নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রতীক সরকার

প্রতীক সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

***শেষ স্মৃতি***

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৯:৫৯

গলিটা পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠেই ছাতাটা খুললেন যোগেন বাবু। আজ রোদটা বেশ চড়েছে, এই কার্তিক মাসে কখন রোদ ওঠে আর কখন যে বৃষ্টি পরে তার কোন ঠিক নেই। তবে বৃষ্টি হোক রোদ হোক আর শরত কালের স্নিগ্ধ আবহাওয়াই হোক না কেন, ছাতা যোগেন বাবুর সব সময়ের সঙ্গী।

বড় রাস্তায় পাশের এক মুদির দোকানে ঢুকলেন যোগেন বাবু। দোকানীকে এক পোয়া আতপ চাল আর একটা ডিম দিতে বললেন। ছাত্রের বাড়িতে আজ পোলাও এর গন্ধটা বেশ ছড়েছিল। এই বয়সে এই সব পোলাও মাংসের লোভ করা খুব একটা ভাল কথা নয়। কিন্তু আজ যেন আর কিছুতেই লোভ সম্বরণ করতে পারছিলেন না তিনি। ছাত্রকে উনি সাধারণত দুই ঘণ্টা পড়ান, কিন্তু আজ আরও এক ঘণ্টা বেশি পড়ালেন এই লোভে, যদি ছাত্রের মা তাকে দুপুরের খাওয়াটা খেয়ে যেতে বলেন। কিন্তু সাড়ে বারটার দিকে যখন ছাত্রের মা প্লেটে দুটা টোষ্ট আর এক কাপ র-চা এনে দিলেন, যোগেন বাবু তখন হতাশ মনে সেই চা আর টোষ্ট খেয়েই ছাত্র কে ছুটি দিয়ে বিদায় নিলেন। অবশ্য মনে মনে তখনই ঠিক করে ফেললেন। আজ তিনি বাড়িতে পোলাও খাবেন আর মাংসের বদলে থাকবে হাঁসের ডিমের দু-পেয়াজি।



“আদাব মাস্টার মশাই, হেঃ হেঃ...। কেমন আছেন? চিনি আর ডিম কিনলেন নাকি?”

চালের আড়তদার মন্সুর মিয়াঁর কথায় থামলেন যোগেন বাবু। মন্সুর মিয়াঁ ওনার এক পুরাতন ছাত্রের বাবা।

“আদাব আদাব...। চিনি না, চাল কিনলাম। পোলাওয়ের চাল”। বললেন যোগেন বাবু।

চালের কথা শুনে মন্সুর মিয়াঁ বেশ অবাক হলেন। বললেন-

“পোলাওয়ের চাল...। এতোটুকু চাল দিয়ে কি করবেন? আমাকে বললেই তো আমি আপনার বাড়িতে পাঁচ কেজি ভালো চিনিগুড়া চাল পাঠিয়ে দিতাম”

লজ্জিত হলেন যোগেন বাবু। লজ্জাটা কে আড়াল করার জন্য মৃদু একটু হেঁসে বললেন-

“আমি একা মানুষ... এইই আমার জন্য অনেক।”

“বেশ বেশ...। আপনি তাহলে পোলাও ও রান্না করতে পারেন। হেঃ হেঃ... খুব ভাল।”

এই সেরেছে। পোলাও রান্না উনি মোটেও জানেন না। এই ব্যাপারটা তো তিনি একদমই খেয়াল করেননি। পোলাওয়ের গন্ধে তিনি এতো মশগুল ছিলেন যে এসব কথা মাথাতেই আসেনি।

“আচ্ছা মাস্টার মশাই, আজ আসি। আদাব।”

মন্সুর মিয়াঁ ফিরে যেতেই ডাক দিলেন যোগেন বাবু। উনি আবার ফিরে তাকাতেই যোগেন বাবু বললেন-

“আচ্ছা, পোলাও রান্না করে কি ভাবে বলতে পারেন?”

