![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নতুন কেউ পৃথিবীতে আসবে, পুরোনো কেউ পৃথিবী ছেড়ে যাবে, আর কেউ যাবার প্রতিক্ষায় রবে। জীবন তো এমনই…
সারাদিন পরে হাসুর দোকানে এসে আউয়াল বললো, ‘হাসু ভাই, চা দাও।’
চায়ের অর্ডার দিয়ে আউয়াল তার দেড় খানা পা বেঞ্চে তুলে বসলো।
সকালে ভিক্ষা করতে বের হয়ে আউয়াল সর্বপ্রথমে হাসুর দোকানে এক কাপ লাল চা খায়, তারপর মানুষের কাছে হাত পাততে নিজেকে নিয়োজিত করে। সারাদিন ভিক্ষা করে সন্ধ্যায় বাসায় ঢোকার আগে হাসুর হাতের আরো এক কাপ চা খায় আউয়াল। চা খেতে খেতে একটু গল্প-সল্পও করে।
‘কোনটা দিবো?’ আউয়াল কোনটা খায় জানার পরও নিশ্চিত হতে চাইলো হাসু।
‘লাল-ই দিবা, আবার কোনটা দিবা!’
একসময় আউয়াল দুধ চা ছাড়া কখনো লাল চা মুখে নিতো না। বহুদিন থেকে দুধ চা সে ছেড়ে দিয়েছে, লাল চায়ে তৃপ্তি খোঁজে।
হাসু আউয়ালের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘আউয়ালের মুখটা শুকনা লাগতেছে ক্যান?’
চা হাতে নিয়ে তাতে একটা চুমুক দিয়ে আউয়াল বললো, ‘ভিক্ষা দেওনের ব্যাপারে পাবলিকের ইন্টারিস্ট কইম্মা গ্যাছে। সকাল থাইকা সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুইরা পঞ্চাশ টাকাও জোটে না। মুখ শুকনা থাকবো না তো কি টকটইক্কা থাকবো!’
শহরে ভিক্ষুকের সংখ্যা যে পরিমানে বেড়েছে তাতে পাবলিকের ভিক্ষা দেয়ায় প্রচণ্ড অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। একজনকে ভিক্ষা দিয়ে মানিব্যাগ পকেটে ঢুকাতে পারা যায় না তার আগেই আশেপাশ থেকে আরো দুই-চারটা হাত সামনে চলে আসে। সব ভিক্ষুককে দুই টাকা করে দিতে গেলে (চার আনা, আট আনা এমনকি এক টাকাও এখন অনেক ভিক্ষুক নিতে চায় না! চার আনা, আট আনা দিতে গেলে ফিরিয়ে দিয়ে তারা বলে, ‘আমারে আপনের ভিক্ষা দিতে হইবো না, আপনেই বরং আমার কাছ থেকে নেন!’) নিজেকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভিক্ষুকের কাতারে আবিষ্কার করতে হবে! ভিক্ষুকদের ইনকাম তাই ক্রমশই কমে আসছে।
ভিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে পাবলিকের অনাগ্রহের বড় একটা কারণ হচ্ছে-দুই টাকা ভিক্ষা দেয়ার পর ভিক্ষুকের মুখ থেকে বর্ষিত শুভ কামনা এখন আর ফলে না। বরং উল্টোটা হয়। হয়তো কোনো পাবলিকের ভিক্ষায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ভিক্ষুক বললো, বউ-বাচ্চা নিয়ে যেনো সে শান্তিতে থাকে কিংবা বললো, আর্থিকভাবে যেনো ভালো থাকে, দেখা গেলো বাসায় ঢোকা মাত্রই বউয়ের সাথে ঝগড়া বেঁধে গেলো নয়তো বাজারে হেঁটে চলার কোনো এক মুহূর্তে তার পকেট মারিং হয়ে গেলো! এ কারণে ভিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে অধিকাংশ পাবলিকই উদাসীন।
