![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রবি বাবুর ভাল নাম রবীন্দ্রনাথ দাস। পেশায় স্কুল টিচার ছিলেন, অবসর নিয়েছেন তা প্রায় বারো বছর হল। এখন সংসারের পরিত্যক্ত বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু মাঝে মাঝেই এই পরিত্যক্ত বস্তু ভীষণ দরকারি হয়ে পড়ে, এই যেমন বাজার করার সময়, নাতি কে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসা করার সময় ওনার বড্ড কদর, কিন্তু পরিবারের কোন সুবিধা অসুবিধায় ওনার মতামত নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। স্ত্রী বিগত হয়েছে বছর আস্টেক হল। অবশ্য স্ত্রী বেঁচে থাকতেও সংসারে উনি খুব বেশি সুবিধা করতে পারতেন না। জীবনের প্রথম অংশে বাবার শাসন, তারপর বউ আর শেষে এসে ছেলের বউ আর ছেলেদের শাসনেই উনি ওঠা বসা করেন। মন যে মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করে ওঠে না, তা নয়। কিন্তু অতি অল্প বয়স থেকেই তিনি সকলের শাসন আর হুকুমের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে আসছেন। বিদ্রোহ ওনার মনে থাকলেও রক্তে নাই।
রবি বাবুর বড় ছেলে ব্যাঙ্কে চাকরি করে, আর ছোট ছেলে তিন তিন বার এইচএসসি ফেল করে শিক্ষার অব্যবস্থাপনা নিয়ে এখন সে ব্যাপক সোচ্চার। এই দেশ যে ভাল ছাত্রের মূল্যায়ন করতে পারে না, তা সে চা এর আড্ডায়, তাস খেলার আসরে অহরহর প্রমাণ করছে।
রবি-বাবুর মতো সাহিত্যিক না হলেও রবি-বাবুর মতই স্ত্রী বৎসল হিসেবে ইতিমধ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে রবি-বাবুর বড় ছেলে সুবীর বাবু। রবি-বাবুর মতন তিনিও ভেজা বেড়াল প্রকৃতির। স্ত্রীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ওনার মুখ হাঁ হয় ঠিকই, কিন্তু তা থেকে আওয়াজ খুব বেশি একটা বের হয় না। কিন্তু সুবীর বাবুর স্ত্রী স্বামীর ভাগের কথাটাও নিজের মুখে বলে যেন স্বামীর কথাবলার কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করেন। খাবার টেবিলে প্রতিদিনই রবি-বাবুর বউমা দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে প্রলাপ করে শোনান তার অবসর প্রাপ্ত শ্বশুর আর বেকার দেওরকে। রবি-বাবু খুব ভালই বোঝেন যে ওনার ছোট ছেলে আবীরের এইসব কথা কর্ণ গহ্বরে প্রবেশ করেনা। কিন্তু রবি-বাবুর মনে হয় যেন ভাত মাছ না, এক গোছা কাগজের টাকা মুখে পুড়ছেন।
রবি-বাবুর লাইফ লাইন হল ওনার প্রভিডেন্ট ফান্ডের জমানো টাকা। যার ইন্টারেস্ট থেকে উনি নিজের খরচ আর ছোট ছেলের হাত খরচ দেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে ঘরের চাল সারানো, বাড়িতে রঙ করা, নাতির ইংরেজি স্কুলের বড় অঙ্কের ভর্তি ফী দিতে হয়েছে ওনাকে। স্ত্রীর প্ররোচনায় ওনার বড় ছেলে যখন ওনার কাছে ধার চেতে এসেছিলো, সেই ধার যে বাবা-মা এর আর সব ঋণের মতই অপরিশোধ্যই থেকে যাবে, তা জানা সত্ত্বেও উনি বরাবরের মতই না করতে পারেননি। উনি বোধ করছিলেন, আস্তে আস্তে ওনার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা যতই কমে আসছে, ওনার আয়ুও যেন সেই তালে কমে আসছে। আপনজন বিহীন অথবা আপনজনের আপনত্ত বিহীন এই ধরা ধামে রবি-বাবুর প্রাণ পাখি যেন রূপকথার দৈত্যের প্রাণের মতই অন্য কোথাও গচ্ছিত।