মন্সুর সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন-

“এই সেরেছে। মাস্টার মশাই আমি চাল বিক্রি করি ঠিকই, কিন্তু এই বস্তু দিয়ে মেয়ে মানুষরা এতো কিসিমের জিনিশ যে কি ভাবে বানায় সে খবর আমি একদমই রাখি না।”

যোগেন বাবু বুঝতে পারলের তিনি খুব বোকার মত প্রশ্ন করে ফেলেছেন। নাহ, এমন প্রশ্ন করা ওনার একদম উচিত হয়নি। চাল বিক্রি করে বলে যে চালের রন্ধন প্রণালিও জানবেন এমনটা ভাবার আসলেই কোন যুক্তি নাই। মন্সুর মিয়াঁ বুঝতে পারলেন যোগেন বাবু অপ্রস্তুত ভাবটা। তিনি বিষয়টা কে স্বাভাবিক করার জন্য বললেন-

“তা মাস্টার মশাই, আজ কিন্তু আমার বসায় পোলাও রান্না হচ্ছে। সাথে মুরগী আর ইলিশ মাছও আছে। আপনি এক কাজ করুন, আমার বসায় চলুন। দুপুরে ওখানেই খাবেন। আপনার বৌমা কিন্তু খুব খুশি হবে”

হঠাৎ এমন প্রস্তাব পেয়ে যোগেন বাবু এবার লজ্জায় পরে গেলেন। লোভ যে একেবারেই হচ্ছিল না তা নয়। কিন্তু তিনি মোটেও হ্যাংলা নন। আত্মসম্মানের বোধ যথেষ্ট আছে ওনার। ভদ্রতার খাতিরেই হোক আর আত্মসম্মান বোধের কারণেই হোক, তিনি মন্সুর মিয়াঁর প্রস্তাবে না করে দিলেন। মন্সুর মিয়াঁও খুব বেশি পিড়াপিড়ি করলেন না। সালাম দিয়ে চলে গেলেন। আসলে অসহায় মানুষকে সকলেই দয়া দেখাতে চায়। করুণা যোগেন বাবু মোটেও পছন্দ করেন না। এই করুণা তিনি নিজের ছেলের কাছ থেকেও নেননি।

যোগেন বাবুর ছেলে শান্তনু আমেরিকায় থাকে, ঠিক মত খোঁজ খবরও নেয় না। অথচ নিজের বাড়ির ভিটা বেঁচে তিনি ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। ছেলে সেখানেই এক বিদেশিনী কে বিয়ে করেছে। যার খবর তিনি অনেক পরে পান। যোগেন বাবুর স্ত্রী মারা যাওয়ার পরও ছেলে তার মা কে একবারটি দেখতে আসেনি। মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে ছেলে তার দায়িত্ব পালন করত। কিন্তু স্ত্রী মারা যাবার পর খুব অভিমান হয় যোগেন বাবুর। ছেলের দয়ার টাকা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। বার কয়েক ফেরত আসার পর ছেলে টাকা পাঠান বন্ধ করে দেয়। প্রায় চার বছর হতে চলল ছেলের সাথে কোন রকম যোগাযোগ নাই ওনার। মাঝে মাঝে দুঃখ হয় বটে, কিন্তু যোগেন বাবু সেসবের পরোয়া করেন না। ছাত্র পড়িয়েই শেষ জীবনটা কাটাতে চান তিনি।

“নমস্কার মাস্টার মশাই। ভালো আছেন?”

যোগেন বাবু অন্যমনস্ক ছিলেন। হঠাৎ সম্মান সূচক সম্বোধনে থমকে দাঁড়ালেন। সামনে হাত জোর করে দাড়িয়ে থাকা ব্যাক্তি টিকে চেনেন তিনি। কিন্তু এই মুহূর্তে নাম মনে করতে পারলেন না। এমন ওনার সাথে প্রায় হয়। সারা জীবনে তো আর কম ছাত্র পড়াননি। তার পরেও অনেক পুরনো ছাত্রদের নাম মনে রাখার খ্যাতি ছিল ওনার। কিন্তু এখন আর কিছুই মনে থাকে না। মাইনাস পাওয়ারের চশ্মার ওপর দিয়ে তাকিয়ে নাম মনে করার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করলেন তিনি।

“চিনতে পারছেন মাস্টার মশাই? আমি জয়ন্ত।”

“জয়ন্ত...। মানে শফিকদের ব্যাচের জয়ন্ত?” প্রশ্ন করলেন যোগেন বাবু।

“না মাস্টার মশাই। আমি শফিকদের দুই ব্যাচ সিনিয়র ছিলাম। সানোয়ারদের ব্যাচের। ক্যামন আছেন আপনি? অনেক দিন পর দেখলাম আপনাকে!”

