নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

নতুন নকিব

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রন-ক্লান্ত। আমি সেই দিন হব শান্ত।

নতুন নকিব › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৫)

২৬ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৪:৫১

পেছনের পর্বগুলো-

বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-২)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৩)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৪)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৫)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৬)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব৭)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৮)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৯)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১০)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১১)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১২)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৩)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৪)



মসজিদে নববীর একাংশে অবস্থিত প্রিয় নবীজীর রওজা মোবারক! জগতের, মর্ত্যের, পৃথিবীর সবচে' সুন্দর, সুন্দরতম স্থানের অন্যতম মহিমান্বিত এই রওজা শরীফ! আয়িশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহার হুজরা ছিল এই রওজা শরীফ! ইনতিকাল পূর্ব অসুস্থতার সময়ের সাত সাতটি দিন আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে এই হুজরা মোবারকে কাটান! এমন অসুস্থাবস্থায়ও তিনি তাঁর স্ত্রীদের থেকে সম্মতি সাপেক্ষে এই স্থানে, অর্থাত, আয়িশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহার হুজরায় অবস্থান করেন! অন্যান্য স্ত্রীগনের অধিকার আদায়ে সমতা রক্ষা ও ইনসাফপূর্ন আচরনের ক্ষেত্রে অাল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দায়িত্ববোধের চূড়ান্ত পরিচয় পাওয়া যায় এখান থেকে! আজ আর রওজা শরীফের মূল অংশ দর্শন করার সুযোগ নেই। ছবিতে যেভাবে দেখা যাচ্ছে, সুদর্শন এই গ্রীল লাগানো বেড়ার বহির্পাশ্ব থেকেই সালাম করতে হয় প্রিয় নবীজীকে। এখান থেকেই হাজ্বী সাহেবানগন প্রানভরে সালাম করেন প্রিয়তম শাফিউল মুজনাবিন সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে! রওজা সংলগ্ন পবিত্র এই পথের স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় দু'ফোটা অশ্রুর নজরানা পেশ করেন সাইয়্যিদুল কাওনাইন সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে! এখানে, রওজা শরীফের পাশে গেলে মনে-প্রানে অদ্ভূত এক শিহরন জাগে! প্রশান্তির পরশে অন্তর সিক্ত হয়! আবেগের আতিশয্যে চোখ অশ্রুসজল হয়! আশিক প্রেমিকের হৃদয় ভেঙ্গে চৌচির হয়! নবীপ্রেমে ধন্য অনন্য হৃদয়ওয়ালারা হয়তো সে শিহরনের অনুভূতি পুরোপুরি লাভে সক্ষম হন। আমাদের মত রিক্ত হস্ত পাপাচারে নিমগ্নগনের সে পূন্য উপলব্ধির ক্ষমতা কোথায়! আল্লাহ পাক তাওফিক দান করুন! আমাদের আমল আখলাক উন্নত করুন! অন্তর প্রশস্ত করুন! তাঁর এবং তাঁর প্রিয় হাবিবের মহব্বতে অন্তর ভরপুর কামিয়াব করুন!

প্রানের কথা:

হজ্বের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কাহ মুকাররমায় পৌঁছার পর থেকেই আমার মত অধমের, ক্ষুদ্রের ভোঁতা অনুভূতিজুড়ে ছিল প্রিয় রাসূলের স্মৃতির অনুসন্ধান। অপলক নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতাম প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছোট বড় প্রতিটি স্মৃতি বিজড়িত স্থানের প্রতি। কি অসীম মায়া! কি অসাধারন প্রেম! বন্ধু, আপনাকে কিভাবে বুঝাতে পারি, প্রিয়তম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যাকে কোনো দিন দেখেনি এই চর্মচক্ষু! যার সংস্পর্শ, সোহবত, সাহচর্য্যলাভে ধন্য হয়নি এই পোড়া মন! যার আলোকোজ্জ্বল, প্রভাদ্বীপ্ত, প্রিয় বদন দর্শনে তৃপ্ত-পরিতৃপ্ত হয়নি এই তাপিত প্রান! তবু তাঁর প্রতি কেন হৃদয়ের অদৃশ্য এই টান! কেন এই চোখ তাঁকে মনে করে অশ্রুর শ্রাবন-প্লাবন অানে! কেন তাঁর স্মৃতির প্রতিটি অলিন্দে অলিন্দে প্রেম খুঁজে মরে পোড়া মন! মূলত: হজ্ব আমরা কেন করি! এও কি প্রিয়তম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখিয়ে দেয়া কিছু পথ ও পদ্ধতির পূর্ন অনুশীলন নয়! আমরা কেন বাইতুল্লাহর চারপাশে তাওয়াফ করি! সাফা মারওয়া পাহাড়ে কেন আমাদের এই সায়ী'! মীনার প্রান্তরে কেন পড়ে থাকেন লক্ষ লক্ষ হাজী সাহেবান! আরাফাতের উম্মুক্ত প্রাঙ্গনে কেন তাদের দু'হাত উর্দ্ধে তুলে ধরে গগনবিদারী রোনাজারি! মুজদালিফার কংকরাকীর্ন প্রান্তরে কেন অশ্রুসিক্ত প্রার্থনায় রাতযাপন! কেন জামারাতের প্রচন্ড ভীড় উপেক্ষা করে পাথর নিক্ষেপনের প্রানপন প্রচেষ্টা! কেন মস্তক মুন্ডনের এই প্রচলন! এ সবই কি প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দেখিয়ে দেয়া পথ ও পদ্ধতির বাস্তবায়নেরই প্রচেষ্টা নয়! এসবই কি তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতির অমোচনীয় এ্যালবামের এক একটি পৃষ্ঠা উল্টে দেখার প্রয়াস নয়, প্রিয় ভাই ও বন্ধু!

প্রিয় পাঠক বন্ধু, আমরা মদিনা মুনাওওয়ারাহর উদ্দেশ্যে কেন ছুটে যাই! হজ্বের আনুসঙ্গিক সকল কাজ; সে তো মক্কাতেই শেষ হয়ে যায়, তো মদিনার পানে ছুটে যেতে পাগলপাড়া হন কেন প্রত্যেক হাজ্বী সাহেবান! মদিনার সাথে তাদের কিসের এত টান! হৃদয়ের তন্ত্রী ছেঁড়া কোন্ প্রেম, কোন্ আবেগ, কোন্ ভালবাসা, কোন্ মুহাব্বাত, কোন্ ইশক, কোন্ মায়া, কোন্ টান তাদের মদিনার পবিত্র মাটির সুঘ্রান, সৌরভ, সুবাস, সুরভী মদিরে পাগল দিওয়ানা করে তোলে! সে কি কেবলই প্রিয় রাসূলের প্রতি অনি:শেষ আনুগত্য আর নি:শর্ত ভালবাসারই অনন্য প্রকাশ-বহিপ্রকাশ-বিকাশ নয়! কবি কতই না সুন্দর বলেছেন-

''রাহে মেরে মাছকান হাওয়ালিয়ে কা'বা,
বানে মেরে মাদফান দিয়ারে মাদিনা।''

''(প্রভূ হে!) আমার বসবাসের জন্য আপনার প্রিয় বাইতুল্লাহর পাশে একটু স্থান দিয়েন!
আমার দাফনের জন্য আপনার প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শহর মদিনাতুত ত্বইয়্যিবায় এক টুকরো জায়গা দিয়েন!''

আল্লাহ পাকের মাহবুব, প্রেমাস্পদ প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যিনি রহমাতুল্লিল আলামীন! সারা জগত জাহানের সকল মানব দানবের জন্য যিনি অনুসরন অনুকরনের সর্বোত্তম আদর্শ! যাকে কুরআন ভূষিত করেছে, 'রহমাতুল্লিল আলামীন', 'জগতসমূহের জন্য করুনাধারা', 'সুসংবাদদাতা এবং সুপারিশকারী' আর 'মহান চরিত্রবান' উপাধিতে! তাঁকে নিয়ে জানার আগ্রহ মেটে না! তাঁর গুনগান গেয়ে শেষ হয় না! তাঁর প্রতি দরূদে মন ভরে না! তাঁর সীরাত পাঠে হৃদয় তৃপ্ত হয় না! তাঁর শান মান, গুনগান বর্ননায় অন্তর পূর্ন-পরিপূর্ন হয় না! তাঁর কাসীদা লিখে কলম ক্লান্ত হয় না! রাতের তারাদের সংখ্যা নিরূপন সম্ভব, কিন্তু তাঁর মু'যিজা বর্ননা করে সাধ্য কার!

