![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যদিও আমি কখনো দুঃস্বপ্নে বিভোর ছিলামনা এবং আজও না ।তবে একটা জাগ্রত স্বপ্ন দেখতাম ; একদিন ভালোবাসব ,ঐ আকাশের বিশালতার মতো নয় কেবল আমার মনের গভীরতা থেকে ।
আজ আর কোন কল্প-কাহিনি লিখতে বসিনি । আজ আমি তাঁকে নিয়েই লিখব যাকে আমি পৃথিবীর সবথেকে বেশী ভালবাসি । এখনো এ পৃথিবীতে আমার বাবা-মা বেঁচে আছেন সুস্থভাবে তবু কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেশ করে ‘তুমি কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসো ’? নির্দ্বিধায় বলবো আন্টি কে ।
আন্টি হল আমার মায়ের ছোট বোন আমার ছোট খালা , জন্মলগ্ন থেকেই যার কাছে ছিলাম এখনো আছি । আম্মু কেবল আমাদের জন্মই দিয়েছেন কিন্তু আমরা কিভাবে আজ এতো বড় হলাম তা হয়তো আম্মু নিজেও সঠিকভাবে বলতে পারবেননা । আমদেরকে তিলে তিলে কোলেপিঠে করে বড় করেছেন আমাদের দুই খালা ।
আমরা পাঁচ ভাইবোন আর মামাতো ভাইকে নিয়ে আন্টির সংসার। আম্মু-আব্বু গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন চাকরির সুবাদে ; কখনো সপ্তাহে আসতেন ; কখনোবা মাসে । এ নিয়ে আমাদের কোন চিন্তা ছিলোনা । ঐ সময়গুলোতে আমি কখনো এক মুহূর্তের জন্য আমার আন্টিকে ছাড়া থেকেছি কি না আমার মনে নেই । আন্টি এ ঘর থেকে ও ঘরে পা দিলেই আমরা পাঁচজন লেজ হয়ে থাকতাম । আন্টি বাহিরে যাবার নাম করলেই আমি আগেই রেডি হয়ে গেইটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম অথবা যদি কোনোভাবে জানতে পারি কোথায় যাবেন তবে আগেই ঐ জায়গাতে গিয়ে উপস্থিত হয়ে যেতাম । দুরের কোন জায়গা হলে চোখের জলের কোন অভাব ছিলোনা । মুহূর্তেই বন্যা বয়ে দিতাম অতএব আন্টির কোন ক্ষমতা ছিলোনা আমাকে রেখে যাবার ।
আমি আমার আন্টিকে হাসতে দেখেছি খুব কম । সবসময়ই গোমরা মুখে বসে থাকতেন ; কোনোদিন কোন আনন্দের উৎসবে যেতে দেখিনি ! বিয়ের প্রস্তাব আসলে অঝোরে শুধুই কাঁদতেন ,পারলে যে প্রস্তাব নিয়ে আসতো তাকে ধমক লাগাতেন । জানতাম না ; কেন এরকম করতেন । যতো ভালো জায়গা থেকেই প্রস্তাব আসুক আর যতো ভালো ছেলেই হোক না কেন তাঁর চোখে জল ছাড়া আমি কখনো দেখিনি । ছোট ছিলাম তাই কোন কৌতূহল ও ছিলোনা কেন এত কাঁদতেন আমার আন্টি । এটাই মনে করতাম বিয়ে হলে সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে তাইজন্য হয়তো কাঁদতেন । বিয়ের প্রস্তাব গুলো ফিরিয়ে দিলেও তাঁর বিরুদ্ধে কাউকে কোন অভিযোগ করতেও দেখিনি । আব্বু-আম্মু ,মামারা ,নানাভাই কেউ ই কিছু বলতনা ; ভাবতাম সবার ছোট এবং সবার অনেক আদরের তাই হয়তো কেউ কিছুই বলেনা । কিন্তু বয়স তো আর বসে নেই ,বাড়তেই আছে । সেই সময় আমরাই ছিলাম তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ ।
এমনি চলছে আন্টির সাথে আমাদের অনেক সুখের সংসার । অনেক সময় না বুঝে আন্টিকে অনেক কষ্ট দিতাম ,মান-অভিমান তো আছেই । মাঝে মাঝে আমরা আন্টি কে না বুঝে কষ্ট দিলে আন্টি বলতেন আজই আমি তোদেরকে ছেড়ে চলে যাবো । এ কথা উচ্চারন করতে দেরি হতো আন্টির কিন্তু কান্না শুরু করতে দেরি হতোনা আমাদের । পাঁচ ভাইবোনের একসাথে গলা ছেড়ে কান্না শুরু ; বলতাম তুমি আমাদের ছেড়ে যেওনা ; আমরা আর এরকম করবনা । আম্মু-আব্বু মাসের পর মাস না এলেও আমাদের কোন অভিযোগ ছিলোনা ; কখনো ইচ্ছে প্রকাশ ও করতাম না যে তাঁরা আসছেন না কেন ।