“আছি, ভালো।” মৃদু সরে উত্তর দিলেন যোগেন বাবু।

জয়ন্তকে চিনতে না পারার জন্য যোগেন বাবুর খুব একটা আপসোস হল না। কারণ স্কুলে জয়ন্ত মোটেও ভালো ছেলে ছিল না। ক্লাসে ভীষণ জালাতন করত। রোল নাম্বার ছিল একেবারে পেছনের দিকে। জয়ন্ত হয়তো আরও কিছু বলত, কিন্তু যোগেন বাবু আর আগ্রহ না দেখিয়ে এগিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু মনের ভুলেই হোক আর খামখেয়ালির বসেই হোক, তিনি আবারো সেই একই পাগলামো করে বসলেন। জয়ন্তকে জিজ্ঞেস করলেন-

“আচ্ছা তুমি পোলাও রান্না করতে পার?”

জয়ন্ত এখন একটা বেশ ভালো চাকরি করছে। বেতনও বেশ ভালই পায়। অনেক দিন পর স্কুলের মাস্টার মশাইকে পেয়ে নিজের অবস্থা আর প্রতিষ্ঠা তুলে ধরবে বলে মনেমনে ভাবছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে বিষম খচ্ছিল আর একটু হলে। কোনোমতে সামলে নিয়ে বড় বড় চোখে অবিশ্বাসের সুরে বলল-

“মাস্টার মশাই, পোলাও......?”

“হ্যাঁ, পারো?”

“না...। মানে পোলাও তো রাঁধতে পারিনা। তবে শুনেছি ভুনা খিচুড়ি আর পোলাও রান্না প্রায় একই রকম। পোলাওয়ে শুধু ওই ডালটা দিতে হয় না।”



পাগলামি যে একটা ছোঁয়াচে রোগ সেটা জয়ন্তর জানা ছিল না। কিন্তু আজ হাতে নাতে প্রমাণ পেল সে। তা না হলে এমন উদ্ভট প্রশ্নের এমন উদ্ভট জবাব তো তার দেওয়ার কথা ছিল না। প্রশ্নের উত্তরটা যে মাস্টার মশাইয়ের পছন্দ হোল না তা মাস্টার মশাইয়ের মুখে বিরক্তি ভাব দেখেই বোঝা গেল। হঠাৎ জয়ন্ত একটা বিষয় লক্ষ্য করল। মাস্টার মশাইয়ের হাতে নতুন ছাতা। সে বেশ অবাকই হল। যোগেন বাবুর ছাতার বাতিকের কথা কে না জানে। জয়ন্ত তার দশ বছরের স্কুল জীবনে কখনও ওনাকে অন্য ছাতা ব্যাবহার করতে দেখেনি। জয়ন্তের বড় দাদারা জখন স্কুলে পড়ত, উনি নাকি তারও আগ থেকে ওনার ছাতা ব্যাবহার করেন। সেই ছাতায় যে কত তালি আর সেলাই তা গুনে শেষ করা যাবে না। উনি ওনার ছাতা কখনও হাতছাড়া করতেন না। জয়ন্ত প্রশ্ন করে বসল-

“মাস্টার মশাই নতুন ছাতা কিনলেন তাহলে। খুব ভালো...।”

জয়ন্তের পোলাওয়ের রেসিপি শুনে যোগেন বাবুর এমনিতেই মেজাজ গরম হয়ে গেছিল। তার ওপর ওনার পৈত্রিক ছাতা নিয়ে মস্করা করায় উনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।

“কেন হে, ছাতা কিনতে যাব কেন? একশ বছরের পুরনো ছাতা, যত্ন করলে আরও......।”

