![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভাঙা সাত নাম্বার বাসের নিচ থেকে বেড়িয়ে আসা রক্তাক্ত পা দেখে দাড়িয়ে গেলেন ড: হাসিবুর রহমান।জগিং থামিয়ে গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলেন। নিচু হয়ে দেখলেন ক্ষত-বিক্ষত যুবক নিথর হয়ে পড়ে আছে। বুকটা ধক করে উঠল।দাড়িয়ে আশেপাশে তাকালেন। মিষ্টভাষী, সদাচারী ড:হাসিবুর রহমান পূর্ণ সচিব হয়ে পাঁচ বছর আগে অবসর নিয়েছেন।আগার-গায়ে ছয় তলা একটা বাড়ি বানিয়ে শান্তিতে জীবন-যাপন করছেন। ইবাদত-বন্দেগী করেই তার সময় চলে যায় মাঝে মাঝে লেখালেখি করেন।নিচ তলার ভাড়াটিয়া আনিস হোসেনকে দূর থেকে আসতে দেখে বুকে সাহস ফিরে পেলেন।আগার-গাও মহিলা পলিটেকনিকস্ সমানে গত পাঁচ বছর যাবত জগিং করেন কিন্তু কখনও এরকম ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি।বুক ফুলিয়ে নি:শ্বাস নিয়ে মনে মনে নিজের কর্তব্য নির্ধারণ করে নিলেন। প্রথমে হাসপাতালে নিচে হবে পড়ে পুলিশ খবর দিতে হবে। ঢাকা মেডিকেলে জরুরী বিভাগে ভর্তি করে দিলেন।যুবকের বন্ধু কামালকে ফোনে পাওয়া গেল, তাকে সংক্ষেপে ঘটনা জানালো হল।
হাসিব সাহেব দুদিন পরে যুবকে দেখতে গেলেন। হেসে মোবাইল-মানিব্যাগ হাতে দিয়ে বলল গুনে দেখ সব ঠিক-ঠাক আছে কিনা।যুবক লজ্জায় বোকার মত হেসে বলল না না, কি যে বলেন। আমি সেদিন তোমাকে হাসপাতালে রেখে গিয়েছিলাম, তুমি আগার-গায়ে বাসের নিচে পড়ে ছিলে। তোমার কোন পরিচিত জন ছিল না বলে আমার কাছে রেখেছিলাম।স্যার আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার মত ভাষা আমার জানা নেই।আপনার মত মানুষেরাই মানবতাকে গৌরবান্বিত করে চলেছে।
তোমার এ অবস্থা কে করেছে।
জানি না। তবে ওরা সারারাত ভয়াবহ অত্যাচার করেছে। খুব মেরেছে। বেঁচে আছি এই ভাগ্য। তবে বলেছে নাস্তিকবাদই লেখা যদি বন্ধ না করি তবে প্রাণে মেরে ফেলব।
তুমি নাস্তিক?
আমি মানুষ, আপনারই মত।
তবে ওরা কেন নাস্তিক বলে তোমার এ হাল করল। সে বিশাল কাহিনী তা বলে আপনার সময় নষ্ট করব না।
ড: হাসিবুর রহমান বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল বলে ফেল। ভার লাঘব হবে।
আমার সন্দেহ হল। আসলে এই ভদ্রলোক কি চায়!
