নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রতীক সরকার

প্রতীক সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

*** বিয়ের ভুত***

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:৩৮

শেষ রাত থেকেই একটানা ধুম বৃষ্টি হচ্ছে। ঘুম থেকে ওঠার কোন তাগিদ না থাকলেও এগারোটা নাগাদ নিজেই বিছানা ত্যাগ করল রুপম। অন্ধকার কাল মেঘে রাত দিনের তফাৎ বোঝা দায়। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ব্রাশ হাতে জানালার পর্দাটা সামান্য সরাল সে। বৃষ্টির জলে আবছা হয়ে যাওয়া সার্সির ভেতর দিয়ে বৃষ্টি ভেজা শহরটিকে একটু দেখে নিলো। আহ অসাধারণ। শরীরের মধ্যে একটা শিহরন খেলে গেল তার। মুখে দেখা দিল এক উদ্দেশ্যহীন হাসি। এমন আবহাওয়ায় সাধারণত সকলের মন খারাপ হয়। প্রেম প্রেম পায়। প্রিয়জনকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু রুপম এই বিষয়ে সম্পূর্ণ আলাদা, নিজেকে নির্জন দ্বীপের একমাত্র বাসিন্দা ভাবতেই সে বেশি ভালোবাসে।
রুপম সেন। কলেজের ফিজিক্সের অধ্যাপক। বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। বিয়ে থা করেনি। বাবা-মা আর ছোট্ট একটা বোন ছিল তার। সে প্রায় বছর বিশেক আগের কথা। রুপম তখন নিজেই কলেজে পরত। একটা সড়ক দুর্ঘটনা, তারপর সব শেষ। এই জগৎ সংসারে একেবারে একা হয়ে যায় সে, অনেক মানসিক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল তাকে। এখন সেই সবকিছুই ইতিহাস। বাবার যা সহায় সম্পত্তি ছিল তা দিয়েই অনেক সংগ্রাম করে আজ নিজেকে সে একটা ভাল অবস্থানে নিয়ে এসেছে। অনেক কম বয়সে অনেক কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হওয়ার ফলে প্রেম ভালোবাসা তার জীবনে খুব একটা আসেনি, আর আসলেও তার নিজের দোষেই পিছলে গেছে।

বই রুপমের সব চাইতে কাছের বন্ধু। বাস্তব জীবনে তার কাছের বন্ধু বান্ধব খুব একটা নেই। আড্ডা দিতেও সে খুব একটা পছন্দ করে না। একাকীত্বকে ভীষণ ভাবে উপভোগ করে। আর সেই কারণেই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত তার।

গতকাল থেকে কলেজে ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে। ছুটির প্রথম দিনই সে বাজার থেকে বেশ কিছু নতুন বই কিনে এনেছে। ছুটিটা বইকেই উৎসর্গ করার প্লান তার। বৃষ্টিটা যেন রুপমের মনস্কামনাকে আরও একটু উস্কে দিল। সকাল থেকে গুনগুণ করে বৃষ্টি নিয়ে যে কত গুল গান সে গেয়েছে, ভাবলে এখন সে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। রবি ঠাকুরের শ্রাবণ দিনেরও প্রথম কদম ফুল থেকে শুরু করে অক্ষয়ের রিম ঝিম বারষা পানি, কোনটাই আজ তার বেসুরো গলা থেকে রেহায় পায়নি। বাইরে অবিরাম বৃষ্টির শব্দ আর হাতে নতুন উপন্যাসের বই, এ যেন স্বর্গীয় অনুভূতি।
রুপমের একটা ঠিকে কাজের লোক থাকলেও সে সব রকমের রান্নাই জানে। ছোটবেলা থেকেই নিজেকে সব রকম কাজে পারদর্শী করে তুলেছে সে। পরনির্ভরশীলতা তার একদম পছন্দ নয়।
দাঁত ব্রাশ শেষ করে নিজের জন্য এক কাপ চা আর দুই টুকরা স্যাকা পাউরুটি নিয়ে জানালর বাইরে আবারও উজাড় করে দিল নিজের মনকে। বৃষ্টির রূপে মুগ্ধ হয়ে সে ঠিক করে ফেলল, আজ দুপুরে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজি হবে । ছুটি উপলক্ষে ঘর থেকে বের না হওয়ার পণ করেছে সে। তার কেনা সব কটি উপন্যাস এই ছুটির মাঝেই শেষ করা চাইই চাই। একেবারে ধনুক ভাঙা পণ। আর সেই কারণে গতকালকেই ফ্রিজে মজুদ করে ফেলেছে মাছ, মুরগী, সবজী আরও অনেক কিছু।

রাইস কুকারে খিচুড়ি উঠিয়ে দিয়ে বই গুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল রুপম। নতুন বইয়ের কাগজের গন্ধে একটা নেশা থাকে, সেই নেশাই অনুভব করতে পারছিল সে। কলেজের পরীক্ষা, ক্লাস এইসব নানা ঝামেলার ভেতরে কিছুদিন থেকেই এক ঘেয়ে বিরক্ত বোধ করছিল। আশেপাশে তাকে ঘিরে থাকা অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য হলেও একটা দূরত্ব চাচ্ছিল সে। আর সেই কারণেই ছুটিটা কে নিয়ে বিশেষ ভাবে প্লান করেছে। আর বৃষ্টি? সে তো আর আগে থেকে প্লান করে আনা যায় না! তবে সোনার ওপর সোহাগা হয়ে বৃষ্টি নিজেই হাজির হয়েছে। পরিবেশ আর প্রকৃতির তার প্রতি অসীম করুণা প্রদর্শনে সে আজ বেজায় খুশি। বই গুলোর ভেরত থেকে একটা বই বেছে নিয়ে শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিল সে।