মুখ দিয়ে আর কথা সরল না যোগেন বাবুর। একি দেখছেন তিনি! এ কার ছাতা! উনি লক্ষ্য করলেন ওনার সর্বক্ষণের সঙ্গী ওনার ছাতাটা ওনার হাতে নেই। তার বদলে নতুন একটা ছাতা। এ কি করে সম্ভব! তবে কি কোথায় বদল হয়ে গেছে? এমনটা তো কখনই হওয়ার কথা নয়, গত বিয়াল্লিশ বছরে তো এমনটা কখনই হয়নি। যোগেন বাবু চোখে অন্ধকার দেখলেন। ওনার দাদু বাবার হাত বদল হয়ে ছাতাটা এসেছে ওনার হাতে। ইন্ট্রান্স পাশের পর ওনার বাবা নিজ হাতে এই ছাতাটা ওনাকে দিয়েছিলেন। নিজের জীবনধারণ আর ছেলের পড়ার খরচ যোগাতে যেয়ে পৈত্রিক সব কিছু হারিয়েছেন তিনি। ছাতাটাই ওনার বংশের একমাত্র স্মৃতি চিহ্ন বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। আর কিছু ভাবতে পারলেন না তিনি। ছাতাটা বন্ধকরে ঊর্ধ্বশ্বাসে যেদিক থেকে এসেছিলেন, সেই দিকে ফিরে গেলেন। জয়ন্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল আর মনে মনে ভাবতে লাগলো।

“স্যারের মাথাটা একেবারেই গেছে।”



যোগেন বাবু ওনার সর্বোচ্চ শক্তিকে অতিক্রম করে হাঁটতে লাগলেন। ছাতা নিশ্চয়ই ছাত্রর বাড়িতেই বদল হয়েছে। বড় রাস্তা পার করে গলি ভেদ করে ছাত্রের বাসার গেটে পৌঁছে জোরে জোরে করাঘাত করলেন তিনি। দরজা খুলতে এক মিনিটের বেশি লাগেনি। কিন্তু এতেই যোগেন বাবুর ধৈর্যের বাঁধ প্রায় ভেঙ্গে গেল। দরজা খুললেন ওনার ছাত্র দিপুর মা। ভর দুপুরে ডাকাত পরার মত এমন অভদ্রোচিত করাঘাতের ফলে বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি। অপরাধীকে দু কথা শুনিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই দরজা খুলেছিলেন, কিন্তু মাস্টার মশাইকে দেখে থমকে গেলেন। কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। ছাত্রের মায়ের অবাক হয়ে যাওয়া গোল গোল চোখ দেখেই যোগেন বাবু বুঝলেন, দরজার বাড়িটা একটু বেশিই জোরে হয়ে গেছে। একটু লজ্জিত হয়ে বললেন-

“না, মানে...আমি মনে হয় আমার ছাতটা রেখে ভুল করে আপনাদের ছাতাটা নিয়ে গেছি। এইটা নিয়ে আমার ছাতাটা একটু যদি......”

“দাঁড়ান, দেকচি”

কথা শেষ করতে পারলেন না যোগেন বাবু। ছাত্রের মা ছাতাটা ওনার হাত থেকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।

এক মিনিটের মধ্যেই উনি ফিরে এলেন, সাথে দিপু। দিপু বা দিপুর মা, কারো হাতেই ওনার ছাতা দেখতে না পেয়ে এক অজানা আতঙ্কে বুকটা কেঁপে উঠল যোগেন বাবুর। তবে কি.........

“না মাস্টার মশাই, ছাতা তো আমাদের এখানে নেই। আপনি মনেহয় ছাতা আনেনি”

নাহ। এমনটা মোটেও হওয়ার কথা না। ওনার দিব্যি মনে আছে, ঘড় থেকে বের হওয়ার সময় ছাতাটা নিয়েই বের হয়েছিলেন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ছাতা নিতে ভুলে যাবেন এমনটা কখনই সম্ভব না। কারন এই ভুল যে তার কখনই হয়নি। যোগেন বাবু মোবাইল ব্যাবহার করেন না। ঘরথেকে বের হওয়ার সময় ছাতা আর ঘরের চাবি নিয়ে বের হন, আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। যোগেন বাবু ছাত্রের মায়ের কথায় বিশ্বাস করতে পারলেন না।

“না না...। আমি তো বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছাতা নিয়েই বের হয়েছিলাম। আমার ঠিক মনে আছে। আর একটু যদি ভালো করে দেখতেন...”