কবির কথায় মন আপ্লুত হয়! কতই না উত্তম বলেছেন তিনি-

'লা ইউমকিনুস সানাউ কামা কানা হাক্কুহু
বা'দাজ খোদা বুজুর্গী তুই কিচ্ছা মুখতাছার।'

বাংলায় কাব্যানুবাদ-

আপনার প্রশংসা করে সাধ্য আছে কার?
যেমনটি আপনি হে রয়েছেন মহান।
সংক্ষেপে শুধু একথাই বলা যায়- 'নবী হে,
বিশ্বপতির পরেই আপনার সম্মান!'

বাংলা কাব্যানুবাদ: বাইতুল্লাহর মুসাফির লেখক।

আল্লামাহ মুহাম্মাদ ইকবাল রহ. এর জওয়াবে শিকওয়া কাব্যগ্রন্থের অনবদ্য দু'টি লাইন-

কী মুহাম্মদ (স.) সে ওয়াফা তূ নে তূ হাম তেরে হ্যাঁয়,
ইয়ে জাহাঁ চীজ হায় কিয়া, লওহ ওয়া কলম তেরে হ্যাঁয়।

বঙ্গানুবাদ:

মুহাম্মদের ভালোবাসো যদি ভালোবাসা পাবে তবে আমার,
'লওহ-কলম' লভিবে তোমরা- মাটির পৃথিবী সে কোন্ ছার!

শ্রেষ্ঠতম মানব: শ্রেষ্ঠতম রাসূল

কোন কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করে মুক্তভাবে কিছু দেয়াকে বলে মহানুভবতা। সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এই মহানুভবতার উৎকৃষ্ট উদাহরন। দানশীল ব্যক্তিরা কোন পুরস্কার প্রত্যাশা করে দান করে থাকেন, হোক তা সম্মান, ভালবাসা, উচ্চ প্রশংসা অথবা প্রভূত্ব; কিন্তু রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরকম কোন কিছুই প্রত্যাশা করেননি। তাঁর বিনয়ী আচরন এমন ছিল যে, তাঁর নিকট থেকে যখন কেউ কিছু নিত তখন তাদের মনে হত তারা নবীজীকে কোন অনুগ্রহ করছেন মাত্র, কিন্তু এর বিপরীত কিছু নয়। তাঁর সুমহান অতুলনীয় চারিত্রিক সুসমা অনুপম উপস্থাপনায় স্বয়ং কুরআনে হাকিমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা এভাবে দিয়েছেন-

وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ

“আর নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত।”

অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন-

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ .

“আমি তো আপনাকে সৃষ্টিকুলের প্রতি শুধু রহমত তথা দয়া রূপেই প্রেরণ করেছি।” সূরাহ আল আমবিয়া, আয়াত-১০৭

কুরআনে কারীমের আরেক আয়াতে প্রিয়তম হাবিব রাসূলে মাকবূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রের অতুলনীয় দয়া, বিনয় ও নম্রতার বিষয়ে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর ঘোষনা

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللّهِ لِنتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لاَنفَضُّواْ مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللّهِ إِنَّ اللّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ

''আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করুন আল্লাহ তাওয়াক্কুল কারীদের ভালবাসেন।'' সূরাহ আল ইমরান, আয়াত-১৫৯

সংক্ষেপে বলা যায়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর রাসূলকে উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিষ্ঠিত করেছেন। সকল দিক থেকে তাকে করেছেন শ্রেষ্ঠ। তার নান্দনিক চরিত্রমাধুরি দেখে কত মানুষ যে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে তা গণনা করে শেষ করা যাবে না। সুন্দর চরিত্রের এমন কোন দিক নেই যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্বে পূর্ণতা পায়নি। পৃথিবীতে তিনিই একমাত্র ও অদ্বিতীয় ব্যক্তি যাকে ঘিরে সুশোভিত হয়েছে সকল প্রকার নান্দনিক গুণাবলি। দান, বদান্যতা, ভদ্রতা, ক্ষমা, মহানুভবতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, নম্রতা, সবর, বন্ধুত্বসুলভ আচরণ, বিনয়, ন্যায়পরায়ণতা, দয়া-করুণা, অনুগ্রহ, সাহসিকতা, বীরত্বসহ সকল দিক থেকে তিনি ছিলেন পরিপূর্ণতার অনন্য দৃষ্টান্ত।

এই পর্বটিতে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনন্য সাধারন জীবনালেখ্য সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশা-আল্লাহ। আপনাদের যাতে ধৈর্য্যচূতি না ঘটে তজ্জন্য লেখার কলেবর দীর্ঘায়িত না করার প্রচেষ্টায় ত্রুটি করিনি। তারপরেও যদি কারও কাছে এই লেখা দীর্ঘ মনে হওয়ায় বিরক্তির কারন হয়, তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

জন্মঃ

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রের বনি হাশিম বংশে জন্মগ্রহণ করেন। প্রচলিত ধারনা মোতাবেক, তার জন্ম ৫৭০ খৃস্টাব্দে। প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা মন্টেগোমারি ওয়াট তার পুস্তকে ৫৭০ সনই ব্যবহার করেছেন। তবে তার প্রকৃত জন্মতারিখ বের করা বেশ কষ্টসাধ্য। তাছাড়া মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেছেন বলে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমান পাওয়া যায় না। এজন্যই এ তারিখটি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এমনকি জন্মমাস নিয়েও মতবিরোধ করেন কেউ কেউ। যদিও এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। যেমন, এক বর্ণনা মতে, তার জন্ম ৫৭১ সালের ২০ বা ২২ শে এপ্রিল। সাইয়েদ সোলাইমান নদভী, সালমান মনসুরপুরী এবং মোহাম্মদ পাশা ফালাকির গবেষণায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তবে শেষোক্ত মতই ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশী নির্ভরযোগ্য। যাই হোক, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের বছরেই হস্তী যুদ্ধের ঘটনা ঘটে এবং সে সময় সম্রাট নওশেরওয়ার সিংহাসনে আরোহনের ৪০ বছর পূর্তি ছিল এ নিয়ে কারো মাঝে দ্বিমত নেই। তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ এবং মাতা বিদূষী রমনী আমিনা। জন্মের পূর্বেই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পিতাকে হারান। ৬ বছর বয়সে মা আমিনা এবং ৮ বছর বয়সে দাদা আবদুল মুত্তালিব এর মৃত্যুর পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর লালন পালনের দায়িত্বভার গ্রহন করেন চাচা আবু তালিব।

শৈশব ও কৈশোর কালঃ

তত্কালীন আরবের রীতি ছিল- তারা মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠার মাধ্যমে সন্তানদের সুস্থ দেহ এবং সুঠাম গড়ন তৈরির জন্য জন্মের পরপরই দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন মহিলাদের কাছে দিয়ে দিতেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফেরত নিতেন। এই রীতি অনুসারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও হালিমা বিনতে আবু জুয়াইব (অপর নাম হালিমা সাদিয়া) -এর হাতে দিয়ে দেয়া হয়।

