নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রতীক সরকার

প্রতীক সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

অন্তর্ঘাত

৩১ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১২:৩১

রাত বারোটা বেজে পঞ্চাশ। একটু কম কিম্বা বেশিও হতেপারে। অন্ধকার ঘড়ে ঠিকমত ঠাওর করতে পারল না শুভঙ্কর। কান একটু সজাগ করে বোঝার চেষ্টা করল আরতি ঘুমিয়েছে কিনা। ঘনঘন নিঃশ্বাস পরছে আরতির। শুভঙ্কর সাহস করে এবার একটু ঘাড়টা ঘুরিয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে চাইল। ঘুমিয়েছে নিশ্চিত হয়ে খুব সাবধানে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। পুরনো খাটটায় একটা ক্যাঁচ করে শব্দ হতেই চমকে আবার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল শুভঙ্কর। নাহ, ঘুম ভাঙেনি। এতক্ষণে অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে তার। জানালার পর্দা চিরে সামান্য যে আলো আসছিল তাতেই স্ত্রীর মিষ্টি মুখখানি স্পষ্ট হয়ে উঠল। আহারে, সারাটা দিন কতই না খাটুনি যায় মেয়েটার ওপর দিয়ে।

বছর দশেক হচ্ছে তাদের বিয়ে হওয়া। রাজনীতির প্যাঁচে পরে শিক্ষাঙ্গন যখন হাঁসফাঁস করছিল, সাতাশ বছর বয়সে কোন রকমে মাস্টার্সের চাপা গলি থেকে নিস্তার পায় শুভঙ্কর।
নিম্নমধ্যবিত্ত শ্যামবর্ণের শুভঙ্কর প্রেম করার সাহস কখনই করেনি। লেখাপড়া শেষ করে একটা মোটামুটি জীবনধারণের মত চাকুরী যোগার করতেই তার লেগে জায় আরও পাঁচ বছর। বত্রিশে বাবা মা এর পছন্দেই শুভঙ্করের ঘরে আসে আরতি। মেয়েটার কাছে কখনই খুব বেশি কিছু আশা করেনি সে। তারপরেও দশটি বছর ধরে তার এই অভাবের সংসার কি ভাবে টেনে চলেছে এখনও সে ভেবে পায় না।

শুভঙ্কর খুব বেশিক্ষণ আরতির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখ নামিয়ে নিলো সে। এই মুহূর্ত মায়া বাড়ানো কোন কাজের কথা নয়। খুব সাবধানে ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসল। পাশের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে একটা ট্রাক চলে গেল। চোখ বন্ধ করে নিলো শুভঙ্কর। মুখটা বিকৃত হয়ে আসল, জেন ট্রাকটি তার বুকের অপর দিয়ে চলে গেল। আধো অন্ধকার ড্রইং রুমের ঠিক মাঝখানে এখন সে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। কিন্তু স্তব্ধতারও যে একটা সূক্ষ্ম কান ঝালাপালা করা শব্দ আছে, শুভঙ্কর আজ সেটা উপলব্ধি করতে পারল। কিছুক্ষণ মূর্তির মত উদ্দেশ্যহীন ভাবে দারিয়ে থেকে পাশের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে। আলতো ভাবে দরজা খুলে ভেতরে চাইল।

ছেলেটা গত মাসে আট বছর পূর্ণ করেছে। দেখতে একদম মায়ের মত হয়েছে, গায়ের রংটাও। অন্ধকারে ছেলের মুখ দেখতে খুব বেশি কষ্ট হল না তার। ছেলেটাকে দেখলে খুব মায়া হয়। ভেতরে ভেতরে একটা অপরাধ বোধ জেগে ওঠে। একটা ভালো ঘরে জন্মালে কতই না যত্নে থাকতো। ছেলেটার আবদার গুলোও সে ভালভাবে পূরণ করতে পারে না। খুব ইচ্ছে ছিল একটা ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করার।

চোখ ভারি হয়ে আসে শুভঙ্করের। নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। আবার সে একশ বিশ স্কয়ার ফিটের ছোট্ট ড্রইং কাম ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়াল। যেটা সে করতে যাচ্ছে, সেটা ঠিক না ভুল, ভাবার আর সময় নেই তার। পরিস্থিতি আর বাস্তবতায় এখন সে কোণঠাসা। কঠিন স্বার্থপর ছাড়া এমন কাজ হয়তো কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়, তবুও সে নিরুপায়। অফিসের ঘটনাটা ভেবে আবার তার চোখ ফেটে জল চলে আসল। চিৎকার করে কাঁদতে পারলে হতো খুব ভালো লাগত। ভেতরের কষ্ট গুলর কিছুটা হয়তো বেরিয়ে যেত। কিন্তু পারল না সে।

অফিসের বসের অপমান, সহকর্মীদের মুখ টেপা হাঁসি, চোখ বন্ধকরেও নিস্তার পাচ্ছে না সে। বার বার ভেসে আসছে সামনে। দোষটা মোটেও তার ছিলনা, কিন্তু অস্বীকার করে মনিবকে অসন্তুষ্ট করার মত সাহসও তার ছিল না। নিজের স্বপক্ষে অল্পকিছু যে কটি যুক্তি সে তুলে ধরেছিল, বসের হুঙ্কারে তা মাটি চাপা পরে যায়। অশ্লীল আর অপমান জনক যে বাক্য গুলো তার দিকে ধেয়ে আসছিল, তার একটি থেকেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি সে।