“আরে বাবা...... আমি ভালো করেই দেখেছি। অন্য কোথাও ফেলে এসেছেন। ভালো করে মনে করে দেখেন...।”

ছাত্রের বদরাগী মায়ের অ-সহিষ্ণু উত্তরে আর কিছু বলার সাহস হল না যোগেন বাবুর। মাথা নিচু করে ফিরে আসলেন। ওনার খুব ইচ্ছা করছিল, মহিলাকে এক ধাক্কা দিয়ে ভেতরে যেয়ে দেখার। কিন্তু ওনার মনে বিপ্লব ঘটে গেলেও শরীর মনের সাথে তাল মেলাতে পারছিল না। দুশ্চিন্তা আর খারাপ কিছুর আশঙ্কায় ওনার মনে তোলপাড় ঘটে যাচ্ছিল। ছাত্রের বাসা থেকে গেলেন সেই মুদি দোকানে, যেখানে তিনি চাল আর ডিম কিনেছিলেন। দোকানী কোনো সদুত্তর দিতে পারল না। দোকানী ওনার হাতে ছাতা দেখেছিল, কিন্তু সেটা নতুনটা না পুরাতনটা তা বলতে পারল না। অবশ্য ছাত্রের বাড়িতেই যেহেতু ছাতা বদল হয়েছে, সেক্ষেত্রে এই মুদীর দোকানে ছাতা বদল হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু যোগেন বাবুর মন আজ কোন যুক্তিই মানতে চাচ্ছে না। ওনার সবথেকে প্রিয় জিনিশ আজ ওনার হাতছাড়া। সম্ভাব্য কোন জায়গাই উনি খোঁজ করতে ছাড়বেন না। আর সেই কারনেই যুক্তি না মেনে খোঁজ করতে চলে গেলেন মন্সুর মিয়াঁর বাসায়। যদি কোন খোঁজ পাওয়া যায়। মন্সুর মিয়াঁর বাসার বাইরের দরজা খোলাই ছিল। একটু ধাক্কা দিতেই হাঁ হয়ে খুলে গেল। ভেতর থেকে পোলাওয়ের গন্ধ আসছে। কিন্তু সে গন্ধে আর কোন মোহ খুঁজে পেলেন না যোগেন বাবু। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে না ঢুকে দরজার পাশের কলিং বেলের সুইচটা তে চাপ দিলেন। কর্কশ একটা শব্দ শোণা গেল। তারপর আবার চাপ দিলেন। পরপর তিনবার। ভেতর থেকে মন্সুর মিয়াঁ নিজেই বেরিয়ে এলেন। দুপুরবেলা, হয়ত খেতে বসেছিলেন। মুখে চোখে বিরক্তির ভাব। ডান হাতটা উঁচু করা। হাতে ভাত লেগে আছে। কিন্তু যোগেন বাবুকে দেখে সেই বিরক্ত যথাসম্ভব লুকিয়ে একটু খুশি হওয়ার ভান করে বললেন-

“আরে মাস্টার মশাই যে...। আসুন আসুন...। এই শুনছ......। দেখ কে এসেছে...। আসুন মাস্টার মশাই, অবশেষে তাহলে এই গরিবের দাওয়াত রাখলেন, হেহ হেহ হেহ...।”

যোগেন বাবু অপ্রস্তুত হলেন।

“না মানে মন্সুর সাহেব, বলছিলাম কি...। আপনি কি আমার হাতে কোন ছাতা দেখেছিলেন?”

মন্সুর মিয়াঁর সব উৎসাহে যোগেন বাবু যেন পানি ঢেলে দিলেন। ইতিমধ্যে মন্সুর মিয়াঁর স্ত্রীও পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দুজনে দুজনের মুখের দিক তাকিয়ে মন্সুর মিয়াঁ বললেন-



“ছাতা!!!”

“আমি আমার ছাতাটা হারিয়ে ফেলেছি। আপনার সাথে জখন দেখা হয়েছিল, তখন আমার হাতে কোন ছাতা দেখেছিলেন?”

মন্সুর মিয়াঁ একটু ভেবে বললেন-

“হুম......। ছাতা তো আপনি মাথায় দিয়েছিলেন।”

“সেটা কি নতুন, না পুরাতন ছিল।”

মন্সুর মিয়াঁ এবার হেঁসে বললেন-

“হে হে... মাস্টার মশাই। আমি যতটুকু লক্ষ্য করেছিলাম। আপনি যে ছাতার জন্য বিখ্যাত, ওটা সে ছাতা ছিলা না।”