আমার চোখে ভয় দেখে হেসে ফেলল, বলল ভয়ের কিছু নেই।
আমার নাম হাবিবুল্লাহ হোসেন। সবাই অবশ্য হাবিব বলেই ডাকে। মাঘ মাসের হাড় কাঁপানো শীতের সকাল। সূর্যটাকে কুয়াশার জন্য পূর্ণ জ্যোৎস্নার উজ্জ্বল চাঁদ মনে হয়। আমি বসে বসে দেখছি গত সপ্তাহে লাগানো লাউ চারাটা কতখানি বেড়েছে।চারাটাকে এইসময় বড় সজীব ও জীবন্ত লাগে।শিশিরে সবুজ পাতাগুলো চকচক করে। জানি একটু পড়েই ও নেতিয়ে পড়ে যাবে। আমার বয়স তখন পাঁচ, সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি।ধোঁয়া উঠা পুকুরের পানিতে ওযু করে চলে যেতাম মক্তবে। মাঝে মাঝে শীতের ভয়ে ওযুও করতাম না। আলিফ জবর আ, বা জবর বা পড়ে যেতাম অনর্গল। কিন্তু মনে মনে অপেক্ষা করতে থাকতাম, কখন ঘরে গিয়ে চায়ে মুড়ি ডুবিয়ে চামচ দিয়ে খাব।ভাষাটা শিখতে আমার ভাল লাগে না তবুও আনন্দ লাগত যখন সবার চেয়ে ভাল পারতাম। ঘরে গিয়ে চুলোর পিঠে হাত দিয়ে কি শিখেছি তার হিসাব দিতাম। আর চায়ের কাপে মুড়ির পাহাড় বানাতাম। হুজুর মাঝে মাঝে এসে নাস্তার সাথে সাথে আমার ভূয়সী প্রশংসা করতেন। শুনে বুক ফুলে ফেটে যাবার উপক্রম হত, খুব লজ্জা পেতাম । এরপর স্কুলের বই আর চট নিয়ে রোদে চলে যেতাম। চাচাত ভাই-বোনেরা সবই পাশাপাশি বসে খানিক পড়া চলত, তারপর ছবি দেখা ছবি আঁকা অবশেষে চলত গল্প । আমরা মানুষের ছবি আঁকতাম না ভয়ে।আমদের ভিতর ধারনা ছিল ছবি আঁকা পাপ, আর আল্লাহ নাকি আদেশ করবে আঁকা ছবির জান দিতে। যদি না পারি তবেই কঠিন শাস্তি।আমরা আঁকতাম ‘দ’ আছে মাথা ব্যথা, বাইশ জন আসছে কবিরাজ টাইপ পাখি। রোদের তেজ বেড়ে অসহ্য হলেই পড়ার ইতি।পান্তা ভাত খেয়ে বেড়িয়ে পড়তাম।আমাদের একটা বিখ্যাত খেলা ছিল ‘গাইচ্ছা-মাউচ্ছা’। এই খেলায় একজন থাকত মগা, যার হাতে থাকবে একটা ছড়ি। ছড়ি দিয়ে গাছে উঠে ছুঁইতে পাড়লে সে মাছ(আউট) হয়ে যেত। আর এর মাঝে কেউ গাছ থেকে নিচে নামত পাড়লে গোল। বউ-জামই খেলা ও দোকানদারী খেলা বেশ জমত। কিন্তু খেলার সমাপ্তি হত হাঙ্গামায়। কেউ না কেউ কাঁদতে কাঁদতে বাসায় যেত তখন ঘণ্টা দুই বাকি সবাই লোপাটটা, কেউ বাড়ির আশেপাশেও ঘিরতাম না। সবাই মিলে পাশের বাড়িতে গিয়ে অন্যদের খেলা ভঙ্গুর করতাম অথবা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম। সবচেয়ে ভয়ংকর লাগত গোসলের সময়, তখন সংকল্প থাকত গড়িমসি করে যেভাবেই হোক গোসল এড়ানো। বেশিরভাগ সময়ই তা সম্ভব হত না। গোসল করলেও এক ডুব দিয়ে ডাঙায়। এরপর সরিষার তেল দিয়ে ধুলো ময়লার জাগরণ রোধ করে রোদে বসে থাকা।