কিন্তু সুখ আর বেশিক্ষণ জুটল না তার কপালে। বইয়ের দুটো পৃষ্ঠা পেরতে না পেরতেই পরম করুণাময় বিদ্যুৎ নিল চোখ বন্ধ করে। লোডশেডিং এ ঘর হয়ে গেল পুরো অন্ধকার। কালো মেঘের আড়াল থেকে সূর্য বাবাজীও রুপমকে কোন সাহায্য করতে পারল না। সব কিছুই তার মন মত চলছিল। হঠাৎ বাধা পাওয়ায় মনে মনে বিরক্ত বোধ করল সে। হাতরে হাতরে বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে রাখা চার্জার লাইটের দিকে এগিয়ে যেতেই সে সম্মুখীন হল দ্বিতীয় বিপদের। কলিং-বেল তার বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠল। থমকে গেল রুপম। মনে মনে আন্দাজ করার চেষ্টা করল, কে হতে পারে। বাইরে এখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি ভেদ করে কারো আসার কথা নয়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল রুপম। আরও একবার বেল না চাপলে সে দরজা খুলবে না। কিন্তু বেল পর পর আরও দুইবার বেজে উঠল। রুপম এইবার একটু নড়েচড়ে উঠল। পা টিপে টিপে দরজার কাছে এগিয়ে গেল সে। অন্ধকারে ততক্ষণ চোখ সয়ে গেছে তার। দরজার ওপাশের ব্যক্তিটিকে আন্দাজ করার একটা অপচেষ্টা করতে না করতেই বেল বেজে উঠল আরও দুইবার। রুপম বুঝতে পারল, দরজা না খোলা পর্যন্ত আগন্তুক রেহাই দেবে না। বেশ বিরক্ত ভরা কণ্ঠে রুপম জিজ্ঞেস করল-
“কে......।’’
ওপার থেকে কোন সারা পাওয়া গেল না। রুপম আবার বলল-
“কে...।’’
এইবার একটা দুর্বল কণ্ঠের শব্দ ভেসে আসল দরজার ওপার থেকে।
“বাবা রুপম আছ?’’
অবাক হওয়ার পালা রুপমের। মনে মনে ভাবছিল হয়তো তার কাজের বুয়া, অথবা আশেপাশের ফ্লাটের কেও। কিন্তু তাকে এমন বাবা সম্বোধন করার মত কোন মানুষ পৃথিবীতে আছে বলে তার জানা নেই। রুপম কোন কালেই ভিতু ছিল না। আর সেই কারণেই বাবা সম্বোধন করা ব্যক্তিটির একবার মুখ দর্শন করার জন্য হলেও কোন কিছু না ভেবেই দরজাটা খুলে ফেলল।

দরজা খুলতেই একরাশ শীতল বাতাস রুপমের চোখ মুখ স্পর্শ করে ঘড়ের ভেতরে প্রবেশ করল আর সাথে প্রবেশ করল একটা বয়স্ক ছায়া মূর্তি। রুপম কিছু বলারই সুযোগ পেল না। তার আগেই সেই দমকা শীতল বাতাসের সাথে তাল মিলিয়েই যেন আচমকা ঘড়ে এসে উপস্থিত হল লোকটি।
“বেজায় বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে, এস একটু বসেই কথা বলি’’
রুপম কিংকর্তব্যবিমুড়। কি বলবে কিছু বুঝতে না পেরে বৃদ্ধকে অনুসরণ করল। লোকটি যেন রুপমের বাড়িঘর সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত। অন্ধকারের মধ্যে বসার সোফাটা খুঁজে নিতে লোকটার একদম কষ্ট হল না। চোখ সয়ে গেলেও রুপম নিজেই অন্ধকারের ভেতর কিছুটা দিশেহারা অনুভব করছিল।

সোফায় বসে লোকটি পকেট থেকে রুমাল বের করে হাল্কা ভাবে নিজের মাথা আর মুখ মুছে নিল। রুপম চুপচাপ বসে রইল। কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। মুখ মোছা শেষ করে রুমালটা খুলে একটা ঝাড়া দিয়ে খুব যত্ন সহকারে ভাঁজ করে পকেটে রাখল। লোকটির ওপর অগাধ কৌতূহলের কারণে আলোর ব্যবস্থা করার কথা মনে রইল না রুপমের, লোকটিও আলোর প্রসঙ্গ তুললো না, তাই বলে আবছা অন্ধকারে লোকটির কার্যকলাপ দেখতে খুব বেশি কষ্ট হল না তার। লোকটি স্থির হয়ে বসতেই রুপম নড়েচড়ে উঠল, লোকটির কাছ থেকে প্রশ্নের আসায়।

“আমাকে বোধয় চিনতে পারনি......। তা চিনতে না পারারই কথা। সময় তো আর কম হল না...। আর চেহারার যে ছিরি হয়েছে...। হেঃ হেঃ...।’’

এক নিঃশ্বাসে কথা গুল বলে গেল লোকটা। রুপম কি বলবে বুঝতে পারল না। শুধু অন্ধকার চিড়ে এক দৃষ্টিতে বৃদ্ধকে চেনার চেষ্টা করতে লাগল সে।

“তোমার স্বপন কাকার কথা মনে আছে? আর চুমকি...?? খুব যে ভাব ছিল তোমাদের...। ছোট বেলায় কত খেলা করেছ একসাথে......। মনে নেই??’’