যাদের অন্য কাজ করার সামর্থ্য-সুযোগ দুটোই আছে তারাও কোনো কাজ জোটানোর ঝামেলায় না গিয়ে চোখ বন্ধ করে ভিক্ষা করতে নেমে পড়ে! আবার নির্দিষ্ট সিজনে ভিক্ষাটাকে উপার্জনের উত্তম উপায় হিসেবে বেছে নেয় অনেকে। যেমন রোজা ও কুরবানির সিজন। ভিক্ষা তাদের কাছে খুবই প্রিয় একটা ব্যাবসা। কারণ, ভিক্ষা করতে পুঁজি বলতে কিছু লাগে না। লাগে শুধু ফুটো একটা থালা, কাঁধে একটা ঝোলা, ছেঁড়া-ফাটা ময়লা কাপড় আর জট পাকানো চুল-দাঁড়ি! এই জিনিসগুলো জোগাড় করা সম্ভবত পৃথিবীর সহজ কাজগুলোর একটি! একারণে অন্য কাজ করার সামর্থ্য-সুযোগ থাকলেও ভিক্ষাটাকেই বেছে নেয়া হয়। আর এইসব ব্যাবসায়ী-সিজনাল ভিক্ষুকদের উৎপাতে পাবলিক বিরক্ত হয়ে যাওয়ায় বড় বিপন্ন হয়ে পড়েছে আউয়ালের মতো ভিক্ষুকেরা যাদের অন্য কোনো কাজ করার সামর্থ্য-সুযোগ কোনোটিই নেই।
প্রতিদিনই পাঁচ-সাত টাকা করে ইনকাম কমে আসছে আউয়ালের। এভাবে চলতে থাকলে ইনকাম বলতে কিছুই থাকবে না এক সময়। তখন কেমন করে তার চলবে সেটা ভাবতে গেলেই জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে যায় আউয়ালের। একসময় কি তেজ, কি শক্তিটাই না ছিলো তার শরীরে। অথচ এখন তাকে দেড় খানা পা নিয়ে মানুষের কাছে হাত পেতে বেড়াতে হয়। না দিতে চাইলে কেউ কেউ ভদ্রভাবেই মাফ করতে বলে। আবার কেউ কেউ মেজাজ দেখায়, গালি দেয়। এসব সহ্য করে দিন কাটাতে কাটাতে সে চরম বিরক্ত। মাঝে মাঝে তাই চলন্ত ট্রেনের চাকার নিচে নিজের ঘাড়টাকে সঁপে দিতে মন চায় আউয়ালের!
চায়ে আউয়াল আরেকটা চুমুক দিলো তখন হাসু বললো, ‘দুপুরে আইজ কি খাইছো?’
‘দু মুঠা মুড়ি খাইছি। দু দিন পর এইডাও আর জুটবো বইলা মনে হয় না!’
হাসু আউয়ালের দিকে এক টাকা দামের একটা পাউরুটি এগিয়ে দিলো, ‘নেও ধরো, পাউরুটিডা খাও।’
হাসুর নিঃশর্ত দান একসময় গ্রহণ করতে আউয়ালের খুব সংকোচ হতো। মানুষের কাছে হাত পেতে পেতে তার সংকোচ অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হাত পেতে সে নিঃসংকোচে হাসুর দান গ্রহণ করলো। তারপর চায়ে ভিজিয়ে খেতে লাগলো।
‘হাসু ভাই, আর কতকাল আমারে এইভাবে ফিরি ফিরি খাওয়াইবা!’ আউয়ালের সংকোচবোধ বিলুপ্ত হলেও কৃতজ্ঞতাবোধ যথাযথভাবেই টিকে আছে এখনো।
‘যতকাল তুমি বাঁচবা, যতকাল আমি বাঁচবো!’
হাসু আউয়ালের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘তোমারে দেইখা মাঝে মধ্যে খুব দুঃখ হয় গো আউয়াল! ’৭১-এ তুমি কি ছিলা আর আইজ কি আছো! ভাবতে খুব খারাপ লাগে যে তোমার মতো লোক ভিক্ষা করে!’
আউয়ালের এসব কথা শুনতে মোটেও ভালো লাগে না, গা জ্বালা করে ওঠে তার। সবচেয়ে গা জ্বালা করে ’৭১ এর কথা শুনলে। এসব শুনলে সে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়।
সে বিরক্তি ঢেকে রাখার চেষ্টা কখনো করে না। বিরক্তির ঝাঁঝালো স্বরে আউয়াল বললো, ‘তোমারে এইসব কে ভাবতে কইছে? যাগো ভাবার দরকার তারাই ভাবে না তুমি ভাইবা কি করবা?’
চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে আউয়াল ঝাঁঝালো স্বরেই বললো, ‘এই দোকানে বইসা ভাইবা তুমি কিছু করতে পারবা! ঐ সংসদের মিনিস্টারগুলার যেইটা ভাবার কথা সেইটা এই দোকানে বইসা ভাবতে তোমারে কে কইছে হাসু ভাই! ভাইবো না গো ভাইবো না, ভাইবা কোনো কূল পাইবা না, খালি খালি কষ্ট পাইবা।’
হাসুকে কাপ ফেরত দিয়ে আউয়াল উঠে দাঁড়ালো। দুই কাপ চায়ের বিল দিয়ে সে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। সকালে সে চায়ের বিল দেয় না, সন্ধ্যায় ভিক্ষার ইনকাম থেকে দুই কাপ চায়ের বিল একসাথেই দেয়। হাসু অবশ্য মাঝে মধ্যে চায়ের বিল মওকুফ করে দেয়।
আউয়ালের ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কাটা। কয়েক বছর আগে একবার স্ট্রোক করেছিলো। তাতে তার বাম পাশ অনেকদিন অবশ হয়ে ছিলো। ধীরে ধীরে সেটা সেরে গেলেও বাম পাশে তার জোর খুব কম। বাম পাশে সে ক্র্যাচ ধরতে পারে না। ডান পাশে একটা ক্র্যাচ ধরে সে হাঁটে। এমনিতে এক পায়ের অর্ধেক নাই তার উপর বাম পাশে ক্র্যাচ ধরার মতো জোর নাই, এমনাবস্থায় একটা মানুষের সকাল থেকে সন্ধ্যা হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করতে কি পরিমান কষ্ট হতে পারে তা বোঝার সাধ্য কি কারো হবে! সুতরাং, আউয়ালের যে মাঝে মাঝে চলন্ত ট্রেনের চাকার নিচে নিজের ঘাড়টা সঁপে দিতে মন চায় সে আর বিচিত্র কি!
আউয়াল বাড়ি ফিরে দেখে ময়না নামের যে মেয়েটা তাকে রাতে রান্না করে দেয়, ঘর গুছিয়ে রাখে, কাপড় ধুয়ে দেয়, অসুখ হলে সেবা করে, মোট কথা, আউয়ালের সবকিছু দেখাশুনা করে সে রান্নার কাজ শুরু করে দিয়েছে।
বস্তিতে ছোট্ট একটা ঘরে থাকে আউয়াল। বউ-ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। বিশাল এই জগতে সে একা, ছোট্ট একটা ঘরই তাই তার সংসারের জন্য যথেষ্ট। অবশ্য, ময়নাকে সে মেয়ে-ই মনে করে। সেই অর্থে আউয়াল একেবারে একা, নিঃসঙ্গ নয়। পরের মেয়ের উপর নিজের মেয়ের মতো অধিকার দাবি করা মানায় না, আউয়ালের জীবনের বড় অংশ তাই নিঃসঙ্গই!
দুপুরে আউয়াল বাইরে যা খুশি তাই খেয়ে নেয়, সকালে খায় পান্তা কিংবা চিড়া-মুড়ি, রান্নার তাই প্রয়োজন হয় শুধু রাতেই। রোজ সন্ধ্যার পর পরই ময়না চলে আসে রান্না করতে। আউয়ালকে খাইয়ে, শুইয়ে দিয়ে সে যায়। বেশির ভাগ দিন আউয়ালের সাথেই খেয়ে নেয় কয়েক ঘর পরেই বাস করা রিক্সাওয়ালার মেয়ে ময়না।
আউয়ালের আগমন টের পেয়ে ময়না বললো, ‘আইলেন কাকা!’
‘হ। আইজ তুই আগে চইলা আইছস না আমিই দেরি করছি?’
‘আপনেই দেরি করছেন কাকা!’