ওনার ছাতার জন্য মানুষ যে আড়ালে ওনাকে নিয়ে টিটকিরি করে, যোগেন বাবু সেটা জানতেন। কিন্তু সরাসরি এভাবে কেউ কখনও বলেনি। যোগেন বাবু কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলেন। মন্সুর মিয়াঁ অবশ্য কথাটা ইচ্ছা করেই বলেছিলেন। ভর দুপুরে মুরগীর ঝোল দিয়ে এক গ্রাস পোলাও মুখে তুলতেই কেও যদি বাড়িতে এসে ছাতার কথা বলে, তবে কারই বা মেজাজ ঠিক থাকে।

“যত্তসব আপদ।” কথাটা বলেই ভেতরে চলে গেলেন মন্সুর মিয়াঁ।

ছাতা যে যোগেন বাবু বাসা থেকে নিয়ে বের হয়েছিলেন, এই বিসয়ে ওনার কোন সন্দেহ নেই। নিজের পৈত্রিক বসত বারিটা বেচেই ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিলেন। তারপর একটা পুরাতন বাড়ির দোতালার একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। সকাল বেলা বের হয়ে ঘড়ের দরজায় তালা দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে তারপর ছাতাটা খুলেছিলেন তিনি। সে সময় ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। ছাতা খুলতে যেয়ে ডান হাতের বুড় আঙুলটাতে একটু চোট ও পেয়েছিলেন। একেবারে স্পষ্ট মনে আছে। তাহলে কি সকালে যে ছাত্রের বাসায় পড়াতে গিয়েছিলেন, সেখানে......। হন হন করে হাঁটতে লাগলেন যোগেন বাবু।

ছাত্রের বাসায়, বাজারে আরও যত সম্ভাব্য জায়গা ছিল। গত দুই তিন দিনে যে যে যায়গায় উনি গিয়েছিলেন, কোথায় বাদ দিলেন না। ফলাফল শূন্য। পাওয়া গেল না ছাতার কোন হদিস। নিজেকে সর্বস্বান্ত অনুভব করলেন যোগেন বাবু। মনে হতে লাগল বাঁচার যেন আর কোন কারণই রইল না। ডান হাতটা নিথর হয়ে রইল। এই ডানহাত যে গত বিয়াল্লিশ বছর ধরে শুধু ছাতাই বয়ে নিয়ে বেরিয়েছে। ছাতা ছাড়া হাতটাও যেন নিষ্প্রয়োজন। দুপুর পার করে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরলেন তিনই। কোন রকমে ঘরের তালাটা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। প্রতিদিন ঘরে ঢুকে সযত্নে ছাতাটা দরজার পাশে রাখেন। এ অভ্যাস যে ওনার কত দিনের উনি নিজেও জানেন না। আজই এর ব্যাত্যয় ঘটল। কিন্তু ঘড়ে ঢুকে একবার ওই ছাতা রাখার জায়গাটায় তাকাতে ভুললেন না। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। ছেলের সাথে বিচ্ছেদেও তিনি এত কষ্ট পাননি। শরীরে ক্লান্তি আর অবসন্যতা। বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। বিছানার পাশে রাখা হাতলওয়ালা পুরাতন কাঠের চিয়ারটায় শরীর এলিয়ে দিলেন। পাশের টেবিলে পরে থাকল আতপ চাল আর ডিম। দুপুরের খাবারের সময় অনেক্ষন চলে গেছে। ক্ষুধা হয়তো লেগেছিল, কিন্তু ছাতা হারিয়ে যোগেন বাবু খাদ্য গ্রহণ করবেন এতটা পাষণ্ড তিনি কখনই হতে পারবেননা। চিয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিলন। আর কিছুই চিন্তা করতে পারছিলেন না। আচ্ছন্নতা চারিদিক থেকে ঘিরে ধরল। চোখ বন্ধ হয়ে আসল। ঝাপসা একটা দৃশ্য ভেসে উঠল ওনার চোখের সামনে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন যোগেন বাবু। ওনার ডান হাতে ছাতা আর বাম হাত ধরে আছে ওনার দশ বছর বয়সী ছেলে শান্তনু। গায়ে স্কুলের পোশাক আর কাঁধে স্কুল ব্যাগ।

“বাবা, তুমি নতুন ছাতা কেন না কেন? এখন কি সুন্দর সব ছাতা বেরিয়েছে। টিপ দিলেই ফটাস করে খুলে যায়।”

“আচ্ছা বাবা, কিনে দেব।”

“আর তুমি? তুমি নেবে না?”