রুপমের অন্ধকার হয়ে যাওয়া মুখে একটু আলোর দেখা পাওয়া খেল। কুঁচকে যাওয়া ভুরু হয়ে গেল সোজা, ঠোঁটের কোনায় দেখা দিল এক চিলতে হাসি আর উদ্বেগে ছোট হয়ে যাওয়া চোখ বিস্ময়ে হয়ে গেল বড় বড়। আর সেই বড় বড় চোখ দিয়ে যেন স্পষ্টই দেখতে পেল তার শৈশবকে।

স্বপন কাকা তার বাবার খুব ভালো বন্ধু ছিল। খুব ভাব ছিল তাদের মধ্যে, যেন আপন দুই ভাই। রুপমের বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি ভালো থাকলেও স্বপন কাকা বেশ দরিদ্র ছিল, তাই বলে তাদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ ছিল না। দুজনের বাড়ি দুই গ্রামে হলেও প্রায় যাওয়া আসা করত তারা। চুমকি স্বপন কাকারই মেয়ে। বয়সে রুপমের থেকে বছর তিনেকের ছোট হলেও তাদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। একটু বড় হলে রুপম তার প্রতি দুর্বলতা অনুভব করতে শুরু করে। গরিবের মেয়ে হলেও চুমকি রূপে গুনে ছিল অতুলনীয়। রুপমের বাবা-মাও চাইত বড় হলে তাদের বিয়ে দিতে। রুপমের কাছে প্রকাশ না করলেও রুপম বেপারটা আন্দাজ করতে পারতো।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর রুপমের জীবনে ঘটে গেল সেই ভয়ানক দুর্যোগ। এক সাথে গোটা পরিবার কে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল সে। তখন স্বপন কাকা তাকে অনেক সহযোগিতা আর মানসিক সাহস যুগিয়েছিল। কিন্তু রুপমই কেন যেন আস্তে আস্তে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। স্বপন কাকার স্ত্রীও বড় একটা অসুখ বাধিয়ে ফেলে। স্বপন কাকা সেদিকে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার তাদের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় চিরতরে।
“আমাদের কথা মনে পড়ে, বাবা?’’
বৃদ্ধের কথায় সদবিদ ফিরে পায় রুপম। নিজের আবেগকে যথাসম্ভব আড়াল করে সে বলল-
“হ্যাঁ...। মানে কাকা, এতদিন পর.........। কেমন আছেন আপনি? কাকিমা এখন কেমন আছে? আর চুমকি? ওর বিয়ে দিয়েছেন কোথায়?’’
বহুদিনের জমে থাকা জিজ্ঞেসা যেন একবারে বের হয়ে আসলো।

“তোমার কাকী তো সেইবারই আমাদের মায়া ত্যাগ করল। তোমার মত আমাদের পরিবারেও একই সাথে অন্ধকার নেমে আসল। কত সুখেরই না ছিল দিনগুলো। তোমরা, আমি, তোমার কাকিমা, চুমকি সবাই মিলে যেন একটাই পরিবার ছিলাম। তোমাদের নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম আমরা। কিন্তু............ এক নিমেষেই সব শেষ। তুমিও একা হয়ে গেলে। আর তোমার কাকিমাও আমাদের নিঃস্ব করে চলে গেল।’’

আধো অন্ধকার ঘরে স্বপন কাকার চোখের কোনায় চিক চিক করে ওঠা জল দেখতে না পেলেও রুপম অনুভব করতে পারল। রুপমের ক্ষত শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই। তবুও বুকের ভেতর কোথায় জানি একটু চিনচিন করে উঠল তারও। কিন্তু তারপরেও পুরাতন কে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে সে একদমই পছন্দ করে না। সব কিছুই নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে সে। বাবা-মা আর ছোট্ট বোনটার অস্বাভাবিক মৃত্যু এখন তার কাছে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এইসব বিষয় নিয়ে কান্নাকাটি করা সে একদমই পছন্দ করে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য রুপম জিজ্ঞেস করল-
“চুমকির বিয়ে দিয়েছেন কোথায়?’’
রুপম খেয়াল করল, তার প্রশ্ন শুনে স্বপন কাকার মুখ যেন আরও কালো হয়ে গেল। আর ঠিক সময় বুঝেই বাইরে থেকে গম্ভীর গলায় মেঘ ডেকে উঠল। সব কিছু মিলে পরিবেশটা বেশ থমথমে হয়ে উঠল। মেঘের গর্জনের পর কিছুক্ষণের জন্য চারিদিকে নীরবতা নেমে আসল। বাইরে যে অবিরাম বৃষ্টির শব্দ শোণা যাচ্ছে, দীর্ঘক্ষণ সেই শব্দ কানে আসার ফলে সেই শব্দও এখন নীরবতার অংশ হয়ে গেছে।
নীরবতার পর্ব শেষ করে রুপমের স্বপন কাকা মুখ খুললেন।
“বাবা রুপম। তুমি তো জানোই আমাদের অবস্থা কখনই খুব একটা ভালো ছিল না। তোমার কাকী অসুস্থ হওয়ার পর শেষ সম্বল টাকা পয়সাও ফুরিয়ে যায়। তাও তো তোমার কাকীকে বাঁচাতে পারলে শান্তি পেতাম। কিন্তু ওপর ওয়ালার যা ইচ্ছে। চলে গেল তোমার কাকী। আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। একে তোমার বাবার মত এমন একটা বন্ধু হারানোর কষ্ট, তার ওপর তোমার কাকী।’’
রুপম কোন কথা না বলে কাকার কথা শুনছিল। কিছু পড়ে কাকা আবার শুরু করলেন-
“আমিও বেশি দিন সুস্থ থাকতে পারলাম না। কাজ কর্ম প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আমার আর চুমকি, এই দুটো মুখের খাবার জোগাড় করতেই আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। কলেজের পর চুমকি নিজের চেষ্টাতেই প্রাইভেট পড়িয়ে কোন রকমে অনার্সটা পাশ করে। আমি তাকে কিছুই দিতে পারিনি, কিছুই করতে পারিনি তার জন্য।’’
আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর-
“বাবা রুপম, মেয়েটা আমার বড় ভালো। তুমি ওকে বিয়ে কর বাবা। উদ্ধার কর মেয়েটাকে। তুমিও তো বিয়ে করনি। ঈশ্বরের হয়তো এটাই ইচ্ছে। আর তোমার বাবা মাও তো তাই চাইতেন। দয়া কর বাবা মেয়েটার ওপর, ওর যে কেও নেই এই জগত সংসারে। উদ্ধার কর বাবা, তুমি ওকে উদ্ধার কর।’’
কথা গুল বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে উঠল স্বপন কাকা। রুপম কি বলবে বুঝতে পারল না। হঠাৎ এমন একটা প্রস্তাব পেয়ে সে নিজেই হতবিহবল হয়ে গেছে। রুপম এখন বেশ শক্ত মনের মানুষ। কারো চোখের জ্বল তাকে টলাতে পারে না। বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে সে অটল থাকতে চায়। এত দিন যে আদর্শ সে তৈরি করেছে এক বৃদ্ধের চোখের জ্বলে তা ধুয়ে যেতে দিতে পারে না। মনে মনে আরও গম্ভীর হল সে। কিছুতেই নরম হওয়া চলবে না।
এদিকে স্বপন কাকা নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ তুলে তাকালেন রুপমের দিকে। চোখ দুটো তার চকচক করছে। রুপমের একটা কথাই যেন তার জীবনটা পাল্টে দিতে পারে।