ইদানীং মৃত্যু ভয় ওনাকে চেপে ধরেছে। বাহাত্তর বছর বয়সেও ওনার বেঁচে থাকার অসীম আকাঙ্ক্ষা। ওনার জীবনে কোন বৈচিত্র্য নাই, কখনও ছিলও না। কিন্তু তবুও কি যেন একটা এখনও করা হয়নি, কি যেন একটা এখনও পাওয়া বাকি থেকে গেছে। আর সেই না পাওয়াটা কে উনি কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারছেন না। একে একে পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে ওনার সমবয়সী সকলেই। স্কুলের পেছনের বেঞ্চে বসা খারাপ ছাত্ররা যেমন পরীক্ষার খাতা দেখানোর সময় আতঙ্কিত হয়ে বসে থাকে আর ভাবে যে এই বুঝি এখন তার নাম ডেকে তাকে তার ফেলের সংবাদ দেওয়া হবে, তেমনি রবি-বাবুও আতঙ্কিত হন এই ভেবে যে এই বুঝি মৃত্যুর সিরিয়ালে তাঁরও নাম উঠে আসলো।
অল্প বয়সে রবি-বাবু কখনই এতটা গো বেচারা ছিলেন না। স্কুল কলেজে বন্ধু মহলে রীতিমত নেতা ছিলেন। গলা ছেরে গান গাইতেন, আবৃতি করতেন এমন কি ইউনিভার্সিটি জীবনে মিটিং মিছিলও করেছেন। মার্কস বাদকে উনি মনে প্রাণে ধারণ করতেন। ইতিহাসের ছাত্র হলেও সাহিত্য ওনার মনে প্রাণে ছিল। সেক্স-পেয়ার যেমন তাঁকে সাহিত্যে অনুপ্রাণিত করত ঠিক তেমনি আগাথা ক্রিস্টি, জুলভারন করত রোমাঞ্চিত। লেখালিখি করে আর ভ্রমণ করেন জীবন কাটাতে চাইতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই হাতে নিয়ে বইয়ের ওপরে লেখা কবির নামের ঠাকুরের অংশটা কে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঢেকে রাখতেন আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে রবীন্দ্রনাথ দাস কল্পনা করতেন।
ওনার লেখা গল্প কবিতার সবথেকে বড় পাঠক ছিলেন ওনার সবথেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আফজাল। শুধু পাঠকই নয়, সবথেকে বড় উৎসাহ দাতাও বটে। ছোট গল্প আর কবিতাতেই বেশি আগ্রহ ছিল ওনার। কলেজে থাকতে কলেজের বার্ষিকীতেও ছাপা হয়েছিল ওনার এক ছোট গল্প। ইউনিভার্সিটিতে থাকতেও বিভিন্ন সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকায় আসতো ওনার গল্প কবিতা। সে সব ম্যাগাজিনের দুই এক কপি এখনও খুঁজলে পাওয়া যাবে। মাঝে মাঝে পুরাতন কাগজ-পাতি ঘাঁটতে লাগলে ওনার গল্পের একটা দুটা বিচ্ছিন্ন পাতা বা কখন কখন উইয়ে কাটা কবিতার টুকরাও পাওয়া যায়। সেই সময় রবি-বাবু খুব ভাবুক হয়ে যান। আবার নতুন করে শুরু করার ইচ্ছা জাগে মনে, কিন্তু আগের মত সেই চিন্তা শক্তি বা সৃজনশীলতা কোনটাই আর খুঁজে পান না। আর তাছাড়া কিই বা হবে এসব লিখে, ওনার সাথে সাথে ওনার লেখা গুলারও গঙ্গা প্রাপ্তি হবে।
