনা আছে। মাঝরাতে জানালার বাইরে থেকে ভেসে আসে কান্নার আওয়াজ। যেমনটা আমরা দেখি উপন্যাসের ভাড়াটে Mr. Lockwood-এর দুঃস্বপ্নে, যখন এক ভূতের হাত তার হাত চেপে ধরে বলে,

“Let me in—let me in!”

কিন্তু এই ভয়ের অনুভূতি শুধু অলৌকিক নয়, ভীষণ মানসিক। চরিত্রদের মনের ভেতরের ঝড়, যন্ত্রণা আর হাহাকারই যেন বাইরের প্রকৃতিতে এবং ভূতের অবয়বে প্রতিফলিত হয়। ভয়টা এখানে আপনার শোবার ঘরে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার মতোই বাস্তব মনে হয়।

আজকের দিনে আমরা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক বেশি সচেতন। অবাক করার মতো বিষয় হলো, এই উপন্যাসটি যেন একুশ শতকের মনোবিজ্ঞানের এক কেস স্টাডি।

১. ট্রমা ও PTSD: হিথক্লিফের শৈশবের বঞ্চনা এবং অপমান তার মধ্যে যে গভীর ক্ষত তৈরি করে, তা Post-Traumatic Stress Disorder (PTSD)-এর লক্ষণের সঙ্গে মিলে যায়, যা পরবর্তীতে তার চরম প্রতিশোধস্পৃহার জন্ম দেয়।
২. ডিপ্রেশন: সামাজিক মর্যাদা ও ভালোবাসার দ্বন্দ্বে ক্যাথরিনের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেওয়া, নিজেকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা—এগুলো আজকের মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ‘Major Depressive Episode’-এর উপসর্গ। ক্যাথরিনকে হারানোর পর হিথক্লিফের সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে করুন,

“The entire world is a dreadful collection of memoranda that she did exist, and that I have lost her.”

অর্থাৎ, “পুরো পৃথিবীটাই যেন এক ভয়ঙ্কর স্মারকলিপি—যে সে একসময় ছিল এবং আমি তাকে হারিয়েছি।” এই কথাটি আজকের ডিজিটাল যুগের জন্য ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। আমরা যেমন প্রিয়জনকে হারানোর পর তার সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল বা পুরনো ছবি ঘেঁটে নিজেদের কষ্টকে আরও বাড়িয়ে তুলি, হিথক্লিফের এই শোকও অনেকটা তেমনই। ভালোবাসা এখানে যেন ‘অনুপস্থিতির এক আর্কাইভ’ বা ‘Archive of Absence’ ব্রাউজ করার মতো।

‘Wuthering Heights’ কোনো আরামদায়ক বা ‘comfort read’ নয়। এটি একটি ‘confront read’—যা আপনাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। এই বই পড়ার পর নিজের ভেতরের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে আপনি ভাবতে বাধ্য হবেন। ঘৃণা, জেদ আর প্রতিশোধের এই বীজ কি আমার ভেতরেও নেই?

উপন্যাসের একেবারে শেষ লাইনে বলা হয় যে, সমাধিক্ষেত্রের ওপর দিয়ে শান্ত বাতাস বয়ে যায় আর লেখক অবাক হয়ে ভাবেন,

“...how any one could ever imagine unquiet slumbers for the sleepers in that quiet earth.”

অর্থাৎ, এই শান্ত পৃথিবীর ঘুমন্ত বাসিন্দাদের জন্য কীভাবে কেউ অশান্ত ঘুমের কথা কল্পনা করতে পারে? কিন্তু ব্রন্টে এখানেই একটি প্রশ্ন রেখে যান। কবর শান্ত হলেও সেই ঘৃণা, প্রেম আর প্রতিশোধের গল্পগুলো ভূত হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাঠকদের তাড়া করে ফেরে।

এই অস্বস্তিকর এবং গভীর প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হওয়াই ‘Wuthering Heights’ পড়ার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। পড়ুন, অস্বস্তিতে পড়ুন, এবং ভাবুন। কারণ প্রতিটি যুগ তার নিজের হিথক্লিফকে খুঁজে নেয়।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:১৬

রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার উপন্যাস।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.