তারপরও কিছু জায়গা অরক্ষিত থেকেই যেত, কানের খাঁচ বা পিঠে, যেখানে হাত পৌঁছানো সম্ভব নয়। সেখানে জাগত মেঘনা-নদীর নতুন চর। কত কান মলনই খেতে হয়েছে সেসব ভাবলে আজও লজ্জা লাগে। বিকেলের খেলা শেষে পায়ে স্যান্ডেল ঢুকিয়ে পা ধুয়ে ঘরে ফিরতাম। চা-মুড়ি খেয়ে শুরু হত পাঠ-পর্ব। কেন জানি না সৃষ্টিকর্তা তখনই দুনিয়ার সব ঘুম আমার চোখে ঢেলে দিতেন। বসে বসে দোল খেতাম, চিৎকারে আবার মাথা সোজা করে জোড়ে জোড়ে পড়া শুরু করতাম। কিন্তু স্বরগ্রাম কখন যে আপার-স্কেল থেকে লোয়ার-স্কেল নেমে নীরব হয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না। তখনই মা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে সারাদিনের অপকর্ম নিয়ে জেরা করে বলত তখন কেন ঘুম আসে না। আমার খুব রাগ অভিমান হত এই ভেবে আমি কি জানি? চড়-কিলেই রাতের পড়ার ইতি ঘটত। তবে মাঝে মাঝে লাঠির ব্যাবহারেও ইতি হতো। যখনই পাঠ চুকে যেত তখন দারুণ মুক্ত লাগত, সব ভুলে যেতাম। কোনরকম খেয়েই বিছানায়।
এভাবে দুটি বছর কেটে গেল। স্কুলে যেতে আমার ভাল লাগে না। সপ্তাহে দু-তিন দিন স্কুল কামাই করি। বাড়িতেই আমার ভাল লাগে। স্কুলে কার সাথে মিশি না একা একা ঘুরি। সবাই খেলে আর আমি একা দাড়িয়ে দেখি। ক্লাসে একটা কথা বলি না দুষ্টুমিও করি না। বসি একমাত্র বন্ধু চাচাত ভাইয়ের পাশে। টিচার আসলে জানালা দিয়ে বাহিরের লোকজনের চলাফেরা দেখি। বাড়ি ফিরি আনন্দ করতে করতে।
তখন অভিভাবকদের মাঝে তাদের সন্তানদের নিয়ে প্রতিযোগিতা তুঙ্গে। তাহার-ফল স্বরূপ ফাইনাল পরীক্ষায় অভিভাবকরা যে যেভাবে পারতেন সন্তানদের সাহায্য করতেন। সেটা চূড়ান্ত হত শেষ ঘণ্টায় হলে ঢুকে শিক্ষার্থীর খাতায় লিখে দিয়ে। আমিও সেই সাহায্যের ধরুন দ্বিতীয় হয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হলাম। প্রথম হল টিচারের ছেলে। অভিভাবকরা দারুণ খুশী। দেখতে দেখতে ক্লাস সেভেনে পৌঁছে গেলাম। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে নতুন কিছু লোকের সাথে পরিচয় হল। অমায়িক ব্যাবহার, দারুণ কথাবার্তা বলেন। তাদের বন্ধু-সুলভ আচার-আচরণ, চমৎকার ব্যাবহারে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হই। নিয়মিত তাদের কাছে আশা-যাওয়া করতে থাকি। পাশে বসে তাদের কথাবার্তা শুনতে বেশ ভাল লাগে। এরপর একদিন মুফতি কারমান হোসেন তার রুমে নিয়ে গিয়ে কিছু কথা বললেন। আশার সময় কিছু উপহার ও পুস্তিকা টাইপ তিনটা বই দিলেন। বই শেষ করে নতুন বই নিলাম। আবার নামাজ পড়তে উৎসাহী করে, তাদের প্রভাবে কিছুদিনের মাঝে আমি পুর-দুস্তর নামাজী হয়ে গেলাম।নামাজ পড়ি, বিকেলবেলা তাদের কথা শুনি, তাদের সাথে চলাফেরা করি। নরম-ভাষায় দারুণ যুক্তি দিয়ে সুন্দর কথা বলতেন। আমার প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতেন। চমৎকার ভাবে আদেশ-উপদেশ প্রদান করতেন। ইতিমধ্যে লম্বা পূরণ করে তাদের সদস্য হয়ে গেলাম। সেটা ছিল এক অবর্ণনীয় অনুভূতি, মনে হয়েছিল আমি বৃহৎ ও মহৎ কাজ করে ফেলেছি। মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করার দায়িত্ব পেয়েছি। হাদিস-কোরানের অনুবাদ পড়ি পুর-দমে। সারাদিনের কাজের রিপোর্ট করি প্রতিদিন বিকেলবেলা। সাথে সাথে চলতে থাকে ইসলামিক শাসন ব্যবস্থার উপর ছোট ছোট পুস্তিকা পড়া। সবাইকে নামাজের আহবান করি। বড়দের ভুল যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দেই। বাসায় কোরান-হাদিস নিয়ে তর্ক করি, যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করি। নব্য মুসলমান বলে খোঁচা দিত অনেকে আমি গায়ে মাখাতাম না। আমি লক্ষে অটল, আমার সাথে আল্লাহ আছেন। তিনি সব দিবেন পরকালে এবং এই পৃথিবীতে। তখন সম্ভবত ২০০২ সাল। আমি মিছিল মিটিং এ নিয়মিত যোগদান করি। কোন সভা-মাহফিল মিস করি না। সন্ধ্যাবেলা মাঝে মাঝে পাশের বাড়িতে সিডি প্লেয়ারে সাইদী নামক এক ব্যক্তির ওয়াজ শুনি। তার কথা শুনে রক্ত টগবগ করে বিচি অনুভূতি হয়। নিজেকে বড় গুরুত্বপূর্ণ লাগে। আমি এখন আগের মত গাছে চড়ি না,লুঙ্গিতে কাঁচা মেরে সাঁতার কাটি না।ফুটবল খেলি না। যে ফুটবল খেলতে আমি দারুণ পছন্দ করতাম, স্বপ্নে দেখতাম ফুটবল খেলছি। খেলার জন্য স্কুলে-বাসায় কত মার খেয়েছি, আঙ্গুল ভেঙেছি। টাকা চুরি করে বল কিনেছি।তবুও বর্ষা নামলে, বিকেল হলে, স্কুল পালিয়ে ফুটবলে শুট করা চাই। তাও ছেড়েছি সতর না ডাকার শাস্তির ভয়ে ।ক্লাস সেভেনের ফাইনাল শেষ হলে পুর-দমে আমি তাদের সময় দিচ্ছি, নিয়মিত মিটিং-সভা করছি। জানুয়ারিতে রেজাল্ট শুনে মাথায় পনেরো হাজার ভোল্ট এর বজ্রপাত পড়ল। আট নম্বর থেকে সোজা আটান্ন নাম্বারে চলে গেলাম। তাও আবার দুটিতে ফেল মেরে কোন রকম প্রমোশন পেলাম।পুরপুরি নি:সঙ্গ হয়ে পড়লাম, কারো সঙ্গ ভাল লাগত না।বিমর্ষ সময় কাটাই আর চিন্তা করতে থাকি কেন এরকম হল। তাদের সঙ্গ পুরোপুরি পরিত্যাগ করলাম। মনে মনে ভাবি আমি তো আল্লাহর পথেই ছিলাম। তাকে রাজী-খুশী করার জন্য কত কি করলাম, পছন্দের সবকিছু ছেড়ে দিলাম। নামাজ-রোজা করলাম, ইসলামিক কাজ-কর্ম করলাম, মানুষকে দাওয়াত দিলাম। তবুও তিনি আমার উপর নারাজ হলেন নাকি তারা আসলে ভুল পথে আছে? চিন্তায় চিন্তায় সন্ধ্যা হয়ে আসে ঘরে ফিরে বই নিয়ে বসি আবার চিন্তাগুলো কোথা থেকে এসে প্রশ্নে জর্জরিত করে তোলে। কখন কখন তার উপর খুব অভিমান হত আবার মনে কোনে তার কার্যক্রম নিয়ে সংশয় জাগত। মনে হতে কোথাও কেউ নেই, পরক্ষনে তওবা করতাম, চিন্তাকে জোর করে অন্যদিকে নিয়ে যেতাম। রেডিও মত কথাগুলো বাজতে থাকত ভিতরে, অসহ্য কষ্ট লাগত খুব। নতুন উদ্যম নিয়ে ফের শুরু করলাম পড়াশুনা। আমার মুখোসগুলো খসতে খসতে আদিম হয়ে গেলাম। দারুণ মুক্তির স্বাদ পেলাম, হঠাৎ মনে হয় এর নামই স্বাধীনতা। পরাধীন হয়ে বুজি স্বাধীন হবার সুমিষ্ট স্বাদ বোঝা যায়। কৌশলে এড়িয়ে চলতাম ওদের।এস এস সি শেষ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম।পরিচিত হচ্ছিলাম নতুন নতুন মানুষ সাথে। রঙিন জগতের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠল।মনে হল শহর আমাকে পছন্দ করেছে, ভালবেসেছে।সাথে সাথে ধর্মের আরও অনেক দিকের সাথে পরিচয় ঘটছিল, পরিচয় হচ্ছিল বাঙালী প্রগতিশীল লেখকদের লেখার সাথে। ধর্মের জ্বীন-শয়তান আমাকে দারুণ প্রভাবিত করল, মাথায় জ্বীন-শয়তান দেখার নেশা চেপে গেল।