ওনার স্বপ্ন ভঙ্গ হল তখন, যখন অনার্স পরীক্ষার পর ওনার জাঁদরেল বাবার এক খানা চিঠি হাতে পেলেন। জরুরী তলবে বাড়িতে যেয়ে দেখলেন যে ওনার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। মেয়ে নাইন ফেল, যদিও ওনার বাবার মতে মেয়ে যথেষ্ট শিক্ষিত। মেয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা, রূপের প্রশংসা আর মেয়ের বাপের জমির খতেন ছাড়া রবি-বাবু মেয়ের ব্যাপারে খুব বেশি কিছু একটা জানতে পারলেন না। অসহায় রবি-বাবু একবার পালানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন, কিন্তু ওনার ভিতু মন বাবার কথা মনে করে আরও ভিতু হয়ে গেল। ওনার বাবার এক অদৃশ্য হাত সব সময়ই যেন ওনার টুটি চেপে ধরে রাখত। রবি-বাবুর কবি আর পর্যটক হওয়ার স্বপ্নে প্রথম আঘাতটা কোনমতে সয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় আঘাত এসে পরল তখন, যখন উনি জানতে পারলেন যে ওনার জন্য প্রাইমারী স্কুলে একটা চাকরি ঠিক করা হয়েছে। এইবার রবি-বাবু আকাশ থেকে পরলেন, জীবনের প্রথম বাবার কথার প্রত্যুত্তর করলেন। উনি নিজের স্বপ্নের কথা বাবাকে না বলতে পারলেও আর উচ্চ শিক্ষার বাসনার কথা বাবার সামনে উপস্থাপন করলেন। তার বিনিময়ে ওনার বাবা উচ্চশিক্ষার অপ্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যে লেকচারটা দিলেন, তার মোহে রবি-বাবু কয়েক সেকেণ্টের জন্য জেন মেনেই নিলেন যে ওনার পড়ালেখা করা বড় অন্যায় হয়ে গেছে। মোহ কাটার পর ওনার আর সাহস হল না কিছু বলার। বিয়ার পরেও যদি ওনার বাবা ওনাকে দুচার ঘা বেতের বাড়ি বসিয়ে দেন, তাহলেও খুব একটা অবাক হবেন না তিনি।
জীবন সব সময়ই গতিশীল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই গতি থামবার নয়। মন মানুষকে যে পথেই ধাবিত করুক না কেন, সময় মানুষকে যেখানে এনে ফেলবে মন কেও সুর সুর করে সেই পথেই আসতে হয়। রবি-বাবুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। তিনি তার স্বপ্ন কে সামান্য পরিবর্তিত পরিমার্জিত করে নিলেন। ভ্রমণের ইচ্ছা পরিত্যাগ করে স্কুলের চাকরি আর লেখালিখিতে মননিবেশ করবেন বলে ঠিক করলেন। নতুন নতুন কবিতা আর গল্প লিখে ওনার স্ত্রীকে শোনাতে লাগলেন। কিন্তু ওনার স্ত্রী গল্প শুনার আগ্রহ প্রকাশ করলেও অর্ধেক গল্প হতে না হতেই ঘুমিয়ে পরতেন, আর কবিতা শোনাতে বসলেই কবিতার দুই লাইন পার হতে না হতেই ঘড়ে নুন নাই তেল নাই বা চুলায় দুধ তুলে দেওয়ার কথা মনে পরে যেত। রবি-বাবু জখন বই পরতে দিলেন, তখন আবিষ্কার করলেন যে ওনার বাবা নিতান্তই সত্য কথা বলেছিলেন। মেয়ে আসলেই উচ্চশিক্ষিত, তা না হলে পড়াশুনার এই অবস্থা নিয়ে ক্লাস নাইন পর্যন্তই বা আসলো কিভাবে?