রুপম হঠাৎ এমন একটা আবদার শুনে মনেমনে বেশ বিরক্ত হলেও বৃদ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে কড়া কথা বলতে পারল না। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে তার কাকার বহু প্রতীক্ষিত প্রশ্নের উত্তর দিল।

“কাকা, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কখনও বিয়ে করব না। আমি নতুন করে কোন সম্পর্ক তৈরি করতে পারব না। বিচ্ছেদের আগুনে আমি একবার পুড়েছি। আমি জেনেশুনে ওই আগুনে আর লাফ দিতে চাই না। আমাকে ভুল বুঝবেন না কাকা। আমাকে ক্ষমা করবেন।’’

স্বপন কাকার একভাবে রুপমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এমন উত্তর যেন তাঁর মোটেও কাম্য ছিল না। কিছুক্ষণ কথা হারিয়ে ফেললেন তিনি। তাঁর চোখেও তখন কোন ভাষা ছিল না। নিজেকে সামলে নিতে কিছুক্ষণ সময় নিলেন তিনি। তারপর আবার বললেন-
“বাবা রুপম, তুমি ছাড়া যে আমার মেয়েটার আর কোন গতি নেই। তুমি যে আমার শেষ ভরসা বাবা। তুমি যদি মেয়েটার প্রতি একটু দয়া না কর আমার আত্মা যে শান্তি পাবে না।’’
রুপম এইবার নিজেকে আর একটু শক্ত করল। পরের কথা গুল বলল চোয়াল চেপে-
কাকাবাবু, আমার জীবনের কঠিন মুহূর্ত গুলো পার করতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। নিজেকে বোঝাতে হয়েছে অনেক। স্বার্থপরতাকেই সব কিছু বলে জানতে শিখেছি। সম্পর্কের বন্ধন কে শুধুই মায়া বলে মানতে শিখেছি। আর শিখেছি নিজেকেই সব থেকে ভালবাসতে। এখন যদি নতুন করে কোন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হই, তবে নিজের সাথেই প্রতারণা করা হবে। আমাকে মাফ করবেন কাকাবাবু। আমি আর সেই রুপম নেই, যাকে আপনি আগে চিনতেন।’’

বাধ্য শ্রোতার মত কথাগুলো শুনলেন স্বপন কাকা। এই কথাগুলোর জবাব কি হতে পারে সেটা তাঁর জানা নেই। ভিক্ষুককে ভিক্ষার বদলে তত্ত্ব কথা শোনালে যা হয়, ওনার অবস্থাও ঠিক তাই হল। অশ্রুস্নাত চোখে আকুতি ছাড়া উনি আর কোন জবাব দিতে পারলেন না।

“ বাবা, আমি তোমার কাছে আমার মেয়ের জীবনটা ভিক্ষে চাচ্ছি বাবা, আমাকে তুমি......।।’’
“কাকা, আমি এই বিসয়ে আর কথা বলতে চাইনা, আমাকে মাফ করবেন। আমার আর কোন উপায় নাই।’’
স্বপন কাকা আর কিছু বলতে পারলেন না। রুপম তাকে থামিয়ে দিল। এবার মনে হল বৃদ্ধ যেন হালটা পুরোপুরি ছেড়ে দিলেন। পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য রুপম আবার বলল-
“কাকা, আর কথা পরে হবে। অনেক দূর থেকে এসেছেন, বসেন আপনার খাবার ব্যবস্থা করি। তার আগে দেখি। আলোর ব্যবস্থা করা দরকার।’’
বৃদ্ধ কোন সারা দিল না। রুপম উঠে গেল পাশের ঘরে, আলো আনার জন্য। কিন্তু পাশের ঘরে রাখা চারজার লাইটে হাত দিতে না দিতেই বেরসিক কারেন্ট মহাশয়ের আবির্ভাব ঘটল। আর কি করার, রুপম আবার বসার ঘরে ফিরে আসতেই ভীষণ অবাক হয়ে দেখলেন স্বপন কাকা নেই। ঘর একদম ফাঁকা।
তবে কি তার ওপর রাগ করেই চলে গেলেন, একটু আশ্চর্যই হল রুপম। কিন্তু বেশি উদ্বিগ্নতা দেখা গেলনা তার মাঝে। মনে মনে ভাবল, যাক আপদ বিদায় হয়েছে, যত্তসব ঝামেলা।