জ্বীনের অস্তিত্ব অনুভবের আশা পাগলের মত পেয়ে বসল।পেপারের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে যাই জ্বীনের কাছে, জ্বীনের মালিক ভুজুং-ভাজুং দিয়ে টাকা দাবি করে। আমার আশ মিটল না, অনুভবে অস্তিত্ব এলো না জ্বীনের।গ্রাম্য জ্বীন ডাক্তারকে মাটির ঢিলা দিয়ে তালের মিছরি পেলাম।জ্বীন পেলাম না। আমার এক দাদীর বড় অপারেশন করেছে নাকি জ্বীন সার্জেন, রোগী সেজে গেলাম জ্বীন সার্জেনের কাছে।সার্জেন অপারেশন করেন মানুষ গভীর ঘুমে অচেতন হলে। একটা অপারেশনের ব্যবস্থা করে বাসায় ফিরলাম। জ্বীন তো দেখলাম না অগত্যা ডাক্তারের ফিস দিতে হল। আগে ফিস পরে তদবির।পরে জেনেছি আমার অপারেশন নাকি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। জ্বীন দেখার আশায় শ্বশানে একাকী ঘুরেছি মাঝ নিশিতে, অমাবস্যার রাতে নির্জন জঙ্গলে গিয়েছি, লাশের সাথে উদ্দাম মেঘনা পারি দিয়েছি। শান্ত নীরবতায় শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তীব্র হাহাকার দেখেছি।জ্বীন আর পেলাম না।জ্বীন আনার তদবির পড়েছি, তবুও জ্বীন রমণীটা আমাকে ধরা দেয় নি , ওর জন্য হাড্ডি-গোবর রেখেছিলাম যতনে। ও যে এলো না।ও যে এলো না।
বাস্তবে না পেয়ে গ্রন্থের আশ্রয় নিলাম। আমার ধর্মের জ্বীনের বর্ণনাকে সত্য জেনে অনুসন্ধান চালাতে থাকলাম। ইহুদী ধর্মে শেদিম এর বর্ণনা পাই, ইসলাম ধর্মে পাই জ্বীন জাতির বিস্তারিত বর্ণনা। কিন্তু খৃস্টান ধর্মে কেন নাই? এর আগে পাওয়া যায় হযরত সোলাইমান (আ যুগে। তিনি জ্বীন দ্বারা বড় কাজগুলো করাতেন।তার ভয়ে জ্বীনেরা অবিরাম কাজ করে যেত। তিনি মারা যাওয়ার পর লাঠির উপর ভর দিয়ে এক বছর ছিলেন। তার ভয়ে জ্বীনরা কাজ চালিয়ে গিয়েছিল। অবশেষে তার লাঠি উইপোকায় খেয়ে ফেললে তিনি পড়ে গেলেন। আর জ্বীনরা বুজে ফেলে তিনি মারা গেছেন।একবছর এভাবে লাঠির উপর ভর দিয়ে ছিলেন তার পরিবারের বা পরিষদের লোকজনেরা কেন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি? তিনি ছিলেন পৃথিবীর মহাশক্তিধর রাজাদের একজন। মানুষেরা নাকি বদ জীনের সাহায্য নিয়ে পিছনের সব খবর বের করে ফেলে। হারিয়ে যাওয়া বা চুরি হওয়া বস্তুর সন্ধান দেয়, আবার মানুষের ক্ষতি সাধন করে যাতে পাগল হয়ে যায় এমনি কি মৃত্যু পর্যন্ত হয়। আচ্ছা এটা কি জর্জ বুশের উপর কাজ করে না? অথবা মুসলিম জ্বীনগুলো লাদেনের হাত শক্তিশালী কেন করে না? ইরান দেশ কেন জ্বীনদের লাগিয়ে আমেরিকার সকল গোপন খবর বের করে না? আরব জ্ঞানী চমকপ্রদ জ্বীনের বর্ণনা দিয়েছেন। তদের মাঝে নাকি কাফের ও মুসলমান আছে, মুসলমানদের মাঝে নাকি আবার শিয়া, সুন্নি, খারেজী মত মতবাদ আছে।যে মতগুলো রাজনৈতিক কারণেই সৃষ্টি, তবে কি জীনেরাও রাজনীতি করে? যে জায়গায় জ্বীনের বর্ণনা পাওয়া তারা সবই আরব দেশে এসেছেন।অনিশ্চয়তার মাঝে দুলতে থাকলাম।