যাই হোক যাচ্ছে দিন আসছে রাত ! তখন ২০০২ সাল ; এমন একটা সুখের দিনে বাসায় একজন মেহমানের আগমন ; যাকে ঘরের সবাই চিনে আমি ছাড়া । সেদিন আম্মু ও উপস্থিত ছিলেন ঘরে ,আম্মু ও চিনেন । সবাই বেশ খুশগল্পে মেতে উঠেছে দেখে ভাবলাম একটু উঁকি মেরে দেখে আসি কে মানুষটা ; নাহ ! চেহারা দেখে আমি চিনলামনা । তবে আমার জীবনে এই প্রথম আমার আন্টিকে মন উজাড় করে হাসতে দেখেছি ,গল্প করতে দেখেছি ,আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে তাঁর মনে ঐ মুহূর্তে । খুব অবাক হলাম তখন । আপুদের জিজ্ঞেস করলাম কে উনি ; ওরা বলে তুমি চিনবেনা । বললাম তাহলে উনি আমাকে চিনে কিভাবে ? আপুরা বলল , উনি তোমাকে ছোট বেলা অনেক দেখেছে তো তাই চিনে । আমার মনে প্রশ্ন জাগে তবে আমি চিনিনা কেন ?
সেইদিনের পরে আন্টি কে হাসতে দেখেছি , সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলতে দেখেছি । যাই হোক আমি তো ছেড়ে দেবার পাত্রি নই । একটা আপুকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছি যে ,ইনি কে আমাকে বলতেই হবে । আমার হাত থেকে আপু আর রক্ষা পেলনা ; বলতে বাধ্য হল । শুনলাম আমার আন্টির করুন কাহিনী ।
আন্টি যখন ইন্টার এ পরতেন তখন এই মানুষটা নানু বাড়িতে লজিং থাকতেন যে কোন কারনে । ঐ সময় পরিচয় । পরিবারের সব মানুষের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে ; আমি খুব ছোট ছিলাম তাই আমার মনে নেই । নানাভাই ও খুব পছন্দ করতেন । কিন্তু তিনি তখন প্রতিষ্ঠিত ছিলেননা তাই নানাভাই সময় দিয়েছিলেন তাঁকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার । আন্টি এই মানুষ টাকে ভীষণ ভালবাসতেন । লজিং থেকে চলে যাবার পরও বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন । বাড়ির দূরত্ব খুব বেশী ছিলোনা তবু কোন সপ্তাহে না এলে চিঠি পাঠাতেন সবার কাছে । এলাকার সবাই ও তাকে খুব পছন্দ করতো । তখনো তিনি কোন কাজ করছেননা তবু নানাভাই হঠাৎ ই মত বদলালেন ; বিয়ের কথা পাকা করে ফেললেন ; সেই মুহূর্তে তাঁর দেশের বাইরে যাবার একটা প্রস্তাব এলো । চলে যাবার আগে নানভাইকে কথা দিয়ে গিয়েছেন যে ফিরে এসে তিনি আন্টিকে বিয়ে করবেন । শুরু হল আমার আন্টির অপেক্ষার দিনগুনা ! সপ্তাহে একটা করে চিঠি আসতো সবার উদ্দেশ্যে । চিঠিতে একজন একজন করে প্রত্যেকের নাম উল্লেখ থাকতো । চিঠি আসতো নানাভাইর নামে । পরে সপ্তাহে না এসে মাসে একটা আসতো । তবু চিঠি আসা মিস হতোনা তাঁর । ধীরে ধীরে চিঠি আসা কমে গেলো । দুই বছর নিয়মিত চিঠি এসেছিল অতঃপর বন্ধ হয়ে গেলো বহুল প্রতিক্ষিত চিঠি গুলি । তাঁর বাড়িতে খোঁজ নেয়া হল ; জানা গেলো তিনি তাঁর বাড়িতে ও চিঠি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন । অবশেষে তাঁর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছিলোনা । বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে কিন্তু তাঁর আর কোন খোঁজ মিলল না । এদিকে আন্টির প্রতিক্ষার শেষ নেই । আন্টির বিশ্বাস তাঁর মনের মানুষ তাঁর কাছে একদিন ফিরে আসবেই সেই বিশ্বাসে বিশ্বাসে ১০ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন কিন্তু তাঁর ফেরার নাম গন্ধ নেই । প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে বিয়ে করবেননা ; তাই বিয়েতে কোন ভাবে রাজি হননি।