আধুনিক এই পৃথিবীতে সমাজের বরই নিচু স্তরের মানুষ হিসেবে মনে হয়েছিল তার, যাদের আত্মসম্মান বলে কিছু থাকতে নেই, প্রতিনিয়ত অপমানই যেন তাদের ন্যায্য পাওনা।
শার্টের কলার ধরে তাকে রুম থেকে বের করে দেয় তার বস। কারো দিকে মুখ তুলে চাইতে পারেনি সে। সহকর্মীদের তির্যক মন্তব্য আর মুখ টেপা হাসি যেন তাকে মাটির সাথে মিসিয়ে দিচ্ছিল। দুনিয়ার ন্যায় অন্যায়ের হিসেব নিকেশ তার কাছে সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। মনটা খুব করে চাইছিল, যে বসের রুমে গিয়ে মুখের ওপর তার চাকরিটা ছুড়ে মারতে। কিন্তু মধ্যবিত্তের বাস্তবতা মনিবের অন্যায় মেনে নেওয়ারই শিক্ষা দেয়।

বাড়ি ফেরার পথে চলন্ত ট্রেন দেখে একবার থমকে গিয়েছিল সে, কিন্তু সাহসে আর কুলিয়ে উঠতে পারেনি। বাড়িতে ফিরে নিজেকে স্বাভাবিক করার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু রাত বারতেই যেমন মানুষের শরীরের রোগ গুলো বেড়ে যায়, তেমনি মনের কষ্ট গুলোও ভেতর থেকে হুহু করে বেরিয়ে আসতে থাকে। আরতিকে বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। গরিবের যদি আত্মসম্মানটা না থাকতো, তাহলে হয়তো তাদের আর কোন কষ্টই থাকতো না।

নিঃশব্দে টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল শুভঙ্কর, টেবিলের ওপর রাখা জগ থেকে শব্দ না করে গ্লাসে জল গড়িয়ে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলল । তারপর পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। রান্নাঘরের ভেতর হাতরে হাতরে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করল সে। খুব বেশি সময় লাগল না। ইঁদুর মারার জন্য যে বিষটা কিছুদিন আগে কিনে এনেছিল, হাতের কাছেই পেয়ে গেল। খুব দ্রুত প্যাকেটটা খুলে ফেলল। সারাটা শরীরের মধ্যে যেন একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে গেল। ভবিষ্যতের জন্য দেখা স্বপ্ন গুলো সে দেখেছিল, এক এক করে ঝরে পরে চুরমার হয়ে যেতে লাগল। নিজের সরির থেকেই জেন ভেসে আসতে লাগল লাশ পচা গন্ধ। কানের ভেতরে ভেজে উঠল বন্দর ছেড়ে যাওয়া সহস্র জাহাজের হর্ন। চোখ দুটো বন্ধ, অথচ চারিদিক থেকে ধেয়ে আসছে তীব্র সাদা আলো। বুকের ভেতরে বেজে উঠল অসংখ্য দামামা।




ঘুম ভাংতেই চমকে উঠল আরতি, পাশে শুভঙ্কর নেই। গোটা ঘর সূর্যের আলোয় মাখামাখি। তাড়াতাড়ি উঠে বসল সে। ঘড়িতে আটটা বেজে পাঁচ। মনে মনে একটু লজ্জাই পেল। এক ঘণ্টা দেরি করে ফেলেছে সে। এতক্ষণে শুভঙ্করের নাস্তা তৈরি করে ফেলার কথা ছিল তার। আর শুভঙ্করই বা কেমন, একটিবার ডেকে দিলেই তো পারতো। হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে আসল, দরজার সামনে শুভঙ্করের জুতোজোড়া আগের মতই আছে, তারমানে এখনও সে অফিস যায়নি। মনে মনে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে ফ্রিজ থেকে আগের দিন রাতের ভাত আর ডাল বের করল। কোন রকমে একটা ডিম ভেজে প্লেটে ভাত ডাল আর ডিম নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখতেই শুভঙ্কর বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। আরতির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল-
“ওহ, উঠে পরেছ। থাম, আমি কাপর বদলে আসছি।’’
শুভঙ্কর ভেতরে চলে গেল, আজ একটু আগে আগে বেরতে হবে। অনেক কাজ বাকি। ছেলেটার স্কুলের মাইনে দিতে হবে। রাতে মা ফোন করেছিল। তাঁর ডায়াবেটিকের ওষুধ শেষ, আজই কিনে কুরিয়ার করতে হবে। আরতি সেই কবে থেকে গ্যাসের চুলাটা সারাতে বলছে, একদমই সময় করে উঠতে পারছে না। আজ অফিস থেকে ফেরার সময় কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আরতি বাইরে থেকে বলল-
“শুনছো, আজ কিন্তু বাবুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে, কতদিন হল কাশিটা ভাল হচ্ছে না।’’

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে আগস্ট, ২০১৫ ভোর ৫:৩৯

আজমান আন্দালিব বলেছেন: যাক না মাইরা ভালো করছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.