কোরান পড়া শুধু করি সাথে শানে নুযূল ও তাফসির এবং হাদিস এই ভেবে এখানে সকল সমস্যার সমাধান নিহিত।চন্দ্র-সূর্যের ব্যাপারে বলা আয়াতগুলো বিজ্ঞানের সাথে আংশিক সাজ্ঞসিক লাগে। কিন্তু আমার জ্ঞানের স্বল্পতাকে দায়ী করি। দৃশ্যমান ব্যাপারে ধর্ম ও বিজ্ঞান কি বলে তা আবিষ্কারের চেষ্টা চালতে থাকি। এক্ষেএে সুরা তারিক এর দুটি আয়াত যা বলে তা না বললে আপনি আমার সংশয়ের কারণটা পুরোপুরি বুঝতে পারবেন না। “ তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে প্রবল বেগে নি:সৃত পানি হতে”- ৬‘”যা বের হয় পিঠ ও বুকের হাড়ের মধ্য হতে”-৭। এ সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞান কি বলে তা জানার জন্য ইন্টারনেটে পড়া শুরু করি। বিশ্বস্ত অনেক সুত্র থেকে যা পেলাম তা আমার বিশ্বাসকে খানিক নাড়া দেয়।সংশয় কাটানো জন্য পরিচিত ডাক্তারকে জিজ্ঞাস করলাম। তিনি ব্যাপারটা ভালভাবে বুঝিয়ে দিলেন। ফেসবুকে কিছু ভিডিও লিংক দিলেন।আমি ব্যাপারটা মেনে নিতেই পারছিলাম না। মনে হল অতি রহস্যময় এখানে হয়ত কোন রহস্য রেখেছেন। আবার ভাবলাম কত থিওরি ও চিকিৎসা পদ্ধতি ভুল প্রমাণিত হয়। এটাও হয়ত কোনদিন....? আয়াত দুটি ও আধুনিক বিজ্ঞান এব্যাপারে কি বলে তা হুবহু লিখলাম। ব্যক্তিগত কোন মন্তব্য লিখলাম না। লেখাটি পোস্ট করেছিলাম ২০১২ এর ১৫ জানুয়ারি। আশা করেছিলাম কেউ হয়ত সঠিক দিশা দিতে পারবে।আমি সংশয়যুক্ত হব। পাবলিশের পর কমেন্টস্ তুমুল দাঙ্গা চলতে থাকল।আমি ঠাণ্ডা মাথায় বুঝাতে চেষ্টা করলাম। ফোনে হুমকি আসতে থাকল, এসএমএস আসতে থাকল চৌদ্দ-গুষ্টিকে গর্ভধারণ করার, সেখানে বাড়ির পাঠা ছাগলটাকেও রেহাই দেয়নি। ফেসবুক মেসেজ এ মানুষ জবাই করার ভিডিও লিংক পাঠানো হতে থাকল। বার বার পড়ছি কি ভুল লিখলাম। গ্রাম থেকে মা ফোনে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুই বাড়ি চলে। তুই কি করছস, কোথায় কি লিখছো। আমি বুঝিয়ে বললাম কিন্তু কাজ হল না। চলে যেতে হল নোয়াখালীতে। জানার আকুতি পর্যবসিত হল আতঙ্কে।স্কুলের টিচার ডেকে নিয়ে জেরা করল। ভৎসনা করে বলল আমার টিচার হওয়ায় নাকি তার নিজের উপর তার ঘৃণা হচ্ছে। তাকে বুঝানো গেল না। আপন দেশে আপন ঘরে নির্বাসিত। ঘৃণা বাড়তে থাকে চারপাশের মানুষের উপর, ধর্মের উপর খুব আক্রোশ তৈরি হল। যা লিখছি তা মাকে বুঝিয়ে বলা অসম্ভব,তাই কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া তার মনে সন্দেহ গাছ তৈরি করল। অধিক মাতৃস্নেহে একটি সেমিস্টার ড্রপ দিতে হল। চরম ক্ষোভ-রাগ হতাশা নিয়ে ঢাকা ফিরি।কোরানের আয়াত ও বিজ্ঞানের কথাগুলো পাশাপাশি লিখতে থাকি। কোন ধরনের মতামত প্রকাশ করি না। রাগের উত্তাপে লেখা প্রকাশ করতে থাকি বিভিন্ন ব্লগে, ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে। অনেকের যুক্তি দিয়ে বোজানোর চেষ্টা আমার ভাল লাগে। বেশির ভাগ যুক্তিই থাকে ভাববাদী ধারার। লেখা বন্ধের জন্য হুমকি-ভয় দেখায় আনেকে। সরাসরি দেখা করে কেউ বুঝাতে চায় বিজ্ঞান যা বলছে তাতে ভুল আছে।এগুলো ইহুদী-খ্রিস্টানদের চক্রান্ত। বার বার ব্লক হচ্ছি আর মেধাবী ছোটভাই হারুন উদ্দাম করে দিচ্ছে।