অবশেষে তাঁর প্রতীক্ষার দিনের অবসান হল । দীর্ঘ ১০ বছর পর বিদেশে থেকে ফিরে এলেন তাঁর বহুল প্রতিক্ষিত মানুষ টি । আর আমাদের মধ্যে ও আনন্দের শেষ নেই ; আমাদের আন্টি আজ হাসছেন , নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করছেন যা এর আগে তিনি করেননি । নতুন ঐ মানুষটির আনাগুনা চলছে বাসায় । ঘরের ল্যান্ড ফোনে নিয়মিত কথা , আন্টিও বলতেন আমরা ও বলতাম । সবাই মিলে হৈ-হূল্লোড় আর আনন্দের শেষ ছিলোনা শুধুমাত্র আন্টির আনন্দে পরিবারের সবকটা মানুষের মনে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে !
২০০৩ সালের অগাস্ট মাস ! আন্টির কাবিন হয়ে গেলো তাঁর বহুল প্রতীক্ষিত মানুষটির সঙ্গে ! আঙ্কেল (খালু) এর বড় ভাই তখনো বিয়ে করেননি তাই আন্টিকে শ্বশুর বাড়িতে পার করা হয়নি অতএব আন্টি তখনো আমাদের সাথে ! আমাদের বাসায় আঙ্কেলের আনাগুনা দিন দিন বাড়তেই থাকলো ! আমাদের পরিবারের একজন সদস্য বেড়ে গেলো ।
অবশেষে এলো আমদের একটা করুন দিন ! ২০০৪ এর ফেব্রুয়ারী মাস ! আন্টিকে শ্বশুর বাড়িতে পার করার দিন ! এটা আমাদের জন্যে যতটা সুখের ছিল ঠিক ততোটা দুঃখের ও মুহূর্ত ছিল ! আন্টির দুঃখের দিনের অবসান হবে তাই অনেক আনন্দিত থাকলেও আন্টি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন এটা ছিল নিঃসন্দেহে একটা করুন কাহিনী আমাদের জন্যে ! সারাদিন সবাই খুব আনন্দের সাথে কাটালাম ,বিদায়ের সময় শুরু হল কান্না পর্ব যা একটা বিয়েতে কমন একটা দৃশ্য ! আমাদের বাসা থেকে আঙ্কেলের বাসার দূরত্ব মাত্র দুই কিলো হবে ! তাই সন্ধ্যা পরে আমরা সব কাজিনরা , আন্টির বান্ধবীর বাচ্চারা , বান্ধবীর বোনের ছেলেরা এবং তাদের বেশ কিছু বন্ধুরা মিলে প্রায় ৩০ জনের মতো চলে গেলাম আন্টির শ্বশুর বাড়িতে তাঁকে দেখতে ! ২/৩ ঘণ্টা বেশ জমজমাট আড্ডা শেষে আমরা ফিরে এলাম আমাদের ঘরে ! তখনো ততোটা খারাপ লাগেনি যে আন্টি আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ভেবে! নিয়মমতো পরদিন আন্টি আসলেন আঙ্কেল কে নিয়ে আমাদের বাসায় ! দুদিন থাকার পর চলে যাবার দিন এলো! ঐ মুহূর্তে সম্বিত ফিরে পেলাম ; সব আনন্দ মাটি হয়ে গেলো ! মনে হচ্ছিল পায়ের নিচ থেকে সব মাটি সরে যাচ্ছে , আমাদের মাথার উপর থেকে এতো বড় ছাতাটা কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ! না ; এ শোক আর ধরে রাখতে পারলাম না ! কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো একেকজনের ! মনের অজান্তেই বুক ফেটে কান্না আসলো ; আবেগ ধরে রাখতে পারছিলাম না কেউ ই ! শুধু আমরা ভাইবোন রা ই না ,আরও কিছু মানুষ ছিল যারা কিনা শুধু আন্টি কে কেন্দ্র আমাদের বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতো ; তারা কেউই কম কষ্ট পায়নি ! ঐ দিনের মতো বুক ফাটা কান্না এর আগে কখনো কাঁদিনি !