বছর দেড়েকের মাথায় রবি-বাবু পিতৃ হারা হলেন। মা যখন গত হয়েছিলেন রবি-বাবু তখন নিতান্তই ছেলে মানুষ। মেজাজি বাবার অনুপস্থিতিতে রবি-বাবু যখন বাড়ির কর্তার ভূমিকা নিতে গেলেন, তখন আবিষ্কার করলেন যে সে বস্তু আগেই হাত ছাড়া হয়ে গেছে। ওনার নরম সরম স্ত্রী এখন বেশ গরম। দোষ আসলে রবি-বাবুর নিজেরই। দাঁড়িপাল্লার একপাশ যত নিচুতে নামে, অপর পাশ ঠিক ততই উঁচু হয়। সংসারের হাল ধরেই রবি-বাবুর স্ত্রী রবি-বাবুর মধ্যবিত্ত সংসারকে উচ্চবিত্ত করার ঘোষণা দিলেন। সেই ঘোষণা অনুযায়ী অবশ্য অধিক পরিশ্রমটা রবি-বাবুকেই করতে হল। স্কুল শেষে ছাত্রদের কোচিং দিতে শুরু করলেন আর সন্ধ্যার পর স্ত্রীর নানান অভিযোগ আর ফাইফরমাশের কারণে লেখালিখির অভ্যাস প্রায় উঠেই গেল।
রবি-বাবুর চরিত্র সঠিক ভাবে বর্ণনা করতে গেলে বলতে হয় রবি-বাবু তরল পদার্থ স্বরূপ। যে পাত্রেই যায়, তারই আকার ধারণ করে। শিক্ষিত সমাজে যেয়ে তিনি যেমন সংস্কৃতি মনা হয়েছিলেন, অর্ধ শিক্ষিত স্ত্রীয়ের সংস্পর্শে উনি এখন পাকা গেরস্ত। তাইবলে যে সাহিত্যের বাইরে থেকে উনি খুব ভাল আছেন, তা কিন্তু নয়। আসলে লেখা লিখির জন্য যে পরিবেশ বা মানসিকতা প্রয়োজন, তার বিস্তর অভাব ছিল রবি-বাবুর আশেপাশে। সারাদিন কাজ শেষে যখন ঘুমাতে যেতেন, তখন বুকটা কেঁপে উঠত ওনার। বিবেক যখন বিগত দিন গুলার হিসাব চাইত, রবি-বাবু সামনে শুধু একটা শূনই দেখতে পেতেন।
একে একে দিন মাস বছর গুলা যে কোন দিক দিয়ে পার হয়ে গেল, রবি-বাবু তা বুঝতেই পারলেন না। কোনদিন দুই ছেলের বাবা হলেন আর কোনদিনই বা তারা বড়ও হয়ে গেল তার কোন কিছুরই হিসেব ওনার কাছে নেই। হঠাৎ একদিন দেখলেন ওনার চুল গুলোয় পাক ধরেছে আর এখন তো কালো চুল খুঁজে পাওয়াই ভার। ইতিহাস বলে, যে অভিভাবকদের চোখ রাঙানী আর সমাজের মুখ ভেঙানির কারণে বাঙ্গালীরা প্রথা ভেঙে নতুন পথে কখনই হাঁটতে পারেনি। রবি-বাবু সেটা আবারও প্রমাণ করলেন।
রবি-বাবুর লেখালিখির অভ্যাস চলে গেলেও রিটার্টমেন্টের পর পড়াশুনার অভ্যাসটা আবার শুরু করেছেন। অবসর কাটানোর জন্য বইয়ের চেয়ে ভাল আর কিছু ভাল হতেই পারে না। আর এই কারণেই ইদানীং বইয়ের দোকানে ওনার আনাগোনা এখন বেশ বেড়েছে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস এসবেই ওনার আগ্রহ বেশি। অন্য দিনের মত আজও তিনি বইয়ের দোকানে গেছিলেন। দোকানদার ছেলেটা রবি-বাবুরই এক সময়ের ছাত্র, নতুন বই এলেই রবি-বাবুর জন্য রেখে দেন আর রবি-বাবু সেই বই নিলে ওনার জন্য ভালো কমিশনও দেয়। আজ নতুন যে বইটা দোকানী রবি-বাবুর হাতে তুলে দিল সেই বইয়ের লেখক কে কেমন জানি চেনা চেনা ঠেকল রবি-বাবুর। বইটা একটা কবিতার। সেই বইয়ের সব কিছুই রবি-বাবুকে ক্যামন জানি