![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি রুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারি(১০'সিরিজ) ডিপার্টমেণ্টে পড়ালেখা করছি। সুযোগ পেলেই লেখালেখিতে বসে যাই। আমার লেখালেখির সব থেকে পছন্দের বিষয় হল ছোটগল্প ।বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ভালো লাগে। আরও ভালো লাগে নতুন বন্ধু তৈরি করতে।
প্রথম যেদিন ছেলেটি মেয়েটিকে দেখল,সেদিন ছিল প্রথম আলো’র পক্ষ থেকে এস.এস.সি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্ততে কৃতী শিক্ষাথীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। মেয়েটিকে দেখতেই ছেলেটি এক ভিন্ন অনুভূতি অনুভব করল,যা আগে কখনো ঘটেনি ওর সাথে। মেয়েটি অন্যরকম সুন্দর। হলুদ রঙের জামা আর ঘন কালো লম্বা চুলে একদম পারফেক্ট দেখাচ্ছিলো মেয়েটিকে। অনুষ্ঠানটিতে ছেলেটির তেমন মনোযোগ ছিল না। বার বার-ই চোখদুটো শুধু কয়েকটি চেয়ার দূরত্বে বসা মেয়েটিকে দেখতে চাই। ছেলিটি ভাবছিল,ইস্ আমার দিকে যদি একবার তাকাতো। কিন্তু তা আর হল না। কিশোর বয়সের নিষ্পাপ ভালো লাগার রঙিন ছাপ কোমল হৃদয়ে বয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হল।
কলেজে ভর্তির সময় আসলো। বন্ধুদের সাথে একই কলেজে ভর্তি হল ছেলেটি। যথারীতি,কিছুদিন পর ক্লাস ও শুরু হল। কলেজে প্রথম ক্লাসের দিন।বন্ধুদের সাথে ক্লাসে আগেই উপস্থিত হল ছেলেটি। হঠাৎ করে সেই হলুদ জামা পরা মেয়েটাকে দেখতে পেল ছেলেটি। তবে আজ হলুদ না সবুজ রঙের জামা পরে আসছে মেয়েটি। সদ্য গোসল করা চুলগুলো তখনো শুকোয়নি। দেখেই বোঝা গেল যে,মেয়েটি অনেক তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। দ্রুত হেঁটে গিয়ে মেয়েটি তার এক বান্ধবীর পাশে গিয়ে বসলো।
প্রত্যেকদিনই ছেলিটি ক্লাসে আগে এসে বসে থাকে,মেয়েটিকে এক নজর দেখবে বলে। দূর থেকে মেয়েটি যখন হেঁটে আসে,কাউকে না দেখার ভঙ্গিতে,ছেলিটি তখন আরও মজা করে তাকিয়ে থাকে। সূর্যের আলোর প্রতিফলনে সোনালী একটা রঙ যেন ঠিকরে পড়ছে মেয়েটির শরীর দিয়ে আর চোখের সেই উচ্ছল ভাবটা;প্রত্যেকবারই কোথায় যেন নিরুদ্দেশ করে দেয় ছেলিটিকে। মেয়েটির প্রতি ভাল লাগাটা বাড়তেই থাকলো। শুধু তাই নয়,অবচেতন মনে নিয়ন্ত্রনহীন কিশোর হৃদয় অনেকদূর ভেবে ফেলেছে যা এই বয়সে প্রেক্ষিতে যৌক্তিকতার অনেক ঊর্ধ্বে।
কিছুদিন পরের ঘটনা। আজ ছেলেটি মেয়েটির সাথে কথা বলবে বলে ঠিক করলো। একই ক্লাসে পরে অথচ কথা বলা হয়নি মেয়েটির সাথে। ছেলিটি তার এক কাছের বন্ধুর সাথে দাড়িয়ে আছে। ছেলিটি ওর বন্ধুটিকে বলল- চল না দোস্ত,ঐ মেয়েটির সাথে কথা বলে আসি।
ছেলিটির বন্ধু বলল-ওর নামতো মিতা,মিতা ভৌমিক।
ছেলিটি বললো-তার মানে,মেয়েটি হিন্দু!