অভিনব, অবিশ্বাস্য এবং প্রাচূর্য্যময় বরকতপূর্ন এক শিশু

এই শিশুকে ঘরে আনার পর হালিমা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা এবং তাঁর পরিবার লক্ষ্য করেন, তাদের সবকিছুতে প্রাচূর্য্য। সকল কাজে বরকত দেখা যায়, হালিমার সচ্ছলতা ফিরে আসে এবং তারা শিশুপুত্রকে সঠিকভাবে লালনপালন করতে সমর্থ হন। তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য – শিশু মোহাম্মদ কেবল হালিমার একটি স্তনই পান করতেন এবং অপরটি তার অপর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। দুই বছর লালনপালনের পর হালিমা শিশু মোহাম্মদকে আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু এর পরপরই মক্কায় মহামারী দেখা দেয় এবং শিশু মুহাম্মাদকে হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। হালিমাও চাচ্ছিলেন শিশুটিকে ফিরে পেতে। এতে তার আশা পূর্ণ হল। ইসলামী বিশ্বাসমতে এর কয়েকদিন পরই একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে – একদিন শিশু নবীর বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে তা জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হয়। এই ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে সিনা চাকের ঘটনা হিসেবে খ্যাত।

স্নেহময়ী মাতার স্নেহছায়াও সরে গেল মাথার উপর থেকে

এই ঘটনার পরই হালিমা শিশু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। এই সময় একদিন মা আমিনার ইচ্ছা হয়, ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেন। মদিনার আত্মীয়দের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারণ ছিল। মা আমিনা ছেলে, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌঁছেন। তিনি মদীনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন। একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আবওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই ইনতিকাল করেন।

দাদাও চলে গেলেন পরপারে

মাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে মক্কায় পৌঁছেন। এর পর থেকে দাদাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দেখাশোনা করতে থাকেন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদাও চলে যান না ফেরার দেশে। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবু তালিবকে প্রিয় দৌহিত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর লালন পালনের দায়িত্ব দিয়ে যান।

সিরিয়া গমন এবং পাদ্রী বুহাইরা কর্তৃক শেষ নবীকে সনাক্তকরন

নবীজীর পিতৃব্য আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে এক বা একাধিকবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বয়স যখন ১২ ব্ছর, তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। প্রগাঢ় মমতার কারণে আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেন না। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। কথিত আছে, শহরটিতে জারজিস সামে এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন, যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গীর্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করান। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন।

ফুজ্জারের যুদ্ধে নবীজীর অংশগ্রহন

ফুজ্জারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন নবীর বয়স ১৫ বছর। এই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিল না। সে সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন।

নবুয়ত–পূর্ব জীবনঃ

আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা, খেয়ানত প্রবণতা এবং প্রতিশোধ পরায়নস্পৃহা দমনের জন্যই হিলফুল ফুজুল নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতে যোগদান করেন এবং এই সংঘকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, তরুণ বয়সে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তেমন কোন পেশা ছিলনা। তবে তিনি বকরি চরাতেন বলে ঐতিহাসিকদের অনেকে উল্লেখ করেছেন। সাধারণত তিনি যে বকরিগুলো চরাতেন সেগুলো ছিল বনি সা’দ গোত্রের। কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি মক্কায় বসবাসরত বিভিন্ন ব্যক্তির বকরিও চরাতেন। এরপর তিনি ব্যবসায় শুরু করেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অল্প সময়ের মধ্যেই এ কাজে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। এই কাজে এতই খ্যাতি তিনি লাভ করেন যে, তার উপাধি হয়ে যায় 'আল আমিন', এবং 'আল সাদিক'। যেগুলোর বাংলা অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে 'বিশ্বস্ত' এবং 'সত্যবাদী'। ব্যবসা উপলক্ষ্যে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুখ্যাতি যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ তা অবহিত হয়েই তাকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাবার অনুরোধ জানান। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান।

বিদূষী রমনী খাদিজার পক্ষ থেকে বিয়ের পয়গাম

খাদীজা মাইছারার মুখে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ভূয়সী প্রশংসা শুনে অভিভূত হন। এছাড়া ব্যবসার বিপুল সফলতা দেখে তিনি তার যোগ্যতা সম্বন্ধেও সম্যক অবহিত হন। এক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্বীয় বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহর কাছে বিয়ের ব্যাপরে তার মনের কথা ব্যক্ত করেন। নাফিসার কাছে শুনে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন যে, তিনি তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলে এ বিষয়ে জানাবেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চাচাদের সাথে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেন। বিয়ের সময় খাদীজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বয়স ছিল ২৫ বছর।

হাজরে আসওয়াদ স্থাপনে সৃষ্ট বিবাদ নিষ্পত্তি

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বয়স যখন ৩৫ বছর তখন কা’বা গৃহের পূনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বেশ কয়েকটি কারণে কাবা গৃহের সংস্কার কাজ শুরু হয়। পুরনো ইমারত ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয় বাইতুল্লাহকে। এভাবে পুনঃনির্মানের সময় যখন হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয় তখনই দেখা দেয় বিপত্তি। মূলত: কোন্ গোত্রের লোক এই পূন্যময় কাজটি করবেন তা নিয়েই ছিল কোন্দল। নির্মাণকাজ সব গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন ছিল নিতান্ত একজনের একটিমাত্র কাজ। কে স্থাপন করবেন এই পবিত্র পাথর, এ নিয়ে বিবাদ শুরু হয় এবং চার-পাঁচ দিন যাবৎ এ বিবাদ অব্যাহত থাকার এক পর্যায়ে এটি এমনই মারাত্মক রূপ ধারণ করে যে, হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় আবু উমাইয়া মাখজুমি একটি সমাধান নির্ধারণ করেন যে, পরদিন প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে যিনি প্রথম প্রবেশ করবেন তার সিদ্ধান্তই সবাইকে মেনে নিতে হবে। পরদিন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবার প্রথমে কাবায় প্রবেশ করেন। এতে সবাই বেশ সন্তুষ্ট হন এবং তাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেন। আর তার প্রতি সবার সুগভীর আস্থাও ছিল। যা হোক, এই দায়িত্ব পেয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত সুচারুভাবে ফয়সালা করেন। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ রাখেন এবং বিবদমান প্রত্যেক গোত্রের নেতাদের ডেকে তাদেরকে চাদরের বিভিন্ন কোণা ধরে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেন এবং তারা তা-ই করেন। এরপর তিনি স্বহস্তে পাথর উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন। এভাবেই তিনি হাজরে আসওয়াদ স্থাপনে সৃষ্ট বিবাদের রক্তপাতহীন এবং অভিনব মিমাংসা করে সকল পক্ষের ধন্যবাদার্হ হন।

নবুওয়ত প্রাপ্তিঃ

চল্লিশ বছর বয়সে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত লাভ করেন, অর্থাৎ এই সময়েই মহান স্রষ্টা তাঁর কাছে সর্বপ্রথম ওহী প্রেরণ করেন। নবুওয়াত সম্বন্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়, আজ-জুহরির বর্ণনায়। জুহরি বর্ণিত হাদীস অনুসারে, নবী সত্য দর্শনের মাধ্যমে ওহী লাভ করেন। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা নিয়মিত তাঁকে খাবার দিয়ে আসতেন। এমনি এক ধ্যানের সময় ফেরেশতা জিব্রাইল আলাইহিস সালাম তাঁর কাছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা প্রেরিত ওহী নিয়ে আসেন। জিব্রাইল আলাইহিস সালাম তাঁকে এই পংক্তি ক'টি পড়তে বলেন:

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ

''পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।'' সূরাহ আল আ'লাক্ক, আয়াত-০১।

خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ

''সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে।'' সূরাহ আল আ'লাক্ক, আয়াত-০২।

اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ

''পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু,'' সূরাহ আল আ'লাক্ক, আয়াত-০৩।

الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ

''যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন,'' সূরাহ আল আ'লাক্ক, আয়াত-০৪।

عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

''শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।'' সূরাহ আল আ'লাক্ক, আয়াত-০৫।

উত্তরে নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানান যে, তিনি পড়তে জানেন না। এতে জিব্রাইল তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই পংক্তি পড়তে বলেন। কিন্তু এবারও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। এভাবে তিন বার চাপ দেয়ার পর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পংক্তিগুলো পড়তে সমর্থ হন। অবর্তীর্ণ হয় কুরআনের প্রথম আয়াতগুচ্ছ; সূরা আলাকের প্রথম এই পাঁচ আয়াত। প্রথম অবতরণের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতটাই ভীত হয়ে পড়েন যে, তিনি কাঁপতে কাঁপতে নিজ গ্রহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেন। বারংবার বলতে থাকেন,

''জাম্মিলুনী! জাম্মিলুনী!''