শুরু হল আমাদের অনেক কষ্টের জীবন আন্টিকে ছাড়া । একটা দিন ও আমাদের ভালো যাচ্ছেনা ! কে কাকে সান্ত্বনা দেবে ; সবাই এক তালে কেঁদেই যাচ্ছে ! আন্টিও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলো আমাদের ছাড়া । তাই আমরা সকাল বিকাল কেউ না কেউ একবার আন্টির বাসাতে ঢুঁ মারি ! যাইহোক ; এমনিভাবে চলছিল আমাদের নতুন জীবন ! এক-দুদিন পর পর আন্টি আসতেন আমাদের বাসায় ,সাথে আঙ্কেল থাকতেনই ! আঙ্কেল কে ছাড়া আন্টি কখনো আসলেও আঙ্কেল অফিস শেষে আমাদের এখানেই আসতেন । আন্টির সাথে ইচ্ছেমত খুশ গল্প করা ,আড্ডা মারার দিন শেষ । আন্টি আমাদের বাসায় আসলেও যেহেতু আঙ্কেল সাথে ই আসেন তাই আমাদের সাথে আর তাঁর বসে থাকা হয়না । আঙ্কেল কে ই সময় দিতে হয় । আন্টি যদি আমাদের সাথে পাঁচ মিনিট বসে আড্ডা দেন আঙ্কেল ততক্ষণে ১০ তা মিস কল দিবে সেলফোনে । অতএব আন্টি যেকোনো একটা মজার আড্ডা থেকে উঠে চলে যায় আঙ্কেলের পাশে ! যখনই আন্টি আসে আমাদের বাসায় এমনি ঘটে প্রত্যেকটাদিন । প্রতিটা মুহূর্তে এমন হওয়াতে আমরা ভাইবোনেরা কিছুটা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম আঙ্কেলের উপর কারন আমরা আর আমাদের আন্টিকে কাছে পাচ্ছিনা আমাদের মতো করে । মাঝে মাঝেই আন্টির সাথে রাগারাগি করতাম যে তুমি আঙ্কেল কে নিয়ে আসো কেন সবসময় ! যাইহোক ; তবু আমরা আমাদের আন্টির কাছাকাছি থাকতে চাইতাম । একসাথে দু’দিন আন্টিকে না দেখে থাকিনি । একদিন আন্টি আমাদের বাসায় না আসলে পরদিন আমি চলে যেতাম আন্টির বাসায় । তারপর আবার আন্টিকে নিয়ে আসতাম আমাদের বাসায় । সাথে আঙ্কেল তো আছেন ই । আঙ্কেল একটা মুহূর্তও আন্টিকে ছাড়া থাকতে চাননা আর আমরাও না ।
এরই মধ্যে আন্টির একটা বেবি নষ্ট হয়েছে ,একটা বেবি জন্মের তের দিনের দিন মারা গেছে ,তারও পরে আরও দু’দুটা বেবি নষ্ট হয়েছে । সুখের দিনের মধ্যে কিছু দুঃখ যোগ হল আবার আন্টির জীবনে ! চিকিৎসা চলছে নিয়মিত ! তবু বার বার ই এমন ঘটছে ! বিয়ের আটটি বছর কেটে গেলো ; আন্টি আর সন্তানের মুখ দেখেননি তখনো । তবু তাদের সুখের সংসারে কোনরূপ ঘুণে ধরেনি ; কোন অশান্তি নেই । আঙ্কেল তাঁর সাধ্য মতো চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন, কোন ধরনের ত্রুটি করছেননা এ বিষয়ে । যে যা পরামর্শ দিচ্ছে সে অনুযায়ী তাঁর কাছেই যাচ্ছেন । ২০১২ এর দিকে পরিকল্পনা করছিলেন মাদ্রাজ যাবেন চিকিৎসার জন্যে ।
তখনো যাওয়া হয়নি ! অক্টোবর মাস ! ২০১২ ! এমনি এক আনন্দঘন দিনে আঙ্কেল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল এ ভর্তি । মাথা ঘুরে পরে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন ! সিটিস্ক্যান রিপোর্ট বলল ব্রেইন টিউমার ! সার্জারি লাগবে , তৎক্ষণাৎ ঢাকা রেফার করা হল ; দুদিন পর সার্জারি হল । Histopathology রিপোর্ট বলল “Consistent with anaplastic ependymoma WHO grade III” !