সেদিনের পর থেকে ছুটিটা খুব একটা ভাল কাটল না রুপমের। শত চেষ্টা করেও স্বপন কাকাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারল না সে। মনে মনে ধারনা করল কাকা নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে, তা না হলে এমন আচরণ কেন করবে! আবার তার এটাও মনে হল যে চুমকির কি সত্যিই বিয়ে হয়নি?
সব কিছু মিলে রুপম বিশাল এক দ্বন্দ্বের মধ্যে পরে গেল। তার স্বেচ্ছায় সরিয়ে রাখা প্রিয় কোন একটা বই যেন নিজের ইচ্ছায় সামনে উপস্থিত হয়ে এক এক করে মেলে ধরছে তার সকল পৃষ্ঠা গুলো। রুপম চাইলেও তার থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। সে যেটাকে অতীত ভাবছিল, এখন তা হঠাৎ ই তার বর্তমানকে প্রভাবিত করে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আর চুমকি সেখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।

রুপমের বাবা মা আর ছোট্ট বোন টার সাথে ঘটে যাওয়া এক কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। আর সেই কারণে ঠিক করেছে তার জীবনের সব থেকে আনন্দ ঘন মুহূর্ত স্থানটিকে চিরতরে বর্জন করবে। সাথে বর্জন করবে সেই সময়ের সাক্ষী মানুষ গুলকেও।
রুপম এখন নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে নিজের মধ্যে। নিজেকেই সে সব থেকে বেশি ভালবাসে। কিন্তু সেই রাতের পর থেকে সব কিছু কেমন জানি ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। আবেগের প্রতি তার কঠিন নিয়ন্ত্রণ যেন আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এতদিন নিজের যে সিদ্ধান্তের ভিতের অপর দার করিয়ে রেখেছিল, সেই ভিত জেন তার নিজের কাছেই নড়বরে মনে হচ্ছে। নিজের আর নারীদের মাঝে যে সূক্ষ্ম দেওয়াল এতদিন সে তৈরি করে রেখেছিল, এখন তা ভঙ্গুর মনে হচ্ছে।

জীবনে একটু ভালোবাসা, কারো একটু সংগ। একটু মান অভিমান। আবার সেই মান ভাঙ্গানোর দুষ্টুমি মাখা নাটক। নিজেকে এসব থেকে সবসময়ই বঞ্চিত করেছে সে। সেদিনের পর থেকে নিজেকে বড়ই কঠোর বলে অনুভব করছে সে। প্রথম প্রেম কখনও ভোলা যায় না সে কথা রুপম শুনেছে। কিন্তু সেসব তার কাছে আদিখ্যেতা বলে মনে হত। কিন্তু এখন সব কিছুই তার কাছে অন্যরকম লাগছে। একটা চৌদ্দ পনের বছরের ছেলে প্রথম প্রেমের অনুভূতি পেলে তার মনের অবস্থা যেমন হয়, রুপমের অবস্থাও ঠিক তাইই হল।

চুমকির কথা যে তার মাঝে মাঝে মোণে পড়তো না তা নয়। কিন্তু সে ধরেই নিয়েছিল যে চুমকির বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বেলায় তাদের একসাথে কাটানো সেই মধুর সৃতি গুলোকে ছেলে মানুষী বলে কখনও পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এখন সেই ছেলে মানুষী গুলকেই সত্য বলে মনে হচ্ছে। তার মৃত যৌবনে সে জেন একটা গরম হাওয়ার পরশ অনুভব করতে পারছে।
দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যেই রুপম কাটিয়ে দিল তার ছুটির বাকি দিন গুল। ছুটির মাঝে বই পরার যে মাইলস্টোন ঠিক করেছিল, তার ধারে কাছেও পৌঁছতে পারল না। কলেজ শুরু হতেই তার ব্যস্ততা বেরে গেল। সেই সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যা নেমে যায়। কিন্তু এত ব্যস্ততার মাঝেও সেদিনের ঘটনার সৃতি তার পিছু ছাড়ল না। গম্ভীর মানুষটা চেহারায় আরও গাম্ভীর্যের ছাপ স্পষ্ট হল। আর এইসবের প্রভাব পরল তার কর্মক্ষেত্রেও। ক্লাসে ভুল করতে লাগল, স্টাফ মিটিঙয়ে সবাই যখন কোন জরুরি বিসয় নিয়ে বিস্তর তর্ক করে, রুপম তখন জানালার বাইরে উদাস মনে তাকিয়ে থাকে। বাজারে গিয়ে জিনিস কিনে টাকা দিতে ভুলে যায়, আর দিলেও বাকি টাকা ফেরত নিতে মনে থাকে না। নিজে রান্না করতে গেলে তরকারী হয় পুড়ে যায়, না হয় লবণ বা ঝাল বেশি দিয়ে ফেলে।

রুপমের এই স্বাভাবিক জীবনের ব্যাত্তয় ঘটায় সে নিজেও বেশ বিরক্ত বোধ করছিল। এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা উপায় সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল। নিজের মনের দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে স্বপন কাকা আর চুমকির খোঁজে গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। দিন দুয়েকের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে ফেলল। ট্রেনের টিকিট আর কলেজের ছুটি, দুইয়েরই ব্যবস্থা হয়ে গেল। এক বুক উৎকন্ঠা নিয়ে রওনা দিল সে।