“আমাকে আবৃত কর”। “আমাকে আবৃত কর”।

ওরাকা বিন নওফেল ছিলেন তাওরাতের পন্ডিত। তাঁর নিকট এ ঘটনা বর্ননা করা হলে, তাঁকে শেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ধীরে ধীরে আত্মস্থ হন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তারপর আবার অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী প্রত্যাদেশের জন্য। একটি লম্বা বিরতির পর তাঁর কাছে দ্বিতীয় বারের মত ওহী আসে। এবার অবতীর্ণ হয় সূরা মুদ্দাস্‌সির -এর কয়েকটি আয়াত। এর পর থেকে গোপনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়ার জন্য প্রেরিত সর্বোত্তম আদর্শ জীবন ব্যবস্থা এই ইসলামের প্রতিষ্ঠার পথ ছিল খুবই বন্ধুর। এই প্রতিকূলতার মধ্যেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মক্কী জীবন শুরু হয়।

অন্তহীন বন্ধুর পথ: প্রিয় নবীজীর মক্কী জীবনঃ

গোপন প্রচার: প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত হওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝতে পারেন যে, এটি প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাকে পুরো আরব সমাজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে; কারণ তৎকালীন নেতৃত্বের ভিত ধ্বংস করা ব্যতীত ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অন্য কোন উপায় ছিল না। তাই প্রথমে তিনি নিজ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মাঝে গোপনে ইসলামের বাণী প্রচার শুরু করেন।

প্রথম ইসলাম গ্রহনকারী সৌভাগ্যশালীগন: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আহবানে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন তাঁর বিদূষী স্ত্রী খাদিজা বিনতি খুওয়াইলিদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা। এরপর মুসলিম হন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চাচাতো ভাই এবং তাঁর ঘরেই প্রতিপালিত কিশোর আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু। ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য নবীজী নিজ বংশীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা করেন। এই সভায় কেউই তাঁর আদর্শ মেনে নেয়নি, এ সভাতে শুধু একজনই ইসলাম গ্রহণ করেন, তিনি হলেন আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু। ইসলাম গ্রহণকারী তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন নবীজীর অন্তরঙ্গ বন্ধূ আবু বকর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু। এভাবেই প্রথম পর্যায়ে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। এবং এই প্রচারকাজ চলতে থাকে যথাসম্ভব সম্পূর্ণ গোপনে, নিরবে এবং নিভৃতে।

প্রকাশ্য দাওয়াত: তিন বছর গোপনে দাওয়াত দেয়ার পর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করেন। এ ধরণের প্রচারের সূচনাটা বেশ নাটকীয় ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাফা পর্বতের ওপর দাড়িয়ে চিৎকার করে সকলকে সমবেত করেন। এরপর প্রকাশ্যে বলেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোন প্রভু নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্‌র রাসূল। কিন্তু এতে সকলে তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড খেপে যায় এবং এই সময় থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার শুরু হয়।

মক্কায় বিরোধিতার সম্মুখীন: বিরুদ্ধবাদীরা কয়েকটি স্তরে নির্যাতন শুরু করে। প্রথমত: উস্কানী ও উত্তেজনার আবহ সৃষ্টি, এরপর অপপ্রচার, কুটতর্ক এবং কূযুক্তি উপস্থাপন। এক সময় ইসলামী আন্দোলনকে সহায়হীন করার প্রচেষ্টা শুরু হয়, যাকে সফল করার জন্য গড়ে উঠে একটি নেতিবাচক ফ্রন্ট। একই সাথে গড়ে তোলা হয় সাহিত্য ও অশ্লীল গান-বাজনার ফ্রন্ট, এমনকি এক পর্যায়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে আপোষেরও প্রচেষ্টা চালায় কুরাইশগন। কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মেনে নেননি; কারণ আপোষের শর্ত ছিল নিজের মত ইসলাম পালন করা, সেক্ষেত্র তার ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই ভেস্তে যেতো।

ইথিওপিয়া/ আবিসিনিয়ায় হিজরত: ধীরে ধীরে যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চরম রূপ ধারণ করে, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছু সংখ্যক মুসলিমকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে পাঠান। সেখান থেকেও কুরাইশরা মুসলিমদের ফেরত আনার চেষ্টা করে, যদিও তৎকালীন আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর কারণে তা সফল হয়নি। বরং সহৃদয় জ্ঞানী বাদশাহ নাজ্জাশী স্বয়ং নিজেই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহন করে মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী সময়ে বাদশাহ নাজ্জাশীর ইনতিকালের সংবাদ শুনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদূর মক্কা থেকে তাঁর জানাজা আদায় করেন। তাঁর জন্য মাগফিরাতের দুআ করেন।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণ: এরপর পর ইসলামের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে তা হল উমর ইবনুল খাত্তাবের মত দুর্ধর্ষ ইসলামের শত্রু ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবসময় চাইতেন যেন আবু জাহল ও উমরের মধ্যে যে কোনো একজন অন্তত ইসলাম গ্রহণ করে। তাঁর এই ইচ্ছা উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর ইসলাম গ্রহনের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। আরব সমাজে উমরের বিশেষ প্রভাব থাকায় তাঁর ইসলাম গ্রহণ ইসলাম প্রচারকে খানিকটা সহজ করে, যদিও কঠিন অংশটিই তখনও মুখ্য বলে বিবিচেত হচ্ছিল। এরপর এক সময় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চাচা হামযা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণে আরবে মুসলিমদের আধিপত্য কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়।

একঘরে অবস্থা: এভাবে ইসলাম যখন শ্লথ গতিতে এগিয়ে চলছে তখন মক্কার কুরাইশরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার অনুসারীসহ গোটা বনু হাশিম গোত্রকে একঘরে ও আটক করে রাখে। তিন বছর আটক থাকার পর তারা মুক্তি পান।

দুঃখের বছর ও তায়েফ গমন: দীর্ঘ তিনটি বছর বয়কট অবস্থায় নিতান্ত কষ্টে শিষ্টে অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করার পরে মুক্তির পরের বছরটি ছিল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য দুঃখের বছর। এই বছরটিকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম 'আমুল হুযন' বা 'দু:খের বছর' বলে আখ্যায়িত করেন। কারণ, এই বছরে খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁর প্রান প্রিয় স্ত্রী খাদিজা ও চাচা আবু তালিব মারা যান। দুঃখের সময়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় ইসলামের প্রসারের ব্যাপরে অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েন। হতাশ হয়ে তিনি এবার ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ যান (অবশ্য তায়েফ গমনের তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে)। কিন্তু সেখানে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি চূড়ান্ত অপমান, ক্রোধ ও উপহাসের শিকার হন। এমনকি তায়েফের লোকজন তাদের কিশোর-তরুণদেরকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিছনে লেলিয়ে দেয়; তারা ইট-প্রস্তরের আঘাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্তাক্ত করে দেয়। কিন্তু তবুও তিনি হাল ছাড়েননি; নব নব সম্ভাবনার কথা চিন্তা করতে থাকেন। তায়েফবাসীর জন্য তিনি তাঁর দুআ'র হাত বাড়িয়ে দেন মহান প্রতিপালকের নিকট।