‘ও।’
আউয়াল তার ঝোলাটা ময়নার হাতে দিলো, ময়না সেটা ঘরে রেখে এসে চুলোর পাড়ে বসলো। আউয়াল তার সারাদিনের ইনকাম হিসেব করতে বসলো চুলোর পাড়ে ময়নার পাশে।
‘আইজ কি খাওয়াইবি রে মা?’
‘কি খাওয়ামু সেইটা নিয়া চিন্তায় পইড়া গেছিলাম! ডাইল আর চাইল ছাড়া তো কিচ্ছু রাইখা যান নাই! আমি কচু পাতা তুইলা আনছি, আর মায়ের কাছ থাইকা দুইটা আলু আইন্না ভাতের ভিতরে দিয়া দিছি।’
‘আইচ্ছা, তুই যে এইভাবে আইসা আমারে রান্না কইরা দিস, মাঝে-মইধ্যে আবার ঘর থেইকা আলু-পিঁয়াজ নিয়া আসিস তোর বাপ-মা তোরে বকে না!’
‘বকবো ক্যান কাকা!’
‘বকতে পারে না! তোর বাপে রিক্সাচালায়া আর কতই ইনকাম করে! আমার যেরম অবস্থা হেরও তো তেরমই অবস্থা!’
‘না কাকা, বকে না।’
‘ঘরের কাম ফালায়া আসিস, মায়েও বকে না!’
‘না কাকা, মায়েও বকে না। সইন্দ্যা হইলে মা-ই তো আমারে কয়, “কখন যাবি, তোর কাকা তো চইলা আইসে বুঝিন”।’
‘না বকলেই ভালো। বাপ-মায়ের বকা খায়া আমরে দেখ-ভাল করতে আইতে হইবো না।’
‘আপনেরে ঐসব ভাবতে হইবো না কাকা। আপনে আমারে খেদায়া দিয়েন না তাইলেই হইবো।’
‘আমি কি আর অতই বোকা! ঘরের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলমু!’
ময়না চুলোয় জাল ঠেলে বললো, ‘কাকা, একখান কথা জিগাইতাম!’
আউয়াল খুচরা কয়েনগুলো গুনতে গুনতে অন্যমনস্কভাবে বললো, ‘জিগা।’
‘আগেও অনেকবার জিগাইছি, আপনে তো চেইতে যান, আইজ কিন্তু চেইতেন না কইলাম!’
ময়না কি জিজ্ঞাসা করবে সেটা বুঝতে পেরে আউয়াল চোখ গরম করে ময়নার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোরে মানা করছি না, এই ব্যাপার নিয়া কোনোদিন কোনো কথা কইবি না! তোরে কিছু জিগাইতে হইবো না।’
‘কাকা, কাইল ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবস। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করতিছে কাকা, কেমন কইরা আপনে যুদ্ধ করছেন, কোথায় কোথায় যুদ্ধ করছেন, কয়টা মেলেটারি মারছেন, কেমনে ল্যাংড়া হইছেন, কাকি-পোলা-মাইয়া কেমনে মরছে, কেমনে-’
‘চুপ কর!’ প্রচণ্ড শব্দ করে আউয়াল ধমকে উঠলো, ‘তুই এখনি চইলা যা, আর আইবি না আমার কাছে। আমারে রান্না কইরা দিতে হইবো না, ঘর গুছায় দিতে হইবো না, তেল মালিশ কইরা দিতে হইবো না গতরে! এখনি চইলা যা, আমার চোখের সামনে আর কোনোদিন আইবি না।’
আউয়ালের একদমই সহ্য হয় না এইসব কথা। খুবই অসহ্য লাগে মুক্তিযুদ্ধ-’৭১-১৬ ডিসেম্বর এই শব্দগুলো শুনতে! নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টাকেও মাঝে মধ্যে খুব ঘৃণা করে আউয়াল! মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যেটুকু সুযোগ-সুবিধা-সম্মান পাবার আশা করেছিলো আউয়াল, তার এক বিন্দুর একশ ভাগের এক ভাগও পায় নি! বিষয়গুলোর উপর তাই প্রচণ্ড ক্ষোভ আউয়ালের। ক্ষোভ তার মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সব সরকারের উপর, সরকারের নেতাগুলোর উপর, দেশ নিয়ে যারা ভাবে, দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতির কথা বলে, তাদের সবার উপর। ক্ষোভ তার মুক্তিযুদ্ধের উপর, এই দেশের উপর। এই দেশ মুক্ত করার তাগিদে আগে-পিছে কিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো যুদ্ধে-এ কারণে নিজের উপরও প্রচণ্ড ক্ষোভ-ঘৃণা আউয়ালের!