থেমে গেলো আমার আন্টির সুখের সংসারের সব হাসি আনন্দ ! ক্যান্সার নামক মরনব্যাধি কেড়ে নিল আমার আন্টির বহুল প্রতীক্ষিত সুখ-শান্তি ! রেডিয়েশন দেয়ার পর শরীর টা আরও দুর্বল হতে থাকলো ! শুরু হল আন্টির আরেক সংগ্রামী জীবন ; সবকিছু ঠিক থাকলেও আঙ্কেল আর স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না । ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সংসারের সবকিছু দেখা শুনা করতে হয় আন্টিকে । আঙ্কেলের টয়লেট করানো , গোসল করানো , খাওয়ানো , শেইভ করানো সবই আন্টি নিজ হাতে করে যাচ্ছেন ; ক্লান্তির কোন ছাপ নেই তাঁর চোখে –মুখে ! সব কিছুর শেষে আঙ্কেলের মাথায় আবার হাত বুলিয়ে ই যাচ্ছেন একটু ঘুম পাড়ানোর আশায় । দিন রাত নামাজ পরে আল্লাহর কাছে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছেন ! আর আঙ্কেল কাঁদছেন আন্টির একটু মানসিক শক্তির জন্যে । প্রতিটা রাতেই আঙ্কেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে তাঁর পাশে বসে কোরআন পড়েন আর কাঁদেন । একটা রাতও আর নিশ্চিন্তে ঘুমাননা আন্টি । দিন হলেই দিনের নিয়মিত কাজ আর রাত হলে শুধু আল্লাহর কাছে একটাই রোদন তাঁর ; তাঁর ভালবাসার মানুষটিকে যেন তাঁর থেকে আলাদা না করেন ।
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মোহিতে ! তাই বলে সুখের শেষে আবার এমন একটা দুঃখের ঘনঘটা ছুয়ে যাবে কারো জীবনে এটা কেউ ই কামনা করেনা । কিন্তু আমার আন্টির সুখের জীবনে এমন একটা ঘনঘটা নামলেও কিছুতে তাঁর ভালবাসার মানুষ টিকে কেড়ে নিতে পারেনি তাঁর থেকে ! আস্তে আস্তে আঙ্কেল কিছুটা সুস্থতা ফীল করলেও বাইক, ল্যাপটপ আর মোবাইল এই তিনটার ব্যাবহার পুরোপুরি নিষেধ ছিল তাঁর । তবু মাঝে মাঝে এগুলো ব্যবহার করার আবদার করতেন আন্টির কাছে । মাঝে মাঝে তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলোতে বসতে পারতেন তবে আন্টি পৌঁছে দিতেন আবার গিয়ে নিয়ে আসতেন । চলাফেরা কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও আঙ্কেলের আচরন পুরোটা ই শিশুসুলভ ! ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দিলে ব্রাশ করছেন তা না হলে ব্রাশ টা হাতে নিয়ে বসেই থাকবেন কিন্তু পেস্ট লাগাতে হবে তারপর ব্রাশ করতে হবে এটা তাঁর ব্রেইন আর বলে দিচ্ছেনা । খাবার সামনে নিয়ে বসেই থাকেন ; খাইতে না বলা পর্যন্ত বসেই থাকেন । নিজ হাতে খেতে পারলেও আন্টি পুরোটা সময় বসে না থাকলে তাঁর আর খাওয়া শেষ হতোনা । শার্ট এর বাম হাত ঢুকান ডান হাতে আর অমনি যখন দেখেন আন্টি, তখনই ঠিক করে পরিয়ে দিয়ে বোতাম লাগাতে বললে সেখানেও ওলটপালট ঘটাবেন ই । এগুলো ছিল আঙ্কেলের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা আর আন্টির নিত্যনৈমিত্তিক কাজ ! এভাবেই চলছে আমার আন্টির অনাকাঙ্খিত দিনগুলি । একটা মুহূর্তের জন্যে আন্টি চোখের আড়াল হলেই সাথে সাথে ডাক শুরু ; অন্য কেউ জবাব দিলে হয়না । সেই কাজ টা অন্য কেউ করে দিতে চাইলেও হবেনা , আন্টিকে ডাকতেই হবে । তা না হলে দুর্বল ঐ শরীর নিয়ে উঠে খোঁজা শুরু করে দিবেন ।