মি‘রাজ তথা উর্দ্ধারোহন: এমন দু:খ ও যাতনাময় সময়েই কিছু শুভ ঘটনা ঘটে। এ সময় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক রাতে মক্কায় অবস্থিত মসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসায় যান; এই ভ্রমণ ইতিহাসে 'ইসরা', তথা 'রাতের ভ্রমন' নামে পরিচিত। মসজিদুল আকসা থেকে তিনি একটি বিশেষ যানে করে উর্দ্ধারোহণ করেন এবং মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করেন। এছাড়া তিনি বেহেশ্‌ত ও দোযখসহ মহাবিশ্বের সকল স্থান পরিভ্রমন করেন। অদৃশ্য জগতের বিষয়সমূহ সচক্ষে অবলোকন করেন। এই যাত্রা ইতিহাসে 'মি’রাজ' তথা, 'উর্দ্ধারোহন' নামে পরিচিত। এই সম্পূর্ণ যাত্রার সময়ে পৃথিবীতে কোন সময়ই অতিবাহিত হয়নি বলে বলা হয়।

মদীনায় হিজরতঃ এই অলৌকিক ঘটনার পর আরও শুভ ঘটনা ঘটে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনে। মদীনার বেশকিছু লোক ইসলামের প্রতি উৎসাহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা মূলত: হজ্জ্ব করতে এসে ইসলামের দাওয়াত পেয়েছিলেন। এরা আকাবা নামক স্থানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে শপথ করেন যে, তারা যে কোন অবস্থায় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্ষা করবেন এবং ইসলামের প্রসারে কাজ করবেন। এই শপথগুলো আকাবার শপথ নামে সুপরিচিত। এই শপথগুলোর মাধ্যমেই মদীনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং একসময় মদীনার ১২ টি গোত্রের নেতারা একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণের মাধ্যমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মদীনায় আসার আমন্ত্রণ জানান। মদীনা তথা ইয়াসরিবে অনেক আগে থেকে প্রায় ৬২০ সাল পর্যন্ত গোত্র গোত্র এবং ইহুদীদের সাথে অন্যদের যুদ্ধ লেগে থাকে। বিশেষত বুয়াছের যুদ্ধে সবগুলো গোত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ায় প্রচুর রক্তপাত ঘটে। এ থেকে মদীনার লোকেরা বুঝতে সমর্থ হয়েছিল যে, রক্তের বিনিময়ে রক্ত নেয়ার নীতিটি এখন আর প্রযোজ্য হতে পারে না। এজন্য তাদের একজন নেতা দরকার যিনি সবাইকে একতাবদ্ধ করতে পারবেন। এ চিন্তা থেকেই তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, যদিও আমন্ত্রণকারী অনেকেই তখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি। এই আমন্ত্রণে মুসলিমরা মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে যান। সবশেষে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবু বকর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনায় হিজরত করেন। তাদের হিজরতের দিনেই কুরাইশরা মুহাম্মাদকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল যদিও তা সফল হয়নি। এভাবেই মক্কী যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে।

মাদানী জীবনঃ নিজ গোত্র ছেড়ে অন্য গোত্রের সাথে যোগদান আরবে অসম্ভব হিসেবে পরিগণিত হত। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সেরকম নয়, কারণ এক্ষেত্রে ইসলামের বন্ধনই শ্রেষ্ঠ বন্ধন হিসেবে মুসলিমদের কাছে পরিগণিত হয়। এটি তখনকার যুগে একটি বৈপ্লবিক চিন্তার জন্ম দেয়। ইসলামী পঞ্জিকায় হিজরতের বর্ষ থেকে দিন গণনা শুরু হয়। এজন্য ইসলামী পঞ্জিকার বর্ষের শেষে AH উল্লেখিত থাকে যার অর্থ: After Hijra।

স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সংবিধান প্রণয়ন: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় গিয়েছিলেন একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। তখন বিবদমান দুটি মূল পক্ষ ছিল আওস ও খাযরাজ। তিনি তাঁর দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করেছিলেন। মদীনার সকল গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদীনা সনদ স্বাক্ষর করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই সনদের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে সকল রক্তারক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির গোড়াপত্তন করা হয় এবং সকল গোত্রের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভুতি সৃষ্টি করা হয়। আওস এবং খাযরাজ উভয় গোত্রই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এছাড়াও প্রধানত তিনটি ইহুদী গোত্র যথাক্রমে বনু কাইনুকা, বনু কুরাইজা এবং বনু নাদিরসহ মোট আটটি গোত্র এই সনদে স্বাক্ষর করেছিল। এই সনদের মাধ্যমে মদীনা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হন তার প্রধান।

মক্কার সাথে বিরোধ ও যুদ্ধ: মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই মক্কার সাথে এর সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে থাকে। মক্কার কুরাইশরা মদীনা রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্য যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করতে থাকে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় এসে আশপাশের সকল গোত্রের সাথে সন্ধি চুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু মক্কার কুরাইশরা গৃহত্যাগী সকল মুসলিমদের সম্পত্তি ক্রোক করে। এই অবস্থায় ৬২৪ সালে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৩০০ সৈন্যের একটি সেনাদলকে পাঠান মক্কার একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে বাঁধা দেয়ার উদ্দেশ্যে। কারণ উক্ত কাফেলা বাণিজ্যের নাম করে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। কুরাইশরা তাদের কাফেলা রক্ষায় সফল হয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যুদ্ধের ডাক দেয়। আত্মরক্ষামূলক এই যুদ্ধে মুসলিমরা সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়ে কুরাইশদের এক তৃতীয়াংশ হয়েও বিজয় অর্জন করেন। এই যুদ্ধ বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত যা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ তারিখে সংঘটিত হয়। আল কুরআনের ভাষ্যমতে, এই যুদ্ধে আল্লাহ পাক মুসলিমদের সহায়তা করেছিলেন। যাহোক, এই সময় থেকেই ইসলামের সশস্ত্র ইতিহাসের সূচনা ঘটে। এরপর ৬২৫ সালের ২৩ মার্চ উহুদ যুদ্ধ সংঘটিতে হয়। এতে প্রথম দিকে মুসলিমরা পরাজিত হলেও শেষে বিজয়ীর বেশে মদীনায় প্রবেশ করতে সমর্থ হন। কুরাইশরা বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও চূড়ান্ত মুহূর্তের নীতিগত দূর্বলতার কারণে পরাজিতের বেশে মক্কায় ফিরে যায়। ৬২৭ সালে আবু সুফিয়ান কুরাইশদের আরেকটি দল নিয়ে মদীনা আক্রমণ করে। কিন্তু এবারও শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরন করে মক্কাভিমুখে ফিরে যেতে বাধ্য হয় কুরাইশগন। এটিই ইতিহাসে খন্দকের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে বিজয়ে উৎসাহিত হয়ে মুসলিমরা শুকরিয়া আদায় করেন। গোটা আরবে তারা একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে পরিগনিত হতে থাকেন। ফলে আশপাশের অনেক গোত্রের উপরই মুসলিমরা প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন।

মদীনার ইহুদিদের সাথে সম্পর্কঃ কিন্তু এ সময় মদীনার আশপাশে বসবাসকারী ইহুদীরা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য হুমকী হয়ে দেখা দেয়। মূলত ইহুদীরা বিশ্বাস করত না যে, একজন অ-ইহুদী শেষ নবী হতে পারেন। এজন্য তারা কখনই ইসলামের আদর্শ মেনে নেয়নি এবং যখন তারা ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তি সম্মন্ধে সম্যক ধারনা লাভ করতে সক্ষম হয়, তখন তারা এর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনা রাষ্ট্রের এবং মুসলিমদের জন্য হুমকি এসব ইহুদী গোত্রের উপর সতর্ক নজর রেখে চলতেন। ইহুদীদের এসব অনৈতিক কারনেই বদর ও উহুদের যুদ্ধের পর বনু কাইনুকা ও বনু নাদির গোত্র সপরিবারে মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়; আর খন্দকের পর সকল ইহুদীকে মদীনা থেকে বিতাড়ন করা হয়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলিমদের প্রতি ইহুদীদের এই বিদ্বেষের পেছনে দু'টি কারণের উল্লেখ পাওয়া যায়, একটি ধর্মীয় এবং অন্যটি রাজনৈতিক। ধর্মীয় দিক দিয়ে চিন্তা করলে আহলে কিতাব হয়েও শেষ নবীকে মেনে না নেয়া ছিল তাদের মস্ত বড় অপরাধ। এর শাস্তি স্বরূপ মদিনা থেকে তাদের বিতাড়িত হওয়া ছিল স্বাভাবিক। বরং তাদেরকে এই লঘু শাস্তি দেয়াই ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মহানুভবতা। আর রাজনৈতিকভাবে চিন্তা করলে, ইহুদীরা মদীনার জন্য একটি হুমকী ও দুর্বল দিক ছিল। এজন্যই তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়।