আকৃষ্ট করল। উনি বইটা কিনে ফেললেন। বাড়িতে এসে বইটা উল্টো পাল্টা করতে যেয়ে কবিতা গুলাও ক্যামন জানি চেনা চেনা লাগলো ওনার, অথচ বইটা নতুন। খুব চিন্তায় পরে গেলেন উনি। লেখক পরিচিতিতে লেখকের জন্ম মৃত্যু আর কর্ম জীবন ছাড়া আর কিছুই তেমন দেওয়া নাই। উনি আরও লক্ষ্য করলেন যে লেখকের মৃত্যু হয়েছে বছর চারেক আগে, অথচ বইটা ছাপা হয়েছে মাত্র ছয় মাস হচ্ছে। এতে অবশ্য কিছুই প্রমাণ হয় না। লেখকের অপ্রকাশিত সৃষ্টি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশ হতেই পারে। হঠাৎ রবি-বাবুর বুকটা কেঁপে উঠলো, ওনার সৃতির কোন এক পরিত্যক্ত কক্ষের দরজা ভেঙ্গে হঠাৎই বেরিয়ে এলো একসময়ের খুব আপন একটা নাম, “আফজাল হসেইন”। একসময় যার সাথে রবি-বাবুর সারাটা দিন কাটতো, আজ তাকেই ভুলতে বসে ছিলেন তিনি। তাহলে ওনার বন্ধু আফজাল আর লেখক আফজালের মধ্যে কি কোন সম্পর্ক আছে? দুইজনের জন্ম তারিখও তো একই মনে হচ্ছে। আফজাল হসেইন এর সাথে রবি-বাবুর যোগাযোগ নাই প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল। ওনার হঠাৎ বিয়ার পর মাত্র একবার দেখা হয়েছিল। রবি-বাবু কবি আর ওনার বন্ধুর মধ্যে যখন সম্পর্ক খুঁজছিলেন তখন কবিতা গুলাও ক্যামন জানি ওনার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। উনি কোনোমতে ওনার জায়গা থেকে উঠে পুরাতন কাগজে ঠাসা ট্রাঙ্কটা খুললেন। কাগজের ধূলা উড়িয়ে আর ট্রাঙ্কে বসবাসকারী তেলাপোকা তারিয়ে উনি একটা খাতা বের করলেন। তারপর উনি যেটা আবিষ্কার করলেন, তা দেখে ওনার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগার। ধপ করে বসে পরলেন মাটিতে। বইয়ে ছাপা প্রায় সব কবিতাই ওনার ইউনিভার্সিটি জীবনে লেখা ওই খাতার কবিতার একেবারে হুবহু, আর যে সব কবিতা ওনার এই খাতায় ছিলনা, তা অন্য খাতা ঘাঁটাঘাঁটি করলে যে পাওয়া যাবে, সে বিসয়ে রবি-বাবুর কোন সন্দেহ নাই।
রবি-বাবু কি করবেন কিছুই বুঝতে পারলেন না। চোখ বন্ধ করে ওনার আরাম কেদারায় বসে সব কিছুর জট ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন। ওনার ভেতরে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া হতে লাগলো। যে ভাবেই হোক, ওনার সৃষ্টি যে একটা বইয়ের মলাটে আবদ্ধ হয়েছে ,তাতে তিনি বেজায় খুশি। দোকানী ছেলেটা বলছিল, বইটা নাকি ভীষণ বিক্রি হচ্ছে। ইতিমধ্যে নাকি দ্বিতীয় সংস্করণ বের হতে যাচ্ছে। অপর দিকে তাঁর প্রিয় বন্ধুর প্রতারণার গন্ধও পাচ্ছেন। রবি-বাবুর মনে লেখকের ওই মৃত্যু আর বই প্রকাশের সময়ের ব্যবধানটা বেশি চিন্তিত করছে। আফজালের কাছে যে রবি-বাবুর লেখা গল্প কবিতার একটা কপি ছিল তা ওনার এখন ভালই মনে পরছে। আসলে রবি-বাবুর হাতের লেখা