সবকিছুর পরেও আল্লাহর কাছে অনেক শূকরিয়া আন্টির যে , আঙ্কেল ভালভাবে হাটতে পারছেন ,কথা বলতে পারছে ,খেতে পারছেন । দেড় বছর চলে গেলো এমনি করে ; আবার শুরু হল একটু একটু মাথা ব্যাথা , চোখে ঝাপসা দেখা আর বমি বমি ভাব ! মাঝে মাঝে ব্যাথার কারণে একেবারে বিছানা থেকে উঠতে পারতেন না । মাঝে মাঝেই আবার ভালো । মাঝে মাঝে দু’চারদিন যায় একেবারে জ্ঞানহীন , আবার সুস্থ হয়ে উঠা । এই বছরের অক্টোবর মাসে আবার ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন ; সিটিস্ক্যান রিপোর্ট আবারো বলল আগে যে জায়গাতে সার্জারি হয়েছিল তার পাশেই আরেকটা টিউমার Grow করছে ; আবারো সার্জারি লাগতে পারে তবে যদি সার্জন পরামর্শ দেন ; ঢাকা রেফার করা হল আগের সার্জন এর কাছেই । কিন্তু যতদূর শুনেছি এসব টিউমার দ্বিতীয়বার সার্জারি করাটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ । প্রথমবার ই ডাক্তার বলেছিল ছয় থেকে সাত মাস বাঁচতে পারেন তাছাড়া আয়ু দানকারি একমাত্র আল্লাহ । সেই অবস্থা থেকে পুরো দুই বছর আল্লাহ অনেক ভালোভাবে দিন কাটানোর তৌফীক দিয়েছেন । কিন্তু দ্বিতীয়বার সার্জারির ব্যপারে কেউ তখনো কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা তেমনি একদিন ঘুম থেকে জাগার পর থেকেই হাত পা গুলাতে কোন অনুভুতি পাচ্ছিলেননা । এমনি দিন যেতে যেতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হতে হতে হঠাৎ ই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন । সারাদিন কোন খাওয়া দাওয়া নাই ; শরীর টা একেবারেই নিস্তেজ হয়ে গেলো । কথা বার্তা নাই ; চোখ বন্ধ , একটা শব্দও বের হচ্ছেনা । অমনি তিনদিন আন্টি পাশে বসে কালিমা শুনাচ্ছেন আর আমরা ক’জন বসে কুরআন পড়ছি । তিনদিন পর চোখ খোললেন , কখনো খুলেন আবার কখনো বন্ধ । ডাক দিলে শুধু জবাব দিতে পারছেন কিন্তু শরীরের সংবেদন ফেরেনি , প্রস্রাব করছেন বিছানায় ।
এমনি অবস্থায় ৯ নভেম্বর ঢাকায় নিয়ে আসলাম আঙ্কেল কে । ডাক্তার অবাক হল এখনো তিনি বেঁচে আছেন দেখে ! যাইহোক ভর্তি করিয়ে নিলাম ; MRI রিপোর্ট দেখে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বললেন সার্জারি করানো যাবে কোন সমস্যা নাই । যেহেতু উনি একবার সার্জারির পর হাঁটাচলা করতে পেরেছেন অতএব এবারও পারবেন ইনশাআল্লাহ ! আমরাও আর দেরি করিনি ; সাথে সাথেই জানিয়ে দিলাম আমরা সার্জারি করাতে রাজি আছি । ১৫ তারিখে সফলভাবে সার্জারি হল এবং সময়মত জ্ঞান ও ফিরে আসলো । পুরো শরীরের সংবেদন একজন সুস্থ মানুষের মতো ই আবার ফিরে আসলো । দুদিনের মাথায়ই নিজ পায়ে হেটে বাথরুমে যেতে পারছেন । কিন্তু Histopathology রিপোর্ট আগের মতো ই বলছে ক্যান্সার Grade III তে আছে অতএব তাঁর বেঁচে থাকার পুরোটাই আয়ুর উপর নির্ভর করছে ।