বন্ধু বললো-হুমম,হিন্দু। তাতে কি হয়েছে?
ছেলেটি স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলো কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিল না। একটা চাপা কষ্টে চোখদুটো পানিতে ভিজে যাওয়ার আগেই ওর বন্ধুটিকে বললো- দোস্ত তুই থাক,আমি আজ যাই।ঝাপসা চোখে দেখা রাস্তাটার দিকে মাথা নিচু করে,বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো ছেলিটি।
ছেলেটি অন্য কোন সম্পর্ক মেনে নিতে পারছিলো না। কিন্তু,সে কিভাবে মেয়েটিকে তার মনের কথা জানাবে;মেয়েটি যে অন্য ধর্মের,তাতে কি শুধু কষ্টই বাড়বে না? জাত,ধর্ম কি জিনিস;তখনো বুঝতে শেখেনি ছেলেটি,কিন্তু তার নির্মম কষাঘাতে কিশোর হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকলো। নিয়ম ভাঙার একটা ইচ্ছা তার মধ্যে জড় হল কিন্তু তা নিয়ে আর বেশি দূর ভাবতে পারল না ছেলেটি। নিজের অনুভূতি জানানোর অপারগতা আর অন্যদিকে কুসুমের ন্যায় নিষ্পাপ ভালোবাসা,কোমল হৃদয়ের দুই প্রান্তে জমতে থাকলো।
ছেলটির বন্ধুরা তার সাথে;মেয়েটির কথা নিয়ে অনেক ইয়ার্কি,হাসি-ঠাট্টা করে আর ছেলেটিও হাসির মাধ্যমে তা উড়িয়ে দেয়। ধীরে ধীরে না পাওয়ার একটা যন্ত্রণা জন্ম নিতে চাইলেও,বন্ধুদের সাথে আড্ডায় তা চাপা পরে যায়।
ছেলেটি ভুলতে পারেনা মেয়েটিকে আবার বলতেও পারে না। সব আবেগকে সে যেন ডাইয়েরীর কাগজগুলোতে সেঁটে ভর্তি করে দেয়,কালো কালির কলম দিয়ে। প্রত্যেকটা কবিতার কোথাও কলমের কালি ঝাপসা তো কোথাও হাতের লেখা অস্পষ্ট। চোখের জল যেন তার সব কালো,ধুয়ে-মুছে নিতে চাই। এভাবেই অজস্র কবিতা,গল্প লেখা হল মেয়েটিকে নিয়ে কন্তু শোনানো হল না।
এইচ.এস.সি পরীক্ষা শেষ হল। ছেলেটি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেল। সে এখন বাড়িতে ক্লাস শুরুর অপেক্ষায়।একদিন বাইরে বেরিয়ে মিতা নামের সেই মেয়েটির সাথে দেখা হল ছেলেটির। রিকসায় করে যেতে দেখল মিতাকে। মিতা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে একটা পরিচিত হাসি দিল আর সাথে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। ছেলেটি বিস্ময়ে থমকে গেল,কি দিয়ে সম্বোধন করবে বুঝতে পারছিলো না।অবচেতন মনেই,তিন বছর ধরে একটা চাপা না বলা কথা বেরিয়ে আসতে চাইল কিন্তু ততক্ষণে রিকসা অনেক দূরে।
ক্যাম্পাসে ফিরে গেলো ছেলেটি। সবকিছুই নতুন তবুও সেই অসম্ভব অতীত তাকে ঈশারা করে ডাকে। মধ্যরাতে সেই পুরনো একটা স্মৃতি নামক দুঃস্বপ্নে তার ঘুম ভেঙে গেলে একা বসে থাকে,ভেবেই পায় না কি করবে।“যদি ভুলতেই পারবো,তাহলে তিন বছরের মধ্যে একটি বারের জন্যেও ভুলতে পারলাম না কেন?” নিজের প্রশ্নই নিজেকে দিশেহারা করে দেয়। অনেক ভেবে সে একটা সিদ্ধান্ত নিল। এবার ছুটিতে বাড়ি গিয়ে মিতাকে তার মনের কথা জানিয়ে দিবে। পর-মুহুরতে ছেলেটি নিজেকে মুক্ত মনে করল,যেন একটা বিশাল পাথর বুক থেকে নেমে গেলো। নিজের তৈরি কারাগার থেকে যে নিজেকে একমাত্র নিজেই মুক্ত করা যায়,অন্য কেউ তা করে দিতে পারে না।