ভোরে অন্ধকার থাকতেই ট্রেনে উঠেছিল রুপম, ট্রেন থেকে যখন নামল তখন দুপুর একটা। গ্রামে শেষ এসেছিল বছর পনের আগে। কোন কিছুই আর আগের মত থাকার কথা নয়, তারপরেও ট্রেন থেকে নামার পর পরিচিত কিছু দেখতে পাওয়ার আসায় রুপম তার চোখ দুটোকে নিক্ষেপ করতে লাগল চারিদিকে। ট্রেনের প্লাটফর্ম, প্লাটফর্মে দাঁড়ান মানুষ এমনকি স্টেশনের পাশে বড় গাছ গুলকেও নিবির ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল সে। এই গাছ গুল কি আগের?? নাকি পরে লাগানো হয়েছে?? এই রকম হাজারো প্রশ্ন তার মনে। রুপমের ঘূর্ণায়মান চোখ হঠাৎ স্থির হল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ওপর একটা চায়ের দোকানের ওপর। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ঢাকায় যাওয়ার জন্য সে জখন প্ল্যাটফর্মে বাবার সাথে ট্রেনের অপেক্ষা করত, তখন বাবা ছেলে মিলে এই দোকানেই বসে চা খেত।

পুরনো সৃতি গুলো বেশ উপভোগ করতে লাগল সে। কিন্তু সেই পর্ব আর বেশিক্ষণ চলল না। নিজেকে বোঝাল সে, এ শুধুই সৃতি। ঘটে যাওয়া অতীত, এই অতীত তার জীবনে আর কখনই আসবে না।

ষ্টেশন থেকে বের হয়ে একটা ভ্যান গাড়ি নিয়ে স্বপন কাকার বাড়ির উদ্দেশে রওনা হল সে।
শেষবার গ্রামে আসার পর বিস্তর সময় পেরিয়ে গেছে। রাস্তাঘাট এখন বেশ ভালো। সবকিছু বেশ পাল্টে গেলেও চিনতে খুব বেশি কষ্ট হয় না। চারপাশে চোখ বুলতে বুলতে এগিয়ে চলল। আশেপাশের পথচারী দেখলেই রুপম নিজেকে যতটা সম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগল। পাছে তাকে কেউ চিনে ফেলে তার অজ্ঞাত বাসের জবাবদিহি চায়, সেই ভয়ে। গ্রামের পথে নতুন আগন্তুক দেখলে গ্রামের মানুষরা একটু বেশিই আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকে। এতে যে সামনের মানুষ বিব্রত হয়, সেটা তাদের অনুভবের বাইরে।

রুপমের সৌভাগ্য, গ্রামের সকলেই তাকে খুঁটিয়ে দেখলেও কেও তাকে চিনতে পারেনি। ভ্যান ওয়ালার চেনাই ছিল তার কাকার বাড়ি। একেবারে দরজার সামনে নামিয়ে দিল তাকে।
রুপমের হৃদ স্পন্দন এখন তুঙ্গে। জড়তা, বিব্রত বোধ, খানিকটা লজ্জা, কিছুটা অস্থিরতা সব ধরনের সামাজিক রোগের ঠিকানা এখন তার ভেতরে। স্বপন কাকাকে দেখে বাড়ির অবস্থা যতটা খারাপ হবে ভেবেছিল, ততটা খারাপ মোটেও না। আগে বাড়ির সামনেটা খোলা ছিল। এখন বারিটিকে আগলে আছে ইটের দেওয়াল। সামনে একটা টিনের দরজাও আছে। দরজাটা সামান্য ভিড়িয়ে দেওয়া। রুপম এগিয়ে গীয়ে দরজাটা ঠেলে দিল। অযত্নে মরচে পরা দরজাটা একটা বেয়াড়া শব্দ করে উঠল। রুপম অবশ্য ইচ্ছা করেই জোরে ধাক্কা দিয়েছে। জাতে ভেতরের মানুষ আগন্তুকের আবির্ভাব সম্পর্কে সচেতন হয়।
দরজাটা সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ছোট ছোট শিশুদের কলরব কানে আসল তার। ভালো করে লক্ষ করল ভেতরের লম্বা উঠোনটা পেরিয়ে টিনের লম্বা চাল দেওয়া ঘরের বারান্দায় কিছু বাচ্চা মেঝেতে মাদুর পেরে বসে পড়াশুনোর নামে হল্লা করছে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারল না রুপম। তবে কি সে ভুল বাড়িতে...............। নাহ, তেমনটা হওয়ার কথা নয়। বদলে যাওয়া বাড়িটার পুরনো কিছু জিনিষ এখনও প্রমাণ করছে এটা স্বপন কাকা, মানে চুমকি দেরই বাড়ি। তারপরেও আরও কিছু ছোট ছোট প্রমাণ মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই একটা ধমকে সে স্থির হল। মহিলা কণ্ঠের ধমকটা তার প্রতি নয়। ছিল ওই দুষ্টু বাচ্চা গুলোর জন্য।

সেই মহিলা কণ্ঠের অধিকারিণী প্রথমে ধমক নিক্ষেপ করে তারপর নিজে আবির্ভূত হলেন।
মহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার সামনে আসতেই চোখ পড়ল রুপমের দিকে। বাচ্চারাও আগে লক্ষ্য করেনি রুপমকে। তারা এখন ধমকের আঘাতে যতটা না নিশ্চুপ , তার থেকে বেশি নিশ্চুপ আগন্তুক, অর্থাৎ রুপম কে দেখে।
“কাকে চান”
মহিলার প্রশ্ন...।
রুপমের বুঝতে কষ্ট হল না যে এই সেই চুমকি। কিন্তু এই গ্রামে, তথা এই বাড়িতে না দেখে যদি অন্য কোথাও দেখত তবে চিনতে পারার সম্ভাবনা প্রায় ছিল না বললেই চলে। হালকা খয়েরি রঙের শাড়ির সাথে কালো ব্লাউজ। এখনও ঠিক আগের মতই ছিমছাম। চুল গুল খোলা, আর মুখ জুড়ে স্নিগ্ধতা।
রুপম প্রথমেই নিজের পরিচয় দিতে কিছুটা কুণ্ঠা বোধ করল। কি বলবে বুঝতে পারল না।

চুমকি আগন্তুকের নীরবতা দেখে নিজেই এগিয়ে আসলো। কাছে আস্তে দেখে রুপম বুঝতে পারল এখন তাকে কিছু একটা উত্তর তো দিতেই হবে।

“স্বপন কাকা............। আছেন?”