“নাহ। আমার তো আছেই।”

“কিন্তু এটা তো পুরনো হয়ে গেছে। ছিঁড়ে গেছে কত যায়গায়। তোমার এই ছাতা দেখে আমার বন্ধুরা সবাই হাসে...।”

যোগেন বাবু মৃদু হাসেন।

“আমি যখন ইন্ট্রান্স পাশ করেছিলাম, তখন এই ছাতা তোমার দাদু আমাকে দিয়েছিল। আর তোমার দাদুর বাবা দিয়েছিল তোমার দাদু কে। এটা তো শুধু ছাতা নয়। এটা ওনাদের আশীর্বাদ। তুমি যেমন আমার হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছ। আমিও তেমনি তোমার দাদু, মানে আমার বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতাম। এখন উনি নেই। এই ছাতা যখন আমার হাতে থাকে, তখন মনে হয় আমি আমার বাবার হাত ধরে আছি।”

শান্তনু মনোযোগ দিয়ে তার বাবার কথা শুনছিল। আরও শক্ত করে ধরল তার বাবার হাত।

“বাবা, আমি যখন বড় হব, তখন তুমি আমাকে এই ছাতাটা দেবে। আমি সারাজীবন আমার কাছে এই ছাতাটা রাখব। তখন মনে হবে তুমি সবসময় আমার পাশে আছ। ঠিক আছে?”

ছেলের কথায় বুকটা ভড়ে ওঠে যোগেণ বাবুর। এক বাবার মূল্যবোধ আর আদর্শ যখন কোন সন্তান গ্রহণ করে, এর থেকে বড় পাওয়া আর কিছুই থাকে না। জীবন তখন প্রবাহিত হয় পিতা থেকে সন্তানের দেহে।

স্যার, স্যার......। স্যার......। দরজার করাঘাত আর স্যার স্যার সম্বোধনে ঘুম ভেঙ্গে গেল যোগেন বাবুর। স্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে অনিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপ ফেলে কোন রকমে দরজা খুলে দিলেন তিনি। বছর দশেকের ছেলে। বাসার নিচে চায়ের দোকানে কাজ করে। প্রতিদিন যোগেন বাবুর চা এই ছেলেই জোগান দেয়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সে। হাতে একটা টিফিন বাটি আর ছাতা। জোগেন বাবু কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ছোঁ মেরে ছাতাটা নিয়ে নিল।

“কোথায় পেলি!!”

“ওই যে, আপনের কাছে পড়ে...। ওই ছেলেটা দিয়ে গেল।”

আনন্দে আত্মহারা যোগেন বাবু কি করবেন বুঝে পেলেন না। বুকে জড়িয়ে ধরল ছাতাটাকে।

“স্যার...। এই বাটি আর এই কাগজটাও দিছে।”

যোগেন বাবু নিজের সম্বিৎ ফিরে অবাক হয়ে বাটি আর কাগজটা ছেলেটার হাত থেকে নিল। ছেলেটা চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে প্রথমে বাটিটা খুললেন। খুলে তো চক্ষুস্থির। বাটিতে পোলাও, একটুকরা মাংস, একটা মিষ্টি। মিষ্টিতে মাংসের ঝোল মেখে একাকার। বাটিটা যে আনাড়ি কেও সাজিয়েছে, তা দেখলেই বোঝা যায়। এরপর কাগজটা খুলে দেখলেন একটা চিঠি। হাতের লেখা একেবারে যাচ্ছেতাই। অনেক কষ্ট করে পাঠোদ্ধার করে যা দাঁড়াল তা হচ্ছে এই-