শব্দগুলো শুনলেই তার মেজাজ গরম হয়ে যায়। শব্দগুলো তাই যার মুখ থেকে বের হয়, তার কাছে যে এই বিষয়গুলো জানতে চায় পুরো ক্ষোভ তার উপরই ঝেড়ে ফেলে আউয়াল। নিজের নিঃসঙ্গ জীবনে একটু ছন্দ এনে দেয়া ময়নার উপর ঝাড়তেও বাঁধে না!
ময়না জানে আউয়াল এই বিষয়ে কথা বলা এদমই সহ্য করে না। কিন্তু খুব জানতে ইচ্ছে করে ময়নার। আউয়ালের গরম চোখের ধমক উপেক্ষা করে ময়না বললো, ‘ক্যান কাকা! যুদ্ধের কথা জিগাইলেই আপনে চেইতে যান ক্যান! আপনে মুক্তিযোদ্ধা-’
‘চুপ!’ মাটি কাঁপানোর মতো স্বরে ধমকে উঠলো আউয়াল, ‘চুপ কর তুই হারামজাদি! আর একটা কথাও কইবি না! চইলা যা সামনে থাইকা! খুন কইরা ফেলাবো না হইলে!’
দুই হাঁটুর মাঝে মুখ ঢেকে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে লাগলো ময়না!
খেকিয়ে উঠে আউয়াল বললো, ‘তুই জানস না এইসব কথা একদমই সুহ্য হয় না আমার। খুবই অসুহ্য লাগে মুক্তিযুদ্ধ-’৭১-১৬ ডিসেম্বর শব্দগুলান! নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টারেও আমি ঘৃণা করি! জানস না!’
একবার দম নিয়ে আবার খেকিয়ে উঠে আউয়াল বললো, ‘কিয়ের মুক্তিযুদ্ধ, কিয়ের স্বাধীনতা! কি পাইসি আমি যুদ্ধ কইরা, কি লাভ হইসে আমার দ্যাশ স্বাধীন হইয়া! ’৭১-এ গোটা পরিবার, ঘরবাড়ি সব হারাইসি, যুদ্ধে হারাইসি আদ্ধেক ঠ্যাং, বিনিময়ে কি পাইসি! কি এমন চাওয়া আছিলো আমার! স্বাধীন দ্যাশে মাথা গুঁজার পাকাপোক্ত একটু জায়গা পাওয়া, পেট পুইরা না হোক, তিন বেলার খাওনের যোগাড় নিয়া চিন্তা না থাকা, এইটুকুই চাওয়া আছিল। কি পাইসি, কি পাইসি আমি! যারা যুদ্ধের সময় দ্যাশ ছাইড়া পালায়া গ্যাছে, দ্যাশের বিরুদ্ধে কাম করসে, যুদ্ধের পর থেইকা হেরাই তো ভালা আছে! আমি কি পাইসি!’
ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলো আউয়ালও। বস্তির এই ঘর থেকে মাঝে-মধ্যেই কান্নার আওয়াজ ভেসে বেড়ায় বস্তির বাতাসে। বাতাসে ভেসে ভেসে কান্নার সে আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে বস্তির ঘরে ঘরে। যারা কারণটা জানে তারা ঘরের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আর যারা জানে না তারা কৌতুহল নিয়ে সে কান্নার আওয়াজ শোনে, নিজেদের সংকটের জীবনে এ কান্নার অর্থ উদ্ধারের সময়-সুযোগ হয় না বস্তির সে কিষ্ট-কান্ত মানুষগুলোর।
প্রকাশিত : স্নান (একটি চিহ্ন পরিপূরক ছোটকাগজ), মার্চ ২০১০।
©somewhere in net ltd.