চুমকি তখন অনেকটা কাছে চলে এসেছে। চেহারায় তার বিস্ময়। রুপমের কথা তার কানেই গেল না। কিছুক্ষণ কিছু একটা আবিষ্কার করার চেষ্টা, তারপর তরল পদার্থের ঘনত্ব নির্ণয়ের সূত্র আবিষ্কার করার পর আর্কিমিডিস যেমন ইউরেকা বলে চিৎকার করেছিলেন, চুমকিও ঠিক তেমনটাই উত্তেজনার সাথে চিৎকার করে উঠল।

“রুপম দা না.........!!!!!!”

রুপম কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। অবশ্য চুমকি তার উত্তরের অপেক্ষাও করল না। হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসিয়ে প্রথমেই বাচ্চাগুলো কে ছুটি দিয়ে দিল। বাচ্চা গুলো কোনরকমে তাদের বই ব্যাগে ঢুকিয়ে সোস্লাসে চিৎকার করতে করতে স্বাধীনতার আনন্দে বাড়ি ত্যাগ করল।

রুপম তখনও নীরব। একদৃষ্টিতে চুমকিকে আগের সাথে মেলানোর চেষ্টা করতে লাগল সে। বাস্তবতা যে মেয়েটিকে তার মতই অনেক বেশি পরিণত করে তুলেছে সেটা তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়। ছোট্ট বেলার চুমকিকে শুধু তার চোখেই পাওয়া যায়। উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি এখনও সেই আগের মতই আছে।

রুপম কিছু না বললেও চুমকি মোটেও থেমে নেই।

“কতদিন তোমাকে দেখিনি বলতো, আমাদের কথা কি তোমার একবারও মনে পরে নি, তুমি কিন্তু অনেক বদলে গেছ। যাক এতদিন পর তাহলে মনে পড়ল। আমি তো প্রথমে চিন্তেই পারিনি। আমি জানতাম, তুমি একদিন নিশ্চয়ই আসবে। এই সেদিনই তো তোমার কথা বলছিলাম...”।।
রুপম চুপ। চুমকির তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।
“তুমি নিশ্চয়ই এখন অনেক বড় চাকরী করছ। কোথায় থাক এখন। একা আসলে যে। বউ বাচ্চা নিয়ে আসতে। তারা তোমার জন্ম স্থান দেখে যেত”।

এইবার রুপম একটু বিষম খেল। তবে কি চুমকি জানে না যে সে বিয়ে করেনি! স্বপন কাকা নিজে জানেন, অথচ মেয়েকে কিছু বলেননি কেন!

চুমকি বলেই যাচ্ছে-
জান,বাবা মারা যাওয়ার আগে তোমার কথা খুব বলছিল। তোমার তো ঠিকানা জানতাম না যে খবর দিব”।
রুপমের চোখ এইবার কপালে ওঠার পালা। এ কি শুনছে সে। স্বপন কাকা এর মধ্যেই মারা গেলেন। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হল তার। এইবার সে নীরবতা ভঙ্গ করে চুমকির কথার জোয়ারকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল।

“কাকা...। মানে কবে...? কবে মারা গেছেন উনি??”
চুমকি বলল-

“এইতো, গত মাসে এক বছর পূর্ণ হয়েছে”
রুপমের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল। বলে কি এই মেয়ে। তবে সেদিন যে মানুষটা তার বাড়িতে গিয়েছিল......। সেটা কিভাবে সম্ভব।

বারান্দার দেয়ালে স্বপন কাকার একটা ছবি ঝুলনো ছিল। ছবির ফ্রেমে পরানো শুকিয়ে যাওয়া ফুলের মালাটা তার প্রথমে চোখে পরেছিল না। তা না হলে সেদিনের লোকটিকে স্বপন কাকা না, অন্য কোন লোক বলার যুক্তি দার করানো যেত।
বেশি কিছু ভেবে উঠতে পারল না সে। ভয়ে নয়, অনেকটা বিস্ময় আর মানসিক চাপেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে।

তারপর অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। সেগুলো না বললেও চলে। কারণ যত যাই বলা হোক না কেন। তার সারমর্ম এই দাঁড়াবে যে চুমকি আর রুপম এখন স্বামী-স্ত্রী। সেদিনের রুপমের জ্ঞান হারানোর পর থেকে আজ পর্যন্ত সবকিছু কেমন করে ঘটল তা রুপমও ঠিক মত বুঝে উঠতে পারে না। মাঝে মাঝে তো সে এই ভেবে অবাক হয়, যে সেদিনের পর জ্ঞান কি তাও আদও ফিরেছে!