স্যার, আজ আমার জন্মদিন ছিল। আমারা গরিব মানুষ, তাই কাওকে দাওয়াত করতে পারিনি। মা মাংস পোলাও রান্না করে বাড়ির সবাইকে নিয়ে এইবারই প্রথম আমার জন্মদিন পালন করল। আমি মা কে বলেছিলাম আপনাকে দাওয়াত করতে, কিন্তু মা রাজি হয়নি। আপনি পড়িয়ে যাওয়ার পর আমি খেয়াল করলাম আপনি ছাতাটা ফেলে গেছেন। আমি তাড়াতাড়ি আপনার ছাতা নিয়ে রাস্তায় আপনার খোঁজ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দোকানদার চাচা কে জিজ্ঞেস করতেই বলল আপনি ওনার কাছ থেকে পোলাওয়ের চাল কিনে বাসার দিকে গেছেন। তখন আমি বুঝতে পারি যে আপনার ইচ্ছা ছিল আমাদের বাসায় খাওয়ার। আমার খুব খারাপ লাগে স্যার। তাই আমি একটা বুদ্ধি করি। ছাতাটা লুকিয়ে ফেলি। আপনি ছাতার খোঁজ করতে আসলেও আমি কিছু বলিনি। পরে মা কে বলি যে ছাতাটা আমি খুঁজে পেয়েছি, বিকালে আপনাকে ফেরত দেওয়ার অনুমতি নেই মার কাছ থেকে। দুপুরে খাওয়ার পর সকলে ঘুমিয়ে পড়লে আমি চুপি চুপি খাবার চুরি করে আপনার জন্য এনেছি। আপনি খাবেন কিন্তু স্যার। আর টিফিন বাটিটা বাসায় এনেন না। আমি পরে যেয়ে নিয়ে আসব।

-দিপু

চোখে জল চলে এলো যোগেন বাবুর। ওনার এক সন্তান ওনার জন্য না ভাবলেও সারা জীবনে সন্তান তুল্য অনেক মানুষ তৈরি করেছেন তিনি। ছাতাটার দিকে তাকাতেই ওনার স্বপ্নটার কথা মনে পরে গেল। কত দিনই বা আর বাঁচবেন উনি, তারপর কি হবে এই ছাতাটার? আজকের ঘটনাটা যেন ওনাকে অনেক বড় শিক্ষা দিল। মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন যোগেন বাবু। উঠে গীয়ে একটা ম্যাচ আর কেরোসিনের বোতল আনলেন। তারপর অতি যত্নের সাথে ছাতাটাকে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে কেরোসিন ঢেলে দিলেন। তারপর ম্যাচের জ্বলন্ত একাটা কাঠি। দেখতে দেখতে পুড়ে গেল ওপরের কাপড়টা। পরে রইল ধাতব রড গুলো। ঠিক এমনটাই তো ঘটেছিল। যখন ওনার বাবাকে চিতায় পোড়ানো হয়েছিল। নিথর দেহের মাংস গুলো পুড়ে যেয়ে অবশিষ্ট পরেছিল হাড় গুলো।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:১২

জুন বলেছেন: প্রতীক সরকার সত্যি আপনার গল্প আমার মনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল।
যোগেন স্যারের চরিত্র দারুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন । অনেক অনেক ভালোলাগা।
+

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:২০

প্রতীক সরকার বলেছেন: ধন্যবাদ.।।। :D @ জুন

২| ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:২১

বেলা শেষে বলেছেন: আপনার লেখাগুলো আমি পড়েছি। সবগুলোই আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে।
অনেক অনেক ভালো থাকবেন।
Salam & Respect to you.
Up to next time.

৩| ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৫৬

একজন ঘূণপোকা বলেছেন:
মন ছুয়ে যাওয়া লেখা।


লেখককে ধন্যবাদ

৪| ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:৪৬

মোঃ নজরুল ইসলাম বলেছেন: ....আপনি কি বই প্রকাশের কথা ভাবছেন!
নতুন বইয়ের জন্য ভালো মানের (ভ্রমণ কাহিনী-বইটির নাম: সদেশে প্রবাসে) লেখা আহ্বান।
তাহলে আর দেরি না করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনার রচিত গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, জীবনীগ্রহন্থ, ধর্মীয় গ্রহন্থ, নাটক ইত্যাদি গ্রহন্থের পান্ডুলী পাঠিয়ে দিন। আমাদের সাথে যোগাযোগ করার ঠিকানা: প্রকাশক, সৃষ্টি প্রকাশনী, E-mail: [email protected] & Mobile: 01557864260 আমরা আপনার যে কোন ধরনের বই প্রকাশে আগ্রহী। স্বল্প খরচে আমাদের ডিজাইনার কর্তৃক আপনার বইয়ের প্রচ্ছদ করিয়ে নিতে পারেন।
http://www.facebook.com/SristyProkashony

৫| ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১০:৩০

লাইলী আরজুমান খানম লায়লা বলেছেন: লেখায় ভাললাগা রেখে গেলাম

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.