হুদাইবিয়ার সন্ধিঃ আল কুরআনে যদিও মুসলিমদের হজ্জ্বের নিয়ম ও আবশ্যকীয়তা উল্লেখ করা আছে, তথাপি কুরাইশদের শত্রুতার কারণে মুসলিমরা হজ্জ্ব আদায় করতে পারছিলেন না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক স্বপ্নে দেখতে পান তিনি হজ্জ্বের জন্য মাথা কামাচ্ছেন। এ শুভস্বপ্ন দেখে তিনি হজ্জ্ব করার জন্য মনস্থির করেন এবং ৬ হিজরী সনের শাওয়াল মাসে হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে ১৪০০ জন সাহাবাকে সাথে নিয়ে মক্কার পথে মদীনা ত্যাগ করেন। কিন্তু এবারও কুরাইশরা বাঁধা দেয়। অগত্যা মুসলিমরা মক্কার উপকণ্ঠে হুদাইবিয়া নামক স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করেন। এখানে কুরাইশদের সাথে মুসলিমদের একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে সুপরিচিত। এই সন্ধি মতে, মুসলিমরা সে বছর হজ্জ্ব করা ছাড়াই মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে। সন্ধির অধিকাংশ শর্ত মুসলিমদের বিরুদ্ধে গেলেও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন।

বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের কাছে পত্র প্রেরণঃ রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা বিশ্বের রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। সুতরাং পৃথিবীর সব জায়গায় ইসলামের আহবান পৌঁছে দেয়া ছিল তাঁর সুমহান দায়িত্ব। হুদাইবিয়ার সন্ধির পর কুরাইশ ও অন্যান্য আরব গোত্রগুলো থেকে আশ্বস্ত হয়ে এ কাজে মননিবেশ করেন তিনি। সেসময়ে পৃথিবীর প্রধান রাজশক্তিগুলো ছিল ইউরোপের রোম সাম্রাজ্য (the holy roman empire), এশিয়ার পারস্য সাম্রাজ্য এবং আফ্রিকার হাবশা সাম্রাজ্য। এছাড়াও মিশরের ‘আযীয মুকাউকিস’, ইয়ামামার সর্দার এবং সিরিয়ার গাসসানী শাসনকর্তাও বেশ প্রতাপশালী ছিল। তাই ষষ্ঠ হিজরীর জিলহজ্জ মাসের শেষদিকে একইদিনে এদেঁর কাছে ইসলামের আহবানপত্রসহ ছয়জন দূত প্রেরণ করেন।

প্রেরিত দূতগণের তালিকাঃ

দাহিয়া ক্বালবী রাদিঅাল্লাহু তাআ'লা আনহুকে রোমসম্রাট কায়সারের কাছে।
আবদুল্লাহ বিন হুযাফা রাদিঅাল্লাহু তাআ'লা আনহুকে পারস্যসম্রাট পারভেজের কাছে।
হাতিব বিন আবূ বুলতা’আ রাদিঅাল্লাহু তাআ'লা আনহুকে মিশরৈর শাসনকর্তার কাছে।
আমর বিন উমাইয়া রাদিঅাল্লাহু তাআ'লা আনহুকে হাবশার রাজা নাজ্জাশীর কাছে।
সলীত বিন উমর বিন আবদে শামস রাদিঅাল্লাহু তাআ'লা আনহুকে ইয়ামামার সর্দারের কাছে।
শুজাইবনে ওয়াহাব আসাদী রাদিঅাল্লাহু তাআ'লা আনহুকে গাসসানী শাসক হারিসের কাছে।
শাসকদের মধ্য হতে শুধুমাত্র বাদশাহ নাজ্জাসী ছাড়া আর কেউ ইসলাম গ্রহণ করেননি।

মক্কা বিজয়ঃ দশ বছর মেয়াদি হুদাইবিয়ার সন্ধি মাত্র দু’বছর পরেই ভেঙ্গে যায়। খুযাআহ গোত্র ছিল মুসলমানদের মিত্র, অপরদিকে তাদের শত্রু বকর গোত্র ছিল কুরাইশদের মিত্র। একরাতে বকর গোত্র খুযাআদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। কুরাইশরা এই আক্রমণে অন্যায়ভাবে বকর গোত্রকে অস্ত্র দিয়ে সহয়োগিতা করে। কোন কোন বর্ণনামতে, কুরাইশদের কিছু যুবকও এই হামলায় অংশগ্রহণ করে। এই ঘটনার পর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশদের কাছে তিনটি শর্তসহ পত্র প্রেরণ করেন এবং কুরাইশদেরকে এই তিনটি শর্তের যে কোনো একটি মেনে নিতে বলেন। শর্ত তিনটি হলো:

১। কুরাইশ খুযাআ গোত্রের নিহতদের রক্তপণ শোধ করবে।
২। অথবা তারা বকর গোত্রের সাথে তাদের মৈত্রীচুক্তি বাতিল ঘোষণা করবে।
৩। অথবা এ ঘোষণা দিবে যে, হুদাইবিয়ার সন্ধি বাতিল করা হয়েছে এবং কুরাইশরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।

কুরাইশরা জানায় যে, তারা শুধু তৃতীয় শর্তটি গ্রহণ করবে। কিন্তু খুব দ্রুত কুরাইশগন তাদের ভুল বুঝতে পারে। এবং আবু সুফয়ানকে সন্ধি নবায়নের জন্য দূত হিসেবে মদীনায় প্রেরণ করে। কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং মক্কা আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করেন।

৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশ হাজার সাহাবীর বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কাভিমুখে রওয়ানা হন। সেদিন ছিল অষ্টম হিজরীর রমজান মাসের দশ তারিখ। বিক্ষিপ্ত কিছু সংঘর্ষ ছাড়া মোটামুটি বিনা প্রতিরোধে মক্কা বিজিত হয় এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিজয়ীবেশে সেখানে প্রবেশ করেন। তিনি মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন। তবে দশজন নর এবং নারী এই ক্ষমার বাইরে ছিল। তারা বিভিন্নভাবে ইসলাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কুৎসা রটিয়ে বেড়াতো। তবে এদের ভেতর থেকেও পরবর্তিতে কয়েকজনকে ক্ষমা করা হয়। মক্কায় প্রবেশ করেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বপ্রথম কাবাঘরে আগমন করেন এবং সেখানকার সকল মূর্তি ধ্বংস করেন। মুসলমানদের শান-শওকত দেখে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ক্ষমাগুণে মুগ্ধ হয়ে অধিকাংশ মক্কাবাসীই ইসলাম গ্রহণ করে। আল কুরআনে এই বিজয়ের ঘটনা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।

নবীজীর ইনতিকাল: বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর হিজরী ১১ সালের সফর মাসে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের তাপমাত্রা প্রচন্ড হওয়ার কারণে পাগড়ির ওপর থেকেও তার উষ্ণতা অনুভূত হচ্ছিল। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এগারো দিন তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রিয় মসজিদে নববীতে নামাজের ইমামতি করেন। অসুস্থতা তীব্র হওয়ার পর তিনি সকল স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আয়েশা রাদিঅাল্লাহু তাআ'লা আনহার কামরায় অবস্থান করতে থাকেন। তাঁর কাছে সাত কিংবা আট দিনার ছিল। ইনতিকালের একদিন পূর্বে তিনি এগুলোও দান করে দেন। বলা হয়, এই অসুস্থতা ছিল খাইবারের এক ইহুদি নারীর তৈরি বিষ মেশানো খাবার গ্রহণের কারণে। ইনতিকালের পূর্ব মুহূর্তে সর্বশেষ যে কথাগুলো তাঁর পবিত্র মুখে উচ্চারিত হয়েছিল, তা ছিল-

আচ্ছালাত! আচ্ছালাত! ওয়ামা- মালাকাত আইমা-নুকুম!