গত দুই বছর ধরে সিলেটে গেলেই আঙ্কলের জন্যে তাদের বাসায়ই থাকা হয় আমার । সিলেট গেলে আর আব্বু,আম্মু,আপুদের সাথে থাকা হয়না । সবাই ই যে যার মতই নিজেকে নিয়ে ব্যতিব্যাস্ত থাকাতে আমি আমার সময়টা আমার অসুস্থ আঙ্কেলের সাথে কাটানোর চেষ্টা করেছি তাই খুব কাছে থেকে আমার আন্টির কষ্টের দিনগুলো দেখার সুযোগ হয়েছে । আন্টির পাশে থাকলে তিনিও কিছুটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেন ।আঙ্কেলের পাশে কিছুটা সময় আমি পাশে বসে থাকলে আন্টি তাঁর জরুরি কাজ গুলো নিশ্চিন্তে করতে পারেন । আঙ্কেল ও ভীষণ ভালবাসেন আমাদের ; এমন করে কোন খালু ভালবাসতে পারে এটা আমার খালুদের না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না । আঙ্কেল আমাকে ‘রঞ্জন’ বলে ডাকেন । একটু এদিক সেদিক হলেই শুরু করেন রঞ্জন কোথায় ? বাসায় যে ই আসুক তাঁর সাথে গল্প করবেন রঞ্জন টা বাসায় আসলে কিছুটা ভালো থাকি ; একটু ভরসা পাই ; ও যেন আমার একটা ছেলে । জানিনা কি দিয়েছি আঙ্কেল কে তবু কেন যেন আমাকে নিয়ে তাঁর অনেক গর্ব । শুয়ে শুয়ে সারাক্ষণ ই দুয়া করবেন আমার রঞ্জন কে তুমি অনেক বড় করে দিও আল্লাহ ! একটু যদি উচ্চারণ করি যে বাসায় যাবো তবে সাথে সাথেই আঙ্কেল বলে বসবে যাও, তবে দুই তিন ঘণ্টা পর চলে এসো । সিলেট গিয়েছি আর এমন যদি কখনো হয়েছে যে আমার বাসায় উঠেছি প্রথমে তবে আন্টি সাথে সাথে ই ফোন দিয়ে বলবেন তুই ওখানে কেন গেছিস ? ঐ বাসায় তোর কি? কখনো বলতে পারিনি যে এখানে তো আমার আব্বু–আম্মু,ভাই–বোন সবাই থাকে । আম্মু সাথে সাথে পাঠিয়ে দিতেন ; যা চলে যা ! তোর আন্টিকে কখনো কষ্ট দিবিনা । এমন ও অনেক হয়েছে সিলেট গিয়েছি কিন্তু আব্বু–আম্মুর সাথে দেখা করতে যেতেই পারিনি আন্টির বাসায় থেকে আবার চলে এসেছি । জানিনা দায়িত্ববোধ থেকেই কিনা ভালবাসা থেকে আন্টির জন্যে সর্বোচ্চ করার চেষ্টা করেছি এবং করবোও । এখনো ব্যাক্তিগত কোন অর্থ–সম্পদের মালিক না হওয়াতে সেই সহযোগিতা ছাড়া আমার সময় আর শ্রম দিয়ে ক্লাস ,পরীক্ষা বাদ দিয়ে আমার আন্টির পাশে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি । ক্যারিয়ার থেকে আমার আন্টির পাশে থাকাটা যে আমার অনেক মুল্যবান কাজ । আমার এই আমি হওয়াতে যার অবদান সব থেকে বেশী তাঁর পাশে ই যদি থাকতে না পারি তবে এই আমার আমি কে দিয়ে কি আর হবে ! যাদের দুয়া আমার অনেক দরকার তাদের দুয়া পাওয়ার জন্যেও তাদের পাশে থাকাটা আমার জরুরি । তাই জীবনের অন্য অনেক কিছু বাদ দিয়ে আমার আন্টি পাশে থাকতে চাই সব সময় । আল্লাহ যেন আমারে এতোটুকু সহযোগিতা করে তাদের পাশে থাকার মতো সুস্থতা দান করে !