মোটেও ভাল ছিল না, অপর দিকে আফজালের লেখায় যেন মুক্ত ঝরত। রবি-বাবু নতুন কিছু লিখলেই তার প্রথম পাঠক হত আফজাল। আর সেই লেখা বিভিন্ন পত্রিকা তে দেওয়ার আগে আফজাল তার ফ্রেস কপি করে দিত নিজের হাতে। আসলে কপি হত দুটা। একটা কাগজে আর অন্যটা রবি-বাবুরই এক ডায়রিতে, যেটা আফজালের কাছেই থাকতো। সেই ডায়রি আফজালের কাছ থেকে আর ফেরত নেননি তিনি। গত পঞ্চাশ বছরে সে ডায়রির কথা মনেও পরেনি। রবি-বাবু বইটা আবার হাতে নিলেন এবং প্রকাশনা সংস্থার নাম ঠিকানা ভাল ভাবে দেখে নিলেন। পরদিনই ঢাকা যাবেন বলে মনস্থির করলেন।
ঢাকায় দীর্ঘদিন আসা হয়নি রবি-বাবুর। অনেক কিছুই আর আগের মত নেই। তারপরেও ওনার গন্তব্যে পৌঁছতে খুব বেশি একটা কষ্ট হল না। প্রকাশনা অফিসে যেয়ে কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিলেন উনি। সরাসরি আসল কথা না বলে, প্রকাশক কে বললেন যে-
“লেখক আমার খুব ভাল বন্ধু ছিলেন, কিন্তু দীর্ঘদিন ওনার সাথে আমার কোন যোগাযোগ নাই। ওনার বই আমার খুব ভাল লেগেছে। কিন্তু, ওনার লেখা ওনার মৃত্যুর পর কেন ছাপা হল”?
প্রকাশক জানালেন- “লেখক আফজাল হোসেনের মৃত্যু হয় তিন বছর আগে। উনি সরকারের অনেক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন, কিন্তু অবসরের পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন। ওনার মৃত্যুর পর ওনার এক মাত্র প্রবাসী ছেলে দেশে ফিরে বাবার পুরাতন কাগজপত্র ঘেঁটে কয়েকটা ডায়রির সন্ধান পায়। ছেলে আগে থেকেই নাকি জানত, ওনার বাবার সাহিত্যে আগ্রহ আছে, কিন্তু লেখা-লিখি যে করতেন সে ব্যাপারে ওনার জানা ছিল না। ছেলে লেখা গুলো আমার কাছে আনেন, উনি বই ছাপানর জন্য টাকাও দিতে চেয়েছিল, কিন্তু লেখা গুলো আমার বেশ ভাল লাগে, ফলে প্রকাশের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমরাই নেই। বইটা ইতিমধ্যে বেশ সারা ফেলেছে। ওনার ছোট গল্প নিয়ে খুব সিগই আরও একটা বই প্রকাশ করতে যাচ্ছি”।
রবি-বাবুর বলার আর কিছুই ছিল না। লেখাগুলা নিজের বলে দাবি করা সম্ভব না, কারণ ওনার কাছে তার কোন প্রমাণ নেই। আসলে রবি-বাবু মনে মনে লেখা গুলা নিজের বলে দাবি করার কোন তাগিদও অনুভব করলেন না, বরং মৃত বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করলেন। কারণ, যেভাবেই হোক না কেন। ওনার লেখা বই হিসেবে স্বীকৃতি তো পেয়েছে। ওনাকে আর বিবেকের কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। আফজাল বলত যে- “রবি, দেখিস তোর বই একদিন সত্যিই বের হবে”। বন্ধুর কথা সত্যি হল। নাই বা থাকল বইয়ে তার নাম। ধন্যবাদ বন্ধু, তোর মৃত্যু আমার মৃত স্বপ্নকে আবার জীবন ফিরিয়ে দিল।
প্রতীক সরকার
07/08/13
©somewhere in net ltd.