সাবধান, নামাজ! সাবধান, নামাজ! আর তোমাদের অধিনস্তদের ব্যাপারে সতর্ক হও!

এরপরে তিনি বলেন- 'বালির রফী-কিল আ'লা'।

আমার মহান প্রভূর প্রিয় সান্নিধ্য!

এ কথাগুলোই ছিল প্রিয় নবীজীর মুখ নি:সৃত সর্বশেষ শব্দাবলী! অবশেষে এরপরেই, ১১ হিজরী সালের রবিউল আউয়াল মাসের ১ তারিখ সন্ধ্যায় পার্থিব সকল মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে, মর্ত্যবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি মহান প্রভূর একান্ত সান্নিধ্যে গমন করেন।

আহ! ইনতিকালের পূর্বমুহূর্তেও তিনি নামাজের কথা ভুলে যান নি! নামাজ তাহলে কত জরুরী! কতটা আবশ্যকীয়! চিন্তা করে দেখেছেন একবার! অধিনস্তদের প্রতি সঠিকভাবে দায়িত্বপালন যে কত গুরুত্বপূর্ন তাঁর অন্তিম সময়ের অসিয়ত তা উপলব্ধিতে সাহায্য করে!

ইনতিকাল পূর্ব আরও দু'একটি ঘটনা: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইনতিকালের পূর্বেকার ঘটনা প্রসঙ্গে আনাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা অানহু বলেন যে, সোমবার দিন ফজর ওয়াক্তে আবূ বাকর রাদিআল্লাহু তাআ'লা অানহু এর ইমামতিতে সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু তাআ'লা অানহুম সালাতরত ছিলেন। এমন সময়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়িশাহ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহার ঘরের পর্দা সরিয়ে সালাতরত সাহাবীগনের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অত:পর মৃদু হাসেন। এদিকে আবূ বাকর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু ইমামের স্থান হতে নিজ পায়ের পিছনের অংশে ভর দিয়ে তাঁর স্থান থেকে পেছন দিকে সরে গেলেন এবং কাতারে সামিল হলেন। তিনি ধারনা করেছিলেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাতে শরীক হওয়ার জন্য ইচ্ছে করছেন।

আনাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু আরও বর্ননা করেন যে, হঠাত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্মুখ ভাগে প্রকাশিত হওয়ায় সালাতরতগন এতই আনন্দিত হয়েছিলেন যে, সালাতের মধ্যেই একটি পরীক্ষায় নিপতিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল (অর্থাত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর শারীরিক অবস্থাদি জিজ্ঞাসার জন্য সালাত ভঙ্গ করে দেয়ার উপক্রম হয়েছিল)। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতের ইশারায় সালাত সম্পূর্ন করে নিতে বলেন এবং ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে পর্দা নামিয়ে ফেলেন। সূত্র: সহিহ বুখারি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অসুখের অধ্যায়।

ইনতিকালের পূর্বে এটাই ছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সর্বশেষ মসজিদে গমন। এরপরে তিনি আর কোনো নামাজের জামাতে অংশগ্রহন করতে পারেননি।

ইনতিকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। আলী রাদিঅাল্লাহু তাআ'লা আনহু তাঁকে গোসল দেন এবং কাফন পরান। আয়েশা রাদিঅাল্লাহু তাআ'লা আনহার কামরার যে স্থানে তিনি ইনতিকাল করেন, সেখানেই দাফন করা হয় প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে।



রাতের অনন্যসাধারন মসজিদে নববী। উপরের দিকে প্রিয় সবুজ গম্বুজ। এই গম্বুজের নিচেই শুয়ে আছেন, দোজাহানের বাদশাহ, তাজেদারে মদীনা, সাকিয়ে কাওসার, সারওয়ারে কায়েনাত সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।



রাতের মসজিদে নববীর আরেকটি অনন্য দৃশ্য।



সারওয়ারে কায়েনাত সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা শরীফ সর্ববামে যে ছিদ্রটি তুলনামূলক একটু বড় ঠিক সেটি বরাবর। এরপরপরই ডান পাশে যে ছিদ্রটি এটি বরাবর হযরত আবূ বাকর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর কবর। সর্বডানে যে ছিদ্রটি এটির অবস্থান হযরত উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর কবর বরাবর। আল্লাহ পাক জগতের শ্রেষ্ঠতম পূন্যাত্মা এবং তাঁর দুই সঙ্গীকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চ মাকামে স্থান দিন। দরুদের মিষ্টতার স্বাদ অনুভব করি আমি গুনাহগারের বিশুষ্ক ঠোঁটেও- ''আল্লাহুম্মা ছল্লি আলা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মানিদন আবদিকা ওয়া রাসূলিক। ওয়াআলাল মু'মিনী-না ওয়াল মু'মিনা-তি ওয়াল মুসলিমী-না ওয়াল মুসলিমা-ত।''



রওজা শরীফের আরেকটি ছবি।



রওজা শরীফের আরও একটি সুন্দর ছবি।



রাতের মসজিদে নববীর চোখ জুড়ানো আরেকটি ছবি।



রওজা শরীফের অসাধারন সৌন্দর্য্যের প্রকাশ। আরও একটি সুন্দর ছবি।



রিয়াজুল জান্নাহর একাংশ। হাদিসের ভাষ্যমতে, রওজা শরীফ এবং আল্লাহর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিম্বারের মাঝখানের অংশটি জান্নাতের অংশবিশেষ। এখানে নামাজ আদায় করা ভীড়ের কারনে কঠিন বৈকি। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা একাধিকবার এই স্থানে যাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছি এবং নামাজ আদায় করেছি।



রওজা শরীফের উপরের দৃষ্টিনন্দন গ্রীলের একাংশ।

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে জুন, ২০১৮ রাত ৯:০৫

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন:
প্রশংসা দু'জাহানে যা, সব তোমারই
যত গুনগান ও শান নামে তোমারই ।।
কর গ্রহন এই নিবেদন আমারই
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী।।

প্রাণের কথা অংশতো যেন প্রাণের ভেতর থেকে নিংড়ে নিয়েছেন সব মনোকথা :)
সংক্ষেপে জীবনি অংশটুকু দারুন হয়েছে।

আপনার উপর রাসূল সা: এর করম ও রহম পূর্ণ বর্ষিত হোক।
এই প্রেম অটুট অবিচল থাকুক জনম জনম
ধন্য হোক মানব জনম
ধন্য হোক সৃষ্ট জীবন।

+++++

২৭ শে জুন, ২০১৮ সকাল ৯:৪৭

নতুন নকিব বলেছেন:



রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্তুতি, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রেমে আপনার কবিতা অমর হয়ে থাক।

প্রতিটি পর্ব সময় নিয়ে পাঠ করা এবং অসাধারন মূল্যবান মন্তব্য দিয়ে অনুপ্রেরনা দিয়ে যাওয়ায় নিরন্তর কৃতজ্ঞতা। হুব্বে রাসূল, ইশকে রাসূল, বাংলায় বললে- রাসূলের মহব্বত, রাসূলের প্রেম- কথাগুলো আমরা বলি। এগুলো নির্দোষ। রহম করম প্রত্যাশা করা যায়, শুধুই আল্লাহ পাকের নিকট।

২| ২৬ শে জুন, ২০১৮ রাত ৯:৫৯

সনেট কবি বলেছেন: হেদায়েতি পোষ্ট। ++++++++++

২৭ শে জুন, ২০১৮ সকাল ১১:৫৮

নতুন নকিব বলেছেন:



মোবারকবাদ। কৃতজ্ঞতা অশেষ পাঠ, মন্তব্য এবং লাইক প্রদানে।

৩| ২৬ শে জুন, ২০১৮ রাত ১০:১৩

মো: নিজাম উদ্দিন মন্ডল বলেছেন: ইয়ে, মানে....
পুরোটা পড়লাম না, তবে ছবিগুলো দারুন!