কিছুদিন পরের ঘটনা। মেয়েটি তখন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে,আপাতত বাড়িতে আছে। ক্যাম্পাস বন্ধের সুযোগে বাড়িতে আসলো ছেলেটি।
পরের দিন সকালবেলা। আজ যে করেই হোক মিতার সাথে দেখা করতে হবে। এখন যদি মিতাকে বাড়িতে না পাই? হুট করেই প্রশ্নটা মনে হল ছেলেটির। তৎক্ষণাৎ মনে হল,যা হোক দরকার হলে সারাদিন বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকবো।
ছেলেটি যাওয়ার আগে ভাবল,কিছু ফুল নিয়ে গেলে মন্দ হয় না। তাই দোকান থেকে চার-পাঁচটা টকটকে লাল গলাপ ফুল কিনলো। ফুলগুলো হাতে নিয়ে ছেলেটি দ্রুত হাঁটতে লাগল,শুধুই মনে হচ্ছিল আজ দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর কিছুদুর গেলেই মিতাদের বাসা। ছেলেটি ভাবল ওকে বাড়ি থেকে ডেকে;বাইরে কোথাও কথাগুলো বলতে হবে।
দূর থেকে একটা রিকসা আসছিলো।ধীরে ধীরে ঝাপসা আর ঘোলাটে দেখা মেয়েটি পরিষ্কার হয়ে আসলো। আরে এ তো মিতা!আজ টকটকে লাল শাড়ি পরে আছে। মিতাকে দেখতে আজ অন্যরকম লাগছে,অন্য সকল দিন থেকে আলাদা। মিতা ছেলটিকে দেখতে পেয়ে রিকসা থামালো। বলল,আকাশ কোথায় যাও? আর পাশে বসা ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল,আমার বয়ফ্রেণ্ড।
তিন বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে তোলা সেই বিশাল ভালোবাসার পাহাড় আজ গলে নয় ধ্বসে পড়ল। চোখদিয়ে জলের অজস্রধারা বয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেটা চাপতে গিয়ে হাঁটুতে বল পাচ্ছিলনা ছেলেটা। গোলাপ আর শাড়ির লাল রঙ মিলে সবকিছু কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছিল।কোন রকম নিজেকে সামলালো ছেলেটা।
মিতা বলল,ফুল নিয়ে কোথায় যাও?
ছেলেটি বলল,যার জন্যে যাচ্ছিলাম সে এখন আর নেই।তুমি নিতে পার ফুলগুলো। এছাড়া আর কোন উত্তর খুঁজে পেল না ও।
মিতা ফুলগুলো নিয়ে বলল,অনেক ধন্যবাদ। এখন সময় দিতে পারছিনা বলে কিছু মনে করো না। বিকালে এসো আমাদের বাড়িতে,অনেক কথা হবে। এই বলে বিদায় নিল।
ছেলেটা হাসার চেষ্টা করল না পেরে বলল,চেষ্টা করব।
মিতা কিছুক্ষণ ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি বুঝল কে জানে? রিকসাওয়ালাকে সামনে আগানোর নির্দেশ দিল।
রিকসার চাকা ঘুরতে থাকলো কিন্তু ছেলেটা ওইখানেই দাড়িয়ে,যেন পৃথিবী থমকে গেছে। রিকসা এখন অনেকদুর,গোলাপগুলো আর দেখা যাচ্ছে না,শাড়ির রঙটাও আস্তে আস্তে ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে।
-সমাপ্ত-
©somewhere in net ltd.