তারপরেও যতটুকু না বললেই নয় সে টুকু বললে এই দাঁড়ায় যে জ্ঞান ফেরার পর রুপম জানতে পারে তার স্বপন কাকা এক বছর আগেই মারা গেছে। তারপর থেকে চুমকি একা। নিজে বিয়ে করার কোন উদ্যোগ নেয়নি। তার মা মারা যাওয়ার পর এতটাই দুরবস্থার মধ্যে তাকে পরতে হয়, যে প্রেম ভালোবাসা তার কাছে বিলাসিতা ছিল, আর সেই কারণেই রুপমের পর তার জীবনে আর দ্বিতীয় কোন পুরুষের আবির্ভাব ঘটেনি।
অপর দিকে রুপম চুমকিকে কাছে পেয়ে নিজের সব আদর্শ আর সিদ্ধান্তকে এক ফুঁয়ে ভুল বলে উড়িয়ে দিল। চুমকিকে পাবে বলেই তার বিয়ে হয়নি বা তার বিয়ে না করার সিদ্ধান্তটা আসলে বিধাতার ইশারা ছিল, যাতে চুমকির সাথেই তার শুভ পরিণয় হয়। এই জাতীয় কিছু মনের মত যুক্তি সে দার করিয়ে নিল। জলের অভাবে শুকিয়ে যাওয়া একটি তুলসী গাছ যে জলের সংস্পর্শে এলে পুনরায় সতেজ হয়ে যায়, তার উদাহরণ পাওয়া গেল রুপমের ঘটনাটি দিয়ে।

সে যাই হোক। চুমকি আর রুপম এখন ভালই সংসার করছে। চুমকি নতুন জায়গায় নিজেকে বেশ মানিয়ে নিলেও রুপমের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। তার জীবনটা এখন পুরই পাল্টে গেছে। সেই একাকীত্বের স্বাধীনতা, নীরবতায় বই পাঠ এগোল এখন তার সিকেয় উঠল। দুই রুমের বিশাল ফ্লাটটা এখন তার কাছে ছোট মনে হয়। বই এর শেল্ফ এর বই গুল এখন একটা তাকেই কোন ভাবে ঠাসাঠাসি করে বাস করে। বাঁকি তাক গুলতে স্থান করে নিল চীনেমাটির থালা প্লেট আর গ্লাস। এত বছর এক এলাকায় থাকার পরেও বাজারের দোকানীরা এতদিন তাকে চিনত না। এখন তারা দেখলেই দূর থেকে ডাক দেয়, এখন যে তাদের সাথে দুই বেলা দেখা হয়। কলেজ শেষে সে আর বই এর বাজারে যায় না, যায় মাছের বাজারে বা সবজীর বাজারে। টিভি তে এখন আর ডিসকভারি, জিওগ্রাফী বা খেলার চ্যানেল ধরে না। টিভি এখন দিনে রাতে গেয়ে চলেছে “জীবন মানে জী বাংলা”।

চুমকির জীবনে শত দুর্যোগ আসলেও সে কখনও নিজেকে পরিবর্তন করেনি। রুপমের প্রতি প্রেম আর ভালোবাসার ছোট ছোট জায়গা গুলো সে ঠিকই খেয়াল রাখে। রুপম সেগুলো ঠিকই উপভোগ করে। বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত যে তার ভুল ছিল সে কোথাও যেমন সে মানে আবার বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা কি সত্যিই ভুল ছিল, এটা নিয়েও সে ভাবে।

আমি বা আমার শব্দ গুল ব্যবহার করে অভ্যস্ত রুপম আমার আর আমাদের শব্দ গুল ব্যাবহার করতে বেশ বেগ পাচ্ছিল। নিজের প্রতি যে তার ভালোবাসা, সেই ভালোবাসা অন্য জনকে ভাগ দিতে হচ্ছিল বলে তার নিজের প্রতি রাগ হত আবার নিজের প্রতি হিংসাও হত। মোট কথা তার জীবন এসে দাঁড়িয়েছিল এক জটিল সমীকরণে।

সঙ্গিনীর সংগের সুফলই বা কতটুকু পাচ্ছে আবার একা থাকার অভ্যাসটাও তার জীবনে কতটা সুফল বয়ে এনেছে সেই উত্তরও এখন তার অজানা।
এরই মাঝে তার বাসায় বন্ধু বান্ধব আর গ্রামের পুরনো আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা বেশ বেড়ে গেছে। কলিং-বেল আগে যেখানে কালে ভদ্রে বেজে উঠত, এখন বেচারা দিনে রাতে চিল্লিয়ে গলা ভেঙ্গে ফেলেছে। বদমেজাজি আর গম্ভীর প্রকৃতির রুপমের গলাবাজি আর ধমক যেখানেই চলুক না কেন, বাড়িতে এলেই সব শেষ। নীরস মানুষটাকে রসালো করতে চুমকি রুপম কে শুধু চিনির সিরায় ডুবিয়ে রাখতেই বাঁকি রেখেছে। কর্মক্ষেত্রে যে শাসক, সাংসারিক জীবনে শোষিততে রূপান্তরিত হয়েছে। নিজের যে এত ভুল ত্রুটি ছিল রুপম তা নিজেই জানতো না।

কিন্তু সব ক্ষেত্রেই যে দোষ চুমকির, তা কিন্তু মোটেও না। আসলে বাস্তবতাকে মেনে নিতে রুপমেরই সমস্যা হচ্ছিল। নিজের পরিকল্পিত ভবিষ্যতকে আবার নতুন করে ঢেলে সাজাতে তার বেগ পেতে হচ্ছিল।
দ্বিধা দ্বন্দ্বে আবৃত রুপম বিবাহের সুফল উপভোগ করলেও যখনই কুফল গুলো তার সামনে আসতো, তখনই তার সেই বৃষ্টির দিনের কথা মনে পরত। আর তখন তার একটাই উপলব্ধি হত-
“ঘাড়ে ভুত না চাপলে কেও বিয়ে করে না”।
ভুত আসলে সবার ঘারেই চাপে, শুধু কেও বুঝতে পারে আর কেও পারে না। রুপম সৌভাগ্যবান ছিল, কারণ সে ভুতের আবির্ভাব বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তারপরেও তার শেষ রক্ষা হয়নি।



মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:০৫

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: ভালো লাগলো +

যদিও ভৌতিক অংশটুকু খুবই টিপিক্যাল । তবে শেষে সুন্দর পরিনতি ভালো লেগেছে ।

শুভকামনা :)

২| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:১০

ভূতের কেচ্ছা বলেছেন: :D :D :D :D ভালো লাগলো +

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.