আমার আন্টির এতোটুকু চাওয়া ছিল আল্লাহর কাছে যেন আঙ্কেল তাঁর নিজ পায়ে হাটতে পারেন আর দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পারেন আর আল্লাহ সেইটুকু ফিরিয়েও দিয়েছেন । আঙ্কলে কে ছাড়া আমার আন্টির বেঁচে থাকার আর কিইবা অবলম্বন থাকতে পারে । বিয়ের দশ বছর পার হল ! সন্তান হীন জীবন টাকে হয়তো কখনো ঐভাবে অনুভব করেননি আঙ্কেল পাশে থাকাতে , কিন্তু যখন তাঁর এই শেষ অবলম্বন টুকু থাকবেনা তখন কি নিয়ে বাঁচবেন আমার আন্টি ! কি করে এই যাতনা সহ্য করবেন ! তিলে তিলে যত্ন করে গত পঁচিশটি বছর ধরে যাকে ভালবেসে আসছেন কি করে কাটাবেন একটা সেকেন্ড তাঁকে ছাড়া । গত দশটা বছর ধরে যে মানুষ টাকে ছাড়া একটা রাত ও কাটাননি কি করে থাকবেন তাঁকে ছাড়া প্রতিটা রাত !
ভালবাসার মৃত্যু যখন সন্নিকটে তখন আমার আন্টির একেকটা রাত যেন ফিরে পাওয়া একেকটা বছর , একেকটা যুগ । এখন তাঁর প্রতিটা রাতই যেন একেকটা যুদ্ধের রাত । সকাল হলেই তাঁর ঠোটে যুদ্ধে জয়ী কোন সৈনিকের মতো একটা মৃদু হাসি ই আঙ্কেলের বেঁচে থাকার মনসিক শক্তি ! আমার আন্টিও হয়তো আজ এই প্রবাদে বিশ্বাস করে বেঁচে আছেন “জীবনের চেয়ে মৃত্যু ই সত্য ; কারন কারো মৃত্যু ঘটলে সে আর জন্মগ্রহণ করেনা” ।
০৭ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:১৪
অবনি মণি বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ! আপনার দোয়া যেন কবুল হয় আল্লাহর দরবারে !
২| ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:৩১
রুদ্র জাহেদ বলেছেন: বাস্তবতাটা যে কেন এতটা দুঃখের হয়?
পড়তে পড়তে ভিতরটা কেমন হাহাকারে ভরে উঠল
০৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:৩৮
অবনি মণি বলেছেন: এই দুঃখের শেষ কোথায় জানিনা ! আবারো একা জীবন ! আর কোন প্রতীক্ষারও জায়গা নেই । দোয়া করবেন ।
৩| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৪৩
দেবজ্যোতিকাজল বলেছেন: ভালো থাকো:$:$:$
২৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৪২
অবনি মণি বলেছেন: ধন্যবাদ
৪| ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১:০৮
দেবজ্যোতিকাজল বলেছেন: আমার পাতায় একটু ঢু দিয়ে যাও
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪৫
অবনি মণি বলেছেন: আচ্ছা ।ধন্যবাদ ।
©somewhere in net ltd.
১|
০৬ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:৪৬
গুরুর শিষ্য বলেছেন: মনোযোগ দিয়ে পড়লাম আর আপনাদের জন্য মন থেকে দোয়া করলাম...আল্লাহ তাঁদের জান্নাতে এক করুন...যেখানে কোন রোগ তাদের আলাদা করতে পারবে না...আপনার সেবার মনোভাব খুবই ভালো...আপনার জন্যও শুভকামনা...