আপনার গত পোস্টটা পরে পড়েছি!
উহুদ যুদ্ধের কাহিনী এখনো মনে আছে!:)
আপনি লেখাতে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং রাদিআল্লাহু তাআ'লা পুরোটা লিখে ভালো করেছেন! সংক্ষেপে লিখলে পুরোটা পড়া হয় না..

২৭ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১২:০১

নতুন নকিব বলেছেন:



গত পর্ব পুরোটা পড়েছেন জেনে ভাল লাগলো। আশা করি, এই পর্বও সময় করে পড়ে নিবেন এবং আপনার মূল্যবান মতামত জানাবেন।

হ্যাঁ, চেষ্টা করি, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু পুরোটা লিখতে। না লিখলে কার্পন্য মনে হয়। বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন দেখে কৃতজ্ঞতা। অনেক ভাল থাকুন।

৪| ২৬ শে জুন, ২০১৮ রাত ১০:১৩

ঢাকার লোক বলেছেন: বিদ্রোহী ভৃগু ভাই,
.. আপনার উপর রাসূল সা: এর করম ও রহম পূর্ণ বর্ষিত হোক."
রাসূল (স) করম ও রহম না বলে আল্লাহর করম ও রহম বলাই কি ঠিক নয় ?

২৭ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১২:০২

নতুন নকিব বলেছেন:



ভাল বলেছেন। ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা অশেষ।

৫| ২৬ শে জুন, ২০১৮ রাত ১০:১৪

মো: নিজাম উদ্দিন মন্ডল বলেছেন: ইয়ে, মানে....
পুরোটা পড়লাম না, ছবিগুলো দারুন!


আপনার গত পোস্টটা পরে পড়েছি!
উহুদ যুদ্ধের কাহিনী এখনো মনে আছে!:)
আপনি লেখাতে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং রাদিআল্লাহু তাআ'লা পুরোটা লিখে ভালো করেছেন! সংক্ষেপে লিখলে পুরোটা পড়া হয় না..

২৭ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১২:০৩

নতুন নকিব বলেছেন:



একই মন্তব্য দু'বার এসেছে। তবু মুছে দেয়া থেকে বিরত থাকলাম প্রিয় মন্তব্য। অনেক ভাল থাকুন।

৬| ২৭ শে জুন, ২০১৮ সকাল ১০:৫৩

রাজীব নুর বলেছেন: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অহদাহু লা শরিকা লাহু, লাহুল মুলকু অ- লাহুল হামদ অ হুয়া আনা কুল্লে শাইন কাদির।

২৭ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১২:০৪

নতুন নকিব বলেছেন:



খুবই গুরুত্বপূর্ন একটি দুআ স্মরন করিয়ে দিলেন। আল্লাহ পাক আপনার উপর রহম করুন। অনেক কৃতজ্ঞতা।

৭| ২৭ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১২:৫০

শাহরিয়ার কবীর বলেছেন:

হে দয়াময় আমাকে শুদ্ধ করো ও ক্ষমা করো,

আল্লাহ পাক যেন আমাকে নবীজির রওজা মোবারক জিয়ারত করার তৌফিন দান করেন।

২৭ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৩:৪২

নতুন নকিব বলেছেন:



হে দয়াময় আমাকে শুদ্ধ করো ও ক্ষমা করো,

আল্লাহ পাক যেন আমাকে নবীজির রওজা মোবারক জিয়ারত করার তৌফিন দান করেন।


-আপনার প্রানের আঁকুতি আল্লহ পাক কবুল করুন। মোবারকবাদ। কৃতজ্ঞতা। অনেক ভাল থাকুন প্রিয় কবি ভাই।

৮| ২৭ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪০

মো: নিজাম উদ্দিন মন্ডল বলেছেন: ট্যাবে ব্লগিং করায় একটু টাচ লাগলেই এমনটা হয়!

একই মন্তব্য দুবার আসলে একটা মুছে ফেলবেন! :(

২৭ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪২

নতুন নকিব বলেছেন:



জ্বি, পরবর্তীতে মুছে দেব ইনশা-আল্লাহ। আপনার পুনরাগমনে মুগ্ধতা। শুভকামনা আবারও।

৯| ২৮ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:৩০

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: @ঢাকার লোক এবং লেখক ভায়া
দুজনেই একি বিষয়ে বলায় একেত্রই বলছি -

যাঁর শাফায়াত বিনে পরকালে গতি নাই! যাঁর শাফায়াতের কামনায় নিত্য মোনাজাতে উম্মাহ
তাঁর রহম, করম প্রত্যাশায় ভুল হয় কি?
গুঢ় তত্ত্ব বাদই দিলাম, শরয়ী ভােবই তা কেন বলা যাবে না?

যে আমার হাতে হাত রাখল সে আল্লাহর হাতে হাত রাখল, কিংবা হে মুহাম্মদ বালি আপনি নিক্ষপ করেননি, আল্লাহই করেছেন
অথবা যে আল্লাহকে পেতে চাও সে মোহাম্মদ সা: কে ভালবাস, আহলে বাইতকে ভালবাস! বিশ্বাসের অঙ্গ করে দেয়া হয়েছে যাদের ভালবাসা - তা কি পার্থিব আর দশটা ভালবাসার মতো?

আমরা দুনিয়ায় আমাদের চেয়ে যে একটু বেশি যোগ্য তার কাছেই আকুতি করি- ভাই/স্যার একটু খেয়াল রাইখেন! আপনার নজর রাইখেন! বা একটু দয়া কইরেন গরিবের উপর! আপনি একটু দয়ার দৃষ্টিতে চাইলেই হবে!
আরবি রহম আর করমে কি কোন অন্য আপত্তি আছে?

তাহলেতো রহিম, করিম নামেও সেই সমস্যা থাকার কথা। যে রহমের অধিকারী সেইতো রহিম! যে করমের অধিকারী সেইতো করিম! নয়কি? সেতো কেবলই আল্লাহ পাক! তবে আইজদ্দির পোলারে যে রহিম করিম বলি-কেমন হয়ে গেল না!

যে রাসূল সা: না হলে জগত হতো না। যে রাসুল না হলে আল্লাহ চিনতাম না! সেই রাসূল সা: এর রহম, করম, শাফায়াত নিত্য কামনা পূন্যের কাজ। রাসূল খুশি হলেই না আল্লাহ মিলবে! এতো আমার কথা না। বানানো বিম্বাস না। কোরআন হাদীসেরই কথা। যে আল্লাহ নিজে নিত্য রাসূল সা: এর শানে দরুদ পড়েন, সেই রাসূল সা: এর রহম করমের আমি প্রার্থী ভাই।
আমি কোন দোষ দেখি না। আপনার/আপনাদের আপত্তির যুক্তিযুক্ত কারণ দেখালে হয়তো ভাবা যেতে পারে।

ভাল থাকুন।


৩০ শে জুন, ২০১৮ সকাল ১১:০৯

নতুন নকিব বলেছেন:



আপনাকে একটি বইয়ের লিঙ্ক দিয়েছি। দয়া করে যদি ডাউনলোড করে দেখে মতামত জানান, কৃতজ্ঞতা থাকবে।

আর এই বিষয়টি আসলে অনেক স্পর্শকাতর। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আলোচনা করা দরকার। হৃদয়ের গহীনের বিশ্বাসে যাতে কেউ আঘাতপ্রাপ্ত না হন, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। আশা করি, আমার কথাগুলো আপনাকে কষ্ট দেয়নি। আফটার অল, জানি, আপনি মনে কষ্ট নেয়ার মানুষ নন। আফটার রিড দ্যাট বুক, ইফ ইউ টেল মি এগেইন প্লিজ, আই শ্যাল এ্যানসার ইউর দিস গুড কমেন্ট।

অনেক ধন্যবাদ। অনেক কৃতজ্ঞতা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.