ভয়ে ভয়ে ক্লাস করি বাসায় ফিরি।এভাবে বছরটা কেটে গেল। যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে অনলাইনে লেখালেখি করি। যুক্ত হলাম বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপে। ক্ষুরধার লেখা প্রসব করে চলছি সেইদিনগুলোতে।ফেব্রুয়ারি ২০১৩ আন্দোলন তখন তুঙ্গে, সাধারণ মানুষ দলে দলে আসছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এর মানুষ একাত্ম ঘোষণা করছে। সক্রিয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় গড়ে উঠছে আন্দোলনের মঞ্চ।গণজাগরণ মঞ্চ।চারদিকে ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই রব।ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে রাজাকারদের। কি আনন্দ তখন চারদিকে, আমদের চোখে মুখে সেকি তৃপ্তি। মিষ্টি বিলানো, একে অপরকে খাওয়ানো, বিজয় মিছিল করা, নাচে-গানে মুখরিত করা আরও কত রকম উদযাপন।
১৫ই ফেব্রুয়ারি রাতে ধর্মান্ধ বিপথগামী পাঁচ ছাত্রের হাতে নৃশংস ভাবে খুন হলেন আহমেদ রাজীব হায়দার।যাহার লেখনীর ধারে আন্দোলন হয়েছিল বেগবান সেই প্রতিভাবান তরুণ চলে গেল। দায় চাপানো হল তার মুক্তচিন্তার লেখার ঘাড়ে। অথচ কত আগে তিনি সেসব প্রবন্ধ লিখেছিলেন তখন ধর্ম কোথায় ছিল, ছিল কোথায় তাদের জিহাদ? আমার মনে খটকা লাগে তবে কি ধর্মের চেয়ে দল বড়? এরপর নাস্তিক আখ্যা দিয়ে আর অনেককে পৃথিবী থেকে বিদায় দিল জিহাদিরা। সৃষ্টিকর্তার কিছু শাস্তির ভার তাদের হাতে তুলে নিয়েছেন দুর্বল বলে? যাদের জন্য সেদিন হাজার হাজার নারী-শিশু-পরুষ বেচে থাকার অধিকার হারিয়েছিল আজ কত তরুণ তাদের জন্যই নিশ্চিত মৃত্যুর জীবন বেছে নিচ্ছে। কই তারা তো তাদের জীবন উপভোগ না করে জিহাদ করেনি, তাদের সন্তানদের এপথে শিক্ষা দেননি। তাদের বেশির ভাগ আবার ইউরোপ-আমেরিকান লাইফ লিড করে। তবে কেন আমরা? কেন আমাদের ভাই? বাঙালী বড়ই হুজুগ-প্রাণ জাতী। বোধহয় হোক সত্যের, যুক্তি-ভালবাসা করুক হৃদয় আলোকিত। আজ লৌহদণ্ডের সাথে পা ঝুলিয়ে হাসপাতালের বিছানায় তীব্র গন্ধে শুয়ে আছি শুরু যুদ্ধাপরাধীর বিচার চেয়েছি বলে? তবে জিহাদ কি শুধু সগোত্রের লোক বাঁচানো জন্য মানুষ হত্যা করা আর ধর্মই কি পৃথিবীতে সবচেয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রের নাম? কিছু মনে করবেন না যদি এতে আপনার বিশ্বাসে আঘাত লাগে। তিনি সৌজন্য সূচক না না ঠিক আছে বললেন।তোমার তো কোন দোষ নেই। বাস্তব থেকে যা শিখেছ তাই বলেছ, জানতে চেয়েছ বুঝতে চেয়েছ। দোষ তাদের যারা বুজাতে পারেনি। হাসিব সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।
২| ১২ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:৩৯
নাইম আকন বলেছেন: ধন্যবাদ।
পলাশ তালুকদার
©somewhere in net ltd.
১|
১১ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৩
Palash Talukder বলেছেন: দারুন...